স্থাপত্য প্রকৌশল, যা ভবন প্রকৌশল বা স্থাপত্যবিদ্যা নামে পরিচিত হল জ্ঞানের একটি শাখা যা ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা, নকশা, নির্মাণ ও প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে বিশদ আলোচনা করে থাকে। এছাড়াও, স্থাপত্য প্রকৌশলে ভবনের পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয় (শক্তি সংরক্ষণ, তাপ, বায়ুপ্রবাহ ও শীতাতপনিয়ন্ত্রকের ব্যবজার, আলোর ব্যবহার, দৃষ্টি, নাদবিদ্যা, চলাচল ব্যবস্থা), কাঠামো, ইমারত নির্মাণে ব্যবহৃত উপাদান ও বস্তুর ব্যবহার ও বৈশিষ্ট্য এবং নির্মাণ ব্যবস্থাপনা নিয়েও আলোচনা করে থাকে।[১][২]
কম গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণকারী ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে স্থাপত্য প্রকৌশলীরা একবিংশ শতাব্দীতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন। তারা আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ভবনের নকশা তৈরি করে থাকেন। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার দরুন বিংশ শতাব্দীতে পেশা হিসেবে স্থাপত্য প্রকৌশলের যাত্রা শুরু হয়, যা প্রকৌশলবিদ্যার অন্যান্য পেশার তুলনায় বেশ নবীন। স্থাপত্য প্রকৌশলীরা বর্তমান বিশ্বে দুইটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, যাতে গোটা বিশ্ব বুঁদ হয়ে আছে: (১) কম্পিউটার নির্ভর প্রকৌশলের প্রভূত উন্নতি, এবং (২) বিশ্বকে দূষণের হাত থেকে মুক্ত করে বাসযোগ্য করে রাখা।[৩]
স্থাপত্যকলা নকশা সংক্রান্ত শিল্প হলে স্থাপত্য প্রকৌশল হল প্রকৌশলের একটি শাখা, যা বিভিন্ন ভবন নির্মাণে শিল্প ও বিজ্ঞানের প্রয়োগ নিয়ে করে।[৪]
অবকাঠামো প্রকৌশল নির্মাণকৃত ইমারতগুলোর (ভবন, সেতু, নির্মাণ কাঠামো, টাওয়ার এবং দেয়াল) পারিপার্শ্বিক অবস্থা নিয়ে বিশ্লেষণ ও পরিকল্পনা করে থাকে। যেসব প্রকৌশলী ভবন নিয়ে বেশি কাজ করেন, তাদের "ইমারত প্রকৌশলী" বলে গণ্য করা হয়। অবকাঠামো প্রকৌশলীদের ইমারত তৈরিতে ব্যবহৃত বস্তুর শক্তি, ইমারত কাঠামো বিশ্লেষণ এবং ইমারতের ভার ( ইমারতের ভর, এর বাসিন্দা এবং তাদের ব্যবহার্য সামগ্রী এবং অস্বাভাবিক ঘটনা যেমন, বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত, তুষারপাত) সহ্য করার ক্ষমতা, ইমারতের ভূমিকম্পনরোধী পরিকল্পনা যা ভূকম্পন প্রকৌশল নামে পরিচিত – এসব বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হয়। স্থাপত্য প্রকৌশলীরা কখনো কখনো কখনো অবকাঠামো প্রকোশলের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে ইমারতের নকশা তৈরি করে থাকে। ইমারত প্রকৌশল যখন প্রকৌশলের একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে বিশ্লেষণ করা হয়, তখন এর সাথে স্থাপত্য প্রকৌশলী এবং অন্যান্য প্রকৌশলীদের কাজের সাথে এর মাঝে মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
যন্ত্র প্রকৌশলী এবং তড়িৎ প্রকৌশলীরা যন্ত্র প্রকৌশল এবং তড়িৎ প্রকৌশলে দক্ষ। কিন্তু, যখন তারা ইমারত নকশা করার কাজে যুক্ত থাকেন তাদের কাজকে যন্ত্র, তড়িৎ এবং পাইপসংক্রান্ত কর্মকাণ্ড বলে অভিহিত করা হয়। যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ায় তাদের কাজ "ইমারত সেবা প্রকৌশল" নামে অভিহিত করা হয়।[৫] যন্ত্র প্রকৌশলীরা ইমারতের তাপ, বায়ুপ্রবাহ ও শীততাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, পাইপের ব্যবহার এবং বৃষ্টির পানি নিষ্কাসনের মত বিষয়গুলো দেখে থাকেন। পাইপ নকশাকারদের কাজের মাঝে সাধারণ সক্রিয় অগ্নি প্রতিরোধী ব্যবস্থা তৈরির দিকে নজর দিতে হয়। জটিল ইমারতের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাটির দিকে নজর দেবার জন্য আলাদাভাবে অগ্নি প্রতিরোধী প্রকৌশলীদের নিযুক্ত করা হয়। তড়িৎ প্রকৌশলীরা ইমারতে বিদ্যুৎ সরবরাহ, টেলিযোগাযোগ, অগ্নি সতর্কীকরণ প্রক্রিয়া ও সংকেত প্রেরণ, বজ্র প্রতিরোধী ব্যবস্থা, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং বৈদ্যুতিক আলো ব্যবস্থাপনা – এসব নিয়ে কাজ করে থাকেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্থাপত্য প্রকৌশল একটি পেশা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।[৬] সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য প্রকৌশল বিষয়ে স্নাতক কার্যক্রম স্থাপত্য প্রকৌশলী দলের সাথে যে কোন প্রকৌশলীর সমমান ও গুণসম্পন্ন ইমারত নকশা করার প্রশিক্ষণ করে থাকে অথবা অবকাঠামো প্রকৌশল, যন্ত্র প্রকৌশল বা তড়িৎ প্রকৌশল সংক্রান্ত স্থাপত্য প্রকৌশলের শাখার শিক্ষা প্রদান করার পাশাপাশি স্থাপত্য প্রকৌশলের অন্যান্য শাখা সম্পর্কে জ্ঞান প্রদান করে থাকে।
আগের আমলের স্থাপত্য প্রকৌশল সে আমলের প্রকৌশলবিদ্যার অন্যান্য শাখাকে অনুসরণ করে গটে উঠেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে সে আমলের স্থাপত্য প্রকৌশলের উন্নতি সাধিত হয়েছিল এবং বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে তা যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়েছিল। জাতীয় প্রকৌশল ও ভূমি জরিপ পরীক্ষক পরিষদ নব্বইয়ের দশকে "স্থাপত্য প্রকৌশল"কে প্রকৌশলবিদ্যার আলাদা শাখা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে এবং ২০০৩ সালের এপ্রিল মাসে স্থাপত্য প্রকৌশল যুক্তরাষ্ট্রে প্রকৌশলবিদ্যার একটি আলাদা শাখা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
বিভিন্ন লাইসেন্স নিয়ন্ত্রিত ক্ষেত্রে, স্থাপত্য প্রকৌশলীদের স্থপতি হিসেবে লাইসেন্স না থাকলে তাদের স্থাপত্যবিদ্যা সংক্রান্ত ক্ষেত্রে কাজ করতে দেওয়া হয় না এবং হাসপাতালের মত বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইমারতে তাদের অবকাঠামো প্রকৌশল সংক্রান্ত ক্ষেত্রে কাজ করার ক্ষেত্রে কখনো কখনো বাধা প্রদান করা হয়। এই ধরনের বাধা এবং রীতির ক্ষেত্রে অঞ্চলভেদে তারতম্য দেখা যায়।
বিভিন্ন দেশে ইমারতের পরিকল্পনা, নকশাকরণ এবং ইমারত নির্মাণ তত্ত্বাবধায়নের মত বিষয়গুলোকে স্থাপত্যবিদ্যায় আলোচনা করা হয় এবং পেশাগত ক্ষেত্রে স্থাপত্যবিদ্যা সংক্রান্ত এই সেবাগুলোকে একত্রে "স্থাপত্য প্রকৌশল" বলে অভিহিত করা হয়। জাপানে "প্রথম শ্রেণীর স্থপতি"রা স্থপতি ও ইমারত প্রকৌশলের দায়িত্ব পালন করলেও বিশেষ ধরনের ইমারত নির্মাণে লাইসেন্সকৃত "ইমারত নকশার জ্ঞানসম্পন্ন প্রথম শ্রেণীর স্থপতি"র (構造設計一級建築士) দরকার হয়।[৭]
কোরীয় এবং আরবিতে "স্থপতি" এবং "স্থাপত্য প্রকৌশলী"কে একই পেশা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিভিন্ন দেশে একজন "স্থাপত্য প্রকৌশলী" (যেমন, ইতালির ingegnere edile) স্থাপত্যবিদ্যা সংক্রান্ত ক্ষেত্রে কাজ করতে পারেন এবং তাদের প্রায়শই "স্থপতি" বলে অভিহিত করা হয়।[৮][যাচাইকরণ ব্যর্থ হয়েছে] এসব ব্যক্তিদের কখনো কখনো অবকাঠামো প্রকৌশলী বলে অভিহিত করা হয়। জার্মানি, আরব অঞ্চলের অধিকাংশ দেশ, অস্ট্রিয়া, ইরানের মত দেশসমূহে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক করা ব্যক্তিরা প্রকৌশল ডিগ্রি লাভ করেন (Dipl.-Ing. – Diplom-Ingenieur)।[৯]
স্পেনে "স্থপতি" বলতে তাদের বোঝানো হয়, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে কারিগরি বিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেছে এবং ইমারত কাঠামো ও এর অন্যান্য সুবিধা সংক্রান্ত বিষয়ের উন্নতি সাধনে অবদান রাখার বৈধ এখতিয়ার রাখে।[১০]
ব্রাজিলের প্রকৌশলী এবং স্থপতিরা দেশটির কেন্দ্রীয় প্রকৌশল, স্থাপত্যবিদ্যা এবং কৃষিবিদ্যা কাউন্সিলের স্বীকৃতি লাভ করত। বর্তমানে স্থপতি এবং নগরবিদরা তাদের নিজস্ব স্থাপত্যবিদ্যা এবং নগরবিদ্যা পরিষদের মাধ্যমে স্বীকৃতি লাভ করে থাকে। এছাড়া, গতানুগতিক স্থাপত্যবিদ্যা এবং ইমারত নকশা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণে ব্রাজিলে স্থাপত্যবিদ্যায় অবকাঠামো , তড়িৎ, জলবাহী এবং যন্ত্র প্রকৌশল সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান করে থাকে। স্নাতকের পর স্থপতিরা স্থাপত্যবিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে ইমারতের নকশা নির্মাণের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করলেও ছোট ভবনের ক্ষেত্রে তারা সব বিষয়ে (বৈদ্যুতিক তারের কাজ ব্যতীত, স্থপতিরা ৩০ কিলোভোল্ট-অ্যাম্পিয়ার পর্যন্ত কাজ করতে পারেন। তড়িৎ সংক্রান্ত কাজ তড়িৎ প্রকৌশলীদের হাতেই ন্যস্ত করা উচিত।) দায়বদ্ধ থাকে। তারা ইমারতের নগর পরিবেশ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ল্যান্ডস্কেপ পরিকল্পনা, অভ্যন্তরীণ পরিকল্পনা এবং অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা মত বিষয় নিয়ে কাজ করে থাকে।[১১][১২]
গ্রিসের লাইসেন্স পাওয়া স্থাপত্য প্রকৌশলীদের কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য অনুষদ থেকে স্নাতক হতে হয় এবং "প্রকৌশল ডিপ্লোমা" লাভ করতে হয়।[১৩] পাঁচ বছর পড়াশোনার পর তারা স্নাতক হন এবং গ্রিস কারিগরি সমিতির সদস্য হবার মাধ্যমে তারা পুরোপুরিভাবে স্থপতি হিসেবে আখ্যা পান (TEE – Τεχνικό Επιμελητήριο Ελλάδος)।[১৪][১৫] গ্রিস কারিগরি সমিতির সদস্য সংখ্যা এক লাখেরও বেশি এবং এসব সদস্যদের মাঝে প্রকৌশল বিদ্যার সমস্ত শাখার মত স্থাপত্যবিদ্যার স্নাতকও বিদ্যমান। সদস্য হবার পূর্বশর্ত হল যোগ্য প্রকৌশলী বা স্থপতি হিসেবে সনদ লাভ এবং গ্রিসের বিশ্ববিদ্যালয় বা দেশটির বাইরের কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রকৌশলবিদ্যা বা স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন। গ্রিস কারিগরি সমিতি কর্তৃপক্ষ সেদেশে কাজ করার জন্য সেদেশের বা সেদেশের বাইরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্নাতক প্রকৌশলী বা স্থপতিদের কাজ করার অনুমতিপত্র প্রদান করে থাকে। পরীক্ষা দেবার মাধ্যমে এই অনুমতিপত্র অর্জন করতে হয়। বছরে তিন থেকে চারবার এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বোলোগনা চুক্তি অনুসারে প্রকৌশল ডিপ্লোমা ইউরোপীয় ক্রেডিট বদলি প্রক্রিয়ার স্নাতকোত্তর ডিগ্রির (৩০০) সমতুল্য।[১৬]
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্য, অবকাঠামো, যন্ত্র এবং তড়িৎ প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করতে হলে সংশ্লিষ্ঠ বিষয়ে খুব গভীর জ্ঞান থাকতে হয়, যা শিক্ষা কার্যক্রম শেষ হবার পর সাধারণত সবাই অর্জন করে থাকে।
স্থাপত্য প্রকৌশল এবং স্থাপত্যবিদ্যার মাঝে পার্থক্য বিদ্যমান। স্থাপত্য প্রকৌশল হল প্রকৌশল বিদ্যার একটি আলাদা বিশাল শাখা যার সাথে প্রকৌশলবিদ্যার অন্যান্য শাখার সম্পর্ক বিদ্যমান।
প্রকৌশল বিদ্যাত এ শাখায় স্থাপত্যবিদ্যা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং স্থাপত্যবিদ্যাকে সমাদর করা হলেও এটি ইমারত নির্মাণ প্রক্রিয়া এবং ইমারত নকশা করার মত বিষয় নিতে আলোচনা করে থাকে। ইমারতের তাপ, বায়ুপ্রবাহ ও শীততাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, পাইপ সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড, অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থা, তড়িৎ ব্যবস্থা, আলোক ব্যবস্থা, নাদবিদ্যার সাহায্যে দৃষ্টিনন্দন ইমারত তৈরি এবং অবকাঠামোগত নানা বিষয় প্রকৌশলবিদ্যার এই শাখায় আলোচনা করা হয়ে থাকে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে এসব বিষয়গুলোর যে কোনো একটিতে ছাত্রদের বিশেষ জ্ঞান অর্জন করতে হয়। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে, ছাত্ররা সাধারণ স্থাপত্য প্রকৌশল বা ভবন প্রকৌশল ডিগ্রি লাভ করে থাকে।