![]() একজন অঘোরীর হাতে মানুষের খুলি, আনু. ১৮৭৫ | |
মোট জনসংখ্যা | |
---|---|
৭০[১]– কয়েক হাজার[২] | |
উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যার অঞ্চল | |
বারাণসী, উত্তর ভারত |
অঘোরী (সংস্কৃত: अघोर, অনুবাদ 'not dreadful', 'dreadless', আইএএসটি: aghora) হল ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত তপস্বী শৈব সাধুদের একটি সন্ন্যাসী শাখা। তারাই একমাত্র জীবিত সম্প্রদায় যারা কাপালিক ঐতিহ্য থেকে উদ্ভূত, যা শৈব ধর্মের একটি তান্ত্রিক, অ-পুরানিক রূপ যা মধ্যযুগীয় ভারতে ৪র্থ থেকে ৮ম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে উদ্ভূত হয়েছিল।[৩][৪][৫][৬][৭]
নিজেদের শৈব পূর্বসূরিদের মতো,[৩] অঘোরীরা সাধারণত মৃতদেহ সম্পর্কিত আচার-অনুষ্ঠানে নিয়োজিত থাকে, প্রায়শই শ্মশানে বাস করে, নিজেদের দেহে শবদাহের ছাই মাখে,[৮] এবং মানুষের মৃতদেহ থেকে হাড় ব্যবহার করে (মাথার খুলির কাপ, যা শিব এবং অন্যান্য হিন্দু দেবতাদের প্রতিমায় প্রায়ই ধারণ করতে বা ব্যবহার করতে দেখা যায়) ও গয়না তৈরির জন্য।[৪][৫][৬] তারা মৃত নরমাংস ভক্ষণের অনুশীলন করে, শ্মশান ঘাট ও অন্যান্য স্থান থেকে মৃতদেহ নিয়ে এসে তার মাংস খায়।[১][৯]
তাদের এসকল অনুশীলন কখনও কখনও প্রচলিত হিন্দুধর্মের রীতি-নীতির বিপরীত বলে মনে করা হয়।[৪][৫][৬][১০] অনেক অঘোরী গুরু গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে প্রচুর শ্রদ্ধা পান এবং ভারতীয় সাহিত্যের মধ্যযুগীয় এবং আধুনিক রচনাগুলিতে তাদের ব্যাপকভাবে উল্লেখ করা হয়, তাদের নিরাময় ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে করা হয়, যা ত্যাগ এবং তপস্যার অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জিত হয়।[৪][৫][৬]
অঘোরীরা হলেন ভৈরবরূপে প্রকাশিত শিবের হিন্দু ভক্ত এবং তপস্বী, যারা জন্ম, মৃত্যু ও পুনর্জন্মের অন্তহীন চক্র (সংসার) থেকে মুক্তি (মোক্ষ) কামনা করেন।[৪][৫][৬][১১] এই মুক্তি লাভ হয় এই তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারা যে, আত্মা (আত্মন্) শাশ্বত এবং রূপহীন পরাবিদ্যক পরম সত্তা ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন। তাদের অদ্বয়বাদ মতবাদের কারণে, অঘোরীরা মনে করেন যে সকল বিপরীত বিষয়ই মূলত অলীক বা মায়া। বিভিন্ন তান্ত্রিক আচার ও রীতির মাধ্যমে নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ, অপবিত্রতা এবং শারীরিক অধঃপতনকে গ্রহণ করার উদ্দেশ্য হলো সামাজিক নিষেধাজ্ঞা অতিক্রম করে অদ্বৈত উপলব্ধি করা, যা মূলত একটি পরিবর্তিত চেতনা অবস্থা অর্জন এবং সমস্ত গতানুগতিক শ্রেণীকরণের মায়াবী প্রকৃতি উপলব্ধি করা।
অঘোরী আচার-অনুষ্ঠান, যা বিশেষভাবে গোঁড়া হিন্দুধর্মে প্রচলিত শুচিতার ধারণার বিরোধিতা করার উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত হয়, সাধারণত প্রকৃতিগতভাবে ভয়ঙ্কর বা বীভৎস।[১২][১৩] অঘোরীদের প্রথা বিভিন্ন এবং এর মধ্যে রয়েছে শ্মশানে বাস করা, শরীরে চিতার ভস্ম মাখা, অলঙ্করণ ও পাত্র হিসেবে মানুষের মাথার খুলি ব্যবহার করা, গাঁজা সেবন, মদ্যপান এবং মৃতদেহের উপরে বসে ধ্যান করা।[৫][৮][১৪][১৫] প্রচলিত হিন্দুধর্মের বিপরীতে হলেও, এই চর্চাগুলি সাংস্কৃতিকভাবে আপত্তিকর কার্যকলাপের মাধ্যমে সাধারণ সামাজিক সম্পর্ক ও ভীতিসমূহের সমালোচনার অঘোরী দর্শনের দৃষ্টান্তস্বরূপ। তাছাড়া, এই প্রথাগুলি মানুষের অভিজ্ঞতার একটি অপরিহার্য এবং প্রাকৃতিক অংশ হিসেবে মৃত্যুর প্রতি অঘোরীদের স্বীকৃতিকে তুলে ধরে।[১২][১৬]
অঘোরীদের আরও একটি অদ্ভুত বিশ্বাস এই যে, তারা নরমাংস খাওয়াকে আধ্যাত্মিক ও শারীরিক সুফল, যেমন বয়সের ছাপ প্রতিরোধ, এর উৎস মনে করে। ২০০৬ সালে, একটি ভারতীয় টেলিভিশন দল গঙ্গায় ভাসতে থাকা একটি মৃতদেহ ভক্ষণরত একজন অঘোরীকে স্বচক্ষে দেখে এবং ডোম সম্প্রদায়ের একজন সদস্য জানান যে, অঘোরীরা প্রায়শই শ্মশান ঘাট (বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার চিতা) থেকে মৃতদেহ সংগ্রহ করে।[১][৯]
তাঁর যোগ: অমরত্ব এবং মুক্তি (১৯৫৮) বইতে, রোমানীয় ধর্মীয় ইতিহাসবিদ এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিরচা এলিয়াদে মন্তব্য করেছেন যে "অঘোরীরা একটি বহু প্রাচীন এবং ব্যাপক সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের উত্তরসূরি, যাদের কাপালিক বা 'করোটি ধারক' বলা হয়।"[৩]ডেভিড লোরেনজেনের মতে, কাপালিকদের উপর প্রাথমিক উৎসের অভাব রয়েছে এবং তাদের সম্পর্কে ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় কল্পকাহিনী এবং অন্যান্য ঐতিহ্য থেকে যারা তাদের অবজ্ঞা করে।[৪] [১৭][৩] বিভিন্ন ভারতীয় সাহিত্যে দাবি করা হয় যে কাপালিকরা অবাধে মদ্যপান করত, যা তাদের আচার-অনুষ্ঠানের অংশ এবং একই সাথে এটি তাদের অভ্যাস।[৪] সপ্তম শতাব্দীতে ভারতে আসা চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ, বর্তমান উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে লেখা তার স্মৃতিকথায়, বৌদ্ধদের সাথে কিছু নগ্ন সন্ন্যাসীর বসবাসের কথা উল্লেখ করেন যারা নিজেদের শরীর ছাই দিয়ে ঢেকে রাখত এবং মাথার চারপাশে হাড়ের মালা পরত। কিন্তু হিউয়েন সাঙ তাদের কাপালিক বা অন্য কোনো বিশেষ নামে অভিহিত করেননি। ভারতীয় ধর্ম এবং হিন্দুধর্ম অধ্যয়ন বিষয়ক ঐতিহাসিক ও পণ্ডিতগণ এই সন্ন্যাসীদের কাপালিক, জৈন দিগম্বর সন্ন্যাসী এবং পাশুপত হিসেবে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেন।[৪]
লোরেনজেনের মতে, কাপালিকরা একটি লিখিত মতবাদযুক্ত সম্প্রদায় না হয়ে বরং একটি সন্ন্যাসী সংঘের মতো ছিল।[৪] কাপালিক ঐতিহ্য থেকে কৌল নামক তান্ত্রিক শৈব উপসম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছে, যা কাপালিক ঐতিহ্যের কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ করে।[১৮] কাপালা শৈবদের কিছু আচার-অনুষ্ঠান বজ্রযান বৌদ্ধধর্মেও পাওয়া যায়[৩] এবং পণ্ডিতগণ এই বিষয়ে একমত নন যে কারা কাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।[১৯] বর্তমানে, কাপালিক ঐতিহ্য শৈব ধর্মের শাখাগুলির মধ্যে টিকে আছে: অঘোরী সম্প্রদায়, কৌল এবং ত্রিক ঐতিহ্য।[১৭][৩]
যদিও মধ্যযুগীয় ভারত ও কাশ্মীরের কাপালিক সন্ন্যাসী এবং দাক্ষিণাত্য মালভূমির কালামুখদের সঙ্গে সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও, অঘোরীদের উৎপত্তি বাবা কিনারামের মাধ্যমে, যিনি ছিলেন একজন শৈব সন্ন্যাসী এবং কথিত আছে তিনি ১৫০ বছর বেঁচে ছিলেন এবং ১৮ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মারা যান।[২০][২১] দত্তাত্রেয়, যিনি একজন অবধূত এবং যাঁর নামে প্রখ্যাত অদ্বৈত মধ্যযুগীয় গীতিকা 'অবধূত গীতা' রচনা করা হয়েছে, তাঁকে অঘোর সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা আদিগুরু হিসেবে চিহ্নিত করেন ব্যারেট (২০০৮: পৃ. ৩৩):
ভগবান দত্তাত্রেয়, শিবের একটি প্রথাবিরুদ্ধ রূপ যা শ্মশানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, তিনি গুজরাটের গিরনার পর্বতের উপরে বাবা কেনারামের কাছে আবির্ভূত হন। অঘোর সম্প্রদায়ের আদিগুরু (প্রাচীন আধ্যাত্মিক শিক্ষক) এবং প্রতিষ্ঠাতা দেবতা হিসেবে গণ্য দত্তাত্রেয় এক তরুণ তপস্বীকে প্রসাদস্বরূপ (আশীর্বাদের একটি রূপ) তাঁর নিজের দেহের মাংস দান করেন। এর মাধ্যমে তিনি তপস্বীকে দূরদৃষ্টি বা অদৃষ্টজ্ঞান লাভের ক্ষমতা প্রদান করেন এবং তাঁদের মধ্যে এক গুরু-শিষ্য সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করেন।[২২]
অঘোরীরা হিন্দু দেবতা দত্তাত্রেয়কেও অঘোরী ঐতিহ্যের পূর্বসূরী হিসেবে পবিত্র মনে করে।দত্তাত্রেয়কে একই দেহে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের সম্মিলিত অবতার বলে মনে করা হয়।দত্তাত্রেয় তন্ত্রের সকল ধারায় পূজিত হন, যা অঘোর ঐতিহ্যের অনুসরণীয় দর্শন। হিন্দু শিল্পকলা এবং এর লোককথার পবিত্র গ্রন্থ পুরাণসমূহে তাঁকে প্রায়শই অঘোরীদের "বামাচার" তান্ত্রিক উপাসনায় মগ্ন অবস্থায় চিত্রিত করা হয়, যা তাঁর প্রধান সাধনা হিসেবে বিবেচিত।
অঘোরীরা বিশ্বাস করে, সম্পূর্ণরূপে অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়ার মাধ্যমেই আলো অথবা আত্ম-উপলব্ধির পথে যাওয়া যায়। অন্যান্য হিন্দু সম্প্রদায়ের থেকে এটি ভিন্ন পদ্ধতি হলেও, তারা এটিকে ফলপ্রসূ বলে বিশ্বাস করে। তাদের কুখ্যাত আচারগুলির মধ্যে শব সংস্কার বা শব সাধনা (মৃতদেহকে বেদি হিসেবে ব্যবহার করে মাতৃদেবীর আরাধনা) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যা শ্মশান তারা রূপে (অর্থাৎ শ্মশানের দেবী তারা) দেবীকে আহ্বান করার উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত হয়। হিন্দু প্রতিমায়, তারা দেবীকে কালীর মতোই দশমহাবিদ্যার একজন হিসেবে গণ্য করা হয়। যথাযথ রূপে আহ্বান করা হলে তিনি অঘোরী সাধকদের অলৌকিক ক্ষমতা প্রদান করে আশীর্বাদ করতে পারেন। অঘোরীদের দ্বারা পূজিত দশ মহাবিদ্যার মধ্যে ধূমাবতী, বগলামুখী এবং ভৈরবী সবচেয়ে জনপ্রিয়।অঘোরী সাধকরা অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক ক্ষমতা লাভের জন্য প্রধানত মহাকাল, ভৈরব, বীরভদ্র, অবধূত এবং শিবের অন্যান্য রূপের পূজা করে থাকেন।
ব্যারেট (২০০৮: পৃ. ১৬১) অঘোরীদের "শ্মশান-সাধনা" নিয়ে আলোচনা করেন, যা তাদের বামপন্থী ও ডানপন্থী উভয় প্রকার আচরণবিধিতেই দেখা যায়। তিনি এটিকে মূলত আসক্তি ও বিতৃষ্ণা দূরকারী এবং আদিম অবস্থাকে প্রধান করে তোলা একটি প্রক্রিয়া হিসেবে চিহ্নিত করেন; যা একটি অমার্জিত ও অসভ্য দৃষ্টিভঙ্গি:[২৩]
অঘোরের গুরু এবং অনুগামীরা মনে করেন তাদের এই পরিস্থিতিটি আদিম এবং সর্বজনীন। তারা বিশ্বাস করে যে সকল মানুষই প্রাকৃতিকভাবে অঘোরী হয়ে জন্মায়। হরি বাবা বিভিন্ন সময়ে বলেন যে সকল সমাজের শিশুই জন্মগতভাবে বৈষম্যহীন হয়; তারা যেমন আনন্দের সাথে তাদের খেলনা নিয়ে খেলে, তেমনই নিজেদের নোংরাতেও খেলতে দ্বিধা করে না।শিশুরা বড় হওয়ার সাথে সাথে ক্রমশ বিচার-বিবেচক হয়ে ওঠে এবং তাদের পিতামাতার সংস্কৃতি থেকে পাওয়া পছন্দ ও অপছন্দগুলি শিখতে পারে। শিশুরা যখন তাদের মাথায় আঘাত পায় এবং মাটিতে পড়ে যায়, তখন তারা তাদের নশ্বরতা (সীমিত জীবনের ধারণা) সম্পর্কে ক্রমশ সচেতন হয়। তারা তাদের মরণশীলতাকে ভয় করতে শুরু করে এবং তারপর একে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করার উপায় খুঁজে এই ভয়কে প্রশমিত করে।
এই অর্থে, অঘোর সাধনা হলো গভীরভাবে আত্মস্থ সাংস্কৃতিক মডেলগুলোকে পরিত্যাগ করার একটি প্রক্রিয়া। যখন অঘোরী সাধনা শ্মশানে অনুষ্ঠিত হয়, তখন সাধক একজন শিশুর মতো মৃত্যুর সম্মুখীন হন এবং জীবনের শুরু ও শেষ - এই উভয় দিকের তাৎপর্য উপলব্ধি করে ধ্যান করেন। এই আদর্শ উদাহরণটি অন্যান্য আঘোর চর্চার, বাম ও ডান উভয় প্রকারের, যা আচার-অনুষ্ঠান এবং দৈনন্দিন জীবনে পালিত হয়, তার একটি আদিরূপ হিসেবে কাজ করে।[২৩]
যদিও অঘোরীরা ভারত, নেপাল এবং এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনুরূপ শ্মশান ভূমিতে বিক্ষিপ্তভাবে উপস্থিত থাকে, তবুও এই ধর্মীয় গোষ্ঠীর গোপনীয়তা এর অনুসারীদের মধ্যে সামাজিক স্বীকৃতি এবং কুখ্যাতির কোনো আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে না।[১]
হিংলাজ মাতা অঘোরীদের কুলদেবতা (পৃষ্ঠপোষক দেবতা)। প্রধান অঘোরী তীর্থকেন্দ্রটি হল বারাণসীর রবীন্দ্রপুরীতে অবস্থিত কিনা রামের কুটির বা আশ্রম। এই স্থানটির পুরো নাম বাবা কিনারাম স্থল, ক্রিম-কুণ্ড। এখানে, কিনা রাম একটি সমাধি বা সমাধিস্থলে শায়িত আছেন যা অঘোরী এবং অঘোরী ভক্তদের জন্য একটি তীর্থস্থান। ১৯৭৮ সাল থেকে বাবা কিনারাম স্থলের বর্তমান প্রধান (মহন্ত) হলেন বাবা সিদ্ধার্থ গৌতম রাম।
ভক্তদের মতে, বাবা সিদ্ধার্থ গৌতম রাম স্বয়ং বাবা কিনারামের পুনর্জন্ম। এছাড়াও, যেকোনো শ্মশানই একজন অঘোরী সন্ন্যাসীর জন্য একটি পবিত্র স্থান।দক্ষিণ এশিয়া এবং হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা হিন্দু দেবীমাতার ৫১টি পবিত্র উপাসনা কেন্দ্র, শক্তিপীঠের নিকটবর্তী শ্মশানগুলি অঘোরীদের দ্বারা সাধনা করার জন্য পছন্দের প্রধান স্থান। তারা ভুতুড়ে বাড়িতেও ধ্যান ও সাধনা করেন বলে জানা যায়।
অঘোরীরা তাদের আচার-অনুষ্ঠানের একটি স্তম্ভ হিসেবে পরিশুদ্ধির মাধ্যমে রোগ নিরাময় করে থাকেন। তাদের রোগীরা বিশ্বাস করে যে অঘোরীরা "রূপান্তরকারী নিরাময়"-এর একটি রূপ হিসেবে রোগীদের মধ্যে স্বাস্থ্য সঞ্চারিত করতে এবং দূষণ দূর করতে সক্ষম। তবে, অঘোরী বিশ্বাস অনুসারে, এই দূষণ অন্য কোনো ব্যক্তির মধ্যে স্থানান্তরিত করতে হয়। কিছু ক্ষেত্রে, অঘোরীরা দাবি করেন যে সফলভাবে নিরাময় সম্পন্ন করার জন্য মানুষ বা পশুর বলিদান অপরিহার্য। কিছু অঘোরী পণ্ডিত এই প্রক্রিয়াটিকে কর্মের স্থানান্তর বলে অভিহিত করেন। এই ধরনের প্রথা হ্রাস পাচ্ছে এবং এখন তেমন দেখা যায় না।
যে অঘোর ঐতিহ্য একসময় সীমাবদ্ধ এবং নির্জনতাপূর্ণ ছিল, তা বাবা ভগবান রামজির সংস্কারের পর আঘোর যোগ চর্চায় রূপান্তরিত হয়েছে। প্রথাগত নিয়ম দ্বারা ঐতিহ্যগতভাবে যে চর্চাগুলি বর্জন করা হতো, সেগুলির পরিবর্তন করে আঘোর যোগ এখন মূলধারার সমাজে প্রবেশ করেছে। বর্তমানে, অঘোর যোগ একটি সুষম ব্যক্তিগত অনুশীলনের উপর জোর দেয়, যেখানে সাধনা (নিজের আধ্যাত্মিক অনুশীলন) এবং সেবা (নিঃস্বার্থ সেবা) উভয়কেই গুরুত্ব দেওয়া হয়।).[২৪]
নিজস্ব সমাজের মধ্যে পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে, বাবা ভগবান রামজি বাবা কেনারামের সমাজ-সচেতন চেতনাকে পুনরুজ্জীবিত করেন যখন তিনি পারাও, বারাণসীতে 'অবধূত ভগবান রাম কুষ্ঠ সেবা আশ্রম' নামে একটি নতুন আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন।[২৫] বাবা ভগবান রামজি দরিদ্র ও পীড়িতদের সেবায় পারাও আশ্রম উৎসর্গ করেন এবং আশ্রমের ভেতরে একটি কুষ্ঠ হাসপাতালও স্থাপন করেন। সমাজের দুঃখকষ্টে জর্জরিত মানুষের সেবায় মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে বাবা ভগবান রামজি প্রাচীন অঘোর ঐতিহ্যকে আধুনিক রূপ দেন।
অঘোর ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য, বাবা ভগবান রামজি তাঁর একজন শিষ্য, বাবা সিদ্ধার্থ গৌতম রামকে, ক্রিম কুন্ড এবং অঘোর বংশের প্রধান হিসেবে দীক্ষিত করেন। ক্রিম কুন্ড এবং পারাও আশ্রম ভারতের বারাণসীতে গঙ্গা নদীর দুই বিপরীত তীরে অবস্থিত।
বাবা ভগবান রামজী শ্রী সর্বেশ্বরী সমূহ আশ্রমও প্রতিষ্ঠা করেন, এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজসেবা সংস্থা যা উত্তর ভারত জুড়ে কাজ করে।[২৬] বর্তমানে অঘোর বংশের অধীনে ভারতের বিভিন্ন স্থানে অনেক আশ্রম এবং অন্যান্য দেশে কিছু কেন্দ্র ও আশ্রম বিদ্যমান।
অঘোরেশ্বর ভগবান রামজী জীবৎকালে প্রাচীন কিণা রাম অঘোরী রীতিনীতির সংস্কারের নেতৃত্ব দেন।[৫]
বাবা ভগবান রামজি এবং তাঁর শিষ্যদের দ্বারা বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত সমস্ত আশ্রমই অবিরাম সেবার প্রতি নিবেদিত। সমসাময়িক অঘোর চর্চা বিশেষভাবে দুর্দশাগ্রস্তদের সাহায্য ও সেবা প্রদানের উপর মনোযোগ দেয়।
শ্রী সর্বেশ্বরী সমূহ আশ্রম সামাজিক সমস্যাগুলির প্রতি বিশেষভাবে নিবেদিত, উল্লেখযোগ্যভাবে পণপ্রথা নির্মূল, বিনামূল্যে কুষ্ঠরোগের চিকিৎসা এবং দরিদ্র শিশুদের জন্য বিনামূল্যে বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা করে।
ক্যালিফোর্নিয়ার সোনোমায় ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত সোনোমা আশ্রম, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অঘোর যোগের মূল কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। সোনোমা আশ্রমের লক্ষ্য হল ব্যক্তিদের মধ্যে আধ্যাত্মিক উন্নতি বৃদ্ধি করা।[২৪]
সোনোমা আশ্রমের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান, অঘোর ফাউন্ডেশন, ২০০১ সালে ভারতের বারাণসীতে গঙ্গা নদীর তীরে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটি এতিম ও পরিত্যক্ত শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় প্রদান করে। অঘোর ফাউন্ডেশন অন্যান্য জনকল্যাণমূলক উদ্যোগও চালায়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অঞ্জলি স্কুল, যা দরিদ্র শিশুদের জন্য একটি অবৈতনিক বিদ্যালয় এবং ভিশন বারাণসী, একটি বিনামূল্যে চোখের চিকিৎসা পরিষেবা কেন্দ্র।[২৭] বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, অঘোর ফাউন্ডেশন 'প্রকল্প শক্তি'ও পরিচালনা করে, যা বারাণসীর সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান করে।[২৮] অঘোর ফাউন্ডেশন সম্প্রতি "অমৃত সাগর পরিবেশ কেন্দ্র" নামে একটি পরিবেশ কেন্দ্র নির্মাণ করতে শুরু করেছে, যা "সর্বোত্তম পরিবেশগত চর্চার একটি কার্যকরী দৃষ্টান্ত এবং টেকসই অনুশীলন প্রদর্শনকারী একটি শিক্ষাকেন্দ্র" হিসেবে কাজ করবে।[২৯]