অতর্কিত আক্রমণ বা চোরাগুপ্তা হামলা (অ্যামবুশ নামেও পরিচিত) হল সুপ্রাচীনকাল থেকে যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়ে আসা সামরিক কৌশল যেখানে ছদ্মবেশ নিয়ে পেছন থেকে শত্রুকে অতর্কিত হামলা করা হয়। প্রাচীনকাল থেকে অদ্যাবধি প্রায় সব যুদ্ধেই এই কৌশল ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
বিংশ শতাব্দীর দিকেও একসাথে কয়েক হাজার সৈন্য সামন্ত নিয়ে পাহাড়ের আড়ালে থেকে বা গেরিলা বাহিনী গঠন করে কোন শত্রুপক্ষের সেনাবাহিনীর উপর এই ধরনের হামলা করার নজির আছে।
প্রায় দুই মিলিয়ন বছর আগেও বড়ো বড় শিকার ধরার জন্য প্রাচীন মানবগোষ্টি অতর্কিত আক্রমণের কলা কৌশল ব্যবহার করতো বলে নৃ-তাত্ত্বিকগণ মনে করেন।[১] উদাহরণ হিসেবে ট্রেবিয়ার যুদ্ধের কথা বলা যায়। এ যুদ্ধে 'হানিবল' তার সৈনিকদের ট্রেবিয়া নদীর তীরে শত্রুক্যাম্পের অদূরেই তাবু ফেলতে নির্দেশ করেন আর কিছুদূরেই, যেখানে বদ্ধ জলাভূমি আর ছোটো ছোট গুল্ম-বীরূৎ জাতীয় উদ্ভিদ ঘন ঝোপ-ঝাড় গড়ে তুলেছিল সেখানে অতর্কিত আক্রমণক্যাম্প গড়ে তুলতে বলেন। যুদ্ধশেষে দেখা যায়, দুইপক্ষের শত শত সৈন্য কাটা পড়লেও 'হানিবল' তার এই পরিকল্পনার জন্য হতবুদ্ধ শত্রুপক্ষ রোমানদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন। যদিও রোমানরা পরাজিত হয়েছিল, তাদের প্রায় ১০০০০ সৈনিক নিজস্ব দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সংজ্ঞবদ্ধভাবে জীবন নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়েছিল। রোমানদের বিরুদ্ধে টিউটবুর্গ বনের যুদ্ধে আরেকটি বিখ্যাত অতর্কিত আক্রমণ করেন জার্মান যুদ্ধপ্রধাণ আর্মেনিয়াস। পশ্চিমা ইতিহাসে এই যুদ্ধ ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। জার্মানরা বের করেছিল একটি সফল অতর্কিত আক্রমণের জন্য কি কি পদক্ষেপ নিতে হয়। তারা ঘণ-গভীর অগম্য বনে লুকিয়ে থাকত যাতে সন্তর্পনে শত্রুপক্ষকে অসতর্ক অবস্থায় পাওয়া যায়। এছাড়াও তাদের সাথে রোমান সেনাবাহিনী থেকে সরে আসা আর্মেনিয়াস ছিলেন। শত্রুপক্ষের যখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা তখন আর্মেনিয়াসের দল শিলাবৃষ্টির মত তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ত।
জার্মানরা সামান্যতম ইতঃস্থত না করেই ছোটো ছোট দলে বিভক্ত হয়ে চোখের পলকেই রোমানদের উপর অনবরত ভয়ানক সব উপর আক্রমণ চালাত। এছাড়াও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যাতে রোমানরা পালিয়ে না যেতে পারে সেজন্য তারা পথ অবরূদ্ধ করে রাখত। এতে নিশ্চিতভাবেই রোমানরা পরাজিত হত এবং ভয়ানক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হত। জার্মানদের এই জয় রোমান সাম্রাজ্যকে 'রাইন' নদী পর্যন্ত প্রায় পরবর্তী প্রায় ৪০০ বছরের সীমাবদ্ধ করে দিল। রোম সম্রাটও অবশ্য রাইনের অপর পাড়ে জার্মানিয়া জয় নিয়ে আর মাথা ঘামান নি।
মুসলমানদের ঐতিহ্য অনুসারে, ইসলামের নবী মুহাম্মাদ সামরিক অভিযানে অতর্কিত আক্রমণ ব্যবহার করতেন। সর্বপ্রথম মরুযাত্রীদের মালামাল লুটে তিনি এই পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন। কুরাইশদের বিরুদ্ধে খারার মরুযাত্রী দলের উপর এই আক্রমণ সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে মুহাম্মাদের নির্দেশে চালানো হয়েছিল। ২০ জন মুহাজিরের একটি দল এই অভিযান চালায়। খারার প্রান্তরে সিরিয়া থেকে মক্কায় ফিরে আসার পথে এই দল অতর্কিত আক্রমণ চালানোর প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু মুসলমানদের আক্রমণের পূর্বেই এই মরুযাত্রীদল মদিনা পার হয়ে গিয়েছিল। [২][৩]
মুসলমানদের ইতিহাসে আরেকটি অতর্কিত আক্রমণের উদাহরণ পাওয়া যায়। বানু থালাবাহ'র প্রথম আক্রমণ খ্যাত আক্রমণটিতে বানু থালাবাহর গোত্র মুসলমানদের পরিকল্পনা সম্পর্কে জেনে যায়, এবং সেভাবে প্রস্তুতি নেয়। তাই যখন মুহম্মদ ইবনে মাসলামা নির্ধারিত জায়গায় উপস্থিত হন, বানু থালাবাহ গোত্র প্রায় ১০০ সৈন্য নিয়ে ঘুমের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকা মুসলমানদের উপর আক্রমণ চালায়। সংক্ষিপ্ত যুদ্ধে মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামার লোকবল মারা যায়। মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা মৃত্যুর অভিনয় করে সেই যাত্রা পার পান। অন্য একজন মুসলমান তাকে মদিনায় ফিরে আসতে সাহায্য করেন। এই অতর্কিত আক্রমণ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। [৪]
হাল আমলে শত্রু-বাহিনী বা সৈন্যবাহী গাড়ি বহরের উপর দলে বা উপদলে বিভক্ত হয়ে গোপন হামলা বা অতর্কিত আক্রমণ চালানোর প্রচলন বেশ লক্ষণীয়। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অতর্কিত আক্রমণের জন্য প্রথমে একদল এবং এই অগ্রবর্তী দলকে সাহায্য করার জন্য পরবর্তীকালে আরো একদল পাঠানো হয়। প্রথম দল শত্রুবাহিনীকে অতর্কিত আক্রমণ করে অতঃপর অপেক্ষমাণ দল পরবর্তী আক্রমণ করে যাতে অগ্রবর্তী দল বিশ্রামের সুযোগ পায়।
অতর্কিত আক্রমণ হল অত্যন্ত দুরহ ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। যার কারণে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে অতর্কিত আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে হয়, এই যেমন ধরা যাক কোথায় আক্রমণ করা যায়, কীভাবে করা যায় ইত্যাদি। অতর্কিত আক্রমণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল আক্রমণ করার জায়গা, যেখান দিয়ে শত্রু বাহিনী গমন করার সম্ভাবনা রয়েছে এবং যে স্থানে সহজে নিজেদেরকে লুকিয়ে রাখা যাবে ও শত্রুবাহিনীকে কতল করা যাবে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল হয় একটি গাছ-পালা বেষ্টিত ঘণ বন-জঙ্গল।
অতর্কিত আক্রমণকে জ্যামিতিক ভাবে নিচের তিনভাবে বর্ণনা করে যায়ঃ
যারা এই ধরনের গোপণ হামলা করতে যেত তাদেরকে অবশ্যই নিচের বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হল:
এই পদ্ধতিতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল,সেটি হল আক্রমণটা এমনভাবে হতে হবে যেন শত্রুরা হতবুদ্ধি হয়ে একজায়গায় জড়ো হয়ে পড়ে এবং পালানোর পথ খুজে না পায় । আর সেনাদল এমনভাবে বাছাই করতে হবে যেন তারা শত্রুদের কোণঠাসা করে ফেলতে পারে। যেসব জায়গায় অতর্কিত আক্রমণ করা যেতনা সেখানে আগে থেকেই মাইন বা বিস্ফোরক পুথে রাখা হত।
ভিয়েত কং অতর্কিত আক্রমণের পদ্ধতি নিচের ৫টি বিষয় নিয়ে গঠিতঃ
অন্যান্য বিষয়গুলো ছিল অবস্থাভেদে ব্যবস্থা নেয়ার মত, এই যেমনঃ স্নাইপার,যারা শত্রুদের রক্ষাব্যুহ ভেদ করে তাদের ছত্রভংগ করে দিত ও সৈন্য-পুনঃপ্রতিস্থাপনে বাধা দিত।
গোয়েন্দারা শত্রুর উপর চোখ রাখত এবং তাদের গতিবিধি, সামরিক শক্তি ও অস্ত্র-শস্ত্র -এসব ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে ইউনিট কমান্ডার বা দলনেতাকে অবহিত করত। গোয়েন্দাদের মধ্যে সাধারণত একজন প্রধান ও বাকীরা সহকারী হিসেবে থাকতো। প্রধান কমান্ডারের সাথে হয় দৌঁড়বিদ বা রেডিওর মাধ্যমে যোগাযোগ রাখা হত। যুদ্ধ শুরু হলেও গোয়েন্দারা সর্বদা শত্রুর উপর নজর রাখতো আর তাদের শক্তি প্রতিস্থাপন বা পালানোর রাস্থা সম্বন্ধে খবর নিত। একদম কেন্দ্রে থাকতেন দলনেতা যিনি পুরো অতর্কিত আক্রমণ প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করতেন।
এ পদ্ধতিতে ৩০০-৪০০ মিটার দূরত্বে যেখানে অতর্কিত আক্রমণ হবে সেটা গভীরভাবে নিরীক্ষণ করা হয়। এজন্য মাঝে মাঝে ছদ্মবেশের আশ্রয় নেয়া হত। রেকনদল পাশাপাশি হয়ে শত্রুদলকে ঘিরে পাহারা দিত এবং যখনই কোন শত্রু কাছাকাছি হত তখনি তারা তাদের সকল নড়া-চড়া বন্ধ করে দিত এবং শত্রু পেছনদিকে ফিরলে আবার তারা চলতে থাকত ---এভাবে রেকনবাহিনী শত্রুর অনেক কাছাকাছি থেকে তাদের খবরাবর রাখত।