বাঙালি |
---|
বিষয়ক ধারাবাহিকের অংশ |
![]() |
অন্ধকূপ হত্যা একটি বহুল প্রচারিত সেনা হত্যাকাণ্ড, যা ব্রিটিশ আমলে কলকাতায় সংঘটিত হয়েছিল বলে উল্লেখ করা আছে। বর্ণিত হয়েছে যে, ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নির্মিত ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের অভ্যন্তরে জানালাবিহীন ক্ষুদ্রাকৃতির একটি কামরায় ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে জুন তারিখে ১৪৬ ইংরেজকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল।[১][২] সেখানে অমানবিক পরিবেশের সৃষ্টি হওয়ায় এক রাতের মধ্যে ১২৩ জনের মৃত্যু ঘটে।[৩] এই কাহিনীটি বর্ণনা করেছিলেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারী, পরবর্তীতে সেনাপতি, জন যেফানিয়াহ হলওয়েল (জন্মঃ ১৭১১- মৃত্যুঃ১৭৯৭ খ্রিষ্টাব্দ) তার লিখিত ইন্ডিয়া ফ্যাক্টস্ নামক গ্রন্থে। হলওয়েল নিজেকে বেঁচে যাওয়া বন্দীদের একজন বলে দাবী করেন এবং পরবর্তীতে নিহতদের স্মরণে দুর্গের পূর্বদ্বারের সম্মুখভাগে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন, যা লর্ড হেস্টিংস ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে ভেঙ্গে ফেলেন।[৪]
বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির প্রধান শহর কলকাতা শহরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য রক্ষার জন্য ফোর্ট উইলিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৭৫৬ সালে ভারত, ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামরিক বাহিনীর সাথে সামরিক সংঘর্ষের সম্ভাবনা বিদ্যমান ছিল, তাই ব্রিটিশরা দুর্গটিকে শক্তিশালী করেছিল। সিরাজ-উদ-দৌলা দুর্গ নির্মাণ ফরাসি ও ব্রিটিশদের দ্বারা বন্ধ করার আদেশ দেন, এবং ব্রিটিশরা হতাশ হওয়ার সময় ফরাসিরা তা মেনে চলে।
তার কর্তৃত্বের প্রতি ব্রিটিশদের উদাসীনতার ফলে সিরাজ উদ-দৌলা তার সেনাবাহিনীকে সংগঠিত করেন এবং ফোর্ট উইলিয়ামকে অবরোধ করেন। যুদ্ধে টিকে থাকার প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ কমান্ডার গ্যারিসনের জীবিত সৈন্যদের পালানোর আদেশ দেন, তবুও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন সিনিয়র আমলা জন সফনিয়া হলওয়েলের বেসামরিক কমান্ডের অধীনে ১৪৬ জন সৈন্য রেখে যান, যিনি আগের জীবনে সামরিক শল্য চিকিৎসক ছিলেন।[৫]
কিন্তু দৈর্ঘ্যে ১৫ ফুট এবং প্রস্তে ১৮ ফুট একটি কামরায় ১৪৬ জন মানুষকে আটক রাখার অবাস্তব ও আজগুবি এই কাহিনীর সত্যতা নিয়ে নানান প্রশ্ন ওঠে। বাংলার নবাব নবাব সিরাজদ্দৌলাকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্য নিয়েই সম্ভবত এই কাহিনী রচিত ও প্রচারিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। সমসাময়িক ইতিহাসে এই ঘটনার অন্য কোন উল্লেখ দেখা যায় নি। পরবর্তীতে ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের অনেকেই নবাব সিরাজদ্দৌলাকে নির্দয়, উদ্ধত, স্বেচ্ছাচারী প্রতিপন্ন করতে যাচাই না-করেই হলওয়েল বর্ণিত কাহিনীটি গ্রহণ করেছেন।
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত তার সিরাজদ্দৌলা (১৮৯৮) নামীয় গবেষণামূলক গ্রন্থে যুক্তি-প্রমাণ সহকারে এই কাহিনীর অসত্যতা ও অবাস্তবতা সম্পর্কে আলোচনা করেন। ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে মার্চ এশিয়াটিক সোসাইটিতে এক সভায় অন্ধকূপ হত্যা অলীক ও ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর মিথ্যা প্রচার বলে প্রমাণ করেন। পরবর্তী কালে হলওয়েল বিবৃত অন্ধকূপ কাহিনীর অসত্যতা সার্বজনীনভাবে প্রতিপন্ন হয়েছে।[৬]