অমৃত (সংস্কৃত ভাষার দেবনাগরী লিপিতে - अमृत, আন্তর্জাতিক সংস্কৃত লাতিন লিপ্যন্তর: amṛta), অমৃৃৃৎ বা আমত (যা সুধা, অমিয় বা অমি বলেও পরিচিত) শব্দের আক্ষরিক অর্থ "অমরত্ব" এবং প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থগুলিতে এটিকে পীযূষ বা মকরন্দ বলে বর্ণিত করা হয়েছে। "অমৃৃত" শব্দটি ব্যুৎপত্তিগতভাবে গ্রীক শব্দ "অ্যাম্ব্রোসিয়া"র সাথে সম্বন্ধযুক্ত[১] এবং উভয় শব্দের অর্থও একই।[২] ঋক বেদে অমৃত শব্দের এখনও অবধি প্রাপ্ত সবচেয়ে পুরানো উল্লেখ পাওয়া যায়৷ বিভিন্ন পুস্তকে অমৃৃতকে দেবতাদের পানীয় সোমরসের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
ভারতবর্ষে প্রচলিত বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে অমৃত নিয়ে বিভিন্ন ধর্মীয় কাহিনী ও গুরুত্ব রয়েছে। শুধু তাই নয় "অমৃত" শব্দটি হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও শিখ ধর্মাবলম্বীদের পুংলিঙ্গে বহুল ব্যবহৃত একটি নাম, আবার স্ত্রীলিঙ্গে এই নামটি "অমৃতা" শব্দে রূপান্তরিত হয়ে যায়।
বিভিন্ন পুস্তকে বারংবার অমৃৃৃতকে দেবতাদের পানীয় তরল হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা পান করে তারা অমরত্ব লাভ করেছিলেন। তা সত্ত্বেও অমৃত পুরোপুরিভাবে অমরত্ব প্রদান করে না। বরং সমুদ্রমন্থনেরই এক কাহিনীতে বর্ণিত আছে অমৃত পান করে সমস্ত দেবতারা তাদের জ্ঞান, শক্তি ও বুদ্ধি বৃদ্ধি করতে সক্ষম হলেও ঋষি দুর্বাসার অভিশাপের ফলে তারা তাদের ক্ষমতা বিস্মৃত হন। কাহিনীটি অভিশাপিত দেবতাদের আত্মবিস্মৃতি ও শক্তিক্ষয়ের ঘটনাকে বর্ণিত করে। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী সুর ও অসুর একে অপরের সহায়তায় ক্ষীরসাগরে সমুদ্রমন্থন করলে অন্যান্য বিভিন্ন রত্নের উত্থানের পর অন্তিমে অমৃৃত প্রাপ্তি ঘটে।[৩]
কখনো কখনো হিন্দু দেবতাদের দেহ থেকে অমৃত সৃৃৃষ্টি বা অমৃত নিঃসরণের উল্লেখ পাওয়া যায়। নিঃসৃত উপাদান চরণামৃৃৃৃতরূপে ভক্তগণ পান করে থাকেন এবং এটিকে মধু বা চিনির মিষ্টত্বের থেকে পৃৃথক ধরনের বলে বর্ণনা করা হয়। সাগর মন্থনে চৌদ্দ রত্নের পর সবার শেষে একটি পাত্রের মধ্যে করে অমৃত লাভ হয়, যা ধন্বন্তরি নামক দেববৈদ্যের আনীত বলে মনে করা হয়ে থাকে।
শিখধর্মে অমৃৃত (গুরুমুখী: ਅੰਮ੍ਰਿਤ, প্রতিবর্ণী. অংম্রিত) হলো অমৃত সঞ্চার তথা শিখ ধর্মান্তকরণ বা গুরু দীক্ষাদান অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত একটি পবিত্র তরল পানীয়। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিখদের মধ্যে খালসা প্রথার শুরু হয় এবং এক্ষেত্রে অমৃৃত পান করার রীতি আছে। এই কৃত্রিমভাবে প্রস্তুত অমৃৃৃতে বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ঐ দ্রবণের সাথে চিনি যুক্ত করে খণ্ডার সাহায্যে তার মিশ্রিত করা হয় এবং এসময়ে ধর্মীয় পাঁচটি মন্ত্রোচ্চারণ করা হয়।
রূপক অর্থে শিখ ধর্মে আরাধ্য দেবতার নামও অমৃত বলে উল্লেখ করা হয়েছে কিছুটা এভাবে,
"ਅੰਮ੍ਰਿਤ ਸਬਦੁ ਅੰਮ੍ਰਿਤ ਹਰਿ ਬਾਣੀ ॥"
"অমৃত সবদু অমৃত হরি বাণী ৷৷"
- দেবতা শব্দটি অমৃত, আবার তার বাণীও অমৃতসম।
"ਸਤਿਗੁਰਿ ਸੇਵਿਐ ਰਿਦੈ ਸਮਾਣੀ ॥ "
"সতিগুরি সেবিঐ রিদৈ সমাণী ৷৷"
- সদগুরুর সেবা হৃদয় আকুল করে তোলে।
"ਨਾਨਕ ਅੰਮ੍ਰਿਤ ਨਾਮੁ ਸਦਾ ਸੁਖਦਾਤਾ ਪੀ ਅੰਮ੍ਰਿਤੁ ਸਭ ਭੁਖ ਲਹਿ ਜਾਵਣਿਆ"
"নানক অমৃত নামু সদা সুখদাতা পী অমৃতু সভ ভুখ লহি জাবণিআ"
- নানকের অমৃতসম নাম সদা সুখ দেয় এবং এই অমৃত পানে ক্ষুধা নিবারণ হয়।[৪]
বৌদ্ধ ঠানিসারো ভিক্ষু অমৃৃত বলতে মনের অমর দিকটিকে তুলে ধরা, যা স্থায়ী ও নির্ভেজাল হলে তাই-ই পরবর্তীকালে নির্বাণের পথ দর্শায়।[৫]
অমত সুত্ত অনুসারে, গৌতম বুদ্ধ তার অনুগামীদের চারটি স্মৃৃত্যুপস্থান অনুসরণ করতে বলেছেন এভাবে, "সন্ন্যাসীগণের এই চিত্তপরিপূর্ণতার বিষয়ে মনোনিবেশ করা উচিত। তোমার কাছে মৃত্যুহীনতাকে হারিয়ে যেতে দিও না।"[৬]
নাগসেনার প্রতি রাজা মিলিন্দ বুদ্ধের জীবদ্দশার প্রমাণ চাইলে, নাগসেনা উপমার সাথে রাজাকে ধম্মের বিবরণ ও প্রমাণ দেন এভাবে:
"সম্মানপূর্বক নাগসেনা বলেন, গৌতম বুদ্ধের আশীর্বাণী অমৃত খণ্ড কোনটি?"
"হুজুর, দেব আশীর্বাদই একমাত্র অমৃৃৃৃত। এই আশীর্বাদস্বরূপ অমৃৃৃতের মাধ্যমে আশীর্বাদধন্য ব্যক্তি দেবতাসহ সারা বিশ্বে সুকৃৃতি করে। আবার দেবতা এবং সাধারণ মানুষের ওপর এই অমৃৃত ছিঁটানো হয় তবে তার জন্ম, জরা, বার্ধক্য, রোগ-ব্যধি, মৃত্যু, দুঃখ, দারিদ্র, বেদনা, হতাশা ও বিষণ্ণতা থেকে মুক্তি পাবেন। অমৃৃৃত কী? এটি হলো চিত্ত পরিপূর্ণতা এবং দেহের সহাবস্থান। হুজুর, আশীর্বাদধন্যরা এরকমই উপলব্ধি করেছেন: 'যে সকল সন্ন্যাসীরা অমৃৃৃৃতের উপলব্ধি করেছেন, তাদের নশ্বর দেহ চিত্ত পরিপূর্ণতায় অধিকৃৃৃত।' হুজুর, এই-ই হলো আশীর্বাদধন্যের অমৃৃতলাভ।"
— মিল্ন ৩৩৫[৭]
বজ্রযান বৌদ্ধ ধর্মের পন্থার ক্ষেত্রেও অমৃত (ওয়াইলি: bdud rtsi) একটি ধর্মগত সংস্কারমুলক একটি গুরুত্বপূর্ণ তরল হিসাবে ব্যবহার হয়, যা অভিষেক, গণচক্র, হোম প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আচারানুষ্ঠানের আগে পান করা হয়ে থাকে। তিব্বতি বিধান অনুসারে "দ্রাবচেন" (দলাই লামাকে উদ্দেশ্য করে দীর্ঘকাল যাবৎ চলা একটি অনুষ্ঠান) অনুষ্ঠানের সময়ে মূলত এই অমৃৃত তৈরী করা হয়। সাধারণত ছোটো আকারের গাঢ় বাদামী বর্ণের দানা শষ্যের সাথে জল মিশিয়ে ভিজিয়ে রাখা হয় বা সামান্য পরিমান মদ্যপানীয়ের সাথে মিশ্রিত করে এই অমৃৃত তৈরী হয়। জনবিশ্বাস যে এটি শারীরিক ও দৈবিক উভয় শক্তিই বৃদ্ধি করে এবং স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো।[৮]
তিব্বতী শাস্ত্রীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের মূল বইগুলিতে উল্লিখিত চারটি তন্ত্রসাধনাকে "অমৃৃতের মূল" বা "অমৃতহৃদয়" বলে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। (ওয়াইলি: snying po bsdus pa (স্নাইং পো ব্স্দুস পা))।
দি ইমাক্যুলেট ক্রিস্টাল গার্ল্যাণ্ড (ওয়াইলি: দ্রি মেদ জ্হাল ফ্রেঙ) বইটিতে সমুদ্রমন্থন এবং সমুদ্রমন্থনে উত্থিত অমৃতের উল্লেখ আছে, যদিও ঘটনাবলী বৌদ্ধধর্মীয় রীতিতে বর্ণিত। বজ্রযান পন্থার এই ধর্মগ্রন্থে রাহু নামক রাক্ষস অমৃৃত চুরি করলে বজ্রপাণির বজ্রাঘাতে রাহু শতধাছিন্ন হয়। যেহেতু রাহু অমৃৃৃত পান করেছিলো, তাই রাহুর মৃত্যু হয় না, বরং তার রক্ত পৃথিবীপৃষ্ঠে পড়ে এবং ভূত্বকে একাধিক ঔষধি গাছের জন্ম হয়। ন্যিগমা অনুযায়ী, তিব্বতি বৌদ্ধধর্মে বুদ্ধদেব তথা বজ্রপাণি রাহুর রূপ ধরে পৃথিবী ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের রক্ষা করেন।
ইনার অফারিং (ওয়াইলি: Nang chod, চীনা: 内供) বা নান চোড হলো সর্বোত্তম প্রতীকী অমৃৃত অর্পণ সমাবেশ, এবং ইনার অফারিং নেকটার পিল (ওয়াইলি: Nang chod bdud rtsi rilbu, চীনা: 内供甘露丸) বা নান চোড ব্দুড ঋৎসি রিলবু হলো বহুমূল্যবান ও লুক্কাইত তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্মীয় ভেষজ, যা নিঙমা বিদ্যাভবনগুলিতে অন্তর্যান্ত্রিকভাবে উচ্চ পদাধিকারী সন্ন্যাসীদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়। এর উপকরণগুলি হলো - পঞ্চামৃত ও পঞ্চপল, যা পঞ্চ বুদ্ধরূপ ও পঞ্চভূতকে সূচিত করে। চক্রবর্তীদের প্রবর্তিত তন্ত্রবিদ্যা অনুসারে এবং বজ্রবারাহী অভিমতে বাৎসরিকভাবে নান চোড ঋৎসি বা আভ্যন্তরীণ অমৃৃত অর্পণ অনুষ্ঠান করা প্রয়োজনীয় ও সকলের এই অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া বাঞ্ছনীয়। পাঁচ প্রকার অমৃত চারটি দিক থেকে সংগ্রহ করতে হয়: পূর্ব দিক থেকে হরিদ্রাভ বর্জ্য, উত্তর দিক থেকে হরিদ্বর্ণ অস্থিমজ্জা, পশ্চিম দিক থেকে শ্বেতবর্ণ বীর্য, দক্ষিণ দিক থেকে লোহিতবর্ণ রক্ত এবং নীলাভ প্রস্রাব, যার কেন্দ্রে অবস্থান। চার প্রকার অমৃৃৃত লামা তথা উচ্চ সন্ন্যাসীদের থেকে সংগ্রহ করা বাঞ্ছনীয় এবং সংগৃহীত ডিম্বকোশ আশীর্বাদধন্য প্রথমবারের জন্য ঋতুমতী মহিলার থেকে সংগ্রহ করা হয়। একইভাবে পঞ্চপলও সংগ্রহ করা হয়: দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে কালো বলদের মাংস, দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে নীল রঙের কুকুরের মাংস, উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে শ্বেতবর্ণের হাতির মাংস, উত্তর-পূর্ব দিক থেকে সবুজ বর্ণের ঘোড়ার মাংস এবং কেন্দ্র থেকে লালবর্ণের কোনো মৃৃৃত মানুষের মাংস। অনুষ্ঠান শেষে এই উপাদানগুলিকে মিশ্রিত করে একস্বাদের অমৃৃৃত তৈরী করা হয়, যা পান করলে আশীর্বাদস্বরূপ জীবনীশক্তি, অমরত্ব ও জ্ঞানলাভ হয়। বর্তমান আধুনিক অনুগামীরা একটি পূর্বনির্মিত গন্ধদ্রব্য চা অথবা মদ্যপানীয়ের সাথে মিশিয়ে উদ্যাপন করে থাকেন। অমৃৃৃত গুটিকা বর্তমানে ভেষজ উপায়ে প্রস্তুত করা হয়।[৯]
চৈনিক বৌদ্ধধর্ম অনুসারে অমৃত (চীনা: 甘露; ফিনিন: gānlù) বা গাংলু হলো পবিত্র জল, কোনো খাদ্য বা অন্যকোনো গ্রহণযোগ্য বস্তু যা মুলত মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে গৃহীত হয়।