অয়ন বায়ু বা পুবালী বাতাস হল স্থায়ী পূর্ব-পশ্চিম বায়ু যা পৃথিবীর নিরক্ষীয় অঞ্চলে প্রবাহিত হয় (৩০° উত্তর এবং ৩০° দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে)। প্রধানত উত্তর গোলার্ধে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে অয়ন বায়ু প্রবাহিত হয়। শীতকালে এবং যখন আর্কটিক কম্পন তার উষ্ণ পর্যায়ে থাকে তখন এই বায়ু জোরদার হয়। শত শত বছর ধরে পালতোলা জাহাজের কাপ্তেনরা বিশ্বের মহাসাগরগুলি অতিক্রম করার জন্য অয়ন বায়ুর সাহায্য নিয়ে এসেছে। ভ্রমণ করে তারা আমেরিকাতে ঔপনিবেশিক প্রসার করতে সক্ষম হয়েছে এবং আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগর জুড়ে বাণিজ্য পথ তৈরি করে নিয়েছে।
আবহাওয়াবিজ্ঞানে, এই বায়ু, আটলান্টিক, প্রশান্ত মহাসাগরীয়, এবং দক্ষিণ ভারত মহাসাগরের উপর যে ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়, তার জন্য পরিচালন প্রবাহ হিসাবে কাজ করে, এবং ওই ঘূর্ণিঝড় উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং মাদাগাস্কার ও পূর্ব আফ্রিকাতে আছড়ে পড়ে। অয়ন বায়ুতে অগভীর পুঞ্জীভূত মেঘ দেখা যায়, তাপ নিষ্ক্রমণের মাধ্যমে অয়ন বায়ু এই মেঘের ঘন ও বড় হওয়া বন্ধ করে, অশ্ব অক্ষাংশের মধ্যে যে অবতরণ বাতাস থাকে তারা এই তাপ নিষ্ক্রমন ঘটায়। অয়ন বায়ু যত দুর্বল হতে থাক, পার্শ্ববর্তী স্থলভাগে তত বেশি বৃষ্টিপাতের আশা করা যায়।
দক্ষিণ-পশ্চিম, ক্যারিবীয় সাগর এবং উত্তর আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্বের কিছু অংশ ছাড়া সমগ্র লাতিন আমেরিকা অঞ্চলে অয়ন বায়ু নাইট্রেট- এবং ফসফেট সমৃদ্ধ সাহারা মরুজ ধুলাও পরিবহন করে নিয়ে আসে।
শব্দটি মূলত চোদ্দ শতকের প্রথম দিকের (মধ্য ইংরেজিরর শেষ যুগে) বাণিজ্য ধারণা থেকেই এসেছে।[১] ১৫শ শতাব্দীর প্রথমদিকেই পর্তুগিজরা উত্তর এবং দক্ষিণ উভয় আটলান্টিক মহাসাগরে নাব্য পথে অয়ন বায়ুর গুরুত্ব স্বীকার করেছিল (তখন নাম ছিল ভোল্টা দো মার, পর্তুগিজ ভাষায় এর অর্থ "সমুদ্রের মোড় ফেরা" অথবা "সমুদ্র থেকে ফেরা")। [২] পশ্চিম আফ্রিকা থেকে, পর্তুগিজদের, মহাদেশীয় আফ্রিকা থেকে দূরে জাহাজ নিয়ে যেতে হত, অর্থাৎ পশ্চিম দিকে ও উত্তর-পশ্চিমে। এরপরে তারা উত্তর পূর্ব দিকে ঘুরে অ্যাজোরেস দ্বীপের কাছাকাছি যেত এবং অবশেষে পূর্ব দিকে গিয়ে ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে পৌঁছতো। তারা আরও শিখেছিল যে দক্ষিণ আফ্রিকা পৌঁছতে, তাদের সমুদ্র পথে অনেক দূরে ব্রাজিলের দিকে যেতে হবে, এবং প্রায় ৩০° দক্ষিণে পৌঁছে আবার পূর্ব দিকে যেতে হবে (এটি কারণ আফ্রিকার দক্ষিণ উপকূল অনুসরণ করার অর্থ দক্ষিণ গোলার্ধে বাতাসের গতির বিপরীতমুখে সমুদ্রপথে যাত্রা)। প্রশান্ত মহাসাগরের সম্পূর্ণ বায়ু সঞ্চালন ইউরোপীয়দের কাছে অজানা ছিল। এর মধ্যে পুবালী অয়ন বায়ু এবং উচ্চ-অক্ষাংশের পশ্চিমী বায়ু উভয়ই অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৫৬৫ সালে আন্দ্রে দে উরদানেতা এর সমুদ্রযাত্রার পর এই বিষয়টি তাদের গোচরে আসে।।[৩]
একটি পালতোলা জাহাজের কাপ্তেন এমন নাব্যপথের সন্ধান করেন, যে পথে, বাতাস ভ্রমণ পথের দিকেই প্রবাহিত হতে পারে বলে আশা করা যায়।[৪]পালতোলা জাহাজের যুগে, চলমান বাতাসের ধরন পৃথিবীর বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছনোকে সহজ বা কঠিন করে তুলত, এবং তাই তখন ইউরোপীয় সাম্রাজ্য-নির্মাণে এবং এইভাবে আধুনিক রাজনৈতিক ভূগোলের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলেছিল। উদাহরণস্বরূপ, ম্যানিলা গ্যালিয়ন বাণিজ্য পোত বাতাসে একেবারেই চলতে পারেনি।[৩]
১৮শ শতকের মধ্যে, ইংল্যান্ডের বণিক বহর আটলান্টিক মহাসাগর অতিক্রম করার জন্য অয়ন বায়ুর গুরুত্ব অনুধাবন করে এই বায়ুর নাম দেন "ট্রেড" উইন্ড (বাণিজ্য বাতাস)। সাধারণ লোক থেকে শুরু করে শব্দের প্রকৃতি-তত্ত্বজ্ঞরাও এই নাম স্বীকার করে নিয়েছিলেন: "(বিদেশী) বাণিজ্য"।[৫] ১৮৪৭ এবং ১৮৪৯ সালের মধ্যে, ম্যাথু ফন্টেইন মরি বিশ্বের সমুদ্রের জন্য বায়ু এবং প্রবাহ নকশা তৈরি করার জন্য পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন।[৬]
হ্যাডলি সেলের অংশ হিসাবে, ভূপৃষ্ঠের বায়ু নিরক্ষীয় অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়, অপরদিকে ওপরের বায়ু প্রবাহিত হয় ভৌগোলিক মেরুর দিকা। নিরক্ষীয় অঞ্চলের কাছাকাছি শান্ত, হালকা পরিবর্তনশীল বাতাসের একটি নিম্নচাপ অঞ্চল থাকে, যাকে বলা হয় স্থির অবস্থা,[৭] নিরক্ষীয় শান্ত বলয়,[৮] আন্তঃ ক্রান্তীয় বলয় বা আন্তঃ ক্রান্তীয় রূপান্তর অঞ্চল।[৯] যখন এটি মৌসুমি বায়ু অঞ্চলে অবস্থান করে, নিম্নচাপ এবং বায়ু সংযোগের এই অঞ্চলটি মৌসুমি নিম্নচাপ অঞ্চলও বলা হয়।[১০] উভয় গোলার্ধে প্রায় ৩০° তে, উপক্রান্তীয় উচ্চ-চাপ বলয়ে বায়ু ভূপৃষ্ঠের দিকে নামতে শুরু করে। সেই অঞ্চলকে বলা হয় অশ্ব অক্ষাংশ। নীচের দিকে নেমে যাওয়া বায়ু তুলনামূলকভাবে শুষ্ক, কারণ এটি যখন নিচে নামে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, কিন্তু আর্দ্রতার পরিমাণ একই থাকে, যার ফলে বায়ু ভরের আপেক্ষিক আর্দ্রতা হ্রাস পায়। এই উষ্ণ, শুষ্ক বায়ু একটি উচ্চতর বায়ু ভর হিসাবে পরিচিত এবং সাধারণত একটি সামুদ্রিক ক্রান্তীয় (উষ্ণ এবং আর্দ্র) বায়ু ভরের উপরে থাকে। উচ্চতার সাথে তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে বিপরীতমুখী তাপমাত্রা বলা হয়। অয়ন বায়ু প্রবাহ অঞ্চলের মধ্যে এমন ঘটলে একে বলা হয় বিপরীতমুখী তাপমাত্রাযুক্ত অয়ন বায়ু।[১১]
এই উপক্রান্তীয় উচ্চ চাপ বলয় থেকে নিরক্ষীয় অঞ্চলীর দিকে প্রবাহিত পৃষ্ঠতল বায়ু উভয় গোলার্ধেই পশ্চিমদিকে ঘুরে যায়। এটি হয় কোরিওলিস প্রভাবের কারণে।[১২] এই বাতাস উত্তর গোলার্ধে মূলত উত্তর-পূর্ব দিক থেকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে মূলত দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত হয়।[১৩] যেহেতু বায়ু যেদিক থেকে বয়ে আসে, সেই দিকের নামেই বায়ুর নামকরণ করা হয়[১৪] এই বাতাসকে উত্তর গোলার্ধে উত্তর-পূর্ব অয়ন বায়ু এবং দক্ষিণ গোলার্ধে দক্ষিণ-পূর্ব অয়ন বায়ু বলা হয়। উভয় গোলার্ধের অয়ন বায়ু স্থির অবস্থা অঞ্চলে মিলিত হয়।[৭]
যখন তারা ক্রান্তীয় অঞ্চলে প্রবাহিত হয়, নিম্ন অক্ষাংশে আরও সরাসরি সূর্যের আলোর কারণে বায়ু ভর উত্তাপিত হয়। স্থলভাগে (মহাদেশীয়) যে বায়ু বিকাশ পায় তারা সমুদ্রের (সামুদ্রিক) অঞ্চলে বিকশিত বায়ুর চেয়ে বেশি শুষ্ক এবং গরম হয়, এবং অশ্ব অক্ষাংশের পশ্চিম পরিধিতে উত্তর দিকে প্রবাহিত হতে থাকে।[১৫] সামুদ্রিক ক্রান্তীয় বায়ু ভরকে কখনও কখনও অয়ন বায়ু ভর হিসাবে উল্লেখ করা হয়।[১৬] উত্তর ভারত মহাসাগর ব্যতীত সমস্ত ক্রান্তীয় সমুদ্রের অয়ন বায়ুর বিস্তৃত অঞ্চল রয়েছে।[১৭]
অয়ন বায়ু ক্ষেত্রের অভ্যন্তরে যে মেঘ তৈরি হয় তা পুঞ্জ মেঘ, এর উচ্চতা ৪ কিলোমিটার (১৩,০০০ ফু) এর বেশি হয়না, এবং অয়ন বায়ুর বিপরীতমুখী তাপমাত্রা একে বড় হতে দেয়না।[১৮] শীতের মরশুমে অয়ন বায়ু সৃষ্ট হয় মেরুর দিক থেকে (উত্তর গোলার্ধের উত্তর-পূর্ব দিক থেকে, দক্ষিণ গোলার্ধের দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে) এবং গ্রীষ্মের তুলনায় শীতকালে বেশি শক্তিশালী থাকে।[১৯] উদাহরণ হিসাবে, গায়ানায় ঝোড়ো হাওয়ার মরশুম জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে ঘটে। গায়ানা দক্ষিণ আমেরিকার নিম্ন অক্ষাংশে রয়েছে।[২০] যখন আর্কটিক কম্পনের উষ্ণ পর্যায় চলে, তখন অয়ন বায়ু ক্রান্তীয়মন্ডলী অঞ্চলে শক্তিশালী থাকে। আর্কটিক কম্পনের শীতল পর্বে অয়ন বায়ুকে দুর্বল পাওয়া যায়।[২১] যখন অয়ন বায়ু দুর্বল থাকে, মধ্য আমেরিকার মত ক্রান্তীয় অঞ্চলে জুড়ে বৃষ্টিপাত বেশি হয়। [২২]
উত্তর গোলার্ধের গ্রীষ্মের মাঝামাঝি (জুলাই) সময়কালে, পশ্চিমমুখী অয়ন বায়ু, উত্তর দিকে চালিত অশ্ব অক্ষাংশের দক্ষিণে, উত্তর পূর্ব দিকে ক্যারিবীয় অঞ্চল থেকে দক্ষিণ-পূর্ব উত্তর আমেরিকা (ফ্লোরিডা]] এবং উপসাগরীয় উপকূল) পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। যখন সাহারার ধুলো শৈলশিরার দক্ষিণ পরিধির চারপাশে ভূমির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায় এবং আকাশের রং নীল থেকে সাদাটে হয়ে যায়। এই সময় সূর্যাস্তে লাল আভা বৃদ্ধি পায়। ধুলোর কারণে বায়ু দূষণ ঘটে।[২৩] যদিও দক্ষিণ-পূর্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, উত্তর আমেরিকার মধ্যে সবচেয়ে পরিষ্কার বায়ু, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছনো আফ্রিকান ধূলিকণা ফ্লোরিডাকে প্রভাবিত করে।[২৪] ১৯৭০ সাল থেকে, আফ্রিকায় বিভিন্ন সময়ের খরার কারণে ধুলোর প্রকোপ আরও বেড়ে গেছে। বছরের পর বছর ক্যারিবিয়ান এবং ফ্লোরিডায় ধুলা পরিবহনে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা গেছে।[২৫] মূলত ১৯৭০ সাল থেকে, ক্যারিবীয় অঞ্চল এবং ফ্লোরিডা জুড়ে প্রবাল প্রাচীর ধ্বংস হওয়ার সঙ্গে এই ধুলোর সম্পর্ক পাওয়া গেছে।[২৬]
প্রতি বছর কয়েক মিলিয়ন টন পুষ্টি সমৃদ্ধ সাহারান ধূলিকণা আটলান্টিক মহাসাগর অতিক্রম করে, ক্ষয়প্রাপ্ত অ্যামাজনের মাটিতে অত্যাবশ্যকীয় ফসফরাস এবং অন্যান্য সার নিয়ে আসে।[২৭][২৮]