অরণ্যের দিনরাত্রি | |
---|---|
পরিচালক | সত্যজিত রায় |
প্রযোজক | অসীম দত্ত নেপাল দত্ত |
রচয়িতা | সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় |
চিত্রনাট্যকার | সত্যজিত রায় |
শ্রেষ্ঠাংশে | |
সুরকার | সত্যজিৎ রায় |
চিত্রগ্রাহক | সৌমেন্দু রায় |
প্রযোজনা কোম্পানি | প্রিয়া ফিল্মস |
মুক্তি |
|
স্থিতিকাল | ১১৫ মিনিট |
দেশ | ভারত |
ভাষা | বাংলা |
অরণ্যের দিনরাত্রি ১৯৭০ সালের একটি বাংলা অ্যাডভেঞ্চার নাট্য চলচ্চিত্র। এটি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রচিত অরণ্যের দিনরাত্রি উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় পরিচালনায় নির্মাণ করা হয়েছিল।[১][২] ছবিটি ২০তম বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা চলচ্চিত্রের জন্য গোল্ডেন বিয়ারের জন্য মনোনীত হয়েছিল ।[৩] গৌতম ঘোষ পরিচালিত একটি সিক্যুয়েল আবার অরণ্যে ২০০৩ সালে মুক্তি পায়।
চার বন্ধু, অসীম, সঞ্জয়, হরি এবং শেখর, কলকাতার বাসিন্দা, ছুটিতে পালামৌ এর কাছাকাছি বেড়াতে এসেছে। অসীম কলকাতায় একটি সওদাগরী আপিসে উচ্চপদস্থ কর্মচারী এবং এই চার বন্ধুর মধ্যে সেই অর্থনৈতিক ভাবে সবচেয়ে সচ্ছল এবং একটি অ্যাম্বাসেডর গাড়ির মালিক। সঞ্জয় কলকাতায় একটি সরকারি আপিসে কাজ করে। হরি একজন ফুটবল খেলোয়াড় এবং সম্প্রতি হরির বান্ধবী হরির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। শেখর বর্তমানে বেকার, জুয়ার প্রতি আকর্ষণ আছে এবং তার সপ্রতিভ ব্যবহারের জন্য সে বন্ধুদের খুব প্রিয়। এরা সকলে কলকাতা থেকে পালামৌ যাবে বলে অসীমের গাড়ি করে বেরিয়ে পড়েছে। পালামৌ এর কাছাকাছি এসে একটা চায়ের দোকানে অসীম খোঁজ করে যে কাছাকাছি কোথাও টুরিস্ট বাংলো আছে কিনা। তখন একটি স্থানীয় লোক, যার নাম লখা, কিছু বখশিসের বিনিময়ে অসীমদের একটা টুরিস্ট বাংলো দেখিয়ে দিতে রাজি হয়। টুরিস্ট বাংলোয় থাকার জন্য ডালটনগঞ্জের ডি. এফ. ও ওর অগ্রিম অনুমতিপত্র থাকা জরুরি। এই নোটিস বোর্ড দেখা স্বত্তেও অসীমরা ঠিক করে তারা ওই টুরিস্ট বাংলোতেই থাকবে এবং বাংলোর চৌকিদারকে প্রয়োজনীয় টাকা দিয়ে বাংলোর ঘর খোলাতে বাধ্য করে।
একটা বাসস্থানের ব্যবস্থা হওয়ায় এরা স্বভাবতই একটু স্বস্তি লাভ করে এবং কিছুক্ষণ বিশ্রামের পরে বিকেলের দিকে জঙ্গলের দিকে ঘুরতে বেরোয়। প্রথমদিকে মনে হচ্ছিল যে এরা জঙ্গলে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে বেরিয়েছে, কিন্তু দেখা গেল যে অসীমের একটা নির্দিষ্ট গণ্ত্যব্য আছে এবং সেটা হলো স্থানীয় বাসিন্দাদের নেশা করার জায়গা। স্থানীয় বাসিন্দারা প্রতিদিন সন্ধেবেলায় হাড়িয়া (বা মহুয়া বা চুল্লু) খেয়ে নেশা করে. অসীমরা সেখানে এসে প্রয়োজনীয় পান সামগ্রী কিনে মদ্যপান করতে সুরু করলো। বন্ধুদের মধ্যে সবাই মদ্যপানে অভ্যস্ত হলেও শেখর এই জায়গায় হাড়িয়া খেতে সম্মত হলো না। অন্যরা যখন মদ্যপানে ব্যস্ত, তখন শেখর একটি সাঁওতালি যুবতীর দিকে হরির দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। এই সাঁওতালি যুবতীটির নাম দুলি। সে সেখানে তার বান্ধবীদের সাথে বসে মদ্যপান করছিল। যখন তার বোতলের পানীয় শেষ হয়ে যাই, তখন দুলি এসে শেখরদের কাছে কিছু পয়সা চায়, যাতে করে সে আরো হাড়িয়া কিনে খেতে পারে। তখন হরি নেশার ঘোরে দুলিকে কিছু পয়সা দেয়। আকন্ঠ মদ্যপানের পর চার বন্ধু মিলে জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে রাতের অন্ধকারে গান গাইতে গাইতে বাংলোয় ফিরে এলো।
পরের দিন সকালে প্রথম ঘুম ভাঙ্গলো শেখরের। শেখর দেখতে পেল তাদের বাংলোর সামনের রাস্তা দিয়ে দুজন ভদ্রমহিলা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে চলে যাচ্ছে। সে তৎক্ষনাত অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে অসীম ও সঞ্জয় কে খবর টা দিল। তারপর সকলের ঘুম ভাঙলে, চা খেয়ে সবাই বাজারে গেল প্রাতরাশের জন্য। এই সময় শেখর দেখতে পেল যে দুলি ও তার বান্ধবীরা বাজারে গোল হয়ে বসে আছে, কাজের অপেক্ষায়। দুলি শেখর আর হরিকে দেখে চিনতে পারল আর জিজ্ঞাসা করলো তাদের সন্ধানে কোনো কাজ আছে কিনা। তখন শেখর দুলিকে বলল পরে বাংলোয় দেখা করতে। প্রাতরাশ করার সময় শেখর কায়দা করে লখার কাছ থেকে সেই দুই ভদ্রমহিলার বাসস্থান জেনে নিল।
এই দুই ভদ্রমহিলা সম্পর্কে বৌদি ও ননদ। বৌদিটির একটি শিশুপুত্র আছে। এরা সকলে, পরিবারের কর্তা, প্রবীণ ব্যক্তি, সদাশিব ত্রিপাঠির সঙ্গে বেড়াতে এসেছে। টুরিস্ট বাংলো থেকে হাঁটা দূরত্বে সদাশিব ত্রিপাঠির একটি বাড়ি আছে যেখানে ত্রিপাঠি পরিবারের সকলে বছরে অন্তত একবার বেড়াতে আসে। শেখররা বাজার থেকে সেই বাড়ির সামনে এলো ওই ভদ্রমহিলাদের সঙ্গে আলাপ করবে বলে। ঠিক তখন ই সদাশিব ত্রিপাঠি প্রাতভ্রমন শেষ করে প্রত্যাবর্তন করছিলেন এবং শেখরদের দেখে এবং তাদের কথা শুনে আনন্দের সঙ্গে তার গৃহে আমন্ত্রণ করেন। পরিচিতি পর্ব শেষ হবার পর সঞ্জয়, শেখর, হরি এবং বৌদি ব্যাডমিন্টন খেলতে শুরু করে।
অন্যদিকে অসীম ননদটির প্রতি আকৃষ্ট হয়। সে কৌশলে ব্যাডমিন্টন খেলা এড়িয়ে গিয়ে ননদ টিকে নিয়ে, পাশেই একটি ওয়াচ টাওয়ার ছিল, সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ নিরালায় আলাপচারিতা করে। অসীম জানতে পারে মেয়েটির নাম অপর্ণা, তার একটি দাদা ছিল, কয়েকবছর হলো সে মারা গেছে, অপর্ণার মা ও গত হয়েছেন এবং অপর্ণারা সকলে প্রতি বছর অন্তত একবার এইখানে বেড়াতে আসে, কারণ জায়গাটা সদাশিববাবুর খুব স্যুট করে। এই আলাপচারিতায় অপর্নাও জানতে পারে যে অসীমরা জোর করে টুরিস্ট বাংলোটা দখল করেছে।
এর মধ্যেই লখা এসে খবর দেয় যে বাংলোয় টুরিস্ট রেঞ্জার সাহেব এসেছেন এবং তিনি এই চার বন্ধুর দর্শনপ্রার্থী। তখন অসীমরা ত্রিপাঠি পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নেয় ও পরেরদিন সকালে প্রাতরাশের জন্য আমন্ত্রিত হয়। অসীমরা বাংলোয় ফিরে এলে রেঞ্জার সাহেব জানান যে বড়সাহেব, অর্থাৎ ডি. এফ. ও, ডালটনগঞ্জ খুব শিগগির বাংলো পরিদর্শনে আসতে পারেন। ফলে বিনা অনুমতিতে বাংলোয় থাকার জন্য অসীমদের বিতাড়িত হবার সম্ভাবনা আছে ও চৌকিদারের ও চাকরি খোয়ানোর সম্ভাবনা আছে। এই শুনে চার বন্ধু বেশ মুষড়ে পড়ে। একটু পরে দুলি এবং তার দুই বান্ধবী বাংলোয় আসে কাজ করার জন্য এবং শেখর ওদেরকে অগ্রিম পারিশ্রমিক দিয়ে ঘর-দোর পরিষ্কারের কাজেও লাগায়। কিন্তু চৌকিদারের আপত্তিতে তারা সরে পড়তে বাধ্য হয়। এই সময় হরির খেয়াল হয় যে তার টাকার ব্যাগ হারিয়ে গেছে এবং সে তৎক্ষনাত লখাকে সন্দেহ করে ও তাকে প্রহার করতে শুরু করে। এই ঝামেলা যাতে আর না বাড়ে তার জন্য অসীম লখাকে তার পাওনা টাকা মিটিয়ে দিয়ে তাড়িয়ে দেয়।
তারপর অসীম, সঞ্জয় ও শেখর বাংলোর লাগোয়া কুয়োর পাড়ে স্নান করতে আসে। তারা যখন খালি গায়ে সাবান মেখে স্নান করছে, সেই সময়ে হঠাৎ গাড়ি করে অপর্ণা এবং বৌদির আবির্ভাব হয়। সেই দেখে সঞ্জয় বুদ্ধি করে কুয়োর পাড়ে নিজেকে আড়াল করে সটান শুয়ে পরে, অসীম কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, একমাত্র শেখরই সপ্রতিভ ভাবে দুই মহিলাকে প্রীতি সম্ভাষণ করে। তখন বৌদি হরির টাকার ব্যাগটি ফেরত দেন, যেটি হরির অজান্তে ব্যাডমিন্টন কোর্টে খেলার সময় পড়ে গিয়েছিল। গাড়ি চলে যাবার পর আনন্দিত সঞ্জয় কুয়োর পেছন থেকে বেরিয়ে আসে, অসীম নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে এবং শেখর এই বলে ওদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে যে এটা কোনো ব্যাপারই নয়।
সেইদিন সন্ধ্যেবেলা ওরা যথারীতি হাড়িয়া পান করতে যায়। রাতে মদ্যপ অবস্থায় বাংলোয় ফেরার সময় ওরা রাস্তায় একটি গাড়ির সামনে পড়ে। গাড়ির হেড লাইট এবং হর্নের আওয়াজে বিরক্ত হয়ে অসীম অপ্রকৃতস্থের মত আচরণ করে। কিন্তু তারা দেখতে পায়না যে গাড়ির মধ্যে অপর্ণা ও বৌদি বসে ছিলেন।
পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে যথেষ্ট দেরি হয়। শেখর ঘুম থেকে উঠেই বুঝতে পারে যে ত্রিপাঠীদের বাসভবনে গিয়ে প্রাতরাশের নিমন্ত্রণ রক্ষা করার সময় চলে গেছে। সে অসীম ও সঞ্জয় কে তিরস্কার করে এবং বাইরে গিয়ে দেখতে পায় বৌদি ওদের জন্য কিছু খাদ্যসামগ্রী একটা টিফিন কৌটোয় পাঠিয়ে দিয়েছেন, একটি চিঠি সমেত। অতপর ওরা চারজনে আবার ত্রিপাঠীদের বাসভবনে যায়, সকালে না আসার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, হরির টাকার ব্যাগ ফেরত দেবার জন্য ধন্যবাদ জানায় এবং দুপুর বেলায় বৌদি ও অপর্নাকে বাংলোয় আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে আসে।
অসীমরা বাংলোয় ফিরে আসার পরে ডি. এফ. ও সাহেব বাংলো পরিদর্শনে আসেন ও তিনি তার কর্তৃত্ববলে অসীমদের বাংলো থেকে চলে যাবার নির্দেশ দেন। ঠিক এই সময় অপর্ণা ও বৌদি বাংলোয় আসেন। দেখা যায় যে ডি. এফ. ও সাহেব ত্রিপাঠী পরিবারের পূর্বপরিচিত এবং অপর্ণা অসীমদের নিজের বন্ধু বলে পরিচয় দেওয়ায় অসীমরা সে যাত্রায় বিতাড়িত হবার থেকে রক্ষা পায়। তারপর দুই ভদ্রমহিলা ও চার বন্ধু মিলে বাংলোর বাগানে আলাপচারিতার মধ্যমে এবং মেমরি গেম খেলে একটা সুন্দর অপরান্হ্য অতিবাহিত করে।
বিকেলের দিকে ওরা একসঙ্গে একটা স্থানীয় মেলায় যায়। সেখানে অসীম অপর্ণার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে এবং যখন জানতে পারে যে অপর্ণারা আগামীকাল সকালেই কলকাতায় ফিরে যাবে, তখন সে অপর্নাকে তার মনের কথা খুলে বলে ও কলকাতায় অপর্ণার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চায়। অপর্নাও অসীম কে নিরাশ করে না। শেখর মেলায় গিয়ে জুয়া খেলে বেশ কিছু টাকা হারায়। এদিকে হরি মেলায় দুলি কে দেখতে পেয়ে তাকে জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে কিছু সময় অতিবাহিত করে। কিন্তু হরি দেখতে পায়না যে লখা হরিকে নজরে রেখেছে। হরি দুলির সঙ্গে জঙ্গলে কিছু সময় কাটাবার পর যখন বাংলোয় ফিরে আসছে, তখন লখা প্রতিশোধ নেবার জন্য হরিকে প্রহার করে ও হরির টাকার ব্যাগ নিয়ে চলে যায়। হরি কিছুক্ষণ অচৈতন্ন্য অবস্থায় পড়ে থেকে, ধুঁকতে ধুঁকতে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বাংলোয় ফেরার চেষ্টা করে। তখন শেখর ওকে দেখতে পেয়ে হরিকে বাংলোয় নিয়ে যায়।
মেলা থেকে কিছু কেনাকাটার পর সঞ্জয় বৌদিকে তাদের বাড়ি পৌছিয়ে দিতে আসে। বৌদি সঞ্জয় কে কফি পান করার আমন্ত্রণ জানালে সঞ্জয় সানন্দে তা গ্রহণ করে। কিছুক্ষণ পর বৌদি সদ্য কেনা সাঁওতালি গহনা পরে সঞ্জয় কে দেখাতে আসেন এবং সঞ্জয় বেশ অপ্রস্তুত বোধ করে। সঞ্জয়ের তরফ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে বৌদি তার ঘরের দরজা বন্ধ করে দেন। সঞ্জয় ও বাংলো থেকে ফিরে আসে।
পরেরদিন সকালে চার বন্ধু কলকাতায় ফেরার প্রস্তুতি নেয়। শেখরের সুশ্রষায় হরি অনেকটা ভালো বোধ করে। অসীম চৌকিদার কে তার প্রাপ্য টাকা দিয়ে বলে যে তার চাকরি খোয়ানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। চৌকিদার তখন এক বাক্স খাবার তাদের হাতে দিয়ে বলে যে বৌদি পাঠিয়ে দিয়েছেন। তারা আনন্দের সঙ্গে বাক্সটি গ্রহণ করে ও কলকাতা অভিমুখে রওনা হয়।
বহিঃস্থ ভিডিও | |
---|---|
ইউটিউবে সম্পূর্ণ চলচ্চিত্র |