জীববিজ্ঞানগত নৃতত্ত্ব, আদালতসম্বন্ধীয় নৃতত্ত্ব ও প্রত্নজিনতত্ত্বে অস্ট্রালয়েড (Australoid) (বা অস্ট্রালো-মেলানেশীয়, অস্ট্রালেশীয়, অস্ট্রালোমেনানেসয়েড)[১] হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ওসেনিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার কিছু অংশের আদিবাসী জনগোষ্ঠী।
এই দলের মধ্যে রয়েছে পাপুয়ান (নিউগিনীয় আদিবাসী), এবরিজিনাল অস্ট্রেলীয়, মেলানেশীয় (প্রধানত ফিজি, নিউ ক্যালেডোনিয়া ও ভানুয়াতু), এবং "নেগ্রিটো" হিসেবে শ্রেণীকৃত জনগোষ্ঠীসমূহ (আন্দামানি জনগোষ্ঠী, সেমাং জনগোষ্ঠী, বাতেক জনগোষ্ঠী, মানিক জনগোষ্ঠী, আয়িতা জনগোষ্ঠী, আতি জনগোষ্ঠী, এবং ফিলিপাইনের অন্যান্য নৃগোষ্ঠীসমূহ)।
শ্রীলঙ্কার ভেদ্দা জনগোষ্ঠী এবং ভারতীয় উপমহাদেশের অভ্যন্তরে বাস করা কৃষ্ণবর্ণের আদিবাসীকেও কেউ কেউ (কিছু দ্রাবিড়ভাষী গোষ্ঠী, এবং মুন্ডা জনগোষ্ঠীর মত কিছু অস্ট্রো-এশীয়ভাষী জনগোষ্ঠী) অস্ট্রালয়েড জনগোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে প্রস্তাব করেন,[২][২][৩] কিন্তু এই অন্তর্ভূক্তি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।[৪]
১৯ শতকে নৃতাত্ত্বিকগণ মানব জাতি বা হিউম্যান রেসকে শ্রেণীবদ্ধ করার জন্য অস্ট্রালয়েড শব্দটির প্রচলন করেন। কেউ কেউ দাবি করেন, এরকম শব্দগুলো রেশিয়াল টাইপ বা জাতি প্রকরণের সেকেলে ধারণার সাথে সম্পর্কিত, এবং বর্তমানে এটি অবমাননার সম্ভাবনা বহন করে।[৫][৬][৭]
জাতিতত্ত্বে "অস্ট্রালয়েড" শব্দটির উদ্ভব হয় ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, এটি "অস্ট্রেলীয় আদিবাসীদের প্রকরণ" ধারণকারী জাতিগোষ্ঠীসমূহকে বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হত।[৮] জীববিজ্ঞানগত নৃতত্ত্বে ডেনিয়েল জন কানিংহাম তার গ্রন্থ টেক্সট - বুক অফ এনাটমি (১৯০২) গ্রন্থেঅস্ট্রালয়েড শব্দটিকে এবরিজিনাল অস্ট্রেলীয়দের অঙ্গসংস্থানসংক্রান্ত বৈশিষ্ট্যগুলোকে প্রকাশ করার জন্য ব্যবহার করেন। থমাস হাক্সলি তার একটি রচনা অন দ্য জিওগ্রাফিকাল ডিস্ট্রিবিউশন অফ দ্য চিফ মোডিফিকেশন্স অফ ম্যানকাইন্ড (১৮৭০) -এ অস্ট্রালিওইড (Australioid, একটি অতিরিক্ত -i- রয়েছে) নামে একটি জাতিগত দলের নাম প্রস্তাব করেন। রচনাটিতে তিনি মানবজাতিকে চারটি প্রধান দলে ভাগ করেছিলেন - জ্যানথোক্রোইক, মঙ্গোলয়েড, নিগ্রয়েড ও অস্ট্রালিওইড।[৯] হাক্সলির মূল নকশায় দক্ষিণ এশিয়ার আদিবাসীদের অস্ট্রালয়েড শ্রেণীভূক্ত করা হয়। তিনি জ্যানথোক্রই (উত্তর ইউরোপীয়) ও অস্ট্রালিওইডদের মিশ্রণ হিসেবে মেলানোক্রই (মেডিটেরানীয় জাতি) নামে আরও একটি শ্রেণী তৈরি করেন।[১০]
হাক্সলি ১৮৭০ সালে অস্ট্রালিওইডদেরকে দীঘল মস্তকের (ডোলিকোসেফালিক) কপালাঙ্ক; মসৃণ, কালো ও তরঙ্গায়িত বা কোঁচকানো চুল, ভারি চোয়াল এবং প্রোগন্যাথিজম (চর্বনাস্থি ও চোয়ালের প্রসারমানতা), চকোলেট বর্ণের ত্বক, ঘন বাদামী বা কালো চোখের মনিবিশিষ্ট হিসেবে বর্ণনা করেন।[১১]
রোল্যান্ড বারেজ ডিক্সন তার গ্রন্থ রেশিয়াল হিস্টোরি অফ ম্যান (১৯২৩) এ "প্রোটো অস্ট্রালয়েড" শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। ১৯৬২ সালের একটি প্রকাশনায় অস্ট্রালয়েডকে ৫টি প্রধান মানব রেস বা জাতির মধ্যে একটি হিসেবে ধরা হয়, যেখানে অন্যগুলো হল ককেশয়েড, মঙ্গোলয়েড, কঙ্গোয়েড ও ক্যাপয়েড।[১২] চারলেটন কুন তার গ্রন্থ দি অরিজিন অফ রেসেস (১৯৬২) তে এরকম বৈজ্ঞানিক বর্ণবাদকে পরিশোধিত করে পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন স্থান থেকে উদ্ভূত হওয়া পাঁচটি রেস বা জাতিব্যবস্থার ধারণা দেন। এরকম সাক্ষ্যপ্রমাণের উপর ভিত্তি করে তিনি দাবি করেন যে অস্ট্রালয়েডদের সবচেয়ে বড় ও মেগাডন্ট দাঁত ছিল, আর তাই এই জাতিটি সবথেকে বেশি প্রাচীন, আর তাই সবচেয়ে বেশি আদিম ও পিছিয়ে পড়া। কুনের পদ্ধতি এবং সিদ্ধান্তগুলো পরবর্তিতে সমালোচিত হয়, এবং একে "মানুষের সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও বিবর্তন সম্পর্কিত নিম্ন বোঝাপড়া বা তার রেসিয়ালিস্ট (বর্ণবাদের একটি রূপ হিসেবে পরিচিত) উদ্দেশ্যের জন্য জাতিতত্ত্বের ব্যবহার" হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।[৫] বেলউড (1985) "ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া এর দক্ষিণাঞ্চলীয় মঙ্গোলয়েড জনসংখ্যার" জিনগত উত্তরাধিকার বর্ণনা করার জন্য "অস্ট্রালয়েড", "অস্ট্রালোমেলানেসয়েড" ও "অস্ট্রালো-মেলানেসিয়ান" শব্দগুলোকে ব্যবহার করেছেন।[১৩] ১৯৮০ এর দশক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নৃতাত্ত্বিক শব্দগুলোতে "-অয়েড" বা "-oid"-কে পরিহার করা হয়েছে, যেখানে অস্ট্রালো-মেলানেশীয় (Australo-Melanesian) শব্দটি পছন্দ করা হয়। অন্যান্য অঞ্চলে, বিশেষ করে ভারতের নৃতাত্ত্বিক সাহিত্যসমূহে অস্ট্রালয়েড শব্দটিকেই পছন্দ করা হয়।[১৪]
শ্রীলঙ্কার ভেদ্দা জনগোষ্ঠী এবং ভারতীয় উপমহাদেশের অভ্যন্তরে বাস করা কৃষ্ণবর্ণের আদিবাসীকেও কেউ কেউ (কিছু দ্রাবিড়ভাষী গোষ্ঠী, এবং মুন্ডা জনগোষ্ঠী, বোন্ডা, খোন্ডা দোরা, হো এর মত কিছু অস্ট্রো-এশীয়ভাষী জনগোষ্ঠী) অস্ট্রালয়েড জনগোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে প্রস্তাব করেন,[২][২][৩] কিন্তু এই অন্তর্ভূক্তি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।[৪] এদিকে ভারতীয় নৃতাত্ত্বিকদের করা মাথার খুলির আকৃতি নিয়ে গবেষণা বলছে, দক্ষিণ এশীয় ভারতীয় জনসংখ্যার মাথার খুলির বৈশিষ্ট্য অস্ট্রালয়েডদের থেকে ভিন্ন। এই পার্থক্যটি সম্ভবত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর লোকেদের আন্তঃবিবাহের ফলে বৃদ্ধি পেয়েছে।[২][৩][৪][১৫] ১৯৮৫ সালের একটি জিনগত গবেষণায় দক্ষিণ ভারত ও শ্রীলঙ্কার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে ফিলিপাইন ও মালয়েশিয়ার নেগ্রিটো জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্ক পাওয়া যায়।[১৬]