অ্যালান কোয়াটারমেইন (ইংরেজি: Allan Quatermain) হচ্ছেন হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড রচিত কিং সলোমন'স মাইন এবং এর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বিভিন্ন খণ্ডের প্রধান চরিত্র। অ্যালান কোয়াটারমেইন এই সিরিজের একটি বইয়েরও নাম ছিল।
কোয়াটারমেইন চরিত্রটি আফ্রিকার দক্ষিণাংশের একজন ইংরেজ পেশাদার পশু শিকারী এবং ব্যবসায়ী। তিনি সভ্যতার আলো অন্ধকার মহাদেশে ছড়িয়ে দেবার ঔপনিবেশিক প্রচেষ্টার সমর্থক, এবং আফ্রিকান অধিবাসীদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তাদের নিজেদের মত থাকা সমর্থন করেন। কোয়াটারমেইনের কাছে ইংরেজ শহর এবং আবহাওয়া অসহ্য বোধ হয়, কারণ তিনি একজন বহির্মুখী মানুষ। যে আফ্রিকাতে তিনি ছোটবেলায় তার বিপত্নীক খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারক বাবার আদরে মানুষ হয়েছেন, সেখানেই তিনি সময় কাটাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। প্রথম দিকের উপন্যাসগুলোতে আফ্রিকান আদিবাসীরা কোয়াটারমেইনকে মাকুমাজন বলে সম্বোধন করে, যার অর্থ "রাতের প্রহরী", যেটা তার নৈশকালীন অভ্যাস এবং তীক্ষ্ণ বিবেচনাবোধের পরিচায়ক। পরবর্তীকালে মাকুমাজনকে মাকুমাজনার সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবে দেখান হয়েছে, যার অর্থ "উৎকৃষ্ট মানব"। কোয়াটারমেইনের পার্শ্বচর হিসেবে প্রায়ই লক্ষ্য করা যায় হটেনটট হানস এর উপস্থিতি, যে কিনা একজন বিচক্ষন এবং দায়িত্বশীল ভৃত্য। তার শ্লেষাত্মক উক্তিগুলোতে ইউরোপিয়ান আদব কায়দার প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ পায়। তার শেষ অভিযানে কোয়াটারমেইনের সঙ্গী হন দুজন ব্রিটিশ, স্যার হেনরি কার্টিস ও রয়াল নেভির ক্যাপ্টেন জন গুড এবং আফ্রিকান বন্ধু উমস্লপোগাস।
কোয়াটারমেইন হলেন প্রবীণ, খর্বাকৃতি, শীর্ণ, এবং আকর্ষণহীন চেহারার অধিকারী। তার দাড়ি এবং খাড়া চুল ছিল। তার যে বৈশিষ্ট্যটি সবার চোখে পরে তা হল তার অব্যর্থ নিশানা। লক্ষ্যভেদে তার তুলনা ছিলেন তিনি নিজেই। কোয়াটারমেইন জানতেন, তার প্রিয় আফ্রিকান বনানীকে ধ্বংসের পিছে তার মত শিকারীদের ভূমিকা অনেক বেশি। জীবনের অনেকটা সময় পেরিয়ে আসার পর তিনি যখন দেখলেন যে তার কাছে জীবিকা নির্বাহের আর কোন উপায় নেই, তখন তিনি বাধ্য হলেন শিকার চালিয়ে যেতে।
কোয়াটারমেইনের পরিবারের ব্যাপারে খুব সামান্যই জানা যায়। তিমি ডারবানে বাস করেন, যা দক্ষিণ আফ্রিকার নাটালের অন্তর্গত। দুবার বিয়ে করা সত্ত্বেও কোনবারই বেশিদিন স্ত্রীর সাহচর্য ভোগ করতে পারেননি। খুব দ্রুত তা স্ত্রীরা পৃথিবী ত্যাগ করেন। তার আদরের পুত্র ছিল হ্যারি। হ্যারির মৃত্যুতে তিনি গভীরভাবে শোকাচ্ছন্ন হন, যার প্রকাশ ফুটে উঠে অ্যালান কোয়াটারমেইন নামের উপন্যাসে। হ্যারি কোয়াটারমেইন চিকিৎসাবিদ্যার শিক্ষার্থী হিসেবে একটি হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। লেখক কোয়াটারমেইনের উপন্যাসগুলো ধারাবাহিকভাবে না লেখার কারণে কিছু জায়গায় ত্রুটি দেখা দিয়েছে।
হ্যাগার্ডের কোয়াটারমেইন উপন্যাসগুলোর মধ্যে কয়েকটি গুচ্ছবিহীন হলেও এই উপন্যাসগুলোর মধ্যে দুটি পৃথক ধারা লক্ষণীয়। যুলু ত্রয়ীর অন্তর্গত মেরী (১৯১২), চাইল্ড অভ স্টর্ম (১৯১৩) এবং ফিনিশডে (১৯১৭) দেখা যায়, যিকালির প্রতিশোধের ফাঁদে আটকা পরেন কোয়াটারমেইন। যিকালি ছিল এক বামন ওঝা যে পরিচিত ছিল "যার কখনো জন্ম হওয়া উচিত ছিল না" এবং " "পথোন্মোচনকারী" হিসেবে। যিকালি, যুলু সেনযাঙ্গাকোনা রাজবংশের উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত সফলকামও হয়।
এই উপন্যাসের শুরুতে কোয়াটারমেইন তার একমাত্র পুত্রকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান হন এবং প্রকৃতির আহ্বানে সাড়া দিতে ব্যকুল হয়ে পড়েন। স্যার হেনরি কার্টিস, ক্যাপ্টেন জন গুড, এবং যুলু সর্দার উমস্লপোগাসকে রাজি করিয়ে তিনি তাদের নিয়ে পূর্ব আফ্রিকার তীর থেকে মাসাই সাম্রাজ্যের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েন। পথে স্কটিশ মিশনারিদের সাথে অবস্থানকালীন সময়ে মাসাই দল কর্তৃক আক্রান্ত হলেও তারা বীরত্বের সাথে তাদের প্রতিহত করতে সমর্থ হন। ক্যানূ দিয়ে তারা একটি পাতাল নদী অতিক্রম করেন এবং একসময় পর্বতশ্রেণীর অন্য পাশে অবস্থিত যু-ভেন্ডিস রাজ্যে প্রবেশ করেন। যু-ভেন্ডিরা যুদ্ধংদেহী শ্বেতকায় জাতি যারা অন্য আফ্রিকান জাতিদের থেকে বিচ্ছিন্ন। ব্রিটিশ অভিযাত্রীরা যখন সেখানে পৌঁছান, তখন যু-ভেন্ডিস নাইলেপথা এবং সোরাইস এই দুই বোন দ্বারা শাসিত হত। যু-ভেন্ডি ধর্মের পুরোহিতরা বিরুদ্ধাচরণ করা সত্ত্বেও অভিযাত্রীরা রানীদ্বয়ের কারণে রক্ষা পান।
দুই বোনই একসাথে কার্টিসের প্রেমে পরে যায়। এদিকে নাস্টা, নাইলেপথা যার বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল, এই সুযোগে একটি গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দেয়। (এ যুদ্ধে সোরাইস এবং নাস্টার সৈন্যরা নাইলেপথা, কার্টিস এবং কোয়াটামেইনের বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে।) একটি খণ্ডযুদ্ধে সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও নাইলেপথার বাহিনী জয়ী হয়; এরপর কপট পুরোহিতরা তাকে প্রাসাদে হত্যার ষড়যন্ত্র করতে থাকে। উমস্লপোগাস এবং একজন বিশ্বস্ত যোদ্ধা তাকে বাঁচাতে সক্ষম হয়, এবং তা করতে গিয়ে তারা নাস্টা ও প্রধান পুরোহিত অ্যাগনকে হত্যা করে। বিজিত এবং ঈর্ষান্বিত সোরাইস আত্মহননের পথ বেছে নেয়। কার্টিস এবং নাইলেপথা এরপর রাজা-রানীর পদ গ্রহণ করে। যুদ্ধের জখমের কারণে কোয়াটারমেইনের মৃত্যু হয়।
অ্যালান কোয়াটারমেইনের জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনার তারিখসমূহ নিন্মে দেওয়া হলঃ[১]
ঘটনার সাল | শিরোনাম | প্রকাশের সাল |
---|---|---|
.২০০০ খৃ.পূ. | উইসডম'স ডটার | ১৯২৩ |
১৮১৭ | অ্যালান কোয়াটারমেইনের জন্ম | |
১৮২৮ | নাডা দ্য লিলি | ১৮৯২ |
১৮৩৫–১৮৩৮ | মেরি | ১৯১২ |
১৮৪২–১৮৪৩ | "অ্যালান'স ওয়াইফ", অ্যালান'স ওয়াইফ গল্পগুচ্ছের শিরোনাম গল্প | ১৮৮৯ |
১৮৫৪–১৮৫৬ | চাইল্ড অভ স্টর্ম | ১৯১৩ |
১৮৫৮ | "আ টেইল অভ থ্রি লায়নস", অ্যালান'স ওয়াইফ গল্পগুচ্ছের অন্তর্গত | ১৮৮৯ |
১৮৫৯ | মাইওয়া'স রিভেঞ্জ: অর, দ্য ওয়ার অভ দ্য লিটল হ্যান্ড | ১৮৮৮ |
১৮৬৮ | "হান্টার কোয়াটারমেইন'স স্টোরি", অ্যালান'স ওয়াইফ গল্পগুচ্ছের অন্তর্গত | ১৮৮৯ |
১৮৬৯ | "লং অডস", অ্যালান'স ওয়াইফ গল্পগুচ্ছের অন্তর্গত | ১৮৮৯ |
১৮৭০ | দ্য হোলি ফ্লাওয়ার | ১৯১৫ |
১৮৭১ | হিউ-হিউ: অর দ্য মনস্টার | ১৯২৪ |
১৮৭২ | শী অ্যান্ড অ্যালান | ১৯২০ |
১৮৭৩ | দ্য ট্রেজার অভ দ্য লেইক | ১৯২৬ |
১৮৭৪ | দ্য আইভরি চাইল্ড | ১৯১৬ |
১৮৭৯ | ফিনিশড | ১৯১৭ |
১৮৭৯ | "মাগেপা দ্য বাক", স্মিথ অ্যান্ড দ্য ফারাওস গল্পগুচ্ছের অন্তর্গত | ১৯২১ |
১৮৮০ | কিং সলোমন'স মাইনস | ১৮৮৫ |
১৮৮২ | শী: অ্যা হিস্ট্রি অব অ্যাডভেঞ্চার | ১৮৮৭ |
১৮৮২ | দ্য এইনশান্ট অ্যালান | ১৯২০ |
১৮৮৩ | অ্যালান অ্যান্ড দ্য আইস-গডস | ১৯২৭ |
১৮৮৪–১৮৮৫ | অ্যালান কোয়াটারমেইন | ১৮৮৭ |
১৮৯৯ | আয়েশা: দ্য রিটার্ন অভ শী | ১৯০৫ |
১৮৮৫ | অ্যলান কোয়াটারমেইনের মৃত্যু, ১৮ জুন, ১৮৮৫ |
অ্যালান কোয়াটারমেইন চরিত্রটি আধুনিক যুগের সাহিত্যিকদের দ্বারা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এটা সম্ভবত হ্যাগার্ডের রচনা উন্মুক্ত সম্পত্তিতে (শার্লক হোমসের মত) পরিণত হওয়ার ফলে সম্ভব হয়েছে।
আমেরিকান সিনেমার চরিত্র ইন্ডিয়ানা জোনসের অণুপ্রেরণা ছিল হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের কিং সলোমন'স মাইনস এবং অ্যালান কোয়াটারমেইনের রোমাঞ্চ নায়ক কোয়াটারমেইন। রেইডারস অভ দ্য লস্ট আর্ক, টেম্পল অভ ডূম, ইন্ডিয়ানা জোনস অ্যান্ড দ্য ল্যাস্ট ক্রুসেইড এবং কিংডম অভ দ্য ক্রিস্টাল স্কাল।
কিং সলোমন'স মাইনস উপন্যাসে বর্ণিত সলোমনের গুপ্তধনে যাবার রাস্তাটাই চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা হয়েছে; বিশেষভাবে শেবার চূড়া এবং থ্রি উইচেস মাউন্টেনে যাবার রাস্তা।
এই ধারাবাহিকে মোট ১৩টি উপন্যাস ও ৫টি ছোটগল্প রয়েছে।