আকাশতরী এক ধরনের বায়ুস্থৈতিক বিমান বা বায়ু অপেক্ষা হালকা বিমান যেটি নিজস্ব শক্তিতে বায়ুর মধ্য দিয়ে চলতে পারে।[১] বায়ুস্থৈতিক বিমানগুলি চারিপাশের বায়ুর পরিবর্তে একটি উত্তোলক গ্যাসের মাধ্যমে তাদের উত্তোলন অর্জন করে।
প্রথম দিকের আকাশতরীগুলিতে যে উত্তোলক গ্যাসটি ব্যবহার করা হত, সেটি ছিল হাইড্রোজেন। এর কারণ হাইড্রোজেনের উত্তোলন ক্ষমতা উচ্চ এবং এটি সহজলভ্য। হিলিয়াম গ্যাসে উত্তোলন ক্ষমতা প্রায় একই সমান এবং এটি হাইড্রোজেনের মত দাহ্য নয়, কিন্তু এটি বিরল ও অপেক্ষাকৃত ব্যয়বহুল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম তাৎপর্যপূর্ণ পরিমাণে হিলিয়াম আবিষ্কৃত হয় এবং কিছুকাল গ্যাসটি কেবল ঐ দেশের আকাশতরীগুলির জন্যই সুলভ ছিল।[২] ১৯৬০-এর দশক থেকে নির্মিত সিংহভাগ আকাশতরী হিলিয়াম ব্যবহার করে আসছে, তবে কিছু কিছু আকাশতরী উত্তপ্ত বায়ুও ব্যবহার করে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে খুব কমসংখ্যক আকাশতরী হাইড্রোজেন ব্যবহার করেছে। যুক্তরাজ্যে ১৯৬৭ সালে প্রথম চিটি ব্যাং ব্যাং নামক আকাশতরীটি হিলিয়াম ব্যবহার করে।</ref>
আকাশতরীর বহিরাবরণীটি নিজেই একটি গ্যাসের থলি হতে পারে, কিংবা এটি অনেকগুলি গ্যাস-ভর্তি কোষ ধারণ করে রাখতে পারে। এছাড়া আকাশতরীতে ইঞ্জিন, চালক-কর্মীদল এবং কদাচিৎ মূল্যবান বোঝা রক্ষণের স্থান থাকে। সাধারণত এগুলিকে এক বা একাধিক ঝুলন্ত কামরা বা প্রকোষ্ঠ থাকে, যেটি বহিরাবরণীটির নিচে দড়ি বা রজ্জুর মাধ্যমে ঝুলে থাকে।
আকাশতরীর মূল প্রকারভেদগুলি হল নমনীয়, অর্ধ-দৃঢ় এবং দৃঢ়। নমনীয় আকাশতরীগুলিকে ইংরেজিতে প্রায়শই "ব্লিম্প" নামে ডাকা হয়। এগুলি অভ্যন্তরীণ চাপের মাধ্যমে আকৃতি ধরে রাখে। অর্ধ-দৃঢ় আকাশতরীগুলিও অভ্যন্তরীণ চাপের দ্বারা আকৃতি ধরে রাখে, কিন্তু এগুলিকে এক ধরনের সহায়ক কাঠামো যেমন তলায় দৈর্ঘ্য বরাবর শক্ত উপাদান দিয়ে তৈরি তলি (keel) আটকানো থাকে। দৃঢ় আকাশতরীগুলিতে একটি বহিস্থ কাঠামো থাকে যা বিমানটির আকৃতি ধরে রাখে এবং এটির সমস্ত গাঠনিক বোঝা বহন করে, আর উত্তোলক গ্যাসটি এক বা একাধিক অভ্যন্তরীণ গ্যাসথলি বা গ্যাসকোষে ধারণ করা থাকে।[৩] কাউন্ড ফের্ডিনান্ড ফন সেপেলিন (জেপলিন) প্রথম দৃঢ় আকাশতরীগুলি আকাশে উড়িয়েছিলেন। তাঁর লুফটশিফবাউ সেপেলিন কোম্পানিটিই প্রায় সমস্ত দৃঢ় আকাশতরীগুলি নির্মাণ করত। এ কারণে দৃঢ় আকাশতরীগুলিকে অনেক সময় জেপলিন বলা হয়।[৪]
আকাশতরীগুলি ছিল নিয়ন্ত্রিত ইঞ্জিনচালিত উড্ডয়নে সক্ষম প্রথম বিমান বা উড়োযান। ১৯৪০-এর দশকের আগে এগুলি প্রচুর ব্যবহৃত হত। বায়ু অপেক্ষা ভারী উড়োজাহাজগুলির সক্ষমতা আকাশতরীগুলিকে ছাড়িয়ে গেলে এগুলির ব্যবহার কমতে শুরু করে। ধারাবাহিকভাবে বেশ কিছু দুর্ঘটনা ব্যাপক প্রচার লাভ করার পরে এগুলির ব্যবহার নাটকীয়ভাবে হ্রাস পায়। এদের মধ্যে ১৯৩০ ফ্রান্সের মাটিতে ব্রিটিশ আর১০১ আকাশতরীটির বিধ্বস্ত হয়ে পুড়ে যাওয়া, ১৯৩৩ ও ১৯৩৫ সালে মার্কিন নৌবাহিনীর হিলিয়াম-পূর্ণ দুইটি দৃঢ় আকাশতরী (বিমানবাহক বিমান) ঝড়ের কারণে বিধ্বস্ত হওয়া (যথাক্রমে ইউএসএস অ্যাক্রন ও ইউএসএস ম্যাকন), এবং সর্বশেষ ১৯৩৭ সালে জার্মান হাইড্রোজেন-পূর্ণ হিন্ডেনবুর্গ আকাশতরীর পুড়ে বিধ্বস্ত হওয়া ছিল কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্ঘটনা। ১৯৬০-এর দশক থেকে মূলত হিলিয়াম আকাশতরীগুলিকেই ব্যবহার করা হচ্ছে। যেসব কাজে গতি বা কৌশলী পরিচালনযোগ্যতার তুলনায় বাতাসে অনেকক্ষণ ভেসে থাকার সক্ষমতাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যেমন বিজ্ঞাপন, পর্যটন, আলোকচিত্রগ্রাহক মঞ্চ, ভূতাত্ত্বিক জরিপ ও বৈমানিক পর্যবেক্ষণ - এইসব কাজেই বর্তমানে এগুলি ব্যবহৃত হয়।