আকাশারোহণ হলো উড্ডয়নের একটি দশা যাতে উড়োযান কোনও পৃষ্ঠতল থেকে আকাশে তথা আবহমণ্ডলে উঠতে শুরু করে। যদি পৃষ্ঠতলটি ভূপৃষ্ঠ হয়, তবে একে ভূমিত্যাগ বলা হয়।
যেসকল উড়োযান আনুভূমিকভাবে আকাশারোহণ করে সেগুলো সাধারণত একটি বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত আরোহণপথ (রানওয়েতে) চলমান অবস্থায় ভূমি থেকে উপরে উঠতে থাকে। বেলুন (আকাশযান), হেলিকপ্টার এবং কিছু বিশেষায়িত অনড়-পাখার উড়োযানে (VTOL জাতীয় উড়োযান যেমন হ্যারিয়ার) কোনো আরোহণপথ প্রয়োজন হয় না।
হালকা উড়োযানগুলোতে (Light Aircraft) সাধারণত আকাশারোহণের সময় পূর্ণমাত্রার শক্তি ব্যবহার করা হয়। বড় যাত্রীবাহী উড়োযানগুলোতে পূর্ণমাত্রার চেয়ে কিছুটা কম শক্তি ব্যবহার করা হয়। এখানে মূলত ইঞ্জিনকে দীর্ঘদিন টেকসই রাখতে, ব্যবস্থাপনা খরচ কমাতে ও অতিরিক্ত শব্দ নিঃসরণ কমাতে পূর্ণ শক্তি থেকে কিছুটা কম শক্তি ব্যবহার করা হয়। কিছু আপদকালীন অবস্থায় উড়োযানের কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য এ শক্তি বৃদ্ধি করা হতে পারে। ইঞ্জিনের সমস্যা আছে কিনা দেখার জন্য আকাশারোহণের পূর্বে নিয়ম করে ইঞ্জিনগুলোকে, বিশেষ করে পিস্টন ইঞ্জিনগুলোকে উচ্চ শক্তিতে চালু করে দেখা হয়।
উড়োযানটির ত্বরণ হবে ঘূর্ণন দ্রুতি (রোটেশন স্পিড) পর্যন্ত (যাকে Vr দ্বারা প্রকাশ করা হয় )। এখানে রোটেশন পরিভাষা ব্যবহার করা হয় কারণঃ ফ্লাইট এটিটিউড পরিবর্তের উদ্দেশ্যে ফ্লাইট কন্ট্রোল পরিচালনার ফলে ভূমিতে থাকা অবস্থায় উড়োযানটি মূল ভূ-অবতরণ গিয়ারের অক্ষে উপরের দিকে ঘুরে যায়।
সামনের অংশ বা নাক প্রায় ৫°-১৫° নোস আপ পিচ এটিটিউডে উপরে উঠে যায় যেন এর পাখার উত্তোলনক্ষমতা (লিফট) বৃদ্ধি পেয়ে যানটির উর্ধ্বমুখী উত্তোলন ত্বরান্বিত হয়। বেশিরভাগ উড়োযানে, এই পিচ-আপ ছাড়া আকাশারোহণ প্রচেষ্টায় আরোহণপথে থাকা অবস্থাতেই ক্রুজ বেগ অর্থাৎ প্রায় পূর্ণমাত্রার বেগ প্রয়োজন।
উচ্চ-গতির কাজ করার জন্য প্রস্তুতকৃত অনড় পাখাবিশিষ্ট (ফিক্সড উইং) উড়োযানগুলোর (যেমন বাণিজ্যিক জেট উড়োজাহাজ) আকাশারোহণকালে তুলনামূলক কম গতির কারণে পর্যাপ্ত উত্তোলিত হবার সময় কিছুটা সমস্যা দেখা দেয়। এই সমস্যার সমাধানের জন্য সেগুলোতে কিছু উচ্চ উত্তোলনক্ষমতার যন্ত্রাংশ (হাই-লিফট ডিভাইস) যুক্ত করা হয় যেমনঃ স্ল্যাট এবং ফ্ল্যাপ। এগুলো ক্যাম্বার ও পাখার ক্ষেত্রফল বাড়িয়ে দেয়। ফলে অল্প গতিতেই সেগুলো বেশি কর্মক্ষম হয় ও তুলনামূলক বেশি উত্তোলিত হতে পারে। এগুলোকে আকাশারোহণের পূর্বে পাখা থেকে প্রসারিত করা হয় এবং আরোহণের পরে আবার গুটিয়ে নেয়া হয়। তবে সেগুলোকে অন্য সময়েও যেমন অবতরণের পূর্বে প্রসারিত করা যেতে পারে।
আকাশারোহণের জন্য প্রয়োজনীয় গতি বায়ুপ্রবাহের গতির সাথে সম্পর্কিত। প্রতিকূল বায়ুপ্রবাহ ভূমির থেকে আকাশারোহণে প্রয়োজনীয় গতি কমিয়ে দেয় কারণ তখন দুই পাখার উপরে বায়ুপ্রবাহ বেশি থাকে। প্রচলিত আকাশারোহণের ক্ষেত্রে জেটলাইনারের প্রয়োজনীয় বায়ুপ্রবাহের গতি ১৩০-১৫০ নট সীমার মধ্যে (১৫০-১৮০ মাইল/ঘণ্টা, ২৪০-২৮৫ কিমি/ঘণ্টা)। হালকা উড়োযানগুলো, যেমন সেসনা ১৫০, প্রায় ৫৫ নটে (৬৩ মাইল/ঘণ্টা, ১০০ কিমি/ঘণ্টা) আকাশারোহণ করে। অতি হালকা উড়োযানসমূহের (আল্ট্রালাইট) আকাশারোহণ গতি তুলনামূলক অনেক কম। যেকোনো উড়োযানের ক্ষেত্রে আকাশারোহণের গতি নির্ভর করে যানটির ভারের উপর; যানটি যত ভারী, তত বেশি গতি প্রয়োজন।[১] কিছু কিছু উড়োযান বিশেষভাবে সংক্ষিপ্ত আকাশারোহণে ও অবতরণের (STOL) জন্যই প্রস্তুত করা হয়। খুব অল্প গতিতেই বায়ুতে উড়নক্ষম হয়ে যানগুলো আকাশারোহণে করে থাকে।
আকাশারোহণের জন্য প্রয়োজনীয় বেগের পরিমাণ বায়ুর ঘনত্ব, উড়োযানের সমগ্র ওজন এবং এর কনফিগারেশন (প্রয়োজনানুসারে স্ল্যাট বা ফ্লাপ পজিশন) অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। বায়ুতে ঘনত্ব ক্ষেত্রের উচ্চতা ও বায়ুর তাপমাত্রা দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাপমাত্রা, উচ্চতা ও বায়ুর ঘনত্বের মধ্যবর্তী সম্পর্ককে বলা হয় উচ্চতা ঘনত্ব, বা আন্তর্জাতিক আদর্শ বায়ুমন্ডল উচ্চতা, যে স্থানের বায়ুর ঘনত্ব প্রকৃত বায়ুর ঘনত্বের সমান হবে।
পরিবাহী উড়োযানগুলোতে আকাশারোহণ ভি-স্পিড (V-Speeds), V1, VR ও V2 এর ধারণা প্রয়োগ করা হয়। আকাশারোহণের উপরোল্লিখিত প্রভাবকসমূহ ছাড়াও আরোহণ পথের (রানওয়ের) দৈর্ঘ্য ও ঢাল এবং কোনো বিশেষ অবস্থা যেমন আরোহণপথের উপরে বা শেষপ্রান্তে কোনো বাধা ইত্যাদি বিবেচনা করে উক্ত বেগগুলো নির্ণয় করা হয়। V1 এর নিচে, ক্রান্তিকালীন ব্যর্থতার (ক্রিটিক্যাল ফেইলিয়র) ক্ষেত্রে, আকাশারোহণটিকে পরিত্যাগ করা হয়। V1 এর উপরে উড়োযানচালক আকাশারোহণ চালিয়ে যান ও অবতরণের জন্য ফিরে আসেন। সহ-উড়োযানচালক V1 বললে, তিনি বলবেন VR বা "রোটেট" (ঘূর্ণন), এটি উড়োযানের ঘূর্ণনের নির্ধারিত বেগ। পরিবাহী উড়োযানের ক্ষেত্রে VR এমনভাবে নির্ণয় করা হয় যে, উড়োযানটি একটি ইঞ্জিন অচল থাকলে যেন রেগুলেটরি স্ক্রিন উচ্চতায় পৌঁছতে পারে। এরপর, V2 (আকাশারোহণের নিরাপদ বেগ) বলে ডাকা হয়। এই বেগটি একটি ইঞ্জিন অচল হবার পরে অবশ্যই এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যেন আরোহণ হার ও আরোহণ কোণের নির্ধারিত মাত্রা পূর্ণ হয়।
এক-ইঞ্জিনবিশিষ্ট বা হালকা দ্বৈত ইঞ্জিনবিশিষ্ট উড়োযানে চালক আকাশারোহণে প্রয়োজনীয় আরোহণপথের দৈর্ঘ্য পরিমাপ করেন এবং পথে বাধা থাকলে তা অপসারণ করেন যাতে আরোহণপথের পর্যাপ্ত ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। একটা নিরাপত্তা মাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয় যাতে পরিত্যাক্ত আকাশারোহণের ক্ষেত্রে আরোহণপথেই থামা যায়। বেশিরভাগ উড়োযানের ক্ষেত্রে ইঞ্জিন বা যেকোনো যান্ত্রিক ত্রুটির ফলে আকাশারোহণ পরিত্যক্ত হয়। তবে অপর্যাপ্ত শক্তিতে ওড়ার ক্ষেত্রে উড়ন বজায় রাখতে আরোহণপথের শেষে অতিরিক্ত যাওয়া যেতে পারে।
যদি কোনো বাধা অতিক্রম করতে হয়, উড়োযানচালক সর্বোচ্চ আরোহণ কোণের বেগে (Vx) আরোহণ করেন। এতে যানটি অতিক্রান্ত প্রতি একক আনুভূমিক দূরত্বের জন্য সর্বোচ্চ উচ্চতাপ্রাপ্ত হয়। কোনও বাধা অতিক্রম না করতে হলে বা বাধা অতিক্রান্ত হয়ে গেলে উড়োযানচালক সর্বোত্তম আরোহণ বেগে (Vy) চলতে পারেন। এতে যানটি অল্প সময়ে সর্বোচ্চ উচ্চতা অর্জন করবে। সাধারণভাবে বললে, Vx বেগ মূলত Vy এর চেয়ে কম এবং Vx -এর জন্য উচ্চতর পিচ অ্যাটিটিউড অর্জন করা প্রয়োজন।
সাহায্যপ্রাপ্ত আকাশারোহণ এমন একটি পদ্ধতি যাতে আকাশেই একটি উড়োযানকে (অবশ্যই সাহায্যকারী যানের নিজস্ব ক্ষমতার উপর নির্ভর করে) সহায়তা করা হয়। যানটির ওজন সর্বোচ্চ আকাশারোহণ ওজন থেকে বেড়ে গেলে, অপর্যাপ্ত শক্তি বা অপর্যাপ্ত দৈর্ঘের রানওয়ে বা গরম ও উঁচু বায়ুমন্ডল অথবা এই চারটির সমন্বিত কোনো সমস্যা হলে উড়োযানটির সাহায্য প্রয়োজন হতে পারে এবং তখন সেটিকে সহযোগীতা নিতে হয়। গ্লাইডারের জন্য সাহায্যপ্রাপ্ত আকাশারোহণ প্রয়োজন হয় কারণ এদের ইঞ্জিন নেই, ফলে এগুলো নিজে নিজে আকাশারোহণে অক্ষম।
উল্লম্ব আকাশারোহণ হলো উড়োযান বা রকেটের উল্লম্ব বা ঠিক খাঁড়াভাবে আকাশারোহণে। এই আকাশারোহণে বায়ুক্ষেত্রের কোনো প্রয়োজন হয় না। বেশির ভাগ উল্লম্ব আকাশারোহণক্ষম উড়োযানসমূহ উল্লম্ব বা আনুভূমিক উভয়ভাবেই অবতরণ করতে পারে, তবে কিছু লুফটওয়াফে রকেট-পাওয়ারড-উড়োযান রয়েছে যেগুলো শুধু উল্লম্ব ভাবে আকাশারোহণ করতে পারে কিন্তু অবতরণ করে ভিন্ন কোন উপায়ে। ব্যাকেম বা ৩৪৯ উল্লম্ব ভাবে আকাশারোহণের পর প্যারাশুটের সাহায্যে অবতরণ করে। এছাড়াও আরো অন্যান্য নাৎসি জার্মান প্রজেক্ট, যেমনঃ হেইনকেল পি.১০৭৭ বা ফোক-উলফ ভোল্কসগেগর ২ নিকটবর্তী উল্লম্ব-কোণে আরোহণ করলেও পরে গড়ানো তলে অবতরণ করতে হয়।[২]
উল্লম্ব আকাশারোহণে ও অবতরণ (ভি-টি-ও-এল) (Vertical take-off and landing-VTOL) উড়োযানের মধ্যে রয়েছে উল্লম্বভাবে হোভার, আকাশারোহ ও অবতরণ করতে সক্ষম ফিক্সড উইং উড়োযান এবং হেলিকপ্টার ও শক্তিশালী রোটরযুক্ত উড়োযান যেমনঃ টিল্টরোটর।[৩][৪][৫] কিছু ভি-টি-ও-এল উড়োযান অন্যভাবেও কাজ করতে পারে যেমনঃ সি-টি-ও-এল (প্রচলিত আকাশারোহণে ও ভূ-অবতরণ), এস-টি-ও-এল (সংক্ষিপ্ত আকাশারোহণ ও অবতরণ) এবং এস-টি-ও-ভি-এল (সংক্ষিপ্ত আকাশারোহণ ও উল্লম্ব অবতরণ)। অন্যান্যগুলো যেমনঃ কিছু হেলিকপ্টার, এগুলো আনুভূমিক গতিকে সামলানোর মতো ল্যান্ডিং গিয়ার না থাকায় শুধু ভি-টি-ও-এল দ্বারাই পরিচালিত হতে পারে। ভি-টি-ও-এলকে মূলত ভি/এস-টি-ও-এল (উল্লম্ব ও সংক্ষিপ্ত আকাশারোহণ ও ভূ-অবতরণ) -এর উপসেট বলা চলে।
এছাড়াও, সামরিক সেবাতে দুই ধরনের ভি-টি-ও-এল উড়োযান আছেঃ টিল্টরোটর ব্যবহারকারী উড়োযান যেমনঃ বেল বোয়িং ভি-২২ অসপ্রে এবং জেট থ্রাস্ট ব্যবহৃত উড়োযান যেমনঃ হ্যারিয়ার (যুদ্ধ বিমান)।
রকেট উৎক্ষেপণ হলো একটি রকেটের আকাশারোহণ দশা। রকেট মূলত কাক্ষিক মহাশূন্য উড্ডয়নের জন্য উৎক্ষিপ্ত হয় অথবা আন্তঃগ্রহ মহাশুন্যে উৎক্ষিপ্ত হয়। উৎক্ষেপন ভূমিতে একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে অথবা স্যান মারকো প্ল্যাটফর্ম বা সামুদ্রিক উৎক্ষেপণ লঞ্চ ভেসেলের মতো ভাসমান কোনো অবস্থান থেকেও হতে পারে।
|তারিখ=
(সাহায্য)