![]() ইসলাম বিষয়ক ধারাবাহিক রচনার একটি অংশ আকীদা |
---|
![]() |
১ আহমাদিয়া, কুতুববাদ ও ওয়াহাবিবাদ সহ ২ আলাওয়ি, আসাসিন ও দ্রুজ সহ ৩ আলেভি, বাক্তাশি, কিযিবাশ ও কালান্দারিয়া সহ ৪ আযারিকা, আজারদি, হারুবিয়া, নাজদাত এবং সুফ্রিয়া সহ ![]() |
ইসলাম |
---|
বিষয়ক ধারাবাহিক নিবন্ধের অংশ |
![]() |
আকিদা ( আরবি: العقيدة–আল্-আকিদাহ ; বহুবচন: العقائد–আল-আকা'ইদ ), যা ইসলামি ধর্মতত্ত্ব নামেও পরিচিত, হল একটি ইসলামি পরিভাষা, যার অর্থ 'কিছু মূল ভিত্তির উপর বিশ্বাস স্থাপন'। বিশ্বাস বা ধর্মবিশ্বাস বুঝাতে মুসলিম সমাজে সাধারণত দুইটি শব্দ ব্যবহৃত হয়: ইমান ও আকিদা। তবে কুরআন ও সহিহ হাদিসে সর্বদাই'ঈমান' শব্দটিই ব্যবহার করা হয়েছে। "আকিদা" ব্যবহৃত হয়নি। হিজরি দ্বিতীয় শতক থেকে তাবেয়ীগণ (সাহাবি ছাত্র) ও পরবর্তী যুগেই ঈমামগণ (ধর্মীয় বিশ্লেষক ) ধর্মবিশ্বাসের খুঁটিনাটি বিষয় আলোচনার জন্যেই"ঈমান" ছাড়াও আরো কিছু পরিভাষা ব্যবহার শুরু করেন। এসকল পরিভাষার মধ্যে রয়েছে 'আল-ফিকহুল আকবার', 'ইলমুত তািহীদ', 'আস–সুন্নাহ', 'আশ-িরীয়াহ', 'উসূলুদিদীন', 'আলকিদাহাহ' ইত্যাদি।[১] এসবের মধ্যে 'আকিদাহ' শব্দটিই অধিক প্রচলিত।
সামগ্রিক অর্থে আকিদা হল, ইসলামের যেসকল ভিত্তি কিতাব, সুন্নাহ এবং সাহাবায়ে কেরামের ঐক্যমত দ্বারা নির্দেশিত তা নির্দ্বিধায় অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করা এবং বিনা বাক্যে মেনে নেওয়া এবং এক্ষেত্রে অন্তরে কোনো ধরনের কপটতার স্থান না দেওয়া। সে সকল বিষয় হল: আল্লাহ, ফেরেশতা, তাঁর কিতাব, তাঁর রসূল, কেয়ামত, তাকদিরের ভালো ও মন্দে বিশ্বাস করা এবং কুরআনে যা কিছু এসেছে তার সমস্ত কিছুর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা সেই সাথে নবি (সা.) যা কিছু আল্লাহর তরফ থেকে নিয়ে এসেছেন তা বিনা দ্বিধায় মেনে নেওয়া। এছাড়াও অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাস, আল্লাহর একত্ববাদ এবং মহত্ত্ব, তার নির্দেশিত পথে উপাসনা করা, কুফরি বাতিল বা অসত্য হওয়ার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন, ইসলামে অবিশ্বাসী ও আল্লাহর সাথে অপরকে শরিককারী সকলের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন, আল্লাহর সাথে সাক্ষাত হওয়া, তাঁকে দেখা ও হাশরের মাঠে তাঁর পুরস্কার ও পরিণতির প্রতি বিশ্বাস রাখাও আকিদার অন্তর্ভুক্ত।[২]
আকিদাহ শব্দটি এসেছে সেমিটীয় ধাতুমূল ʿআ-ক্ব-দ থেকে, যার অর্থ "বাঁধা, গিঁট বা দেওয়া"[৩] ("আকিদাহ" শব্দটি শুধু ইসলামী ঈশ্বরতত্ত্ব/ বিশ্বাসব্যবস্থাকেই বোঝায় না; বরং ইসলামে 'ঈশ্বরতত্ত্ব' শব্দটির প্রতিশব্দ হিসেবেও একে ব্যবহার করা হয় এবং সেই অনুযায়ী: "ঈশ্বরতত্ত্ব (আক্বীদাহ) মুসলমানদের সকল বিশ্বাস ও বিশ্বাসব্যবস্থাকে অন্তর্ভূক্ত করে, যার মাঝে নিজেদের সাম্প্রদায়িক পার্থক্যসমূহ এবং দ্বন্দ্বের বিষয়সমূহও অন্তর্ভূক্ত।)[৪] প্রচলিত আরবি ভাষায় আকিদা শব্দটি বিশ্বাস বা ধর্মমত বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
ঈমান অর্থ হলো স্বীকৃতি দেওয়া বা স্বীকার করা, যার তিনটি ধাপ, প্রথম ধাপটি হলো অন্তরে বিশ্বাসের মাধ্যমে স্বীকৃতি প্রদান, দ্বিতীয় ধাপটি হলো মুখ দ্বারা অর্থাৎ প্রকাশ্যে বলে ঘোষণার মাধ্যমে স্বীকৃতি প্রদান, আর তৃতীয় ধাপটি হলো কাজের মাধ্যমে বা কাজে পরিণত করার মাধ্যমে স্বীকৃতি প্রদান। এর মধ্যে অন্তরে বিশ্বাসের মাধ্যমে স্বীকৃতি প্রদান করার ধাপটি আকিদার বা বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কযুক্ত, যা ঈমানের মূল বা মৌলিক ভিত্তি বা শিকড়স্বরূপ। এর প্রমাণ বা দলিল হলো নিম্নোক্ত হাদিসটিঃ
আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ’আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, ’’তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কোন গর্হিত কাজ দেখবে, সে যেন তা নিজ হাত দ্বারা পরিবর্তন করে দেয়। যদি (তাতে) ক্ষমতা না রাখে, তাহলে নিজ জিভ দ্বারা ( উপদেশ দিয়ে পরিবর্তন করে)। যদি (তাতেও) সামর্থ্য না রাখে, তাহলে অন্তর দ্বারা (ঘৃণা করে)। আর এ হল সবচেয়ে দুর্বল ঈমান।’’
— সহীহুল বুখারী ৯৫৬, মুসলিম ৪৯, তিরমিযী ২১৭২, নাসায়ী ৫০০৮, ৫০০৯, আবূ দাউদ ১১৪০, ৪৩৪০, ইবনু মাজাহ ১২৭৫, ৪০১৩, আহমাদ ১০৬৮৯, ১০৭৬৬, ১১০৬৮, ১১১০০, ১১১২২, ১১১৪৫, ১১৪৬৬, দারেমী ২৭৪০১
এছাড়া আলেমগণ আকীদা ও ঈমানের পার্থক্য করে বলেন যে, আকীদা বলতে ধর্মবিশ্বাসের সকল মত, পথ, প্রচলন, বৈচিত্র্য ও বর্ণালীকে বোঝায় আর ঈমান শুধু সুনির্দিষ্ট বিশুদ্ধ ইসলামী ধর্মবিশ্বাসকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া আরবি ভাষায় আভিধানিকভাবে আকীদা শব্দটির অর্থ বিশ্বাস, এবং ঈমান শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো স্বীকৃতি দেওয়া, স্বীকার করা বা মেনে নেওয়া। অর্থাৎ কোন বিষয়ে বিশ্বাসের প্রকৃতি বা ধরনের নাম হলো আকীদা, আর কোন আকীদা বা বিশ্বাসকে স্বীকৃতি দেওয়া বা মেনে নেওয়ার নাম হলো তার উপর ঈমান আনা।
ইসলামি আকিদার একমাত্র উৎস হচ্ছে ওহী। ইসলামি বিশ্বাস অনুসারে দু প্রকারের ওহী প্রেরিত হয়েছে : কিতাব (কুরআন) ও সুন্নাত (হাদীস)। কুরআন অনুসারে আল্লাহ রাসূলের প্রতি কিতাব ও হিকমত অবতীর্ণ করেছেন।[৫] হিকমতকে রাসূলের সুন্নাহ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। কুরআনের সাথে সুন্নাহর পার্থক্য হল, সুন্নাহর শব্দাবলী আল্লাহর পক্ষ থেকে নয়। তবে উভয়টিরই তথ্যসমূহ আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত।[৬]
কর্ম বা আমলের বিষয়ে ইসলামের বিধান নির্ণয়ে কিয়াস বা অনুমানের উপরে নির্ভর করা যায়। কিন্তু ইসলামি বিশ্বাস গায়েব বা অদৃশ্য বিষয়ের উপর নয়। মুসলিম পণ্ডিতদের মতে, এ সকল বিষয়ে মানুষ ওহীর নির্দেশনা ছাড়া অনুমান করে অথবা গবেষণা করে কোনো সমাধান দিতে সক্ষম নয়। এছাড়া ওহীর ব্যাখ্যা সেভাবেই করতে হয়, যেভাবে সাহাবী ও তাবেয়ীগণ ব্যাখ্যা করেছেন।
ঈমানের বা ইসলামি আকীদা বিশ্বাসের উপর স্বীকৃতির ছয়টি বা মতান্তরে সাতটি স্তম্ভ এসেছে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে (আরকান আল-ঈমান)[৭]। যা সব মুসলমানদের দ্বারা গৃহীত হয়েছে। বিশ্বাসের স্তম্ভগুলো হল:
উমার বলেন,
একদিন আমরা আল্লাহর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট বসেছিলাম, এমন সময় হঠাৎ এক ব্যক্তি আমাদের সামনে উপস্থিত হয় ..... এরপর বলল: "আমাকে ঈমান সম্পর্কে বলুন"। তিনি বললেন: "তা হচ্ছে এই- আল্লাহ্, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ ও আখেরাতের উপর ঈমান আনা এবং তাকদীরের ভাল-মন্দের উপর ঈমান আনা।"..... [সহীহ্ মুসলিম, হাদীসটি জিবরাঈলের হাদীস নামে পরিচিত][৮]
তাওহিদ (আরবি: توحيد) ইসলাম ধর্মে এক আল্লাহর ধারণাকে বোঝায়।[৯] তাওহিদ শব্দের অর্থ একত্ববাদ৷[১০] ইসলামি পরিভাষায় তাওহিদ হল সৃষ্টি ও পরিচালনায় আল্লাহকে এক ও অদ্বিতীয় হিসেবে বিশ্বাস করা, সকল ইবাদাত-উপাসনা কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য করা, অন্য সবকিছুর উপাসনা ত্যাগ করা, আল্লাহর সুন্দর নামসমূহ ও সুউচ্চ গুণাবলীকে তার জন্য সাব্যস্ত করা এবং দোষ ত্রুটি থেকে আল্লাহকে পবিত্র ও মুক্ত ঘোষণা করা।[১১][১২]
ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ স্বীকার করা, স্বীকৃতি দেওয়া, মতান্তরে দৃঢ় বিশ্বাস করা। ইসলাম ধর্মে ঈমানের অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক[১৩]। ঈমানের সাতটি স্তম্ভ হচ্ছেঃ[১৪][১৫][১৬][১৭]
আল-কোরআনের সূরা-বাকারা এর দুই হতে চার আয়াতে ঈমান সম্পর্কে এই বিষয় গুলি উল্লেখ করা হয়েছে।
জিব্রাইলের হাদিসে "হে আল্লাহর রসূল, ইসলাম কি?" প্রশ্নের উত্তরে ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ (তাওহিদ, সালাত, সাওম, জাকাত, হজ) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই হাদিসটিকে কখনও কখনও "সত্যিকারের প্রথম এবং সবচেয়ে মৌলিক আক্বীদা" বলা হয়।[১৮]
নামাজ/নামায বা সালাত বা সালাহ ইসলাম ধর্মের একটি দৈনিক নিয়মিত ইবাদত। একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নামাজ আদায় করতে হয় যা কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত আছে। এটি মুসলমানদের জন্য প্রতিদিন অবশ্যকরণীয় একটি ধর্মীয় কাজ। তবে প্রতিদিন আবশ্যকরণীয় বা ফরজ ছাড়াও বিবিধ নামাজ রয়েছে যা সময়ভিত্তিক বা বিষয়ভিত্তিক।
সালাত একটি সুনির্দিষ্ট প্রকৃতির ইবাদত যার পদ্ধতি ‘ইসলামী শরী‘আতে পরিপূর্ণভাবে বর্ণিত হয়েছে। নামাজ ‘তাকবিরে তাহরিমা’ দ্বারা শুরু হয় ও ‘সালাম ফিরানো’ দ্বারা শেষ হয়’।[১৯]
নামাজ (সালাত) ইসলামের পাঁচটি রোকনের মধ্যে দ্বিতীয় রোকন৷ নামাজ প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক ও বুদ্ধি-জ্ঞান সম্পন্ন, নারী পুরুষ নির্বিশেষে, প্রতিটি মুসলিমের জন্য ফরজ বা অবশ্যকরণীয়।
রোযা বা রোজা (ফার্সি روزہ রুজ়ে), সাউম বা সাওম (আরবি صوم স্বাউম্, অর্থঃ সংযম), বা সিয়াম ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মূল ভিত্তির তৃতীয়। সুবহে সাদেক বা ভোরের সূক্ষ আলো থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার,পাপাচার, কামাচার এবং সেই সাথে যাবতীয় ভোগ-বিলাস থেকেও বিরত থাকার নাম রোযা। ইসলামী বিধান অনুসারে, প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের জন্য রমযান মাসের প্রতি দিন রোজা রাখা ফরজ, (فرض ফ়ার্দ্ব্) যার অর্থ অবশ্য পালনীয়।
যাকাত (আরবি: زكاة zakāt, "যা পরিশুদ্ধ করে", আরও আরবি: زكاة ألمال, "সম্পদের যাকাত"[২০]) হলো ইসলাম ধর্মের পঞ্চস্তম্ভের একটি। প্রত্যেক স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক মুসলমান নর-নারীকে প্রতি বছর স্বীয় আয় ও সম্পত্তির একটি নির্দিষ্ট অংশ, যদি তা ইসলামী শরিয়ত নির্ধারিত সীমা (নিসাব পরিমাণ) অতিক্রম করে তবে[২১], গরীব-দুঃস্থদের মধ্যে বিতরণের নিয়মকে যাকাত বলা হয়।[২২][২৩] সাধারণত নির্ধারিত সীমার অধিক সম্পত্তি হিজরি ১ বছর ধরে থাকলে মোট সম্পত্তির ২.৫ শতাংশ (২.৫%) বা ১/৪০ অংশ[২৪][২৫][২৬] বিতরণ করতে হয়। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে হজ্জ্ব এবং যাকাত শুধু শর্তসাপেক্ষ যে, তা সম্পদশালীদের জন্য ফরয বা আবশ্যিক হয়। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনে "যাকাত" শব্দের উল্লেখ এসেছে ৩২ বার। নামাজের পরে সবচেয়ে বেশি বার এটি উল্লেখ করা হয়েছে।[২৭]
হজ্ব বা হজ্জ বা হজ (আরবি: حج) ইসলাম ধর্মাবলম্বী অর্থাৎ মুসলমানদের জন্য একটি আবশ্যকীয় ইবাদত বা ধর্মীয় উপাসনা। এটি ইসলাম ধর্মের চতুর্থ স্তম্ভ। শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য জীবনে একবার হজ সম্পাদন করা ফরজ বা আবশ্যিক।[২৮][২৯][৩০] আরবি জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ হজের জন্য নির্ধরিত সময়।[৩১][৩২] হজ পালনের জন্য বর্তমান সৌদি আরবের মক্কা নগরী এবং সন্নিহিত মিনা, আরাফাত, মুযদালিফা প্রভৃতি স্থানে গমন এবং অবস্থান আবশ্যক। এটি পৃথিবীর বাৎসরিক তীর্থযাত্রা।[৩৩] শারীরিক ও আর্থিকভাবে হজ পালনে সক্ষম হয়ে ওঠার অবস্থাকে ইস্তিতাহ বলা হয় এবং যে মুসলমান এই শর্ত পূরণ করে তাকে মুস্তি বলা হয়। হজ হ'ল মুসলিম জনগণের সংহতি, এবং আল্লাহর নিকটে তাদের আনুগত্যের প্রদর্শনী।[৩৪][৩৫] যিনি হজ সম্পাদনের জন্য গমন করেন তাকে বলা হয় হাজী। হজ শব্দের অর্থ "একটি যাত্রায় অংশ নেওয়া", যা ভ্রমণের বাহ্যিক কাজ এবং উদ্দেশ্যগুলির অভ্যন্তরীণ কাজ উভয়কেই বোঝায়।[৩৬]
জিহাদ (আরবি: جهاد), যার অর্থ সংগ্রাম; কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য লাভের জন্য সমগ্র শক্তি নিয়োগ করাকে বোঝানো হয়। এর আভিধানিক অর্থ পরিশ্রম,সাধনা,কষ্ট, চেষ্টা ইত্যাদি। তবে সচরাচর ইসলামী পারিভাষিক অর্থে 'জিহাদ' কথাটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কুরআনে জিহাদের কথা ৪১ বার উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে "আল্লাহের পথে সংগ্রাম করা" অর্থে 'জিহাদ' কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে।[৩৭][৩৮] জিহাদের সাথে জড়িত ব্যক্তিকে মুজাহিদ বলা হয়। জিহাদকে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হিসাবে গণ্য করা হয়। কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যা অনুযায়ী স্থানভেদে জিহাদ তিন রূপ হতে পারেঃ (ক) পাপ থেকে বেঁচে থাকার জন্য স্বীয় কৃপ্রবৃত্তির বিরূদ্ধে জিহাদ, (খ) মুসলিম সমাজকে উন্নয়নের সংগ্রাম, এবং (গ) যুদ্ধক্ষেত্রে সংগ্রাম। [৩৯]
দা'ওয়াহ বা দাওয়াহ (আরবি: دعوة, প্রতিবর্ণীকৃত: "আমন্ত্রণ") মানে ইসলামের প্রচার। দা'ওয়াহ আক্ষরিক অর্থে "আমন্ত্রণ" করাকে বোঝায়, ক্রিয়ার সক্রিয় অংশগ্রহণ যার অর্থ বিভিন্নভাবে "ডাকা" বা "আমন্ত্রণ জানানো"। একজন মুসলিম যিনি ধর্মীয় কর্মী হিসাবে বা স্বেচ্ছাসেবক সম্প্রদায়ের প্রচেষ্টায় দা'ওয়াহ অনুশীলন করেন, তাকে দাঈ, বহুবচন দুʿআত বলা হয়। এইভাবে একজন দাঈ এমন একজন ব্যক্তি যিনি মানুষকে একটি সংলাপ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইসলাম বোঝার জন্য আমন্ত্রণ জানান, এবং কিছু ক্ষেত্রে মিশনারির ইসলামিক সমতুল্য হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা যেতে পারে, যিনি মানুষকে বিশ্বাস, প্রার্থনা বা ইসলামিক জীবনে আমন্ত্রণ জানান।[৪০]
আখিরাত (আরবি: الآخرة) একটি ইসলামী শব্দ যেটির দ্বারা মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে বোঝানো হয়।[৪১] মুসলিমদের বিশ্বাস অনুযায়ী আখিরাত বা পরকালের জীবনের শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। আখিরাতে মানুষের দুনিয়ার কাজকর্মের হিসাব নেওয়া হবে এবং অতঃপর ভালো কাজের জন্য পুরস্কার এবং মন্দ কাজের জন্য শাস্তি দেওয়া হবে।
ইসলামী সকল পণ্ডিতগণ বলে থাকেন যে, প্রথমত আকীদা বা বিশ্বাস দ্বিতীয়ত মানহাজ বা পদ্ধতি সঠিক না হলে আমল আল্লাহর নিকট কবুল হয় না। অর্থাৎ আমল কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হলো প্রথমত আকীদা বা বিশ্বাস ঠিক হওয়া ও দ্বিতীয়ত মানহাজ বা পদ্ধতি ঠিক হওয়া। সালাফি আলেমদের মতে, মানহাজ বা পদ্ধতির দ্বারাই আকীদা বা বিশ্বাস নির্ধারিত হয়, তাই তারা বলেন, সকল কাজের মানহাজ বা পদ্ধতির ক্ষেত্রে সালাফদের পূর্নাঙ্গ অনুসরণ করা উচিৎ, কারণ তাদের মতে, একমাত্র এর মাধ্যমে ইসলামী সঠিক আকীদা বা বিশ্বাস ধারণ করা ও আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য আমল সম্পাদন করা সম্ভব।
মনজুর এলাহি তার "সমাজ সংস্কারে সঠিক আকীদার গুরুত্ব" বইতে "সমাজ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা ও সে ক্ষেত্রে সঠিক ইসলামী আকীদার ভূমিকা ও গুরুত্ব" সম্পর্কে বলেন,[৪২]
মানুষ তার ব্যক্তি জীবনের সকল চাহিদা মেটানোর জন্যই সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করে। যে কোনো সমাজ গঠনের প্রধান লক্ষ্যই হল সে সমাজের সকল সভ্যের সার্বিক কল্যাণ সাধন ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিতকরণ। কিন্তু ব্যক্তি জীবনের অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও স্বার্থপরতা সমাজ জীবনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে সমাজকে দুর্নীতি, বৈষম্য, বিভক্তি, হানাহানি প্রভৃতি ব্যাধিতে কলুষিত ও বিষাক্ত করে তোলে। তখনই দেখা দেয় সমাজ সংস্কারের বিরাট প্রয়োজনীয়তা, যেমনটি আমরা অনুভব করছি আমাদের বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে। সমাজের বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি সমস্যা জর্জরিত দুর্নীতিগ্রস্ত ঘুণে ধরা এ সমাজের মানুষের মধ্যে সঠিক আকীদার জ্ঞান নেই বললেই চলে। এরই অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে আকীদায় অনৈক্য এবং প্রবৃত্তির চাহিদা অনুযায়ী যার যেমন ইচ্ছা তেমন আকীদা পোষণ, কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক এর যথার্থতা থাকুক বা নাই থাকুক। অন্যদিকে মানুষের ঈমান হয়ে পড়েছে অত্যন্ত দুর্বল, অন্তর থেকে তাকওয়ার বিদায় ঘটেছে, পরকালীন শাস্তির কথা সে বিস্মৃত হয়েছে। ফলে সমাজে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা, লুটে-পুটে খাওয়ার প্রবণতা, নানা প্রকার সন্ত্রাস ও অপসংস্কৃতির বিস্তার ইত্যাদি আরো অনেক সমস্যা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সীরাতে আমরা দেখি তিনি তৎকালীন জাহেলী সমাজকে বদলে দিয়ে একে পরিণত করেছিলেন তখনকার সর্বোৎকৃষ্ট সমাজে। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের ইতিবাচক পরিবর্তন সাধনের যে আন্দোলন তিনি শুরু করেছিলেন নবুওয়াত প্রাপ্তির পর থেকে, তার প্রাথমিক প্রক্রিয়াই ছিল আকীদাগত সংস্কার। এ সম্পর্কে সাইয়েদ কুতুব তার مقومات التصور الإسلامي (ইসলামিক উপলব্ধির উপাদান) গ্রন্থে বলেন:
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রেরিত হয়েছেন এমন এক সময়ে যখন জাযিরাতুল আরব উত্তরে রোমান ও দক্ষিণে পারস্যের মধ্যে লুটেরা সম্পদ হিসাবে বন্টিত ছিল। এরা তাদের হাত প্রসারিত করেছিল জাযিরাতুল আরবের উর্বর ভূমি, সমুদ্রোপকুল, সম্পদ ও বাণিজ্যের সকল উৎসের প্রতি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনই এক সময়ে প্রেরিত হয়েছেন যখন বিরাজমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা দাসত্ব যুগের প্রতিনিধিত্ব করত বিপুল সমারোহে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনই এক সময়ে প্রেরিত হয়েছেন যখন মদ, যেনা, জুয়া, খেল-তামাশা, মন্দ ও বিপর্যয় সৃষ্টিতে মানব চরিত্র জাহেলিয়াতের ধারায় বহমান ছিল। এ সবের কোনোটি দিয়েই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংস্কার কাজ শুরু করেননি। জাযিরাতুল আরবের উর্বর ভূমি থেকে রোমান ও পারসীদের তাড়ানোর জন্য তিনি জাতীয়বাদী ঐক্যের দিকে আরবদেরকে আহ্বান করতে সক্ষম ছিলেন। যুদ্ধের সকল শক্তি তিনি তাদের ব্যাপারে নিয়োগ করতে পারতেন এবং জাতীয় শত্রুদের প্রতি তিনি আরবদের ক্ষেপিয়ে তুলতে পারতেন। ফলত তারা তার নেতৃত্বের প্রতি অনুগত হত এবং তাদের সকল হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে যেত।……কিন্তু আল্লাহ জানতেন, তিনি তাঁর নবীকে জানিয়েছিলেন এবং নির্দেশনা দিয়েছিলেন যে, এটা সঠিক পথ নয় এবং এটা মূল কাজ নয়। মূলকাজ হচ্ছে মানুষ তার সত্যিকার রবকে জানা এবং শুধু তাঁরই দাসত্ব মেনে নেওয়া, আর তাঁর বান্দাদের দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়া এবং পরিশেষে আল্লাহর কাছ থেকে যা-ই তাদের কাছে আসে তার সব কিছু গ্রহণ করা….”।
...লক্ষ্যণীয়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াতের পর মাক্কী জীবনের ১৩ বৎসরে আকীদা বিষয়ক জ্ঞান প্রচারের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। নবী সা. ই শুধু নয়, বরং সকল নবী ও রাসূলগণের প্রথম কাজই ছিল সঠিক আকীদার প্রতি সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে আহবান। আল-কুরআনের ভাষায় তাদের সেই আহবান ছিল: “হে আমার জাতি, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো সত্যিকার ইলাহ নেই।” [আল-আ‘রাফ: ৫৮] এর কারণ ছিল একটিই, আকীদা শুদ্ধ না হলে ব্যক্তি জীবন শুদ্ধ হয় না, আর ব্যক্তি শুদ্ধ না হলে সমাজও শুদ্ধ হয় না।
...(১) বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য স্থাপনে সঠিক আকীদার ভূমিকা: সঠিক আকীদার উপর একমত হওয়া ছাড়া বৃহত্তর ঐক্য স্থাপন করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি সারা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর পক্ষেও ঐক্যবদ্ধ হওয়া সুদূর পরাহত। এ প্রসঙ্গে (ড.) উমার সুলায়মান আল-আশকার বলেন: “একই আকীদা যতক্ষণ মুসলিমদেরকে ঐক্যবদ্ধ না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত মুসলিম ঐক্য বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব না।” প্রকৃতপক্ষে আকীদাগত বিভ্রান্তিই সমাজে অনৈক্যের বীজ বপন করে। সমাজ হয়ে পড়ে বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত। যদি প্রশ্ন উঠে যে, প্রত্যেকেই নিজ নিজ আকীদা ও বিশ্বাসকে সঠিক বলে মনে করে। সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো আকীদাকে সঠিক ধরে নিয়ে একমত হওয়া সম্ভব হবে না। কারণ প্রত্যেক দল নিজ মতের প্রতি আস্থাশীল। এ প্রশ্নের উত্তরে (ড.) উমার সুলাইমান আল-আশকার বলেন: “বিশুদ্ধ ইসলামী আকীদা বিষয়ে কুরআন ও সুন্নায় স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে। এ আকীদার প্রতিটি মৌলিক ও খুটিঁনাটি বিষয়ে দলীল পেশ করা সম্ভব। আর সালাফে সালেহীন সত্য ইসলামী আকীদার উপরই প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তারা এ আকীদা এতটাই ভালোভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন যে, তা ফেরকাবাজী ও বিভ্রান্ত লোকদের আকীদা থেকে পুরোপুরি পৃথক। এ মহান ব্যক্তিত্বদের মধ্যে রয়েছেন আল্লামা ত্বহাবী, যিনি একটি আকীদা গ্রন্থ লিখেন যা তার নিজের নামেই বিখ্যাত। এ গ্রন্থের ব্যাখ্যা লিখেছেন মুহাম্মাদ ইবন আবিল ইয্ আল-হানাফী। বিষয়টি এখানেই থেমে থাকেনি, বরং সহীহ আকীদার উপর বহু আলেম এর আগে ও পরে লিখেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম আহমাদ, ইবনু তাইমিয়াহ, শওকানী ও সাফারীনী প্রমুখ।”
(২) দুর্নীতি, রাহাজানি, যুলুম-নির্যাতনমুক্ত সুশীল সমাজ গঠনে সঠিক আকীদা এমন একটি মজবুত ভিত তৈরী করে।যার ভিত্তিতে পরিচালিত হয় সমাজের সকল কাজ-কর্ম, পারস্পরিক লেন-দেন। অতএব আকীদা যদি হয় বিকৃত বিভ্রান্ত ও মিথ্যার উপর স্থাপিত, তাহলে সামাজিক জীবন হয়ে পড়বে বিপন্ন, বিপর্যস্ত ও ধ্বংসের মুখোমুখী। আজ আমাদের সমাজ যে অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে, তার কারণ মূলত এটাই। সুতরাং সমাজকে বিকৃতি, বিপর্যয় ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে সঠিক আকীদার দিকেই ফিরে আসতে হবে।
(৩) সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সঠিক আকীদায় গুরুত্ব: একজন মুসলিম ব্যক্তির আকীদার অবিচ্ছেদ্য অংশ এই যে, সে আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হুকুম অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করাকে অপরিহার্য মনে করে এবং তাদের হুকুমের নাফরমানী করা অবৈধ বলে বিশ্বাস করে। আল্লাহ বলেন: “আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো নির্দেশ দিলে কোনো মুমিন পুরুষ ও নারীর জন্য নিজদের ব্যাপারে অন্য কিছু এখতিয়ার করার অধিকার থাকে না।” [আল-আহযাব: ৩৬] সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আল্লাহ তা‘আলা যখন মুসলিমদেরকে পরস্পরের ভাই বলে অভিহিত করেন, কোনো ব্যক্তির জান ও মালের উপর চড়াও হওয়াকে গুরুতর অপরাধ বলে সনাক্ত করেন, চুক্তিবদ্ধ সকল অমুসলিমের সাথে কৃত চুক্তি পালনের নির্দেশ প্রদান করেন, সে তখন দ্বিধাহীন চিত্তে সে নির্দেশ মেনে নেয়, কেননা এভাবে মেনে নেয়াটা তার আকীদারই অংশ। আল্লাহ বলেন: “অতএব তোমাদের রবের কসম, তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে বিচারক নির্ধারণ করে, তারপর তুমি যে ফয়সালা দেবে সে ব্যাপারে নিজদের অন্তরে কোনো দ্বিধা অনুভব না করে এবং পূর্ণ সম্মতিতে মেনে নেয়।” [আন-নিসা: ৬৫]
(৪) রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়নে সঠিক আকীদার গুরুত্ব: ইসলামী আকীদার অপরিহার্য একটি মৌলিক বিষয় হচ্ছে এ বিষয়ে দৃঢ় ঈমান রাখা যে, আল্লাহ যেমন এ বিশ্ব জগতের সৃষ্টি কর্তা, তেমনি তিনিই এর শাসন-কর্তৃত্ব ও নির্দেশের মালিক। আল্লাহ বলেন: “জেনে রাখ, সৃষ্টি ও নির্দেশ তাঁরই।” [আল-আরাফ: ৫৪] “বল, নিশ্চয় সব বিষয় আল্লাহর।” [আলে ইমরান: ১৫৪] “হুকুম তো কেবল আল্লাহরই।” [আল-আন‘আম: ৫৭] এছাড়া আল্লাহই সকল সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক এবং একমাত্র আইনদাতা ও বিধানদাতা। এটা তাকে রব হিসাবে মেনে নেয়ারই অন্যতম অর্থ। আমাদের সমাজে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা তখনই ফিরে আসতে পারে যখন এ আকীদার প্রতি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দৃঢ় প্রত্যয় থাকবে। মূলত মানব রচিত আইন দিয়ে কোনো মুসলিম সমাজেই শান্তি, শৃংখলা ও স্থিতিশীলতা আসতে পারে না। সম্ভবত বাস্তবতাই এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ ও সাক্ষী।
(৫) অপসংস্কৃতি রোধে সঠিক আকীদার গুরুত্ব: বিজাতীয় ভিনদেশী ও ভিন্ন ধর্মের অনুকরণে আমাদের বাংলাদেশী সমাজে সংস্কৃতির নামে বর্তমানে যে সব কিছুর চর্চা হচ্ছে, তাকে অপসংস্কৃতি নামে অভিহিত করলে বোধকরি কোনো অত্যুক্তি হবে না। কেননা এসব সংস্কৃতি যেমনি আমাদের দেশীয় চিন্তা-চেতনা ও ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে না, তেমনি তা মুসলিম আকীদার সাথে বহুলাংশেই সাংঘর্ষিক। স্মরণ রাখতে হবে আমাদের এ দেশটি মুসলিম প্রধান দেশ। তাই যদি আমরা আমাদের সকল সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানকে সঠিক ইসলামী আকীদার আলোকে বিন্যস্ত করি, তাহলেই দেশ উপহার পেতে পারে একটি সুন্দর, রুচিশীল, শালীন ও সুস্থ-সংস্কৃতি।
(৬) চিন্তার ক্ষেত্রে নৈরাজ্য ও বিভ্রান্তি এবং শির্ক ও বেদ‘আত থেকে সমাজকে মুক্ত করার ব্যাপারে সঠিক আকীদার গুরুত্ব: সঠিক ইসলামী আকীদার জ্ঞানই পারে সমাজের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর চিন্তা জগতকে আলোকিত করতে যা দিয়ে তারা জাতিকে দিতে পারবেন সত্য পথের দিশা। আজ একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবিদের চিন্তার ক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য ও বিভ্রান্তি আমরা লক্ষ্য করছি, মুসলিম নামধারী হওয়া সত্ত্বেও ইসলামের বিরুদ্ধে তারা যে কলমযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তার সম্ভবত সবচেয়ে বড় কারণ এই যে, ইসলামকে তারা বিকৃতভাবে জেনেছেন, সঠিক ইসলামী আকীদা অর্জনের সৌভাগ্য তাদের হয় নি। একই কথা প্রযোজ্য সে সকল শিক্ষিত ও অশিক্ষিত মুসলিমদের ক্ষেত্রেও যারা ইবাদাত মনে করে শির্ক ও বেদ‘আতের মধ্যে নিমজ্জিত। কুরআন ও সুন্নার আলোকে তারা শির্ক ও বেদ‘আতের পরিচয় পায় নি। শির্ক ও বেদ‘আতকে চেনার যে সকল মূলনীতি রয়েছে তারা সেসব সম্পর্কে সম্পূর্ণ গাফেল। সঠিক আকীদার প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আকীদার জ্ঞান অর্জনই নিশ্চয়তা দিতে পারে এসব বিভ্রান্তি এবং শির্ক ও বেদ‘আত থেকে সমাজের সবাইকে মুক্ত করার।
অতএব সহীহ ইসলামী আকীদার জ্ঞান অর্জনই আল্লাহর প্রকৃত মু’মিন ও মুসলিম বান্দা হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার একমাত্র পন্থা। অনুরূপভাবে একটি সমাজকে পরিপূর্ণ ইসলামী সমাজ রূপে গড়ে তুলতে চাইলে সমাজের সকলকে সহীহ আকীদার জ্ঞানে সমৃদ্ধ করার কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইসলামী সংগঠনগুলোকে গুরু দায়িত্ব পালন করতে হবে। ইসলামী শরীয়াহ ও স্টাডিজের উপর যারা দক্ষ তারা সহীহ আকিদা বিষয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থ রচনা করে এ বিষয়ে বাংলা ভাষায় লিখিত বইয়ের যে অপ্রতুলতা রয়েছে তা দূর করতে পারেন। এ ব্যাপারে মসজিদের ইমাম, খতিব ও মাদরাসা শিক্ষকদের সাহায্যও নেওয়া যেতে পারে। অবশ্য তার আগে তাদেরকে সহীহ আকিদার জ্ঞানে সমৃদ্ধ হতে হবে। সহীহ আকিদা প্রসারের প্রচেষ্টার মাধ্যমে এভাবে আমাদের সমাজ গড়ে ওঠতে পারে শির্ক ও বেদ‘আতমুক্ত একটি সুন্দর সুশীল সমাজ হিসাবে।
সুন্নি মুসলমানরা বিশ্বাস করেন যে, আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের (ইসলামে যাকে "ঈমান" বলা হয়) ছয়টি দিক রয়েছে: আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, ফেরেশতাদের উপর বিশ্বাস, ঐশ্বরিক মাধ্যম হতে আগত গ্রন্থসমূহ (ইসলামে যাকে "আসমানী কিতাব" বলা হয়), যেমন- তাওরাত, যাবুর, ইনজিল ও কুরআনের প্রতি বিশ্বাস, নবী ও রাসুলদের উপর বিশ্বাস, "অন্তিম সময়" বা শেষ যুগের উপর বিশ্বাস (ইসলামে "কিয়ামত" বলা হয়) এবং পূর্বনির্ধারিত সময় বা পুনরুত্থানের উপর বিশ্বাস।
কালাম, অর্থাৎ ইলমুল কালাম (বাচনের প্রজ্ঞা) হচ্ছে ধর্মতত্ত্বের মূলনীতিসমূহকে পারষ্পারিক যুক্তিতর্কের মাধ্যমে অনুসন্ধান করার ইসলামি দর্শন। আরবি ভাষায়, কালাম শব্দের অর্থ হলো "কথা"। কালামে পারদর্শী পন্ডিতকে বলা হয় মুতাকাল্লিম (মুসলিম ধর্মতত্ত্ববিদ, বহুবচনে মুতাকাল্লিমীন)।
মনজুর এলাহি তার "সমাজ সংস্কারে সঠিক আকীদার গুরুত্ব" বইতে কালামশাস্ত্র সম্পর্কে বলেন,[৪৩]
মুতাকাল্লিমীনগণ আকীদা শাস্ত্রকে ‘‘ইলমুল কালাম’’ এবং দার্শনিকগণ ‘‘আল-ফালসাফা আল-ইসলামিয়্যাহ’’ বা ইসলামী দর্শন, ‘‘আল-ইলাহিয়্যাত’’ ও ‘‘মেটাফিজিক্স’’ (অতিপ্রাকৃতিকতা) নামে অভিহিত করেছেন। শেষোক্ত এ নামগুলো সম্পর্কে ড. নাসের আল-আকল সহ আরো অনেকে বলেন যে, ইসলামী আকীদাকে এসকল নামে অভিহিত করা মোটেই শুদ্ধ নয়। এর কারণ বর্ণনায় মুহাম্মদ ইবরাহীম আল হামাদ বলেন, “কেননা ইলমুল কালামের উৎস হল মানব বুদ্ধি-বিবেক, যা হিন্দু ও গ্রিক দর্শন নির্ভর। পক্ষান্তরে তাওহীদের মূল উৎস হল ওহী। তাছাড়া ইলমুল কালামের মধ্যে রয়েছে অস্থিরতা, ভারসাম্যহীনতা, অজ্ঞতা ও সংশয়-সন্দেহ। এজন্যই সালাফে সালেহীন ইলমুল কালামের নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন। আর তাওহীদ হল জ্ঞান, দৃঢ় বিশ্বাস ও ঈমান নির্ভর,….. আরেকটি কারণ এও বলা যেতে পারে যে, দর্শনের ভিত্তি অনুমান, বাতিল আকীদা, কাল্পনিক চিন্তা ও কুসংস্কারচ্ছন্ন ধারণার উপর স্থাপিত”। ইমাম হারাওয়ী ذم الكلام وأهله নামে ৫ খন্ডের একটি বই এবং ইমাম গাযযালী تهافت الفلاسفة নামে একটি বই রচনা করেছেন। এছাড়া ‘ইলমুল কালাম’ ও ‘ফালসাফা’ যে সঠিক ইসলামী আকীদার প্রতিনিধিত্ব করে না, সে বিষয়ে ইমাম ইবনে তাইমিয়া ও ইবনুল কাইয়েমসহ আরো বহু মুসলিম স্কলার বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
মুজাতিলা মতাবলম্বীরা মানুষ ও তাদের স্রষ্টার মধ্যকার সম্পর্কের মধ্যে অদৃষ্টবাদের উপর মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাকে জোড় দেয় এবং ঈশ্বরের অসীম ক্ষমতার উপর ঈশ্বরের ন্যায়বিচারকে অর্পণ করে। মুতাজিলা মতাবলম্বীরাও কুরআনের প্রকৃত অর্থ নির্ধারণের জন্য যুক্তির ব্যবহারে বিশ্বাস করে। এটি এবং ইজতিহাদের মূলনীতি, তাদের গতিশীল ফিকহের প্রতি বিশ্বাসের দিকে পরিচালিত করেছিল।
আশʿআরিবাদ বা আশআরী আকিদা বা আশʿআরি ধর্মতত্ত্ব[৪৪][৪৫] (আরবি: أشعرية, প্রতিবর্ণীকৃত: al-ʾAšʿarīyah বা ٱلْأَشَاعِرَة) হল সুন্নি ইসলামের প্রধানতম ধর্মতাত্ত্বিক মাজহাব যা শাস্ত্রীয় কর্তৃত্ব, যৌক্তিকতা[৪৬][৪৭] এবং অর্ধ-যুক্তিবাদের[৪৬][৪৮][৪৯][৫০] ভিত্তিতে সর্বজনগৃহীত আকিদাগত দিকনির্দেশনা প্রদান করে।[৫১] আরব ধর্মতত্ত্ববিদ আবুল হাসান আল-আশআরি এই মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন।[৫২] এই মতাবলম্বীদের আশʿআরি[৪৬] এবং মতবাদকে আশʿআরি মাজহাব[৪৬] নামেও অবিহিত করা হয়। আশʿআরিবাদ সুন্নি ইসলামের সবচেয়ে প্রভাবশালী ধর্মতাত্ত্বিক চিন্তাধারা।[৫৩] এটিকে মাতুরিদি[৫৪][৫৫] ও আসারি মাজহাবের পাশাপাশি সুন্নি ইসলামের অন্যতম অর্থোডক্স ধর্মতাত্ত্বিক মাজহাব হিসেবে বিবেচনা করা হয়।[৫৬]
মাতুরিদি (আরবি: الماتريدية) হল সুন্নি ইসলামের অন্তর্গত অন্যতম প্রধান ধর্মতাত্ত্বিক মাজহাব। এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন আবু মনসুর আল-মাতুরিদি যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নিদের মধ্যে ইতোমধ্যে বিদ্যমান আকিদাগুলোকে একটি সুসংবদ্ধ কালামশাস্ত্রীয় চিন্তাধারায় উপনীত করেন এবং যৌক্তিকতা[৫৭] ও যুক্তিবাদের[৫৮][৫৯] ওপর গুরুত্বারোপ করেন। মাতুরিদি মতবাদকে আশআরি মতবাদের পাশাপাশি সর্বজনগৃহীত বা অর্থডক্স সুন্নি আকিদা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।[৬০]
মাতুরিদিবাদ পারস্যের সুন্নি মুসলমান, হানাফি ও আহলে আর রায়ের মাঝে বরাবরই প্রভাবশালী ছিল এবং অটোমান সাম্রাজ্য ও মোগল সাম্রাজ্যে অগ্রগণ্য মাজহাবের মর্যাদা লাভ করেছিল। এর বাইরে অধিকাংশ তুর্ক, মধ্য এশীয় ও দক্ষিণ এশীয় সুন্নি মুসলমানরা মাতুরিদি আকিদায় বিশ্বাসী। আরব মুসলিমদের মধ্যেও মাতুরিদিবাদী পণ্ডিত বিদ্যমান।[৬১]
পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, তুর্কিস্তান, আমু দরিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় এলাকাসমূহ, যেমন: উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, বুখারা, সমরকন্দ, তাশখন্দ, তিরমিজ ইত্যাদি অঞ্চলের অধিকাংশ মুসলমান মাতুরিদি মতাবলম্বী।
আসারি (আরবি: الأثرية, "আল-আসারিয়্যাহ"), অন্যান্য নাম: সনাতনবাদী ধর্মতত্ত্ব, প্রথাবাদী ধর্মতত্ত্ব, ঐতিহ্যবাদী ধর্মতত্ত্ব, পরম্পরাবাদী ধর্মতত্ত্ব বা মূলগ্রন্থবাদী ধর্মতত্ত্ব বা ইসলামী অক্ষরবাদী ধর্মতত্ত্ব, হলো একটি ইসলামি পাণ্ডিত্যনির্ভর আন্দোলন, যা ৮ম শতাব্দীর শেষের দিকে উদ্ভূত হয়, যারা কুরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে জাহির অর্থবাচকতার সমর্থনের ফলশ্রুতিতে ইলমুল কালামকে প্রত্যাখ্যান করে থাকে। [৬২][৬৩] এই নামটি কৌশলগত দৃষ্টিকোণ হতে আরবি শব্দ "হাদিস"-এর অনুবাদ হিসেবে আছার (প্রথা বা ঐতিহ্য) নামক শব্দ থেকে এসেছে। একে মাঝেমধ্যে অন্যান্য নামেও ডাকা হয়, যেমন সহীহ আকীদা, সালাফী আকীদা, আহলে হাদীস আকীদা, সালফে সালেহীনদের আকীদা ইত্যাদি।
ঐতিহ্যবাদী ধর্মতত্ত্বের অনুসারীগণ কুরআনের জাহির (আক্ষরিক, প্রত্যক্ষ) অর্থে বিশ্বাস করে এবং হাদিস হলো তাদের বিশ্বাস ও আইনকানুনের সকল বিষয়ে বিধিবিধানের একমাত্র ভিত্তি এবং তাদের কাছে যৌক্তিক সমালোচনা হল নিষিদ্ধ, এমনকি যদি তা সত্য যাচাই করার জন্য হয় তবুও।[৬৪] তাঁরা কুরআনকে আক্ষরিক অর্থে পড়ে থাকে এবং তাঁরা কুরআনকে রূপকার্থে ব্যাখ্যা করার (তাউইল) বিরোধিতা করে। তাঁরা কুরআনের অর্থকে যুক্তির ভিত্তিতে ধারণা করার প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকে এবং তারা বিশ্বাস করে যে, তাদের বাস্তবতা শুধু আল্লাহর কাছে সমর্পণ করা উচিত, যাকে তাফউইদ বলা হয়।[৬৫] মোটকথা, কুরআন ও হাদিসের লেখনীকে তাঁরা কোনো রকম প্রশ্ন করা ব্যতিরেকে গ্রহণ করে থাকে, যাকে বলা হয় "বি-লা কাইফা", যার ফলে এই মতবাদটিকে কুরআনীয় অক্ষরবাদী বা ইসলামী অক্ষরবাদী মতবাদও বলা হয়ে থাকে।
ঐতিহ্যবাদী ধর্মতত্ত্ব বা আসারি মতবাদ মুহাদ্দিসদের মাঝে বিস্তৃতি লাভ করে, যারা পরবর্তীতে আহমদ ইবনে হাম্বলের (৭৮০-৮১৫) অনুসরণে "আহলুল হাদিস" নামে একটি আন্দোলনের মাধ্যমে সংগঠিত হন।[৬৬] ধর্মবিশ্বাসের বিষয়সমূহে, তাঁরা মুতাজিলা ও সমসাময়িক অন্যান্য ধর্মতত্ত্বের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল, এবং তারা সেসকল ধর্মতত্ত্বের মূলনীতির বিভিন্ন বিষয়কে দোষারোপ করতো, যার মধ্যে অন্যতম ছিল অন্যান্যদের নিজস্ব আত্মরক্ষামূলক যুক্তিনির্ভর ব্যাখ্যাপদ্ধতি।[৬৬] ১০ম শতাব্দীতে, আশআরী ও মাতুরিদি ধর্মতত্ত্ব মুতাজিলা যুক্তিবাদ ও হাম্বলি আক্ষরিকতাবাদের মাঝখানে মুতাজিলাদের যুক্তিনির্ভর ব্যখাপদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে মধ্যস্থতা তৈরি করে, যাকে মুতাজিলাগণ আছারীদের অধিকাংশ বিশ্বাসকে প্রতিহত করতে ব্যবহার করত।[৬৭] যদিও যে সকল হাম্বলি পণ্ডিত এই সংমিশ্রণকে প্রত্যাখ্যান করেছিল তাঁরা ছিল সংখ্যালঘু, তাদের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি তাদের আবেগপ্রবণ ও বর্ণনা-ভিত্তিক পদক্ষেপ কিছু এলাকার শহুরে লোকজনের মধ্যে প্রভাবশালী অবস্থায় থেকে গিয়েছিল, আর তা ছিল প্রধানত আব্বাসীয় খিলাফতের শাসনামলে বাগদাদ এলাকায়।[৬৮]
যদিও আশআরী ও মাতুরিদি মতবাদকে প্রায়শই সুন্নি "সনাতন ধারা" বলে ডাকা হয়, আছারী মতবাদও এদের পাশাপাশি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, যার অনুসারীরা একে সনাতন সুন্নি ধর্মবিশ্বাস বলে দাবি করে আসছে।[৬৯] আধুনিক যুগে, ইসলামী ধর্মতত্ত্বের উপর আছারী মতবাদের একটি ধারণাতীত প্রভাব রয়েছে, যা ওয়াহাবি ও অন্যান্য সমসাময়িক ঐতিহ্যবাদী (আসারি) সালাফি অনুসারীদের দ্বারা অনুসৃত হচ্ছে এবং তা হাম্বলি মতাদর্শের সীমা অতিক্রম করে আরও বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।[৭০]
আছারী আকীদা সম্পর্কে ছালিহ ইবনে ফাউজান আল-ফাউজান বলেন, "যে ব্যক্তি শুধু ভালোবাসা নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করবে, সে সুফী বলে গণ্য হবে। যে ব্যক্তি শুধু ভয় নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করবে, সে খারেজী। যে শুধু আশা-আকাঙ্খা নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করবে, সে মুর্জীয়া। আর যে ভালোবাসা, ভয়-ভীতি, এবং আশা-আকাঙ্খা নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করবে, সেই প্রকৃত মুমিন।"[৭১]
শিয়া মুসলমানরা বিশ্বাস করেন যে আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের পাঁচটি দিক রয়েছে: ঐশ্বরিক একত্ব (ইসলামে যাকে "তাওহিদ" বলা হয়), ন্যায়বিচার, নবুওয়ত (নবিত্ব), ইমামত্ব ও পরকালবিদ্যা।
জায়েদি (আরবি: الزيدية, প্রতিবর্ণীকৃত: al-Zaidiyyah; পঞ্চমী নামে পরিচিত) হল শিয়া ইসলামের একটি শাখা যা ধর্মতাত্ত্বিক দিক দিয়ে ইবাদি ও মুতাজিলা চিন্তাধারার এবং ফিকহশাস্ত্রীয় ক্ষেত্রে হানাফি মাজহাবের নিকটবর্তী। অষ্টম শতাব্দীতে শিয়া চিন্তাধারা থেকে জায়েদি মতবাদ উৎপত্তিলাভ করে।[৭২] তৃতীয় ইমাম হোসাইন ইবনে আলীর দৌহিত্র এবং চতুর্থ ইমাম আলী ইবনে হোসাইনের পুত্র জায়েদ ইবনে আলীর নামানুসারে জায়েদিদের নামকরণ করা হয়।[৭২] জায়েদি মাজহাবের অনুসারীদের জায়েদি শিয়া নামে অবিহিত করা হয়। জায়েদিরা ইয়েমেনের মোট মুসলিম জনসংখ্যার ৫০% যা দেশটির বৃহত্তম শিয়া মুসলমান সম্প্রদায়৷[৭৩][৭৪]
বাতিন (আরবি: باطن) শব্দের আক্ষরিক অর্থ- "ভিতর", "অভ্যন্তরীণ", "লুকানো" ইত্যাদি। উদাহরণস্বরূপ, কুরআনের বাহ্যিক বা আপাত অর্থে, যহিরের বিপরীতে একটি লুকানো অর্থও আছে। সুফিরা বিশ্বাস করে যে প্রত্যেক ব্যক্তির আত্মার জগতে একটি বাতিন আছে। ইহা ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ সত্ত্বা; যখন আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শকের আলো দ্বারা শুদ্ধ করা হয়, তখন তা আধ্যাত্মিকভাবে উন্নীত হয়।[৭৫][৭৬] এই ধারণা লুকানো আল্লাহর গুণাবলীর সাথে সংযুক্ত, যাকে দেখা যায় না কিন্তু জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিদ্যমান।
ইসনা আশারিয়াত যার বাংলা অর্থ দ্বাদশী (আরবি: ٱثْنَا عَشَرِيَّة, প্রতিবর্ণীকৃত: ʾIthnā ʿAšarīyah; ফার্সি: شیعه دوازدهامامی, প্রতিবর্ণীকৃত: Šī'eh-ye Davâzdah-Emâmī), যা ইমামিয়াত (আরবি: إِمَامِيَّة, প্রতিবর্ণীকৃত: Imāmīyah) নামেও পরিচিত, হল শিয়া ইসলামের বৃহত্তম শাখা। দ্বাদশী শব্দটি দ্বারা এর অনুসারীদের বারোজন ঐশ্বরিকভাবে মনোনীত নেতা তথা বারো ইমামে বিশ্বাস এবং সর্বশেষ ইমাম মুহম্মদ আল-মাহদীকে অন্তর্হিত ইমাম ও প্রতীক্ষিত মাহদী হিসেবে বিশ্বাস করাকে বোঝানো হয়। শিয়া ঐতিহ্য অনুসারে মাহদীর শাসনামল নবী ঈসার দ্বিতীয় আগমনের সমসাময়িক হবে এবং ঈসা মাহদীকে দজ্জালের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহযোগিতা করবেন।
ইসনা আশারিয়ারা বিশ্বাস করে যে বারো ইমাম হলেন নবী মুহাম্মদের আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক উত্তরসূরী। এই ধর্মতত্ত্ব অনুযায়ী বারো ইমাম অনুকরণীয় মানবীয় ব্যক্তিত্ব যাঁরা ন্যায়বিচারের সাথে সমাজ পরিচালনার পাশাপাশি শরীয়ত ও কোরআনের গূঢ়ার্থ সংরক্ষণ ও ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। মুহাম্মদ ও ইমামদের কথা ও কাজ (সুন্নত) জনসমাজের জন্য অনুসরণীয় পথপ্রদর্শক ও আদর্শ; ফলে তাঁদের অবশ্যই ত্রুটি ও পাপমুক্ত হতে হবে এবং অবশ্যই মুহাম্মদের মাধ্যমে ঐশী ফরমান বা নাস দ্বারা মনোনীত হতে হবে।[৭৭][৭৮][৭৯]
ইসনা আশারিয়া মতবাদ শিয়া ইসলামের বৃহত্তম শাখা যা গোটা শিয়া সম্প্রদায়ের ৮৫% এবং সংখ্যায় প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ মিলিয়ন।[৮০][৮১][৮২][৮৩]
জাহমি (আরবি: جهمي) একটি মতবাদ। জা’দ ইবন দিরহাম (১১৮ হি) নামক একজন নতুন প্রজন্মের পারসিক মুসলিম মহান আল্লাহর গুণাবলি অস্বীকার করে তাঁকে ‘নির্গুণ’ বলে দাবি করতে থাকেন। তার ছাত্র জাহম ইবন সাফওয়ান সামারকান্দী (১২৮ হি)।[৮৪] তিনি এ মতটিকে জোরালোভাবে প্রচার করতে থাকেন এবং এর সাথে অনেক দর্শনভিত্তিক মতবাদ তিনি প্রচার করেন।
মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণকারী হিসেবে ইসলামে কাদারিয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। তাদের কাদারিয়া বলা হয় কারণ তারা এই মত পোষণ করেন মানুষের কাজ করার 'কাদর' বা শক্তি আছে।[৮৫][৮৬] এই মতবাদের প্রবক্তারা মানুষের ইচ্ছা বা কর্মের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। কাদারিয়াদের মতে, আল্লাহ বা বিধাতা কাজের জন্য সরাসরি দায়ী হতে পারেন না, কারণ কাজ ভালো বা মন্দ উভয়ই হতে পারে। মানুষ তার নিজের কাজের মালিক কিন্তু তার কাজ করার ক্ষমতা বিধাতা কর্তৃক প্রদত্ত। এই অর্থে বিধাতা চূড়ান্তভাবে কাজের কর্তা বা মালিক। কোনো বহিঃশক্তি দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে মানুষ তার নিজের কাজের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণে তার নিজস্ব শক্তি আছে।[৮৭] এই সম্প্রদায়ের কেউ কেউ দাবি করেন যে মানুষের কাছে কিছু ঐশী ক্ষমতা হস্তান্তর বা অর্পণ করা হয়েছে এবং মানুষের যেটা সঠিক এবং যেটা ভুল তা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে নিঃশর্ত বিবেচনামূলক ক্ষমতা আছে।[৮৮] তাদের কিছু মতবাদ পরে মু'তাজিলিদের দ্বারা গৃহীত হয় এবং আশআরিয়দের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়।[৮৭]
কাদারিয়া ইসলামের প্রথমদিকে দার্শনিক ধর্মতত্ত্বের একটি। এই আন্দোলন নিয়ে পাওয়া প্রাচীনতম দলিল হচ্ছে হাসান আল-বসরির রিসালা, যা ৭৫/৬৯৪ থেকে ৮০/৬৯৯ এর মধ্যে লেখা হয়। অবশ্য ইসলামে মুক্ত ইচ্ছা নিয়ে বিতর্ক এই লেখার পূর্বে পাওয়া যায়।
সুন্নি সূত্র মতে, জরাথুস্ট্রবাদের সাথে তুলনা দিয়ে মুহাম্মদ নিজেই এর নিন্দা জানিয়েছেন।[৮৯] সুনান আবু দাউদে বর্ণিত হয়েছে: "আব্দুল্লাহ ইবনে উমর: নবী বলেন, "কাদারিয়াহ হল এই সম্প্রদায়ের মাজিয়ান। যদি তারা অসুস্থ হয়, তবে তাদের কাছে যাবেন না, আর যদি তারা মারা যায় তবে তাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যাবেন না।"
বিচারের ঘটনার শেষে যে দলগুলো আলীর সেনাবাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল তারা মুহাক্কিমা (আরবি: محكمة) নামক শাখা গঠন করেছিল। তারা প্রধানত খারেজী ও ইবাদি নামে দুটি প্রধান সম্প্রদায়ে বিভক্ত।
খারিজি (আরবি: الخوارج, আল-খাওয়ারিজ, একবচন خارجي, খারিজি), আশ-শুরাহও বলা হয় (আরবি: الشراة, প্রতিবর্ণীকৃত: আশ-শুরাহ "যে (টাকা) ভাঙিয়ে দেয়") শব্দ দ্বারা ইসলামের প্রথম যুগে উদ্ভব হওয়া একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে বুঝায়। ৭ম শতাব্দীতে এই গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল। ইরাকের দক্ষিণাশে তারা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। সুন্নি ও শিয়াদের থেকে খারিজিরা ভিন্ন মত পোষণ করত। পরবর্তীতে সময়ের সাথে সাথে খারিজিরা সংখ্যায় বৃদ্ধি পায়। খলিফা আলি ইবনে আবি তালিবের শাসন শুরু হওয়ার পর তারা প্রথমে তা মেনে নেয়, তবে পরে তার শাসন প্রত্যাখ্যান করে। আলি নিজেও আবদুর রহমান ইবনে মুলজাম নামক একজন খারিজির হাতে নিহত হন।
ইবাদি ইসলাম (আরবি: الإباضية, প্রতিবর্ণীকৃত: al-Ibāḍiyyah), ইবাদি মতবাদ বা ইবাদি আন্দোলন হল ইসলামের একটি শাখা যা ওমানে সবচেয়ে প্রভাবশালী।[৯০] এছাড়া আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া ও পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন অংশে এর অস্থিত্ব রয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে এই আন্দোলন ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে বা মহানবী হজরত মুহম্মদের (স.) মৃত্যুর ২০ বছর পর শুরু হয় যা সুন্নি ও শিয়া মতবাদের চেয়েও প্রাচীন।[৯১] আধুনিক ঐতিহাসিকেরা এর উৎপত্তি সন্ধান করতে গিয়ে একে খারিজি আন্দোলনের একটি মধ্যপন্থী ধারা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।[৯২][৯৩][৯৪]:৩ সমসাময়িক ইবাদিরা তাদের খারিজি হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করার তীব্র বিরোধিতা করেন, যদিও তারা স্বীকার করেন যে তাদের আন্দোলন ৬৫৭ খ্রিষ্টাব্দের খারিজি বিদ্রোহ থেকে উৎপত্তিলাভ করেছে।[৯৪]:৩
ইবাদি ইসলামের একটি ক্ষুদ্র মাযহাব। এই মাযহাব সুন্নি বা শিয়া পন্থার অন্তর্ভুক্ত নয়। এর আবির্ভাব ইবাদি আন্দোলন থেকে। এই আন্দোলন মহানবীর প্রয়াণের ২০ বছর পর শুরু হয় বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। আব্দুল্লাহ ইবন ইবাদ আল-তামিমিকে এই মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা মনে করা হয়। কিন্তু এই মাযহাবের অনুসারীরা দাবি করেন যে এর প্রতিষ্ঠাতা জাবির ইবন জাইদ আল-আজদি। এই মতবাদের ওপর খারিজিদের প্রভাব আছে বলে মনে করা হয়।[৯৫] ইবাদিরা নিজেদের "মুসলমান" বা "সরলতার লোক" বলে উল্লেখ করেন।[৯৬][৯৭]
মুরজিয়াহ (আরবি: المرجئة) ছিল একটি প্রাথমিক ইসলামী বিদ্যালয় যার অনুসারীরা আরবিতে "মুরজিউন" বা "আল-মুরজিউন" (المرجئون) নামে পরিচিত। পাপ এবং ধর্মত্যাগের (রিদা) মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ে এটি খারিজিদের প্রাথমিক প্রশ্নের জবাবে মুরজিয়া একটি ধর্মতাত্ত্বিক বিদ্যালয় হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল। মুরজিয়াহরা বিশ্বাস করতেন যে পাপ একজন ব্যক্তির বিশ্বাস (ইমান) প্রভাবিত করে না বরং তাদের পূণ্য বা তাকওয়াই ইমানকে প্রভাবিত করে। অতএব, তারা "বিলম্বিত রায়" (ইরজা) ধারণার পক্ষে ছিল। মুর্জিয়ারা বলে যে, যে কেউ ন্যূনতম ঈমান ঘোষণা করে তাকে অবশ্যই মুসলমান হিসেবে গণ্য করতে হবে এবং শুধু পাপই কাউকে কাফের করতে পারে না। মুরজিয়ার মতবাদ শেষ পর্যন্ত খারিজিদের উপর প্রাধান্য পায় এবং সুন্নি ইসলামের মূলধারার মত হয়ে ওঠে। সুন্নি ধর্মতত্ত্বের পরবর্তী বিদ্যালয়গুলো তাদের অবস্থানকে নিজেদের ভেতরে গ্রহণ করে এবং তা থেকে আরও বিকশিত ধর্মতাত্ত্বিক বিদ্যালয় এবং ধারণা তৈরি করে।
তাশবিহ (আরবি: تشبيه) একটি ইসলামিক ধর্মীয় ধারণা যার অর্থ নৃতাত্ত্বিকতা, ঈশ্বরকে তাঁর সৃষ্টির সাথে একীভূত করা/তুলনা করা। ইসলামী ধর্মতত্ত্বে, দুটি বিপরীত শব্দ আল্লাহর প্রতি আরোপিত হয়, তাশবিহ এবং তানজিহ (অতিক্রম)।
তাশবিহের পূর্ণ অর্থ হল 'সাদৃশ্য নিশ্চিত করা', অর্থাৎ ঈশ্বর ও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে সাদৃশ্য নিশ্চিত করা। এই ধারণাটি চিরন্তনভাবে আল্লাহর তানজিহ (অতিক্রম বা 'অসংগতি ঘোষণা') এর সাথে যুক্ত।
তা'তিল, ঈশ্বরকে তাঁর গুণাবলী থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া এবং তাশবিহ, নৃতাত্ত্বিকতা, উভয়কেই সুন্নিদের দ্বারা ধর্মদ্রোহিতা বলে মনে করা হয়।
শিয়া শিক্ষায় তাশবিহ বহুল প্রচলিত ছিল, বিশেষ করে ৮ম শতকের খ্রিস্টাব্দের জাইদি ইমাম আল-কাসিম আল-রাসি-এর চিন্তাধারায়।
কাররামিয়াহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন কাররাম। ইবনে কাররাম মনে করতেন যে ঈশ্বর একটি পদার্থ এবং যখন তিনি আরশের সংস্পর্শে আসেন তখন নির্দিষ্ট দিকে তাঁর একটি সসীম দেহ (জিসম) ছিল।
অবতারের বিশ্বাস প্রথমে সাবাইয়াতে আবির্ভূত হয়েছিল, এবং পরে কিছু ব্যক্তিত্বকে যেমন মুহাম্মদ ইবনে আল-হানাফিয়া, আবু মুসলিম, সানপদ, ইসহাক আল-তুর্ক, আল-মুকান্না, বাবাক খোররামদিন, মাজিয়ার এবং প্রথম ইসমাইলকে আল্লাহর অবতার হিসেবে গুলাত শিয়াগণ বিশ্বাস করতেন।
আহমদীয়া; পূর্ণরূপে আহমদীয়া মুসলিম জামাত (উর্দু: احمدیہ مسلم جماعت; আরবি: الجماعة الإسلامية الأحمدية) একটি মুসলিম ধর্মীয় পুনর্জাগরণ অথবা মসিহবাদী আন্দোলন যার উদ্ভব হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ব্রিটিশ ভারতের কাদিয়ান এলাকার মির্যা গোলাম আহমদের জীবন ও শিক্ষার ভিত্তিতে। মির্যা গোলাম আহমদ (১৮৩৫-১৯০৮) দাবী করেছিলেন যে আল্লাহ তাকে আখেরী জামানায় প্রতিশ্রুত ও মুসলমানদের প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদী ও প্রতিশ্রুত মসীহ (যীশু বা ঈসা) উভয় হিসেবেই প্রেরণ করেছেন ইসলামের চূড়ান্ত বিজয় শান্তিপূর্ণভাবে সংঘটিত করতে এবং অন্যান্য ধর্মীয় মতবাদের প্রতীক্ষিত পরকালতাত্ত্বিক ব্যক্তিত্বদের মূর্ত করতে। নবী মোহাম্মদের বিকল্প নাম 'আহমদ' থেকে এই আন্দোলন ও সদস্যগণ ('আহমদী মুসলিম' বা সংক্ষেপে 'আহমদী') নিজেদের নামকরণ করলেও সাধারণভাবে মুসলিম বিশ্বে তাদের প্রতিষ্ঠাতার জন্মগ্রহণকারী অঞ্চলের নাম কাদিয়ান এর নামে কাদিয়ানী হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়।
আহমদীরা বিশ্বাস করে যে মির্যা গোলাম আহমদ ইসলামকে তার আসল প্রথমযুগীয় অবস্থায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী কিতাবে উল্লেখিত যীশু বা ঈসার গুণবিশিষ্ট ইমাম মাহদী হয়ে এসেছেন ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত করতে ও দীর্ঘস্থায়ী শান্তির লক্ষ্যে এর নৈতিক ব্যবস্থা চলমান করতে। তারা আরও বিশ্বাস করে যে মির্যা গোলাম আহমদ ইসলামের শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ(সা.) এর প্রদর্শিত পথে পাঠানো একজন “উম্মতী নবী”। তাদের মতে নবুয়াত খাতামান্নাবিঈন এর অর্থ নবুয়াত এর সমাপ্তি নয় বরং খাতামান্নাবিঈন মানে "নবীগনের মোহর" বা নবীগনের সত্যায়নকারী। তাদের মতে নবী মোহাম্মদ এর প্রকৃত অনুসরণে নতুন নবী আসতে পারবেন তবে তিনি হবেন ‘উম্মতী নবী’ ও তিনি কোনো নতুন শরীয়ত আনবেন না।[৯৮] আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত বা সুন্নীদের মতে, এই ‘উম্মতী নবীর’ ধারণা কুরআন ও হাদীস দ্বারা সমর্থিত নয় এবং তারা তাদেরকে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত মানে না।[৯৯][১০০] আহমদীয়াদের মতে যেহেতু তারা কালিমা তৈয়্যিবা ‘লা ইলাহা ইলাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ মনে প্রাণে বিশ্বাস করে বলে তাদের ‘অমুসলিম’ ঘোষণা করার অধিকার কারো নেই।[১০১]
ইসলামি আকিদা বিষয়ে প্রথম বই লেখেন ইমাম আবু হানিফা। বইটি আল ফিকহুল আকবার নামে পরিচিত।[১০২] আকিদা বিষয়ে অসংখ্য বই লেখা হয়েছে। এর মধ্যে প্রাচীন কয়েকটি বই হল - ইমাম আহমাদ লিখিত "আস-সুন্নাহ", ইমাম আবু দাউদ সুলাইমান লিখিত "আস-সুন্নাহ", ইমাম আবু জাফর ত্বহাবী লিখিত "আকিদাতু আহলিস সুন্নাহ", ইমাম ইবনু রজাব হাম্বালী লিখিত "কিতাবুত তাওহীদ" ইত্যাদি। ইমাম ইবনে আবীল ইয আল-হানাফী ইমাম ত্বহাবীর লেখা আকিদার বইয়ের ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেছেন যা "শারহুল আকিদা আত্-ত্বহাবীয়া" নামে পরিচিত। এছাড়া সালাফী মতানুসারীদের মাঝে ইবনে তাইমিয়া রচিত আকিদাহ আল-ওয়াসিতিয়াহ, মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব রচিত কিতাবুত তাওহীদ গ্রন্থগুলো প্রসিদ্ধ।
Zakat is a religious tax that every Muslim has to pay.
zakat is alms-giving and religiously obligatory tax.
The Atharis can thus be described as a school or movement led by a contingent of scholars (ulama), typically Hanbalite or even Shafi'ite, which retained influence, or at the very least a shared sentiment and conception of piety, well beyond the limited range of Hanbalite communities. This body of scholars continued to reject theology in favor of strict textualism well after Ash'arism had infiltrated the Sunni schools of law. It is for these reasons that we must delineate the existence of a distinct traditionalist, anti-theological movement, which defies strict identification with any particular madhhab, and therefore cannot be described as Hanbalite.