আণবিক ভর (ইংরেজি: Molecular mass, সংক্ষেপে m) হল সংশ্লিষ্ট কোন পদার্থের একটি অণুর ভর: এটিকে ডাল্টন এককে (Da বা u)[১][২] পরিমাপ করা হয়। একই যৌগের বিভিন্ন অণুর বিভিন্ন আণবিক ভর থাকতে পারে, কারণ তারা একটি পদার্থের ভিন্ন ভিন্ন আইসোটোপ দ্বারা গঠিত হয়ে থাকতে পারে। ইউপ্যাক সংজ্ঞানুযায়ী, একক পারমাণবিক ভরের সাথে সেই অণুর ভরের অনুপাত কে আপেক্ষিক আণবিক ভরের পরিমাণ বলা হয় (যা ডাল্টন নামেও পরিচিত) এবং এটি এককবিহীন হয়। আণবিক ভর এবং আপেক্ষিক আণবিক ভর সম্পূর্ণ আলাদা হলেও মৌলের ভরের সাথে সম্পর্কিত। নির্দিষ্ট একটি পদার্থের ভর এবং সেই পদার্থের পরিমাণের অণুপাতকে মোলার ভর বলা হয়। অর্থাৎ মোলার ভরের সংজ্ঞানুযায়ী, একটি পদার্থের ভরকে সেই পদার্থের পরিমাণ দ্বারা ভাগ করাকে বোঝায় এবং এটিকে গ্রাম/মোল (g/mol) এককে প্রকাশ করা হয়। সাধারণত বড় আকারের এবং সহজেই বিশ্লেষণযোগ্য (ওজনযোগ্য) পদার্থের পরিমাপ করতেই মোলার ভর ব্যবহৃত হয়।
অনেকক্ষেত্রে প্রামাণিকভাবে, আণবিক ওজনকে আপেক্ষিক আণবিক ভরের সমার্থক হিসেবে ধরা হয়; যদিও এটি অত্যন্ত পরিবর্তনশীল। আণবিক ওজন কে যখন ডাল্টন (Da বা u) এককে পরিমাপ করা হয়, তখন তা গড় ওজন অর্থাৎ মোলার ভরের সমান হয় এবং এটি বিভিন্ন এককযুক্ত হয়ে থাকে। আণবিক জীববিজ্ঞানে, বৃহদাকৃতি জটিল অণুর ভরকে তাদের নিজস্ব আণবিক ওজন হিসেবেই ধরা হয় এবং কিলোডাল্টন (kDa) এককে তা প্রকাশ করা হয়। যদিও এর সংখ্যাসূচক মানটিকে একটি আনুমানিক এবং একটি গড়মান হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।
পারস্পরিক সম্পর্কিত এই আণবিক ভর, আণবিক ওজন এবং মোলার ভর শব্দগুলিকে বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রায়শই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ব্যবহার করা হয় এবং যেখানে এদের মধ্যে পার্থক্য করা ভীষণ কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রে, এদের মধ্যে পার্থক্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত আণবিক ভর একটি একক অথবা নির্দিষ্ট অণুর ভরকে নির্দেশ করে এবং এটি আণবিক ওজনের থেকে কিছুটা আলাদা হয়। আণবিক ওজন একটি নমুনার গড় ওজনকে নির্দেশ করে। ২০১৯ সালে এসআই একক পরিশোধন এবং পুনঃসংজ্ঞায়িত করার আগে, ডাল্টন (Da বা u) এককে প্রকাশিত এই পরিমাণগুলি সংজ্ঞানুযায়ী সংখ্যাগতভাবে সমতুল্য ছিল এবং এই নির্দিষ্ট পরিমাণকে গ্রাম/মোল (g/mol) এককে প্রকাশ করা হত এবং যা ছিল সংখ্যাগতভাবে আন্তঃপরিবর্তনশীল। ২০ মে ২০১৯ সালে এসআই এককের পুনঃসংজ্ঞায়নের পর, এই সম্পর্কগুলিকে শুধুমাত্র প্রায় সমতুল্য হিসেবে গণ্য করা হয়।
ছোট থেকে মাঝারি আকারের অণুগুলির আণবিক ভরকে ভর বর্ণালি বীক্ষণ দ্বারা পরিমাপ করা হয় এবং সেই নির্দিষ্ট অণুর উপাদানগুলির গঠন নির্ধারণ করতেও এটি ব্যবহার করা হয়। প্রোটিনের মতো বৃহদাকৃতি অণুর আণবিক ভরগুলিকেও ভর বর্ণালি বীক্ষণ দ্বারা নির্ধারণ করা যায়; যদিও, পদার্থের স্ফটিকবিজ্ঞান-জাত তথ্য (অর্থাৎ পদার্থের নির্দিষ্ট অণুর উপাদানগুলির গঠন) অথবা ভর বর্ণালীকৃত তথ্য উপলব্ধ না থাকলেও পদার্থের সান্দ্রতা এবং আলোক-বিচ্ছুরণ ধর্মকে ব্যবহার করে সেই পদার্থের আণবিক ভর নির্ধারণ করা সম্ভব।
আণবিক ভরকে সেই অণুতে উপস্থিত প্রতিটি নিউক্লাইডের পারমাণবিক ভর থেকে গণনা করা হয়, আর প্রতিটি উপাদানের আদর্শ পারমাণবিক ওজন[৩] থেকে মোলার ভর নির্ণয় করা হয়। কোনো একটি নমুনার সংশ্লিষ্ট উপাদানের আইসোটোপিক বন্টনকে নির্ধারণ করতে আদর্শ পারমাণবিক ওজন গণনা করা হয় (সাধারণত "স্বাভাবিক" বলে ধরে নেওয়া হয়)। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পানির মোলার ভর ১৮.০১৫৩(৩) গ্রাম/মোল হলেও এক একটি জলকণার আণবিক ভর ১৮.০১০ ৫৬৪৬৮৬৩(১৫) ডাল্টন (1H2 16O) এবং ২২.০২৭ ৭৩৬৪(৯) ডাল্টন (2H2 18O) এই সীমার মধ্যেই থাকে।
পারমাণবিক এবং আণবিক ভর সাধারণত ডাল্টন এককে নির্ধারণ করা হয়, যা আইসোটোপ 12C (কার্বন ১২) এর ভরের সাপেক্ষে নির্ণয় করা হয়। অর্থাৎ সংজ্ঞানুযায়ী,[৪] 12C-এর ভর ১২ ডাল্টনের সমান। উদাহরণস্বরূপ নিচের তালিকায় মিথেনের (আণবিক সংকেত: CH4) মোলার ভর এবং আণবিক ভর গণনা করা হল:
মিথেনের (CH4) মোলার ভর বা আণবিক ওজন | |||
---|---|---|---|
আদর্শ পারমাণবিক ওজন | সংখ্যা | মোট মোলার ভর (গ্রাম/মোল) বা আণবিক ওজন (ডাল্টন বা গ্রাম/মোল) | |
কার্বন (C) | ১২.০১১ | ১ | ১২.০১১ |
হাইড্রোজেন (H) | ১.০০৮ | ৪ | ৪.০৩২ |
মিথেন (CH4) | ১৬.০৪৩ | ||
12C1H4 যৌগের আণবিক ভর | |||
নিউক্লাইডের ভর | সংখ্যা | মোট আণবিক ভর (Da বা u) | |
কার্বন১২ আইসোটোপ (12C) | ১২.০০ | ১ | ১২.০০ |
হাইড্রোজেন১ আইসোটোপ(1H) | ১.০০৭৮২৫ | ৪ | ৪.০৩১৩ |
মিথেন (CH4) | ১৬.০৩১৩ |
আরও নির্দিষ্টভাবে একে "আপেক্ষিক আণবিক ভর" বলা হয়ে থাকে। প্রসঙ্গত আপেক্ষিক পারমাণবিক এবং আণবিক ভরের মান মাত্রাহীন হয়। কিন্তু সাধারণত এককরূপে ডাল্টন ব্যবহৃত হয়। পদার্থের ১ মোল পরিমাণ ভরকে মোলার ভর হিসাবে ধরা হয়, অর্থাৎ সংজ্ঞানুযায়ী প্রতি মোল পরিমাণে একক পরিমাণ ভরকে (গ্রাম) মোলার ভর বলা হয়।
উপরোক্ত উদাহরণের তালিকায়, কার্বনের আদর্শ পারমাণবিক ওজন হল ১২.০১১ গ্রাম/মোল, ১২.০০ গ্রাম/মোল নয়। কারণ প্রাকৃতিকভাবে কার্বনকে 12C, 13C এবং 14C আইসোটোপের একটি মিশ্রণরূপে পাওয়া যায়, যাদের ভর যথাক্রমে ১২ Da, ১৩.০০৩৩৫৫ Da এবং ১৪.০০৩২৪২ Da হয়ে থাকে। এই আইসোটোপগুলির অনুপাতও বিভিন্ন নমুনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকমের হয়, তাই পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় এর গড় মানকে ১২.০১১ গ্রাম/মোল হিসেবে ধরা হয়। এর বিপরীতে, প্রাকৃতিকভাবে হাইড্রোজেন কম বৈচিত্র্যময় হয়ে থাকে বলে এর আদর্শ পারমাণবিক ওজনও কম বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং কম পরিবর্তনশীল হয়ে থাকে। অর্থাৎ, কার্বনের এই উদাহরণে বোঝা যায় যে, সর্বোচ্চ বৈচিত্র্যের আদর্শ পারমাণবিক ওজন দ্বারা মোলার ভরের নির্ভুলতা সীমাবদ্ধ থাকে। মোলার ভরের অনিশ্চয়তা এবং আণবিক ভরের অনিশ্চয়তা সমান নয়। আণবিক ভরের অনিশ্চয়তা বিশ্বের প্রাকৃতিক আইসোটোপগুলির বৈচিত্র্যের ওপর নয়, পরিমাপের বৈচিত্র্য (ত্রুটি) এর ওপর নির্ভরশীল। উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন ভর বর্ণালি বীক্ষণে ভর আইসোটোপোমার গুলিকে 12C 1H4 এবং 13C 1H4 এক একটি স্বতন্ত্র অণু হিসাবে পরিলক্ষিত হয়, যাদের আণবিক ভর যথাক্রমে ১৬.০৩১ Da এবং ১৭.০৩৫ Da হয়ে থাকে। ভর বর্ণালি বীক্ষণে পরিলক্ষিত শিখর বিন্দুগুলির তীব্রতা আণবিক পদার্থের আইসোটোপিক প্রাচুর্যের সমানুপাতিক হয়। ১৭ Da আণবিক ভর বিশিষ্ট 12C 2H 1H3 ক্ষেত্রেও এটি লক্ষ্য করা যায়।
ভর বর্ণালিবীক্ষণে একটি ছোট অণুর আণবিক ভরকে সাধারণত একক আইসোটোপ বিশিষ্ট ভর (মনোআইসোটোপিক মাস্) হিসাবে ধরা হয়। অর্থাৎ, অণুর ভর শুধুমাত্র প্রতিটি উপাদানের সবচেয়ে সাধারণ আইসোটোপকে ধারণ করে থাকে। উল্লেখ্য যে, আইসোটোপ নির্বাচনকে যেরূপভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়ে থাকে, তা আণবিক ভরের এই আইসোটোপ চয়নের ক্ষেত্রে খানিকটা আলাদা প্রকৃতির হয় এবং এইভাবে নির্ধারিত নির্দিষ্ট আণবিক ভরকে অনেক সম্ভাবনার একটি একক রূপে গণ্য করা হয়। একক আইসোটোপ বিশিষ্ট আণবিক ভর গণনা করার ক্ষেত্রে, ব্যবহৃত ভরগুলিকে আইসোটোপের ভর তালিকাতে পাওয়া গেলেও একটি সাধারণ পর্যায় সারণীতে পাওয়া যায় না। অধীক পরমাণু বিশিষ্ট বৃহত্তর অনুগুলির গঠন, অণুগুলি তে উপস্থিত প্রতিটি উপাদানের প্রচুর সংখ্যক সাধারণ আইসোটোপের ওপর নির্ভরশীল না হওয়ার কারণে এসব ক্ষেত্রে প্রায়ই গড় আণবিক ভর ব্যবহৃত হয়। পরিসংখ্যানগত ভাবে প্রতিটি অণু জুড়ে আইসোটোপ প্রতিনিধিত্বকারী পরমাণুগুলির বিচরণের সম্ভাবনা থাকায়, তাত্ত্বিকভাবে পর্যায় সারণীর আদর্শ পারমাণবিক ওজন ব্যবহার করে গড় আণবিক ভরকে গণনা করা হয়। একক নমুনার গড়, ভৌগলিকভাবে বন্টিত নমুনার গড়ের সমান না হওয়ার কারণে একটি নমুনার গড় আণবিক ভর সাধারণত ভিন্ন হয়।
একক-অণু স্তরে প্রোটিন, লিপিড, শর্করা এবং নিউক্লিক অ্যাসিডের আণবিক ভর নির্ধারণের জন্য একটি দ্রুত, দ্রবণ নির্ভরশীল, ধাপ-মুক্ত পদ্ধতি হল ভর আলোকমিতি (ইংরেজি: Mass Photometry, সংক্ষেপে MP)। প্রতিসরণাঙ্ক বিশিষ্ট বিচ্ছিন্ন আলোকের অণুবীক্ষণের[৫] ওপর যা নির্ভরশীল। এটি দ্বারা প্রোটিন দ্রবণ এবং কাচ পাত্রের জোড়বন্ধনের মাঝে বিক্ষিপ্ত আলোর বৈসাদৃশ্যকে শনাক্তকরণ করা হয়ে থাকে এবং এটি অণুর ভরের সাথে রৈখিকভাবে সমানুপাতিক হয়। এই পদ্ধতিটি নমুনার সমসত্বতা[৬] পরিমাপ করতে, প্রোটিনের বহুমুখী অবস্থার শনাক্তকরণে, জটিল বৈশিষ্ট্যযুক্ত বৃহদাকার অনুগুলির সমাবেশ নির্ধারণে (যেমন: রাইবোজোম, GroEL, AAV) এবং প্রোটিনের মিথস্ক্রিয়া নির্ণয় (যেমন: প্রোটিন-প্রোটিন মিথস্ক্রিয়া)[৭] করতেও কাজে লাগে। ৪০ হাজার ডাল্টন থেকে ৫ লাখ ডাল্টন পর্যন্ত বিস্তৃত পরিসরের (৪০kDa – ৫MDa) আণবিক ভরকে একটি সঠিক মাত্রায় পরিমাপ করতে ভর আলোকমিতি ব্যবহার করা হয়।
প্রাথমিক ভাবে, আণবিক ভরকে মার্ক-হাউইঙ্কয়ের সম্পর্ক[৮] দ্বারা নির্ধারণ করা হয়। এর মূলনীতি হল, "বৃহদাকার অণুর দ্রবণগুলির (বা সাসপেনশন) অন্তর্নিহিত সান্দ্রতা একটি নির্দিষ্ট দ্রাবকের মধ্যে বিচ্ছুরিত কণাগুলির আয়তনের অনুপাতের উপর নির্ভরশীল।" বিশেষত, আণবিক ভরের সাথে সম্পর্কিত হাইড্রোডাইনামিক আকারও একটি রূপান্তর কারকের (ইংরেজি: Conversion Factors) উপর নির্ভর করে, যা একটি নির্দিষ্ট অণুর আকৃতিকেই বর্ণনা করে থাকে। হাইড্রোডাইনামিক প্রভাবের প্রতি সংবেদনশীল বিভিন্ন নিয়ম থেকে আপাত আণবিক ভরকে নির্ণয় এবং বর্ণনা করা যায়; এর মধ্যে ডি এল এস, এস ই সি (জি পি সি নামেও পরিচিত যখন দ্রবীর্ভূত হল একটি জৈব দ্রাবক), সান্দ্রতা মাপণ, এবং বিস্তৃত পারমাণবিক চৌম্বকীয় অনুরণনীয় বর্ণালি বীক্ষণ (DOSY)[৯] বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এরপর বৃহদাকার অনুগুলির নির্দিষ্ট মানের ক্রম[১০] ব্যবহার করে আপাত হাইড্রোডাইনামিক আকার দ্বারা আনুমানিক আণবিক ভর গণনা করা যেতে পারে। যেহেতু এই গণনাতে ক্রমাঙ্কনের প্রয়োজন হয়, তাই এটিকে "আপেক্ষিক" আণবিক ভর নির্ধারণের একটি পদ্ধতি হিসাবেই গণ্য করা হয়।
সাধারণত এবং পারম্পরিকভাবে, জিমের পদ্ধতি (ইংরেজি: Zimm method) ব্যবহার করে আলোক বিচ্ছুরণ থেকে সরাসরি পরম আণবিক ভর নির্ধারণ করা সম্ভব। আধুনিক স্থিতিশীল আলোক বিক্ষেপণ পদ্ধতি ব্যবহার করে অথবা বহু-কোণ আলোক বিক্ষেপণ শনাক্তকরণ পদ্ধতির মাধ্যমে এর মান নির্ধারণ করা যায়। এই পদ্ধতিতে নির্ধারিত আণবিক ভরের ক্রমাঙ্কনের কোনো প্রয়োজন হয় না বলে এই আণবিক ভরের মানকে "পরম" হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। শুধুমাত্র বাহ্যিক পরিমাপের প্রয়োজনে প্রতিসরাঙ্ক বৃদ্ধি সূচক ব্যবহার করা হয়, যা ঘনত্বের সাথে প্রতিসরাঙ্কের পরিবর্তনকে নির্দেশ করে থাকে।
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)