আন্তর্জাতিক আইনের উৎস

ভিয়েনা কংগ্রেসে গৃহীত আইনের প্রচ্ছদ; এ ধরনের কংগ্রেস বা কনভেনশনে গৃহীত চুক্তি বা সন্ধি আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম উৎস

আন্তর্জাতিক আইনের উৎস আইন সৃষ্টির সাথে সম্পর্কিত। এ আইন একদিনে গড়ে উঠে নি। ধীরে ধীরে কতিপয় উৎসের ওপর ভিত্তি করে এটি গড়ে উঠেছে। বহু বছর ধরে বিচার-বিশ্লেষণ ও বিতর্কের পরে অনেক প্রভাবশালী রাষ্ট্রের সাধারণ সম্মতিক্রমে তা গড়ে উঠেছে এবং ধীরে ধীরে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক আইনের বিধান সৃষ্টি হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার ফলাফল হল আন্তর্জাতিক আইন।

আন্তর্জাতিক আইনের উৎসগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়:

  1. আনুষ্ঠানিক উৎস;
  2. বস্তুগত উৎস।

একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া ও পদ্ধতিতে সার্বভৌম রাষ্ট্রের সাধারণ সম্মতি সৃষ্টি হয়। এ সাধারণ সম্মতি আন্তর্জাতিক আইনের মূল ভিত্তি। রাষ্ট্রসমূহের এ সাধারণ সম্মতি আন্তর্জাতিক আইনকে বৈধতা দান করে। সুতরাং আন্তর্জাতিক আইন পালনের মূলসূত্র হিসেবে সাধারণ সম্মতিকে ধরে নিয়ে "জনগণের ইচ্ছা" যা রাষ্ট্রসমূহের সমন্বিত ইচ্ছা দ্বরা প্রতিফলিত হচ্ছে, তাকে আন্তর্জাতিক আইনের আনুষ্ঠানিক উৎস বলা হয়।

আবার যেসব বিষয় বা বস্তু আন্তর্জাতিক আইনের উপস্থিতির সাক্ষ্য দেয় অর্থাৎ যে প্রকৃত উৎস থেকে আইন তার শক্তি আহরণ করে, তাকে বস্তুগত উৎস বলে। আন্তর্জাতিক চুক্তি, প্রথা, আন্তর্জাতিক আদালতের সিদ্ধান্ত বা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের গৃহীত প্রস্তাবাবলী বস্তুগত উৎসের অন্তর্গত। আন্তর্জাতিক আইন মূলত প্রথাভিত্তিক আইনের একটি অন্যতম উৎস হিসেবে স্বীকৃত। প্রথাই আন্তর্জাতিক আইনের প্রাথমিক উৎস এবং অনেকাংশে প্রথাসমূহই ক্রমান্বয়ে চুক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক আইনের উৎস হিসেবে ন্যায়পরায়ণতাকে বিবেচনায় আনা হয়।

আন্তর্জাতিক আদালতের সংবিধি ৩৮ (১)

[সম্পাদনা]

আন্তর্জাতিক আইনের উৎস নির্ণয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের সংবিধি ৩৮ (১) ধারা যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে।[] এ ধারা অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আদালত যে আইন প্রয়োগ করবে তা হল:

  1. বিভিন্ন বিধি-বিধান সৃষ্টিকারী আন্তর্জাতিক কনভেনশন বা চুক্তি যা বিরোধপক্ষসমূহ কর্তৃক স্বীকৃত;
  2. আন্তর্জাতিক প্রথা যা আইন হিসেবে সাধারণভাবে স্বীকৃত;
  3. আইনের সাধারণ নীতিমালা যা সভ্য জাতিসমূহ কর্তৃক স্বীকৃত;
  4. বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত; এবং
  5. বিভিন্ন দেশের খ্যাতিমান পণ্ডিত ব্যক্তিদের মতবাদ যা আইনের বিধান নির্ণয়ে সহায়ক ভূমিকা পালনে সক্ষম।

আন্তর্জাতিক চুক্তি

[সম্পাদনা]

আন্তর্জাতিক আদালতের সংবিধি ধারা ৩৮-এর প্রথম অনুচ্ছেদ অনুসারে আন্তর্জাতিক আইনের উৎস হিসেবে আন্তর্জাতিক চুক্তিকে প্রথমে স্থান দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী চুক্তি বলতে দুই বা ততোধিক রাষ্ট্রের মধ্যে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বিষয় লিখিত দলিলমূলে আবদ্ধ আন্তর্জাতিক ঐক্যমতকে বোঝায়। আন্তর্জাতিক অঙ্গণে আইন প্রণয়নের জন্য কোন নির্দিষ্ট পরিষদ নেই। রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের মধ্যে চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে আইন প্রণয়ন করে। ১৯৬৯ সালের চুক্তি আইন সম্পর্কিত ভিয়েনা কনভেনশন অনুসারে রাষ্ট্রসমূহ আন্তর্জাতিক বিষয়ে একাধিক চুক্তি করতে পারে। বর্তমান যুগে আন্তর্জাতিক চুক্তির ভূমিকা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক আইনের উৎস হিসেবে আন্তর্জাতিক চুক্তি বিশেষ স্থান দখল করে রেখেছে। চুক্তিসমূহ আন্তর্জাতিক কনভেনশন, কভিন্যান্ট, এগ্রিমেন্ট, প্রোটোকল, চার্টার ইত্যাদি নামেও পরিচিত।

আন্তর্জাতিক প্রথা

[সম্পাদনা]

প্রথা হল এমন সব আচার-আচরণ যা নিয়মনীতিতে পরিণত হয়ে আইনগত স্বীকৃতি লাভ করে। প্রথা হলেই যে তা আন্তর্জাতিক আইনের উৎস তা নয়। প্রথাকে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট হতে হবে; অনির্দিষ্ট কোন প্রথা কখনোই আইনের উৎস হতে পারে না। কেবলমাত্র স্মরণাতীতকাল থেকে চলে আসা আইনের উৎস প্রথা হিসেবে বিবেচিত। এটিকে যথেষ্ট পরিমাণে যৌক্তিক হতে হবে এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোন প্রথা স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য নয়। এবং সবশেষে প্রথাকে অবশ্যই ন্যায্য অধিকার আদায় ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে হবে।

সাধারণ নীতিমালা

[সম্পাদনা]
আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত; আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম উৎসস্থল

যেসব ক্ষেত্রে প্রথাভিত্তিক আইন আর চুক্তিভিত্তিক আইনের মধ্যে মতবিরোধ পরিলক্ষিত হয়, সেসব ক্ষেত্রে জাতিসমূহ কর্তৃক স্বীকৃত ও গৃহীত আইনের সাধারণ নীতিসমূহ আন্তর্জাতিক আইন হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এ সাধারণ নীতিমালা দুই ধরনের: আন্তর্জাতিক আইনের সাধারণ নীতি ও রাষ্ট্রীয় আইনের সাধারণ নীতি। এ ধরনের আইনগুলো ন্যায়বিচার, সাম্য, সুবিধাবিধৃত ও যুক্তিনির্ভর বলে আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক আদালত সাধারণ নীতি বলতে নিন্মোক্ত বিষয়াবলীকে নির্দেশ করেছে:

  • সরল বিশ্বাস
  • দায়িত্বশীলতা
  • চিরাচরিত সুবিধা
  • স্ববিরোধিতায় অনাগ্রহ ও বিরোধভুক্ত পক্ষ কখনো বিচারক না হওয়া
  • আদালত কর্তৃক মোকদ্দমায় উভয় পক্ষকে সমান সুবিধা দান।

উল্লেখ্য, রাষ্ট্রীয় আইনের কিছু সাধারণ নীতিমালা আন্তর্জাতিক আইনের উৎস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত এবং পণ্ডিত ব্যক্তিদের মতামত

[সম্পাদনা]

বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত ও আন্তর্জাতিক আইনবিদদের লেখনীকে আইনের সঠিক বিধান নির্ণয়ের অন্যতম সহায়ক মাধ্যম। আইনের প্রকৃত বিধান নির্ধারণে অবশ্যই এর যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। রাষ্ট্রীয় আদালতের রায় ও আন্তর্জাতিক বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক আইনের বিধান নির্ধারণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও বহিঃসমর্পণ সংক্রান্ত অনেক আন্তর্জাতিক প্রথার বিকাশে এ ধরনের রায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।[]

ন্যায় পরায়ণতা

[সম্পাদনা]

আন্তর্জাতিক আইন একটি ক্রমবিকাশমান আইন এবং এ কারণে উৎস হিসেবে ন্যায়পরায়ণতার গুরুত্ব অত্যধীক। কিছু কিছু মামলায় আন্তর্জাতিক আদালত যখন কোন চুক্তি, প্রথা বা অন্য কোন উৎসের উপস্থিতি পায় না, তখন অনেক ক্ষেত্রেই ন্যায়পরায়ণতার উপর ভিত্তি করে মামলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. "আন্তর্জাতিক আদালতের সংবিধি ধারা ৩৮ (১)"। ২৯ জুন ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ জুলাই ২০১৩ 
  2. Article 59 of the ICJ Statute Statute of the International Court of Justice ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৯ জুন ২০১১ তারিখে.

আরও পড়ুন

[সম্পাদনা]
  • Thirlway, H., International Customary Law and its Codification (A. W. Sijthoff: Leiden, 1972).

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]