আবু হুরাইরাহ | |
---|---|
أبو هريرة | |
ব্যক্তিগত তথ্য | |
জন্ম | ৬০৩ খ্রিস্টাব্দ |
মৃত্যু | ৬৭৮ খ্রিস্টাব্দ |
সমাধিস্থল | জান্নাতুল বাকি |
ধর্ম | ইসলাম |
যে জন্য পরিচিত | সাহাবা |
আবদুর রহমান ইবনে সখর আদ-দৌসি[১] বা আবু হুরায়রা[২](আরবি : أبىْ هريْرة رضى الله عنْه) নবী মুহাম্মাদের একজন সাহাবা ও সেবক ছিলেন যার প্রকৃত নাম আবদুর রহমান ইবনে সাখর অথবা উমায়র ইবনে আমির।[৩] তিনি আহলে সুফফার একজন সদস্য ছিলেন এবং একনিষ্ঠ জ্ঞান পিপাসু ছিলেন। তিনি তিন বছর নবী মুহাম্মদের সান্নিধ্যে ছিলেন এবং বহুসংখ্যক হাদিস আত্মস্থ করেন এবং বর্ণনা করেন। হিসাব অনুযায়ী, ৫,৩৭৪ টি হাদিস তার কাছ থেকে লিপিবদ্ধ হয়েছে। বলা হত যে, উর্বর মস্তিষ্ক ও প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন তিনি। তার কাছ থেকে আটশত তাবেঈ হাদিস শিক্ষা লাভ করেছিলেন।
আবু হুরায়রা এর ইসলাম গ্রহণের আগে নাম ছিলো আবদু শামস। ইসলাম গ্রহণের পরে মুহাম্মাদ (সা:) তার নাম পরিবর্তন করে রাখেন আবদুর রহমান। আবু হুরায়রা নামটিতে একটি মজার কাহিনী রয়েছে। একদিন হযরত আবু হুরায়রা জামার আস্তিনের নিচে একটি বিড়াল ছানা নিয়ে রাসূলের দরবারে উপস্থিত হন। বিড়ালটি হঠাৎ সকলের সামনে বেরিয়ে পড়ল। এ অবস্থা দেখে রাসূল (সা:) তাঁকে রসিকতা করে- ‘হে বিড়ালের পিতা'!বলে সম্বোধন করলেন। এরপর থেকে তিনি আবু হুরায়রা নামে খ্যাতি লাভ করেন। আরবি ভাষায় হুরায়রা স্ত্রী লিঙ্গ আর হিররিন পুং লিঙ্গ। হুরাইরাহ শব্দের অর্থ বিড়ালছানা। আবু হুরায়রা শব্দের অর্থ বিড়ালছানার পিতা।
আবু হুরায়রা ইয়েমেনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৫৯৯ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। ৬৭৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
আবু হুরাইরা ইসলামে দীক্ষিত হন প্রখ্যাত সাহাবী তুফায়িল ইবন আমর আদ-দাওসীর হাতে। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি স্বীয় দাওস গোত্রের সাথেই অবস্থান করতে থাকেন। ষষ্ঠ হিজরী সনে তার গোত্রের একটি প্রতিনিধিদলের সাথে তিনি মদীনায় এসে মুহাম্মাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। তবে আমর ইবনুর গালাস বলেন, তিনি বছর ৭ম হিজরীতে ইসলাম গ্রহণ করেন।
মদিনা আসার পর তিনি দিন রাত ২৪ ঘণ্টা হযরত মুহাম্মাদের সাহচার্যে থাকতেন, এবং হযরত মুহাম্মাদের জীবদ্দশায়, তখনো আবু হুরাইরাহ বিবাহ করেননি। বাড়িতে শুধু তার বৃদ্ধা মা ছিলো। এই বৃদ্ধা হযরত মুহাম্মাদের দোয়ার কারণে ইসলাম কবুল করেন। ঘটনাটি হল আবু হুরায়রা তার মাকে আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি ঈমান আনার আহ্বান জানালে তার মা রাসুলের প্রতি অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করলেন। এতে হযরত আবু হুরায়রা ভীষণ মর্মাহত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে রাসুলের দরবারে উপস্থিত হলেন। রাসুল তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, কাঁদছো কেন? তিনি বললেন, আমি সব সময় আমার মাকে ইসলামের দাওয়াত দেই; কিন্তু তিনি তা অস্বীকার করেন। প্রতিদিনের মতো আজো আমি তাকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলাম। এরপর তিনি আপনার সম্পর্কে এমন কিছু কথা বলেছেন যা আমাকে ভীষণ পীড়া দিয়েছে। ইয়া রাসুলাল্লাহ! দু’আ করুন আল্লাহ যেন আমার মায়ের হৃদয়কে ইসলামের আলোকে আলোকিত করে তুলেন। তখন রাসুল দু’আ করলেন- ‘হে আল্লাহ! আবু হুরায়রার মাকে হেদায়াত দান কর।’-এর ফলেই তার মা ইসলামের ছাঁয়াতলে প্রবেশ করে নিজেকে ধন্য করেন।
আবু হুরাইরাহ নিজে জ্ঞান অর্জন করতে ও জ্ঞান বিতরণ করতে ভালোবাসতেন। এইজন্য তিনি সবসময় মুহাম্মাদের থেকে তার মুখ নিসৃত কথা হাদিস শুনতেন। মুহাম্মাদ থেকে এত বেশি হাদীস বর্ণনার ব্যাপারটি অনেকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতো। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা হয়তো মনে করছো আমি খুব বেশি হাদিস বর্ণনা করি। কিন্তু আমি ছিলাম রিক্তহস্ত, দরিদ্র, পেটে পাথর বেঁধে সর্বদা মুহাম্মাদের সাহচর্যে কাটাতাম। আর মুহাজিররা ব্যস্ত থাকতো তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে এবং আনসাররা তাদের ধন-সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণে।[৪]
তিনি আরও বলেন, ‘‘একদিন আমি বললামঃ ‘ইয়া মুহাম্মাদ, আমি আপনার অনেক কথাই শুনি, কিন্তু তার অনেক কিছুই ভুলে যাই।’ একথা শুনে মুহাম্মাদ বললেন, ‘তোমার চাদরটি মেলে ধরে বুকের সাথে লেপ্টে ধর। এরপর থেকে আর কোন কথাই আমি ভুলে যাইনি।[৫]
ইমাম বুখারী বলেন, ৮০০ এর বেশি সাহাবা ও তাবেয়ী আবু হুরাইরাহর নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। সাহাবীদের মধ্যে যাঁরা তার থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন তাদের মধ্যে, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আবদুল্লাহ ইবন উমার, জাবির ইবনে আবদুল্লাহ, আনাস ইবনে মালিক, ওয়াসিলা প্রমুখ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
রাসূল যে খাদ্য হাদিয়া পেতেন, প্রায় সময়ই তা আসহাবুস্ সুফফার মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। আবু হুরায়রার ভাগে যতটুকু পড়তো, অত্যন্ত অপর্যাপ্ত হলেও তা খেয়ে দিন কাটিয়ে দিতেন। সাহাবীগণ তাঁকে কখনও ক্ষুধায় কাতর দেখলে নিজের গৃহে ডেকে এনে আহার করাতেন। একদা জাফর ইবনে আবু তালিব তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যান; কিন্তু ঘরে কিছু না থাকায় ঘি’এর শূন্য পাত্রটি হাজির করলেন। আবু হোরায়রা তা-ই চেটে ক্ষুধা বৃত্তির প্রয়াস পেলেন। অনেক সময় খেজুর আর পানি খেয়েই তিনি দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতেন। কখনও কখনও পেটে পাথর বেঁধে শুয়ে থাকতেন; কিন্তু কোনো দিন কারো নিকট কিছু চাইতেন না।
রাসূলের সময় আবু হোরায়রা সংসারবিরাগী চরম দারিদ্র্যে দিন কাটালেও পরবর্তী জীবনে তিনি বিয়ে করে সংসারী হন। সন্তান-সন্ততির পিতা হন এবং ধনসম্পদের অধিকারী হন। তবে তিনি সবসময় বলতেন, আমি ইয়াতীম অবস্থায় বড় হয়েছি, রিক্ত হস্তে হিজরাত করেছি।
অন্তিম রোগ শয্যায় মারওয়ান ইবনুল হিকাম তাকে দেখতে এসেছিলেন। মারওয়ান তার সাথে সাক্ষাৎ এর পরপরই তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ঐতিহাসিক ওয়াকিদী বলেন, ওয়ালিদ বিন উকবা’ আসরের নামাযের পর তার জানাযার নামাযের ইমামতি করেন। আবদুল্লাহ ইবনে উমর, আবু সাঈদ খুদরী প্রমুখ সাহাবী তার জানাযায় উপস্থিত ছিলেন।
ওয়ালিদ ইবনে উকবা তার মৃত্যুর খবর হযরত মুয়াবিয়ারকে অবহিত করলে তিনি তাঁকে লিখেন, তার উত্তরাধিকারীদের খুজে বের করে দশ হাজার দিরহাম দাও এবং তার প্রতিবেশীদের সাথে সদাচরণ কর। কারণ, উসমানের গৃহবন্দী অবস্থায় তিনি তাঁকে সাহায্য করেছিলেন।
আল্লামা ইবনে হাজার আসকিলানী ‘আল ইসাবা’ গ্রন্থে আবু সুলাইমানের সুত্রে উল্লেখ করেছেন, আবু হুরাইরা ৭৮ বছর জীবন লাভ করেছিলেন। ওয়াকিদীর মতে তার মৃত্যুসন ৫৯ হিজরী, তবে ইমাম বুখারীর মতে তার মৃত্যুসন হিজরী ৫৭। মদীনার অদূরে 'কাসবা' নামক স্থানে মৃত্যুবরণ করেন।
অগাধ জ্ঞান, সীমাহীন বিনয় ও উদারতার সাথে আবু হুরাইরার মধ্যে তাকওয়া ও আল্লাহপ্রীতির এক পরম সম্মিলন ঘটেছিল। তিনি দিনে রোযা রাখতেন, রাতের তিন ভাগের প্রথম ভাগ নামাযে অতিবাহিত করতেন। তারপর স্ত্রীকে ডেকে দিতেন। তিনি রাতের দ্বিতীয় ভাগ নামাযে কাটিয়ে তাদের কন্যাকে জাগিয়ে দিতেন। কন্যা রাতের বাকী অংশটুকু নামাযে দাঁড়িয়ে অতিবাহিত করতেন। এভাবে তার বাড়ীতে সমগ্র রাতের মধ্যে ইবাদত কখনও বন্ধ হতো না। ইকরিমা ইবনে আবু জাহল বলেন, আবু হুরাইরা প্রতিদিন বার হাজার বার তাসবীহ পাঠ করতেন।
আবু হুরাইরার একটি নিগ্রো দাসী ছিল। একদিন তার অশোভন আচরণের কারণে তার পরিবারের সবাই দুঃখ পান, এবং পরিশেষে তিনি তাকে আযাদ করে দেন।
তার মা যতদিন জীবিত ছিলেন আবু হুরাইরা তার সাথে সর্বদা সদাচরণ করেছেন। তিনি সবসসময় বাড়ি পৌঁছে মাকে সালাম করতেন। আবু হুরাইরা নিজে যেমন মুরুব্বিজনদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন, তেমনি সকলকে তিনি উপদেশ দিতেন মাতাপিতার সাথে সদাচরণের, আত্মীয় স্বজনদের সাথে সুসম্পর্ক কায়েম রাখার উপদেশ দিতেন।
আবু হুরাইরা মুহাম্মাদ ও তার নিসৃত কথার প্রতি প্রচণ্ড নিবেদিত ছিলেন। জ্ঞান অর্জন ও জ্ঞানচর্চা তার অভ্যাস ও প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিল।
যায়িদ বিন সাবিত বলেন, একদিন আবু হুরাইরাহ,আমাদের এক বন্ধু ও আমি মসজিদে আল্লাহর কাছে দু’আ করছিলাম। ইতিমধ্যে মুহাম্মাদ আমাদের মধ্যে উপস্থিত হলে, আবু হুরাইরাহ সেই দিন দোয়া করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে চাই, আমার দুই বন্ধু যা দোয়া করেছে। আর সেইসাথে চাই এমন জ্ঞান যা কখনও ভুলে যাবোনা।
আবু হুরাইরাহ দানশীলতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন, তার মেয়ে তার নিকট সোনার গহনা বানিয়ে চাইলে, তিনি এটি দিতে চাননি, বরং বলেছেন, আমার সম্পদ আমি আল্লাহ্র রাস্তায় খরচ করতে পছন্দ করি।
একদিন মারওয়ান ইবনুল হাকাম ১০০ দিনার আবু হুরাইরার কাছে পাঠালেন। কিন্তু পরের দিনই মারওয়ান আবার লোক পাঠিয়ে জানালেন, ‘আমার চাকরটি ভুলক্রমে দিনারগুলি আপনাকে দিয়ে এসেছে, ওগুলি আমি আপনাকে দিতে চাইনি, বরং অন্য এক ব্যক্তিকে দিতে চেয়েছিলাম।’ একথা শুনে আবু হুরাইরা লজ্জা ও বিস্ময়ের সাথে বললেন, ‘আমি তো সেগুলি আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে ফেলেছি। আগামীতে বাইতুল মাল থেকে যখন আমার ভাতা দেওয়া হবে, সেখান থেকে নিয়ে নেবেন।
দ্বিতীয় খলীফা উমর আবু হুরাইরাকে বাহরাইনের শাসক নিযুক্ত করেছিলেন। পরে তাকে অপসারণ করেন। তারপর আবার নিযুক্ত করতে চাইলে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন এবং মদীনা ত্যাগ করে আকীক নামক স্থানে গিয়ে বসবাস করতে থাকেন।
হযরত মুয়াবিয়ার শাসনামলে আবু হুরাইরা একাধিকবার মদীনার শাসক নিযুক্ত হয়েছিলেন। তবে শাসন ক্ষমতা তার স্বভাবগত মহত্ব, উদারতা ও অল্পেতুষ্টি ইত্যাদি গুণাবলীতে কোন পরিবর্তন সৃষ্টি করতে পারেনি।