আবেতত্ত্ব বা আবেনোমিক্স হল জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে উদ্ভাবিত একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যা ২০১২ সালের জাপানি সাধারণ নির্বাচনে আবে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর জাপানে প্রবর্তিত হয়। এই তত্ত্বের "তিনটি মূল লক্ষ্যমাত্রা" হল - মুদ্রানীতি শিথিলকরণ, রাজস্ব নীতির সংস্কার এবং কাঠামোগত সংস্কার।[১][২] দি ইকোনমিস্ট এই ব্যবস্থাকে "মুদ্রাস্ফীতি, সরকারি ব্যয় ও প্রবৃদ্ধির কৌশলের মিলবন্ধন" বলে অভিহিত করে।[৩]
জাপান সরকার ১৯৯৭ সালে বাজেটে ভারসাম্য আনয়নের লক্ষ্যে ভোক্তা করের হার ৩% থেকে ৫% এ উত্তীর্ণ করে, যার ফলে মন্দা আরও ঘনীভূত হয় এবং সরকারের রাজস্ব ৪.৫ ট্রিলিয়ন ইয়েন কমে যায়, কারণ ভোক্তা কর বৃদ্ধির ফলে ভোগ ও ক্রয় কমে যায়। কর বৃদ্ধির ফলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ০% এর নিচে চলে যায়। ১৯৯৬ সালে দেশটির জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার রেকর্ড করা হয় ৩%, কিন্তু কর বৃদ্ধির ফলে অর্থনীতিতে মন্দা আরও ঘনীভূত হয়।[৪] এই কর বৃদ্ধির পরের ৫ বছর জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার শূন্যের নিচে ছিল।[৫][৬] ১৯৯২ থেকে ১৯৯৭ সালে জাপানের গড় বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি পায়, কিন্তু ১৯৯৭ সালে ভোক্তা কর বৃদ্ধির প্রভাবে মজুরি কমতে শুরু করে। ১৯৯৭ সালের পর মজুরি জিডিপির চেয়েও দ্রুত কমতে থাকে।
২০১২ সালে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিকো নোদার অধীনে জাপানের ডায়েটে জাতীয় বাজেটে ভারসাম্য আনার লক্ষ্যে ভোক্তা করের হার ২০১৪ সালে ৮% এবং ২০১৫ সালে ১০% করার বিল পাস করা হয়।[৭] এই কর বৃদ্ধি ভোগের পরিমাণ আরও কমিতে দিবে বলে মনে করা হয়।[৮]
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাকালীন ২০০৮ সালে জাপানের প্রকৃত মোট দেশজ উতপাদন ০.৭% কমে যায় এবং পরের বছর তা আরও মারাত্মক হারে ৫.২% কমে। অন্যদিকে, ২০০৮ সালে বৈশ্বিক প্রকৃত মোট দেশজ উৎপাদন ৩.১% বৃদ্ধি পায় এবং ২০০৯ সালে ০.৭% কমে।[৯] ২০০৮ থেকে ২০০৯ সালে জাপান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি ২৭% কমে এবং ৭৪৬.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে কমে দাঁড়ায় ৫৪৫.৩ বিলিয়ন ডলারে।[১০] ২০১৩ সালে জাপানের মোট দেশজ আয় ১৯৯১ সালের অবস্থায় এসে দাঁড়ায় এবং নিক্কেই ২২৫ স্টক মার্কেট ইনডেক্স তৃতীয় স্থানে অবস্থান করে।[৩]
আবেতত্ত্ব ব্যক্তিমালিকানায় বিনিয়োগ বাড়াতে মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কৌশল গ্রহণ করে। নির্দিষ্ট নীতিসমূহ হল - মুদ্রাস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ২% এ আনয়ন, ইয়েনের অত্যধিক উপচয় সংশোধন, ঋণাত্মক সুদের হার ধার্যকরণ, দ্রুত সম্পদের পরিমাণ শিথিলকরণ, সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, ব্যাংক অব জাপান কর্তৃক বন্ড ক্রয় এবং ব্যাংক অব জাপান আইন সংশোধন।[১১]
আবেতত্ত্ব গ্রহণের পরপরই জাপানের বিভিন্ন আর্থিক বাজারে এর প্রভাব দেখা যায়। ২০১৩ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে আবেতত্ত্ব নীতির কারণে জাপানি ইয়েনের দরপতন হয় এবং টপিক্স স্টক মার্কেট ইনডেক্সে ২২% দাম বৃদ্ধি পায়।[১] বেকারত্বের হার ২০১২ সালের শেষ ভাগ থেকে ২০১৩ সালের প্রথম ভাগে ৪.০% থেকে কমে ৩.৭% এ দাঁড়ায়, এবং পূর্ববর্তী সময়ের রূপ ধারণ করে।[১২]
মুদ্রানীতি শিথিলকরণের পরেও ২০১২ সালের দ্বিতীয় ভাগের তুলনায় ২০১৩ সালের দ্বিতীয় ভাগে মার্কিন ডলারের তুলনায় ইয়েনের মূল্য ২৫% হ্রাস পায়। ২০১৩ সালে মে মাসে স্টক মার্কেট ৫৫% বৃদ্ধি পায়, প্রথম ভাগে ভোক্তা ব্যয়ের ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় বার্ষিক ৩.৫%, এবং শিনজো আবের গৃহীত রেটিং ৭০% পর্যন্ত ঠিক হয়।[৩] নিক্কির এক জরিপে দেখা যায় ৭৪% অংশগ্রহণকারী জাপানকে দীর্ঘমেয়াদী মন্দা থেকে উত্তরণের জন্য এই নীতির প্রশংসা করেছেন।[১৩]
মজুরি প্রভাব ও ভোক্তার মনোবৃত্তি আরও কমে যেতে থাকে। ২০১৪ সালে জানুয়ারিতে কিদোর এক সংবাদ জরিপে দেখা যায় ৭৩% জাপানি অংশগ্রহণকারী আবেতত্ত্বের প্রভাব ব্যক্তিগতভাবে লক্ষ্য করেন নি, মাত্র ২৮% মজুরি বৃদ্ধির আশা করেছেন, এবং প্রায় ৭০% ভোক্তা কর বৃদ্ধির ফলে ব্যয় কমানোর কথা বিবেচনা করেন।[১৪]
ইয়েনের মূল্যমান কমে যেতে থাকলে, আবেতত্ত্ব খাদ্য, তেল ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি করে, কারণে জাপান এসবের প্রতি নির্ভরশীল। আবে সরকার এই নীতিকে স্বল্পকালীন পিছিয়ে পড়া হিসেবে দেখে, যাতে রপ্তানির পরিমাণের ভিত্তিতে ইয়েনের কম মূল্যমান বৃদ্ধি পায়। এছাড়া জাপান বিদেশ থেকে বিনিয়োগ আয়ের কারণে সার্বিক উদ্বৃত্ত হিসাব রাখার ব্যবস্থা করে।[১৫]
|তারিখ=
(সাহায্য)