আব্দুল মুমিন বিন আলী আল কৌমি

আব্দুল মুমিন বিন আলী আল কৌমি
عبد المؤمن بن علي الكومي
পূর্ববর্তী খলিফাইবনে তুমার্ত
জন্ম৪৮৭ হিজরি/১০৯৪ খ্রিস্টাব্দ
নাদরুমাহ, আলজেরিয়া
মৃত্যু৫৫৮ হিজরি/ ১১৬৩ খ্রিস্টাব্দ
সাল্লা, মাগরেব
যুগ সময়কাল
মধ্যযুগ
ধর্মইসলাম (সুন্নি)

আব্দুল মুমিন বিন আলী আল কৌমি (৪৮৭ হিজরি/১০৯৪–৫৫৮ হি./১১৬৩ ) ছিলেন মুওয়াহহিদ রাজ্যের দ্বিতীয় খলিফা। তিনি ১১৪৭ থেকে ১১৬৩ সাল পর্যন্ত রাজধানী মারাকেশ থেকে তা শাসন করেন এবং তিনি জাহিরি আইনশাস্ত্রআশআরী চিন্তাধারার সমন্বয়ে একটি সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন করেন, যা তিনি তার পূর্বসূরিদের থেকে গ্রহণ করেন। তিনি এসবের প্রয়োগ ঘটান এবং তিনিই প্রথম মাগরেবকে একত্র করে তাকে একটি রাষ্ট্র ( যেমন: আন্দালুস) হিসাবে শাসন করেন। তিনি একে এক বিশ্বাস এবং একটি সরকারের অধীনে রেখেছিলেন। [][][][][]

জীবনী

[সম্পাদনা]

আব্দুল মুমিন বিন আলীর পুরো নাম “আব্দুল মুমিন বিন আলী বিন মাখলুফ বিন ইয়া'লা বিন মারওয়ান বিন নাসর বিন আলী বিন আমের বিন আসর বিন মুসা বিন আব্দুল্লাহ বিন ইয়াহিয়া বিন ওয়ারিগ বিন ইয়াকুর বিন মাতমাত বিন হাওদাজ আবু মুহাম্মদ আল-কৌমি। []

তিনি মরক্কোর তৎকালীন মুরাবিত রাজ্যের টেমসেনের কাছে তাগির শহরে জন্মগ্রহণ করেন[] এবং সেখানেই তিনি বড় হন; লেখাপড়া শেখেন। তার পিতা একজন কামার ছিলেন। তিনি পড়ালেখায় কিছু আইনশাস্ত্রনবীর জীবনী অধ্যয়ন করেন। এরপর তিনি বড় বড় অনেক আলেম থেকে জ্ঞান অর্জন করেন, বিশেষ করে শেখ আব্দুস সালাম আল-তিউনিসি, যিনি আইনশাস্ত্র, হাদীসতাফসিরে সময়কালীন ইমাম ছিলেন। তার পর তিনি পূর্বদিকে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হন। যাওয়ার আগে আগে তিনি একজন মহান ফকিহের উপস্থিতির কথা শুনেন। তিনি তাকে দেখার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তার কাছে যান। তিনি রাজধানী বেজাইয়ার কাছে মালালা শহরে থাকেন। তখন তা হাম্মাদিয়া রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

এ বৈঠকে আব্দুল মুমিন ইবনে তুমার্তের ব্যক্তিত্ব, তার জ্ঞানের প্রাচুর্য এবং সমর্থক ও অনুসারীদের একত্রিত করার ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হন এবং তিনি প্রাচ্য ভ্রমণের ইচ্ছা ত্যাগ করেন। তিনি ইবনে তুমার্তের কাছেই থেকে যান এবং তাঁর অধীনে অধ্যয়ন শুরু করে দেন। ইবনে তুমার্ত একজন মহান পণ্ডিত ও একজন দক্ষ আইনজ্ঞ ছিলেন। তিনি মাগরেবের বিভিন্ন দেশে পড়াশোনা করে প্রাচ্য ভ্রমণ করেছিলেন। তারপর দুজনের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় হয় এবং তারা মালালা ছেড়ে ফেজে চলে যান।

যাত্রাপথে ইবনে তুমার্ত ফেজ শহরে না পৌঁছানো পর্যন্ত ভাল কাজের নির্দেশ দেওয়া ও মন্দকাজ থেকে নিষেধ করা বন্ধ করেননি। সেখানে তিনি ৫১৪ হি/১১২০ সাল পর্যন্ত জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছিলেন। তার পর তিনি আব্দুল মুমিন বিন আলী কোমির সাথে ভ্রমণ করে মুরাবিতুন রাজ্যের রাজধানী মারাকেশে যান এবং তারা সেখানে অবস্থান করতে থাকেন। []

মুরাবিতুন রাজ্যের পতন

[সম্পাদনা]

আব্দুল মুমিনকে মুওয়াহহিদিন আন্দোলনের অন্যতম নেতা ইবনে তুমার্তের বিশ্বস্ত সেনাপতি উপাধি দেওয়ার কারণ হল, ৫২৪ হিজরি সালে বুহায়রা যুদ্ধের প্রস্তুতির সময় যখন ইবনে তুমার্ত আব্দুল মুমিনকে মুরাবিতুন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আদেশ দেন; তখন তিনি বলেন: "তোমরা মুমিন, আর ইনি তোমাদের আমির।" []

আব্দুল মুমিন দেখলেন যে, মুরাবিতদের নির্মূল করার সুযোগ এসেছে। তাই তিনি দ্রুত এটি লুফে নিতে এবং তাদের রাজ্যের কেন্দ্রস্থলে তাদের আক্রমণ করা শুরু করার প্রস্তুতি নিলেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি একটি বিশাল সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করেন এবং তিনমেলে নিজের ঘাঁটি ত্যাগ করেন। এটি ৫৩৪ হি/১১৪০ খ্রিস্টাব্দে হয়। তখন তিনি পূর্ব মরক্কোর দিকে রওনা হয়। আল আকসা ও এর দক্ষিণপূর্ব দিকে; শক্তিশালী মুরাবিত সেনাবাহিনীর কেন্দ্র মারাকেশ থেকে অনেক দূরে উপজাতিদের তার আহ্বানে বশীভূত করতে আব্দুল মুমিন তার এ বিজয়ে টানা সাত বছরেরও বেশি সময় ব্যয় করেছিলেন এবং সেই সময়ে তিনি বিভিন্ন সামরিক কৌশল ও সামরিক দক্ষতা প্রদর্শন করেছিলেন। তার ফলে মুরাবিতুনদের বাহিনী নিষ্পত্তিমূলক বৈঠক এবং সিদ্ধান্তমূলক যুদ্ধের সাথে সাক্ষাত না করেই দুর্বল হয়ে পড়ে।[]

এ আক্রমণের সময় মুরাবিতুন রাজ্যের সুলতান আলী বিন ইউসুফ (৫৩৭হি./১১৪২ খ্রিস্টাব্দ) মারা যান এবং তার পুত্র তাশফিন স্থলাভিষিক্ত হন; কিন্তু তাশফিনও আব্দুল মুমিনের সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করতে অক্ষম হন। ৫৩৯ হিজরিতে (১১৪৪ খ্রি) তিনি টেমসেনে প্রবেশ করতে সক্ষম হন এবং এরপর তাশফিন ওরান শহরের দিকে পিছু হটে। মুরাবিত সেনাবাহিনী তাকে অনুসরণ করে পেছনে চলে। আব্দুল মুমিন শহরটি ঘেরাও করে এবং এর দুর্গের দরজায় আগুন ধরিয়ে দেয়। তাশফিন চেষ্টা করে দুর্গ থেকে পালানোর জন্য;কিন্তু তিনি ঘোড়া থেকে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন (২৭ রমজান ৫৩৯ হি/২৩ মার্চ ১১৪৫ খ্রিস্টাব্দ)। মুয়াহহিদরা ওরানে প্রবেশ করে এবং যে সেখানে জীবিত ছিল তাকে হত্যা করে।[]

ওরানের পরপর আব্দুল মুমিন ফেজ শহর জয় করার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠেন। তাই তিনি সেনাদলসহ ফেজ শহরে যান এবং এর চারপাশে একটি কঠোর অবরোধ আরোপ করেন, যা সাত মাস স্থায়ী হয়েছিল। শহরের লোকেরা অবরোধের কঠোরতায় ভোগে অতিষ্ঠ হয়ে যায়। তাই গভর্নর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ফলে মুওয়াহহিদরা সেখানে প্রবেশ করে ( ১৪ যুল-কাদাহ, ৫৪০ হি/৫ মে, ১১৪৫ খ্রিস্টাব্দ)।[]

তারপরে সেউতা বিজিত হয় এবং উভয় শহরই (ফেজ ও সেউতা) মুওয়াহহিদ রাজ্যের আনুগত্যে প্রবেশ করে এবং এরপর বাহিনী মারাকেশ জয় করার জন্য রওনা হয়। সেখানে ইসহাক বিন আলী বিন তাশফিন একটি বসতি স্থাপন করেছিলেন। শহরের রক্ষকরা সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করে, কিন্তু তা কোনো কাজেই আসেনি। তাদের হাতে আর কিছুই করার ছিল না। মুওয়াহহিদ বাহিনী (১৮ ই শাওয়াল, ৫৪১ হি./২৪শে মার্চ ১১৪৭ খ্রিস্টাব্দ) এ শহরটি দখল করে ইসহাক বিন আলীকে হত্যা করে। তিনি ছিলেন শেষ মুরাবিত রাজপুত্র। তার মৃত্যুর ফলে মুরাবিত রাজ্যের পতন ঘটে এবং আব্দুল -মুমিন বিন আলী আল কৌমির কর্তৃত্বে একটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, যাকে তার "খলিফা" বলা হয়।[]

কৃতিত্ব

[সম্পাদনা]

আব্দুল মুমিন বিন আলী চৌত্রিশ বছর শাসন করেন এবং তার শাসন মাগরেবে ( উত্তর আফ্রিকা) সবচেয়ে সমৃদ্ধ যুগের একটি হিসাবে বিবেচিত হয়। তিনি ইবনে তুমার্তের কাছে থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে একটি বিপ্লবী আন্দোলন পেয়েছিলেন এবং তিনি তাকে একটি রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করেন। এটির কর্তৃত্ব প্রসারিত করে সমগ্র মাগরেব এবং আন্দালুসিয়ার অবশিষ্ট অংশ অন্তর্ভুক্ত করেন। এর জন্য প্রশাসনিক নিয়ম ও ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন, যা এটিকে বিষয়গুলি পরিচালনা করতে সক্ষম করে। ইতিহাস আন্দালুসের জনগণের কাছে আব্দুল মুমিনের পাঠানো একটি দীর্ঘ চিঠি সংরক্ষণ করে, যা মুওয়াহহিদ সরকার ব্যবস্থার জন্য একটি সংবিধান গঠন করে। [১০]

আব্দুল মুমিন তার রাজ্যগুলিকে সংগঠিত করেছিলেন এবং এর জন্য তিনি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন। তার একজন বিচার ও অভিযোগ শুনানির মন্ত্রী ও একজন যুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ছিল। তিনি মতামত ও বাগ্মীতায় দক্ষ ব্যক্তিদের মন্ত্রী নিযুক্ত করেছিলেন এবং তাদের সবার বিবেচনা করার জন্যও আব্দুল মুমিনের একটি বিশেষ পরিষদ ছিল, যা আইনবিদ, উপজাতীয় প্রতিনিধি এবং সিনিয়র রাষ্ট্রীয় নেতাদের নিয়ে গঠিত ছিল।

আব্দুল মুমিন নিজেকে সেনাবাহিনীর জন্যে নিবেদিত করেন এবং তাকে সময়ের অন্যতম সেরা সেনাবাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি নিজেই একজন মহান নেতা ও একজন দুর্দান্ত সৈনিক ছিলেন; রাস্তার কষ্ট ও সামরিক জীবনের কঠোরতা তাদের সাথেই ভাগ করে নিয়েছিলেন। তিনি তার জন্য শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী সংগ্রহ করেছিলেন যা তার মতো মাগরেবের রাজাদের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি এবং তাদের সাথে তিনি এর বদৌলতে বিস্ময়কর বিজয় অর্জন করেছিলেন।

মুওয়াহহিদিনরা (আব্দুল মুমিন ইবনে আলী এবং তার উত্তরসূরিরা) বাধ্যতামূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন এবং যারাই মুওয়াহহিদ ব্যানারে যোগদান করেছিলেন তাদের প্রত্যেককে শিখতে হয়েছিল এবং ধর্মীয় শিক্ষা শুধুমাত্র পুরুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তাদের সাথে মহিলারাও অংশগ্রহণ করেছিলেন। মুওয়াহহিদ শাসকরা রাবাত শহরে নৌকা চলাচল শেখানোর জন্য একটি স্কুল ও মারাকেশে কর্মীদের স্নাতক করার জন্য আরেকটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিল। আব্দুল মুমিন ইবনে আলি মুখস্থকারীদের (তরুণ ছাত্রদের) আল-মুওয়াত্তা বই মুখস্থ করে শিক্ষিত করতেন এবং সেই সাথে ইবনে তুমার্তের মৌলিক রচনাও অন্তর্ভুক্ত থাকত। তিনি প্রতি শুক্রবার নামাযের পর তাদের প্রাসাদের ভিতরে নিয়ে আসতেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি তাদের কখনো ঘোড়া-চালনা, তীর নিক্ষেপ, হ্রদে সাঁতার কাটা ইত্যাদি শেখাতেন।[১০]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Kojiro Nakamura, "Ibn Mada's Criticism of Arab Grammarians." Orient, v. 10, pgs. 89-113. 1974
  2. "إسلام ويب - سير أعلام النبلاء - الطبقة التاسعة والعشرون - عبد المؤمن بن علي- الجزء رقم20"। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১১-১০ 
  3. كوجيرو ناكامورا, "Ibn Mada's Criticism of Arab Grammarians." Orient, v. 10, pgs. 89-113. 1974
  4. Dictionary of World Biography: The Middle Ages - Page 4 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০২২-০৩-৩০ তারিখে
  5. Encyclopaedia of the World Muslims: Tribes, Castes and Communities ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০২২-০৩-২৩ তারিখে
  6. تاريخ ابن خلدون - ابن خلدون - الجزء 6 - الصفحة 126
  7. "قصة الإسلام | عبد المؤمن أول حكام دولة الموحدين"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৪-২৫ 
  8. "قصة الإسلام | عبد المؤمن أول حكام دولة الموحدين"। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১১-১০ 
  9. عبد الواحد المراكشي، المعجب في تلخيص أخبار المغرب، تحقيق وتعليق محمد سعيد العريان ومحمد العربي العلمي، القاهرة، 1949، ص. 192.
  10. "مهد الموحدين ومسقط رأس عبد المؤمن بن علي الكومي الندرومي"। ২০১৫-০৭-০৬। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১১-১০