আমাজন কিন্ডল বলতে বোঝায় Amazon.com উদ্ভাবিত ও বিপণনকৃত এক ধরনের ই-বুক পাঠযন্ত্রকে। আমাজন কিন্ডল ব্যবহার করে একজন পাঠক খুব সহজে ডিজিটাল ফরমেটে থাকা বই, ম্যাগাজিন, সংবাদপত্র ইত্যাদি যেকোনো ধরনের লিখিত নথি পড়তে পারেন। পড়ার সুবিধা ছাড়াও কিন্ডল ব্যবহার করে একজন ব্যবহারকারী ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমাজন স্টোরে থাকা কয়েক লক্ষ বই থেকে তার পছন্দের বই কিনতে, জমা রাখতে ও ডাউনলোড করতে পারেন।[২] তাছাড়া কিছু কিছু কিন্ডল মডেল ব্যবহার করে ব্যবহারকারী বিনা খরচে তৃতীয় প্রজন্মের ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন। আমাজন কিন্ডলের হার্ডওয়্যার প্রস্তুত করা হয়েছে আমাজনের ভর্তুকিপুষ্ট গবেষণাগার ল্যাব ১২৬ এ। ল্যাব ১২৬ শুরুতে একটি মাত্র যন্ত্র দিয়ে পথ চলা শুরু করলেও পরবর্তীকালে একাধিক কিন্ডল মডেল, ই-ইঙ্ক ইলেক্ট্রনিক পেপার ডিসপ্লে ও নিজস্ব ডিজাইনের এ্যান্ড্রয়েড ভিক্তিক ট্যাবলেট পিসি উদ্ভাবন করেছে।
ল্যাব ১২৬ এর অণুরোধে আমাজন কিন্ডলের নামকরণ করেন ব্র্যান্ডিং পরামর্শক মিখাইল ক্রোনান। ক্রোনান ও কারিন ডেভিসন পরামর্শ দেন ইবুক পাঠযন্ত্রটির নাম কিন্ডল রাখা হোক যার শাব্দিক অর্থ 'অগ্নি প্রজ্বালন করা'।[৩] তাঁদের মতে এই নামটি অধ্যয়ন ও বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে ব্যবহার যোগ্য এই যন্ত্রটির জন্য যথাযথ রুপক নাম।[৪]
বর্তমানে প্রচলিত কিন্ডলের হার্ডওয়্যার প্রস্তুত করা হয়েছে ২০০৭ সালে প্রস্তুতকৃত কিন্ডল ও ২০০৯ সালে প্রস্তুতকৃত কিন্ডল ডিএক্স লাইন(বড় স্ক্রিন সংবলিত) যন্ত্র দুটোর উপর ভিত্তি করে। বর্তমান বাজারে প্রচিলত কিন্ডল মডেলগুলোর মধ্যে রয়েছে
২০০৭ সালের ১৯ই নভেম্বর আমাজন প্রথম কিন্ডল বাজারজাত করা শুরু করে। প্রথম প্রজন্মের কিন্ডলগুলোর[৯] মুল্য ছিল ৩৯৯ মার্কিন ডলার। বাজারে আসার সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার মধ্যেই প্রথম কিন্ডলটি বিক্রি হয়ে যায়।[১০] পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যেই উৎপাদিত সবগুলো কিন্ডল বিক্রি হয়ে যায় ও প্রায় পাঁচ মাস বিক্রি বন্ধ থাকার পর ২০০৮ সালের এপ্রিল থেকে আবার বিক্রি করা শুরু হয়।[১১] এযাবৎ প্রস্তুতকৃত কিন্ডলগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র এই কিন্ডলটিতেই এসডি কার্ড ব্যবহার করে মেমরি বাড়িয়ে নেয়ার সুযোগ ছিল। কিন্ডলটির ডিসপ্লে ছিল ৬ ইঞ্চি ও ৪ মাত্রার গ্রেস্কেল। বিল্ট ইন মেমরি ছিল ২৫০ মেগাবাইট। এই ডিভাইসটিতে প্রায় ২০০ টির মত বই রাখা যেতো। এছাড়া এতে একটি স্পিকার ও হেডফোন জ্যাক ছিল। আমাজন কিন্ডলের এই সংস্করণটিতে বিনামূল্যে থ্রিজি ইন্টারনেট ব্যবহার করে আমাজন স্টোরে কোন বই জমা করে রাখা ও পরবর্তীকালে তা ডাউনলোড করার সুযোগ রাখা হয়েছিলো। আমাজন এর প্রথম প্রজন্মের কিন্ডল শুধুমাত্র উত্তর আমেরিকার মধ্যেই বাজারজাত করতো।[১২]
কিন্ডল ২
২০০৯ সালের ১০ই অক্টোবর আমাজন কিন্ডল ২ বাজারে আনার ঘোষণা দেয়। [১৩] তবে ২৩ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ থেকে কিন্ডলটি বিক্রি করা শুরু হয়। কিন্ডল ২ তে টেক্সট-টু-স্পিচ প্রযুক্তি ছিল যার মাধ্যমে কিন্ডলটি বিশেষ ফরম্যাটে থাকা টেক্সট ফাইলগুলোকে পাঠ করে শোনাতে পারতো। এর ইন্টারনাল স্টোরেজ ছিল ২ গিগাবাইট যার মধ্যে ১.৪ গিগাবাইট ব্যবহারকারীর জন্য উন্মুক্ত ছিল। আমাজনের তথ্য অনুসারে কিন্ডল ২ প্রায় ১৫০০ বই বা টেক্সট ফাইল সংরক্ষণ করতে পারে। তবে প্রথম প্রজন্মের কিন্ডলের মত কিন্ডল ২ তে কোন এসডি কার্ড স্লট রাখা হয়নি যার মাধ্যমে এতে বাড়তি মেমরি যোগ করা যায়।[১৪]
আমাজন কিন্ডল বিপণনের গতি বাড়ানোর জন্য স্টিফেন কিং ইউর (UR) নামের একটি নোভেল্লা লেখেন যা শুধুমাত্র আমাজন কিন্ডল স্টোর থেকে সংগ্রহ করা যায়।[১৫] iFixIt এর সমালোচনা অনুসারে কিন্ডল ২ এ ৫৩২ মেগাহার্টজ প্রসেসর, ৩২ মেগাবাইট প্রধান মেমরি, ২ গিগাবাইট ফ্ল্যাশ মেমরি ও ৩.৭ ভোল্টের ৫৩০ মিলি এম্পিয়ার আওয়ার পলিমার ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়েছিলো।[১৬] ২০০৯ সালের ৮ জুলাই আমাজন কিন্ডল ২ এর মূল্যহ্রাস করে ও ৩৫৯ মার্কিন ডলার থেকে ২৯৯ মার্কিন ডলারে পুনঃনির্ধারণ করে।[১৭] iSuppli এর মতে প্রতিটি কিন্ডল ২ উৎপাদন করতে আমাজনের প্রায় ১৮৫.৪৯ মার্কিন ডলার খরচ হয়।[১৮]
অক্টোবর ২২, ২০০৯ সাল থেকে আমাজন কিন্ডল ২ এর বিক্রি বন্ধ ঘোষণা করে। ২৪ নভেম্বর, ২০০৯ সালে আমাজন কিন্ডল ২ এর জন্য একটি ফার্মওয়্যার হালনাগাদ রিলিজ করে। আমাজনের দাবী অনুযায়ী ফার্মওয়্যারটি ব্যবহার করার ফলে কিন্ডল ব্যাটারির স্থায়িত্ব ৮৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
২০০৯ সালের ৭ অক্টোবরে আমাজন কিন্ডল ২ এর আন্তর্জাতিক সংস্করণ বাজারে আনার ঘোষণা দেয়। নতুন সংস্করণটি ব্যবহার করে প্রায় ১০০ টি দেশ থেকে বই বা কিন্ডল সমর্থিত ফাইল ডাউনলোড করা যেতো। ১৯ অক্টোবর, ২০০৯ থেকে সর্বসাধারণের কেনার জন্য কিন্ডলটি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। নতুন আসা কিন্ডলটির সাথে কিন্ডল ২ এর বাহ্যিকভাবে কোন পার্থক্য ছিল না। পার্থক্য ছিল মূলত কিন্ডলের জন্য ব্যবহার করা মোবাইল নেটওয়ার্ক স্ট্যান্ডার্ডে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রস্তুতকৃত কিন্ডল ২ সিডিএমএ ২০০০ প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্প্রিন্ট নেটওয়ার্কে চলতো অপারদিকে কিন্ডল ২ এর আন্তর্জাতিক সংস্করণটি জিএসএম এবং থ্রিজি জিএস এম প্রযুক্তি ব্যবহার করতো। কিন্ডলের এই সংস্করণটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এটিএন্ডটি এর মোবাইল নেটয়ার্ক ব্যবহার করতো।[১৯]
কিন্ডল ২ আন্তর্জাতিক সংস্করণে মার্কিন সংস্করণটির চাইতে পরিষ্কার পর্দা ব্যবহার করা হয়েছিলো। যার ফলে ছবি বা লেখা পড়ার জন্য কিন্ডল ২ মার্কিন সংস্করণের চাইতে কিন্ডল ২ আন্তর্জাতিক সংস্করণ অনেক বেশি উপযোগী ছিল। যদিও আমাজন এই উন্নয়নের কথা কখনও ঘোষণা বা উল্লেখ করেনি।[২০]
এদিকে গ্যাজেট ল্যাবের[২১] সমালোচনায় বলা হয় কিন্ডল ২ এর ফন্ট প্রথম প্রজন্মের কিন্ডলের চাইতে অস্পষ্ট। বিশেষ করে ছোট আকৃতির কোন লেখা পড়তে গেলে পাঠককে বেশ বেগ পেতে হয়। এমনকি এইসব ফন্ট প্রচলিত সাধারণ কাগজের বইয়ে থাকা ফন্টগুলোর চাইতেও আকারে অনেক ছোট। একই কথা বলা হয় আরেকটি ওয়েব সাইটেও।[২২] সেখানে বলা হয় কিন্ডল ২ এর ফন্ট সাইজ প্রথম প্রজন্মের কিন্ডলের চাইতে অনেক ছোট ও অস্পষ্ট। এই সমস্যা সমাধানের জন্য আমাজন পরবর্তীতে ই-ইঙ্ক পার্ল প্রযুক্তির পর্দা ব্যবহার করা শুরু করে।
২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর আমাজন কিন্ডল ২ আন্তর্জাতিক সংস্করণের মূল্য হ্রাস করে ২৭৯ ডলার থেকে ২৫৯ ডলারে নির্ধারণ করে। একই সময়ে আমাজন কিন্ডল ২ এর উত্তর আমেরিকা সংস্করণও উৎপাদন ও বিক্রয় বন্ধ ঘোষণা করে। ২০১০ সালের ২১ জুন বার্নস এন্ড নোবেলস তাদের তৈরি ইবুক রিডার নুক এর দাম কমানোর মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে আমাজনও কিন্ডল ২ এর মূল্য কমিয়ে ১৮৯ ডলার পুনঃনির্ধারণ করে।
২০০৯ সালের ৬ মেতে আমাজন ইবুক পাঠযন্ত্রের নতুন সংস্করণ কিন্ডল ডিএক্সের ঘোষণা দেয়। কিন্ডল ডিএক্সের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল এর বড় পর্দা। এছাড়াও কিন্ডল ডিএক্সে পিডিএফ ফাইল পড়ার ব্যবস্থা ছিল। ইতোপূর্বে প্রচলিত সকল কিন্ডলের চাইতে কিন্ডল ডিএক্স ছিল পাতলা ও এই ইবুক পাঠযন্ত্রটিতে এক্সিলারোমিটার ছিল। এক্সিলারোমিটার থাকার ফলে কিন্ডলটিতে থাকা কোন ফাইল পড়ার সময় একজন পাঠক সহজেই আড়াআড়ি বা খাড়াভাবে ফাইলটি পড়তে পারতেন। কোন পাঠক যদি খাড়াভাবে কোন ফাইল পড়তে চান তবে কিন্ডলটি উলম্বভাবে চোখের সামনে ধরতে হত। অপারদিকে কোন ফাইল আনুভুমিকভাবে পড়তে চাইলে শুধুমাত্র কিন্ডলটিকে ভুমির সাথে আনুভুমিক করলেই ফাইলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আনুভুমিক হয়ে যেতো। আমাজনের দাবি অনুসারে এই সুবিধা থাকার ফলে কিন্ডল ডিএক্স ব্যবহার করে খুব সহজেই সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রিকা পড়া যাবে।[২৩] কিন্ডল ডিএক্স শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ভিক্তিক হুইসপারনেট ব্যবহার করে ইন্টারনেটে সংযুক্ত হতে পারতো। কিন্ডল ডিএক্সের পরবর্তী আন্তর্জাতিক সংস্করণগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্র ভিক্তিক সংস্করণগুলোর পার্থক্য বোঝা যেতো "B004" সিরিয়াল নাম্বার দিয়ে।[২৪]
২০১০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে কিন্ডল ডিএক্সের আন্তর্জাতিক সংস্করণ ১০০ টির মত দেশে বিপণন করা শুরু হয়।[২৫] কিন্ডল ডিএক্সে ৯.৭ ইঞ্চি মাপের ই-ইঙ্ক পর্দা ব্যবহার করা হয়েছে। ডিএক্স থ্রিজি তারবিহীন নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে পারে ও এর ক্রমিক শুরু হয় "B005"।[২৪]
২০১০ সালের জুলাই মাসে আমাজন; কিন্ডল ডিএক্স গ্রাফাইট বের করে। গ্রাফাইট কিন্ডল ডিএক্স সংস্করণটির উন্নততর সংস্করণ ছিল। কিন্ডল ডিএক্সের তুলনায় কিন্ডল ডিএক্স গ্রাফাইট অধিকতর উন্নত সংস্করণ হলেও আমাজন গ্রাফাইটের মূল্য কমিয়ে ৩৭৯ ডলার নির্ধারণ করে। গ্রাফাইটে ই-ইঙ্ক পার্ল পর্দা ব্যবহার করা হয়। ই-ইঙ্ক পার্ল পর্দার ব্যবহার হওয়ায় গ্রাফাইটের কন্ট্রাস্ট রেশিও কিন্ডল ডিএক্সের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি পাওয়া যায়। কিন্ডল ডিএক্স গ্রাফাইট শুধুমাত্র একটি রং; গ্রাফাইটে পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় ডিএক্স গ্রাফাইটের রং গ্রাফাইট হওয়ার কারণে এর ব্যবহারকারীরা কোন কিছু পড়ার সময় কিন্ডল ডিএক্সের তুলনায় অধিকতর কন্ট্রাস্ট রেশিও অণুভব করেন। কেননা ইতিপূর্বে কোন কোন ব্যবহারকারী কিন্ডল ডিএক্সের মাধ্যমে কোন কিছু পড়ার সময় হালকা ধূসর বর্ণের পটভূমি অণুভব করতেন বলে অভিযোগ করেন।