আমিষ মানবদেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান।[১] এটি দেহকলার গাঠনিক উপাদানগুলোর একটি এবং জ্বালানির উৎস হিসেবেও কাজ করতে পারে। জ্বালানি হিসেবে আমিষ শর্করার সমপরিমাণ শক্তি ঘনত্ব প্রদান করে: প্রতি গ্রামে ৪ কিলোক্যালরি (১৭ কিলোজুল)। এর বিপরীতে স্নেহপদার্থ বা চর্বি প্রতি গ্রামে ৯ কিলোক্যালরি বা ৩৭ কিলোজুল শক্তি প্রদান করে। পুষ্টিগত দৃষ্টিকোণ থেকে আমিষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ও সংজ্ঞাসূচক বৈশিষ্ট্য হল এর ভেতরে অ্যামিনো অ্যাসিডসমূহের সংযুক্তি।[২]
আণবিক জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে আমিষ বা প্রোটিন হল পেপটাইড বন্ধনসমূহ দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত অ্যামিনো অ্যাসিডের পলিমার শৃঙ্খল। মানব পরিপাকের সময় পাকস্থলীতে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড ও প্রোটিয়েজ নামক উৎসেচকের ক্রিয়ার ফলে আমিষ অণুগুলো ভেঙে অনেকগুলো ক্ষুদ্রতর পলিপেপটাইড শৃঙ্খলে পরিণত হয়। মানবদেহ অত্যাবশ্যকীয় অ্যামিনো অ্যাসিডগুলো জৈবসংশ্লেষ করতে পারে না, তাই খাদ্য হিসেবে গৃহীত আমিষে অবস্থিত এই অ্যামিনো অ্যাসিডগুলো শোষণ হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।[৩]
মানুষকে তাদের খাদ্য থেকে অবশ্যই নয়টি অত্যাবশ্যকীয় অ্যামিনো অ্যাসিড আহরণ করতে হয়, যাতে প্রোটিন-শক্তি অপুষ্টি এর পরিণামে মৃত্যু প্রতিরোধ করা যায়। এই নয়টি অ্যামিনো অ্যাসিড হল ফিনাইল-অ্যাালানিন, ভ্যালিন, থ্রিওনিন, ট্রিপ্টোফ্যান, মেথিওনিন, লিউসিন, আইসোলিউসিন, লাইসিন এবং হিস্টিডিন।[২][৪] অত্যাবশ্যকীয় অ্যামিনো অ্যাসিডের সংখ্যা ৮ নাকি ৯, এ নিয়ে বিতর্ক হয়েছে।[৫] বর্তমানে আপাতদৃষ্টিতে ঐকমত্য ৯টি অ্যামিনো অ্যাসিডের পক্ষে, কেননা হিস্টিডিন প্রাপ্তবয়স্ক মানবদেহে সংশ্লেষিত (তৈরি) হয় না।[৬] অন্যদিকে, মানবদেহ পাঁচটি অ্যামিনো অ্যাসিড সংশ্লেষণ করতে সক্ষম। এগুলি হল অ্যালানিন, অ্যাসপার্টিক অ্যাসিড, অ্যাস্পারাজিন, গ্লুটামিক অ্যাসিড এবং সেরিন। এছাড়া ছয়টি শর্তসাপেক্ষ অত্যাবশ্যকীয় অ্যামিনো অ্যাসিড আছে, যেগুলির সংশ্লেষণ বিশেষ রোগ-শারীরবৈজ্ঞানিক অবস্থায় সীমিত হতে পারে, যেমন নবজাতকের প্রাক-পরিপক্কতা কিংবা গুরুতর অপচিতিমূলক সংকটাবস্থায় আক্রান্ত ব্যক্তিসমূহের দেহে। এই ছয়টি অ্যামিনো অ্যাসিড হল আর্জিনিন, সিস্টেইন, গ্লাইসিন, গ্লুটামিন, প্রোলিন এবং টাইরোসিন।[২] আমিষের খাদ্য উৎসগুলির মধ্যে আছে মাংস, দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যাদি, মাছ, ডিম, শস্যদানা, শিম ও শুঁটিজাতীয় উদ্ভিদ, বাদাম[৭] এবং ভক্ষণযোগ্য কীটপতঙ্গ।
উৎস অনুযায়ী আমিষকেকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
১ গ্রাম আমিষ থেকে চার কিলোক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়। দৈনিক প্রয়োজনীয় ক্যালরির ২০-২৫ ভাগ আমিষ জাতীয় খাদ্য থেকে গ্রহণ করা উচিত। প্রতিদিন খাবারে উদ্ভিজ্জ আমিষের পাশাপাশি কিছু প্রাণিজ আমিষও গ্রহণ করতে হবে।
আমাদের দেহের অস্থি, পেশী, বিভিন্ন দেহযন্ত্র, রক্ত কণিকা থেকে শুরু করে দাঁত, চুল, নখ পর্যন্ত প্রোটিন দিয়ে গঠিত। আমিষ শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধি সাধন ও দেহ গঠন করে। আমাদের দেহের কোষগুলো প্রতিনিয়তই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এই ক্ষয়প্রাপ্ত স্থানে নতুন কোষগুলো গঠন করে ক্ষয়পূরণ করতে ও কোনো ক্ষতস্থান সারাতে প্রোটিনের ভূমিকা রয়েছে। যখন দেহে চর্বি ও শর্করার অভাব দেখা যায় তখন প্রোটিন তাপশক্তি উৎপাদনের কাজ করে। রোগ সৃষ্টিকারী রোগজীবাণুকে প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের দেহে তাদের প্রতিরোধী পদার্থ বা অ্যান্টিবডি তৈরী করা আমিষের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। মানসিক বিকাশ বা মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য আমিষ অপরিহার্য।
দেহে আমিষেরর অভাব হলে বর্ধনরত বয়সের শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। দীর্ঘদিন ধরে খাদ্যে আমিষের ঘাটতি থাকলে কোয়াশিয়রকর রোগ হয়। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, মেধা ও বুদ্ধি কমে যায়। তাই আমিষ জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করা প্রয়োজন।