এই নিবন্ধে একাধিক সমস্যা রয়েছে। অনুগ্রহ করে নিবন্ধটির মান উন্নয়ন করুন অথবা আলাপ পাতায় বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করুন।
|
মুফতী আমীমুল ইহসান | |
---|---|
জন্ম | ১৯১১ পাঁচনা, মুঙ্গ, বিহার প্রদেশ, ব্রিটিশ ভারত |
মৃত্যু | ২৭ অক্টোবর ১৯৭৪ ঢাকা, বাংলাদেশ |
উপাধি | মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফকীহ, মুফতিয়ে আযম |
উচ্চশিক্ষায়তনিক কর্ম | |
বিদ্যালয় বা ঐতিহ্য | হানাফি |
প্রধান আগ্রহ | তাফসির, হাদিস ও ফিকহ শাস্ত্র |
উল্লেখযোগ্য কাজ |
|
মুফতী সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান বারকাতী (আরবি: مفتى سيد محمد عميم الاحسان بركتى) ছিলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট মুসলিম পণ্ডিত। তিনি কলকাতা আলিয়া ও ঢাকা আলিয়ায় শিক্ষকতা করেছিলেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমের প্রথম খতিব (১৯৬৪-১৯৭৪) ছিলেন।[১] তার বই আরব বিশ্বে ও উপমহাদেশের বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠ্য পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এবং বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ও ইসলামের ইতিহাস বিভাগের সিলেবাস ভুক্ত রয়েছে।[২]
আমীমুল ইহসান ১৯১১ সালের ২৪ জানুয়ারি (হিজরী: ২২ মুহাররম ১৩২৯) ভারতের বিহার প্রদেশের মুঙ্গের জেলার অন্তর্গত পাঁচনা নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হাকিম আবদুল মান্নান এবং মায়ের নাম সৈয়দা সাজেদা। আমীমুল ইহসান চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন। পিতা ও মাতা উভয় সূত্রেই তিনি নাজিবুত্তারাফাইন। জন্মের পর মুফতী সাহেবের নাম রাখা হয় মুহাম্মাদ এবং লকব 'আমীমুল ইহসান'। তার দাদা সাইয়্যেদ নুরুল হাফেয আল-কাদেরিও একজন আধ্যাত্মিক সাধক ছিলেন। তিনি কুরআনের বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তিনি মাওলানা মোহাম্মদ আলী আল-কাদেরী আল মোজাদ্দেদী আল মুংগেরীর একজন খলীফা ছিলেন।[৩] তার বংশ-তালিকা ফাতেমা-মুহাম্মাদ পর্যন্ত পৌঁছেছে বিধায় তার পূর্ব-পুরুষগণ নামের পূর্বে ‘সাইয়্যেদ’ শব্দ ব্যবহার করেছেন।[৪][ক]
আমীমুল ইহসান তার পিতা ও চাচার নিকট থেকে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি পাচ বছর বয়সে মাত্র তিন মাস সময়ের মধ্যে তার চাচা আবদুদ দাইয়ানের নিকট হতে ৩০ পারা কুরআন খতম করেন। এরপর আবদুদ দাইয়ান তাকে ফার্সি ভাষা শেখান। এরপর তিনি পাঞ্জাবের সাধক সুফি বরকত আলীর নিকট দুই বছর ধরে আরবী ব্যাকরণের মীজান মুনশায়ের, উচ্চতর ফার্সী সাহিত্য ও তাজবীদের প্রাথমিক জ্ঞান গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে আমীমুল সুফি বরকত আলীর মুরীদ হন। এজন্য আমীমুল ইহসান নিজ নামের শেষে ‘বারকাতী’ শব্দটি যুক্ত করেন।
দশ বছর বয়সে ১৯২১ সালে তিনি তার সুফি বরকত আলীর নিকট কুরআন মাজীদের অনুবাদ, সুফী মতবাদ সম্পর্কিত বই-পুস্তক, ইলমে সরফ, তাফসীর, হেসনে হাসিন ও ফার্সি সাহিত্যের উচ্চতর গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করেন।[৫]
১৯২৬ সালে পনের বছর বয়সে ইহসান কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। তিনি ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে আলিম পরীক্ষায় হাদীস বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হন। এরপর ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে ফাযিল ও ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে হাদীস বিষয়ের উপর কামিল পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন এবং “মুমতাজুল মুহাদ্দিসিন” উপাধি লাভ করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি তার ওস্তাদ মুফতী মুশতাক আহমেদ কানপুরীর নিকট থেকে মুফতী সনদ লাভ করেন।
আমীমুল ইহসান ১৯২৫ সালে তার পিতার মৃত্যুর ২ বছর পূর্বে পারিবারিক চিকিৎসালয় পরিচালনা ও প্রেস পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এবং পাশাপাশি স্থানীয় জালুয়াটুলী গ্রামের মসজিদের ইমামের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৩৪ সালে তাকে কলকাতার নাখোদা মাদ্রাসার মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক ও নাখোদা মসজিদের সহকারী ইমাম পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৩৫ সালে নাখোদা মাদ্রাসা দারুল ইফতার প্রধান মুফতীর দায়িত্ব দেয়া হয়, তিনি এই দায়িত্ব ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পালন করেন। ১৯৩৫ সালে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল থেকে গ্রান্ড মুফতী অফ কলকাতা নামে এক বিশেষ সীলমোহর ও পদবি প্রদান করা হয়। এরপর থেকে তিনি 'মুফতী-এ-আযম' উপাধি লাভ করেন।
১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ সরকার তাকে মধ্য কলকাতার কাজী পদে নিয়োগ করেন। এই সময় তিনি একাধারে নাখোদা মসজিদের ইমামত, মসজিদ সংলগ্ন মাদ্রাসায় অধ্যাপনার দায়িত্ব এবং কাজী পদের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। ১৯৪০ সালে তিনি আঞ্জুমানে কুররায়ে বাংলার (বাংলার ক্বারী সমিতি) সভাপতি নিযুক্ত হন। ১৯৪৩ সালে তিনি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষকতার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৪৩ সাল থেকে ভারত বিভাজন (১৯৪৭) পর্যন্ত তিনি টাইটেল কামিল ক্লাসে হাদীস, তাফসীর, ফিকাহ এবং ফাযিল শ্রেণীতে উর্দু-ফার্সী শিক্ষা দিতেন। এছাড়াও তিনি কলিকাতার কেন্দ্রীয় ঈদগাহে ইমামতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর আমীমুল ইহসান ২২ আগস্ট কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন। ১৯৪৭ সালে আলিয়া মাদ্রাসা ঢাকায় স্থানান্তরিত হলে তিনি এই দেশে চলে আসেন, এবং ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যাপনার কাজে যুক্ত হন। ১৯৪৯ সালে তৎকালীন সরকার তাকে ধর্মীয় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মনোনীত করেন। ১৯৫৫ সালে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার হেড মাওলানা, জাফর আহমদ উসমানী অবসর গ্রহণের পর আমীমুল ইহসান সেই পদে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ পান। এরপর তিনি ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত স্থায়ীভাবে সেই পদে নিযুক্ত ছিলেন।
আলিয়া মাদ্রাসায় কর্মরত অধ্যাপক হিসাবে তিনি ব্যাখ্যাসহ বুখারী শরীফ পড়াতেন। তার নিজের উক্তি হইতে জানা যায়, তিনি কমপক্ষে পঁচিশবার বুখারী শরীফের প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত পড়িয়েছেন। কয়েক হাজার হাদীস তার কণ্ঠস্থ ছিল, তিনি লেখালিখির কাজে সময় দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করায় ১৯৬৯ সালের ১ই অক্টোবর উক্ত পদ হতে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ ও আলেমে দ্বীন মোহাম্মাদ ফখরুদ্দীন রহ অন্যতম।
১৯৬৪ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে কাবা শরীফের গেলাফ প্রস্তুত করে ঢাকায় প্রদর্শনীর জন্য আনা হয়। তখন এই গেলাফটি প্রদর্শনীর দায়িত্বে ছিলেন মুফতি মুহাম্মাদ গোফরান বারকাতী ও আমীমুল ইহসান বারকাতী।
১৯৬৪ সালে বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদ প্রতিষ্ঠার পর তৎকালীন কমিটির চেয়ারম্যান ইয়াহিয়া বাওয়ানীর অনুরোধে এবং মসজিদ কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে তিনি সেই মসজিদের খতীবের এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত এই দায়িত্বে বহাল ছিলেন। অনেক আরবী ভাষা-ভাষী উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ ও রাষ্ট্রনায়কও তার খুৎবার প্রশংসা করেছেন। এছাড়াও তিনি ১৯৫৫ সালে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসায় হেড মাওলানার পদে উন্নীত হবার পর তৎকালীন ঢাকার প্রধান ঈদগাহ পুরানা পল্টন ময়দান ঈদগাহে ইমামতি করেছেন।[৬]
১৯৪৭ সালে তিনি ঢাকায় এসে একটি ভাঙ্গা মসজিদের খবর পান, এবং মসজিদটিকে পুনর্নির্মাণ করে নামকরণ করেন নকশবন্দী মসজিদ, তবে ১৯৯৪ সালে মসজিদটিকে সম্পূর্ণ নতুন ভিত্তিতে গড়ে তুলে নাম দেওয়া হয় মসজিদে মুফতী-এ আযম। আমীমুল ইহসান ঢাকায় এসে এই মসজিদের নিকটেই বাড়ি তৈরি করে আমৃত্যু পর্যন্ত বাস করেছিলেন।
মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান ইলমে তাসাউফের প্রানসাধক ছিলেন। প্রাথমিক জীবনে তিনি তার চাচা মুহাম্মাদ আব্দুদ দাইয়ান বারাকাতী এবং শ্বশুর মুহাম্মাদ সুফি বরকত আলীর নিকট থেকে বিভিন্ন তরীকতের ইজাজাত গ্রহণ করেন। ঢাকায় আগমনের পর শাহ সাইয়েদ আবদুস সালাম আহমদের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন। এরপরে তিনি নকশবন্দি বারকাতীয়া তরিকা প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন।
সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান বারকাতী ২০০ এর অধিক গ্রন্থ রচনা করেন। উল্লেখযোগ্যগুলো হলোঃ[৭]:
হযরত মুফতী সাহেবের অনেক গ্রন্থ মাদ্রাসার পাঠ্য তালিকাভুক্ত। তার প্রধান গ্রন্থসমূহ যেমনঃ ফিকহুস সুনানে ওয়াল আসার, সীরাতে হাবিবে ইলাহ, তারীখে ইলমে ফিকাহ, তারীখে ইসলাম, তারীখে ইলমে হাদীস, আদাবুল মুফতী, কাওয়ায়েদুল ফিকাহ, মীযানুল আখবার, মিয়ারুল আসার প্রভৃতি মিসরের জামে আল আজহার, ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দসহ, পাকিস্তান, সিরিয়া, মিসর ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের সকল কওমী, আলিয়া মাদ্রাসা গুলোতে পাঠ্য বই হিসাবে পড়ানো হয়।
এছাড়াও তার রচিত “কিতাবুল আওকাত” এর উপর ভিত্তি করেই ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ তার রচিত নামাযের সময়সূচি অনুযায়ী বর্তমানে সারা বাংলাদেশে নামাযের সময় ও ওয়াক্ত নির্ধারণ করা হয়।
আমীমুল ইহসান ১৯২২ সালে মায়মুনার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন; এই স্ত্রী ১৯২৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। অতঃপর তিনি ১৯৩০ সালে ফাতেমার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন; এই স্ত্রীও ১৯৩৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর ১৯৩৮ সালে আমীমুল ইহসান খাদিজাকে বিয়ে করেন; যিনি ১৯৮৫ সালে মারা যান। দ্বিতীয় স্ত্রী ফাতেমার গর্ভে তার এক পুত্র এবং এক কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। কন্যা আমেনা খাতুন ১৯৯১ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
আমীমুল ইহসান অবসরে বই পড়তে পছন্দ করতেন। তার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে ছিল সাড়ে তিন হাজারের অধিক বিভিন্ন ইসলামী বই ছিলো। এরমধ্যে কিছু প্রাচীন ও দুর্লভ কিতাব তিনি সংগ্রহ করেছিলেন তার পীর, শিক্ষক ও শশুরের নিকট থেকে।
আমীমুল ইহসান জীবনে তিনবার হজ্জ পালন করেছেন। সর্বপ্রথম এবং ফরয হজ্জ আদায় করেন ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে, এরপর ১৯৬৮ সালে তিনি দ্বিতীয়বার সস্ত্রীক হজ্ব পালন করেন এবং ১৯৭১ সালে তৃতীয়বার হজ্জ পালন করেন।
মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান বারকাতী ১৯৭৪ সালের ২৭ অক্টোবর (হিজরী: ১০ শাওয়াল ১৩৯৫) সালে ৬৩ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত কারনে নিজ বাস ভবনে মৃত্যুবরণ করেন।
ইসলামের সেবায় ও দাওয়াতি কার্যক্রমে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালে তাকে মরণোত্তর স্বর্ণপদক ও সনদ দান করেন।