আর. কে. নারায়ণ | |
---|---|
জন্ম | রাসীপুরম কৃষ্ণস্বামী আইয়ার নারায়ণস্বামী ১০ অক্টোবর ১৯০৬ মাদ্রাজ, ব্রিটিশ ভারত |
মৃত্যু | ১৩ মে ২০০১ চেন্নাই | (বয়স ৯৪)
পেশা | লেখক |
জাতীয়তা | ভারতীয় |
ধরন | কথাসাহিত্য, পৌরাণিক সাহিত্য, গদ্যসাহিত্য |
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার | পদ্মবিভূষণ, সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার, এসি বেনসন মেডেল |
আত্মীয় | আর. কে. লক্ষ্মণ (ভাই) |
আর. কে. নারায়ণ (১০ অক্টোবর, ১৯০৬ – ১৩ মে, ২০০১) ছিলেন একজন ভারতীয় লেখক। কাল্পনিক দক্ষিণ ভারতীয় শহর মালগুডির পটভূমিকায় লেখা তার রচনাগুলির জন্য তিনি সর্বাধিক পরিচিত। তার পুরো নামটি হল রাসীপুরম কৃষ্ণস্বামী আইয়ার নারায়ণস্বামী। ইংরেজি ভাষায় ভারতীয় সাহিত্যের প্রথম যুগের তিন জন পুরোধা ব্যক্তিত্বের অন্যতম ছিলেন নারায়ণ (অন্য দুজন ছিলেন মুল্ক রাজ আনন্দ ও রাজা রাও)। তারাই এই সাহিত্যকে বিশ্বে সুপরিচিত করে তুলেছিলেন।
নারায়ণ তার পরামর্শদাতা ও বন্ধু গ্রাহাম গ্রিনের সাহায্যে আত্মপ্রকাশ করেন। গ্রিনই তার প্রথম চারটি বইয়ের জন্য প্রকাশক সংগ্রহে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এই চারটি বইয়ের মধ্যে তিনটি আংশিক আত্মজীবনীমূলক বই স্বামী অ্যান্ড ফ্রেন্ডস্, দ্য ব্যাচেলর অফ আর্টস্ ও দি ইংলিশ টিচার অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া তার অপর রচনা দ্য ফাইনান্সিয়াল এক্সপার্ট ১৯৫১ সালে অন্যতম সর্বাধিক মৌলিক রচনা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। তার অপর একটি রচনা দ্য গাইড বইটির জন্য তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হন। এই বইটি অবলম্বনে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ও একটি ব্রডওয়ে নাটক মঞ্চস্থ হয়।
নারায়ণের গল্পগুলির অধিকাংশেরই পটভূমি মালগুডি নামক কাল্পনিক শহরটি। স্বামী অ্যান্ড ফ্রেন্ডস্ বইতে এই শহরের প্রথম উল্লেখ দেখা যায়। তার গল্পগুলিতে সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতটি আলোচিত হয়েছে। চরিত্রগুলির দৈনন্দিন জীবন এগুলিতে সহানুভূতির সঙ্গে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তাকে উইলিয়াম ফকনারের সঙ্গে তুলনা করা হয়। ফকনারও তার রচনায় সত্যিকারের শহরের আদলে একটি কাল্পনিক শহর গড়ে তুলেছিলেন, সাধারণ জীবনের মধ্যে থেকে হাস্যরস ও জীবনীশক্তি বের করে এনেছিলেন এবং মানবতাবাদের প্রতি গভীর সহানুভূতি ব্যক্ত করেছিলেন। নারায়ণের ছোটোগল্প লেখার ভঙ্গিটিকে গাই দে মঁপাসার গল্পরচনার ভঙ্গিটির সঙ্গে তুলনা করা হয়। উভয়েই গল্পের উপাদানগুলির আকর্ষণীয়তা বজায় রেখে গল্পরচনায় দক্ষ ছিলেন। গদ্য ও ভাষ্যের অতিসরলীকরণের জন্য নারায়ণ সমালোচিতও হয়েছেন।
নারায়ণের লেখক জীবন ষাট বছরেরও বেশি সময় জুড়ে পরিব্যাপ্ত। তিনি একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। এগুলির মধ্যে রয়্যাল সোসাইটি অফ লিটারেচারের এসি বেনসন মেডেল, ভারতের তৃতীয় ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা যথাক্রমে পদ্মভূষণ ও পদ্মবিভূষণ উল্লেখযোগ্য।[১] তিনি ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য হয়েছিলেন।
আর. কে. নারায়ণ ব্রিটিশ ভারতের মাদ্রাজ (অধুনা চেন্নাই) শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।[২] তার বাবা ছিলেন একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। সেই বিদ্যালয়ে নারায়ণও কিছুদিন পড়াশোনা করেছিলেন। তার বাবার বদলির চাকরির সূত্রে নারায়ণ তার ছেলেবেলায় একটি অংশ তার দিদিমা পার্বতীর যত্নে কাটিয়েছিলেন।[৩] এই সময় তার বন্ধু ও খেলার সঙ্গী ছিল একটি ময়ূর ও একটি দোষ্টু বাঁদর।[৪][৫][৬]
নারায়ণের দিদিমা তার ডাকণাম রেখেছিলেন ‘কুঞ্জাপ্পা’। তার পরিবারের সকলে তাকে এই নামেই ডাকতেন।[৭] দিদিমার কাছে তিনি পাটিগণিত, পুরাণ, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করেছিলেন।[৮] নারায়ণের ছোটো ভাই আর. কে. লক্ষ্মণ বলেছিলেন যে, তার পরিবারের সকলে প্রধানত ইংরেজিতেই কথাবার্তা চালাতেন। নারায়ণ ও তার ভাইবোনেদের ব্যাকরণগত ভুলগুলি সম্পর্কে তারা উন্নাসিক ছিলেন।[৯] দিদিমার কাছে থাকার সময় নারায়ণ একাধিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। এর মধ্যে রয়েছে পুরসওয়ালকমের লুথারান মিশন স্কুল,[১০] সি. আর. সি. হাইস্কুল ও ক্রিস্টিয়ান কলেজ হাইস্কুল।[১১] নারায়ণ ছিলেন একজন উৎসাহী পাঠক। প্রথম জীবনে তিনি চার্লস ডিকেন্স পি. জি. উডহাউস, আর্থার কোনান ডয়েল ও টমাস হার্ডির রচনা থেকে অণুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন।[১২] বারো বছর বয়সে নারায়ণ স্বাধীনতার দাবিতে একটি পদযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন। এই জন্য তার মামা তাকে বকেন। কারণ, তার পরিবার ছিল অরাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী এবং তারা সব সরকারকেই দোষ্ট মনে করতেন।[১৩]
নারায়ণের বাবা যখন মহারাজা’স কলেজ হাইস্কুলে বদলি হয়ে যান, তখন নারায়ণ তার পরিবারের সঙ্গে মহীশূরে চলে আসেন। এই বিদ্যালের গ্রন্থাগারটি ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। তার বাবারও বইয়ের একটি বিশাল সংগ্রহ ছিল। নারায়ণের বই পড়ায় বিশেষ আগ্রহ থাকায় এতে তার সুবিধাই হয়। এই সময় তিনি লেখালিখিও শুরু করেন। উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করার পর নারায়ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় অণুত্তীর্ণ হন। এই সময় এক বছর তিনি বাড়িতে থেকে পড়াশোনা ও লেখালিখি করতে থাকেন। ১৯২৬ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি মহারাজা কলেজ অফ মাইসোরে যোগদান করেন। সাধারণত তিন বছরে স্নাতক পাঠক্রমের পড়াশোনা শেষ হলেও, নারায়ণের এই পাঠক্রম শেষ করতে চার বছর লেগেছিল। তার এক বন্ধু তাকে বলেছিলেন, স্নাতকোত্তর পাঠক্রমে পড়াশোনা করলে সাহিত্যের প্রতি তার আগ্রহ কমে যাবে। তাই তিনি পড়াশোনা ছেড়ে কিছু সময়ের জন্য বিদ্যালয় শিক্ষকের চাকরি গ্রহণ করেন। কিন্তু সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাকে শারীরশিক্ষার দায়িত্বে নিয়োগ করতে চাইলে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন।[১০] এই অভিজ্ঞতা থেকে নারায়ণ উপলব্ধি করেন যে, তার একমাত্র কর্মজীবন লেখালিখির ক্ষেত্রেই হওয়া সম্ভব। তিনি বাড়িতে থেকে উপন্যাস রচনা করবেন বলে মনস্থির করেন।[১৪][১৫] তার প্রথম প্রকাশিত রচনাটি ছিল ডেভেলপমেন্ট অফ মেরিটাইম লজ অফ সেভেনটিনথ সেঞ্চুরি ইংল্যান্ড নামে একটি বইয়ের সমালোচনা।[১৬] এরপর তিনি ইংরেজি সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রপত্রিকায় মাঝে মাঝে স্থানীয় বিষয় অবলম্বনে গল্প লিখতে শুরু করেন। লেখালিখি করে তিনি বিশেষ উপার্জন করতেন না (প্রথম বছরে তার আয় ছিল নয় টাকা বারো আনা মাত্র)। কিন্তু তার পরিবার ও বন্ধুবান্ধবেরা তার এই প্রথাবহির্ভূত কর্মজীবন নির্বাচনের ব্যাপারটিকে শ্রদ্ধা ও সমর্থন করতেন।[১৭] ১৯৩০ সালে নারায়ণ তার প্রথম উপন্যাস স্বামী অ্যান্ড ফ্রেন্ডস্ রচনা করেন।[১৬] তার মামা এই প্রয়াসটিকে পরিহাস করেছিলেন।[১৮] প্রথম দিকে প্রকাশকরাও এটি ছাপতে চাননি।[৯] এই বইতেই নারায়ণ মালগুডি নামে একটি শহরের কল্পনা করেছিলেন। এই শহরটি ছিল দেশের সামাজিক পরিস্থিতির একটি সুন্দর উপস্থাপনা। এখানে ঔপনিবেশিক শাসনের আরোপিত সীমাবদ্ধতাগুলি উপেক্ষিত হয়েছিল এবং শহরটি গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ ও স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে।[১৯]
১৯৩৩ সালে কোয়েম্বাটোরে বোনের বাড়িতে ছুটি কাটাতে গিয়ে নারায়ণের সঙ্গে রাজাম নামে স্থানীয় একটি ১৫ বছরের মেয়ের আলাপ হয়। তিনি মেয়েটির প্রেমে পড়ে যান। জ্যোতিষ ও আর্থিক বাধা সত্তেও তিনি মেয়েটির বাবার থেকে অনুমতি গ্রহণে সমর্থ হন এবং মেয়েটিকে বিয়ে করেন।[২০] বিয়ের পর নারায়ণ দ্য জাস্টিস নামে একটি মাদ্রাজ-ভিত্তিক সংবাদপত্রে সাংবাদিকতা শুরু করেন। এই সংবাদপত্রটির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অব্রাহ্মণদের অধিকার নিয়ে আন্দোলন করা। নারায়ণের মতো একজন ব্রাহ্মণ আইয়ার তাদের হয়ে কথা বলছেন দেখে প্রকাশকরা আশ্চর্য হয়ে যান। এই সংবাদপত্রে কাজ করার সময় নারায়ণ বিভিন্ন ধরনের মানুষ ও বিষয়ের সংস্পর্শে আসেন।[২১] এর আগে নারায়ণ অক্সফোর্ডে তার এক বন্ধুর কাছে স্বামী অ্যান্ড ফ্রেন্ডস্ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েছিলেন। এই সময় সেই বন্ধুটি সেই পাণ্ডুলিপি গ্রাহাম গ্রিনকে দেখান। গ্রিন এই বইটি তার প্রকাশকের কাছে পাঠিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৩৫ সালে বইটি প্রকাশিত হয়।[৪] এছাড়া ইংরেজি-ভাষী পাঠকমণ্ডলীর কাছে নিজেকে সুপরিচিত করার জন্য গ্রিন নারায়ণকে তার নামটি ছোটো করার পরামর্শ দেন।[২২] স্বামী অ্যান্ড ফ্রেন্ডস্ ছিল একটি আংশিক আত্মজীবনীমূলক রচনা। নিজের ছেলেবেলায় দেখা অনেক ঘটনার ভিত্তিতে নারায়ণ এই বইখানি লিখেছিলেন।[২৩] সমালোচকরা বইটির প্রশংসা করলেও বইটি তেমন বিক্রি হয়নি। নারায়ণের পরবর্তী উপন্যাস দ্য ব্যাচেলর অফ আর্টস্ (১৯৩৫) ছিল অংশত তার কলেজ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া।[২৪] এই উপন্যাসে দেখা যায় এক বিদ্রোহী কিশোর কীভাবে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিতে পরিণত হচ্ছে।[২৫] এই উপন্যাসটির জন্যেও গ্রিন প্রকাশক সংগ্রহ করেছিলেন। বইটি একাধিক প্রকাশক প্রকাশ করেন। নারায়ণের তৃতীয় উপন্যাস দ্য ডার্ক রুম (১৯৩৮) ছিল একটি গৃহবিবাদ সংক্রান্ত রচনা।[২৬] এই উপন্যাসে পুরুষকে দমনশীল ও নারীকে বিবাহের শিকার রূপে দেখানো হয়েছে। অপর একটি প্রকাশক এই উপন্যাসটি প্রকাশ করেন। এটিও সমালোচকদের দ্বারা প্রশংসিত হয়। ১৯৩৭ সালে নারায়ণের বাবা মারা যান। সেই সময় তার আর্থিক সংকট থাকায় তিনি মহীশূরের সরকারের থেকে একটি ভাতা নিতে বাধ্য হন।[২৭]
প্রথম তিনটি বইতে নারায়ণ দেখিয়েছিলেন নির্দিষ্ট সামাজিক ব্যবস্থায় উত্থিত সমস্যাগুলিকে। প্রথম বইতে তিনি ছাত্রজীবনের সমস্যা, শ্রেণিকক্ষে বেত্রাঘাত ও তার ফলে উত্থিত লজ্জার বিষয়টি তুলে ধরেন। হিন্দু বিবাহে কোষ্ঠীবিচার ও তার ফলে স্বামী ও স্ত্রীর জীবনে মানসিক ভার দ্বিতীয় বইটির মূল উপজীব্য ছিল। তৃতীয় বইতে নারায়ণ দেখিয়েছিলেন স্বামীর ব্যবহার ও দৃষ্টিভঙ্গি একজন স্ত্রীর পক্ষে মানিয়ে নেওয়ার সমস্যার বিষয়টিকে।[২৮]
১৯৩৯ সালে টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হয়ে রাজাম মারা যান।[২৯] তার মৃত্যুতে নারায়ণ গভীরভাবে শোকাহত হন এবং দীর্ঘকাল অবসাদে ভোগেন। তিনি তার তিন বছর বসয়ী মেয়ে হেমাকে নিয়েও চিন্তিত ছিলেন। পত্নীবিয়োগের শোক তার জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনে। এই ঘটনা থেকে অণুপ্রাণিত হয়ে তিনি তার পরবর্তী উপন্যাস দি ইংলিশ টিচার রচনা করেন।[১৬] প্রথম দুটি বইয়ের মতো এই বইটিও ছিল আত্মজীবনীমূলক। শুধু তাই নয় এটি স্বামী অ্যান্ড ফ্রেন্ডস্ ও দ্য ব্যাচেলর অফ আর্টস্ গ্রন্থদুটিকে নিয়ে একটি স্বতঃসিদ্ধ বিষয়গত উপন্যাসত্রয়ীর ধারাটিকে সম্পূর্ণ করে।[৩০][৩১] পরবর্তীকালের সাক্ষাৎকারগুলিতে নারায়ণ জানিয়েছিলেন যে, দি ইংলিশ টিচার প্রায় সম্পূর্ণত আত্মজীবনীমূলত। যদিও চরিত্রগুলির নাম তিনি পালটে দিয়েছিলেন এবং গল্পটিকে মালগুডির পটভূমিতে উপস্থাপিত করেছিলেন। তিনি আরও জানিয়েছিলেন যে, এই বইতে তিনি যে ভাবাবেগ ব্যক্ত করেন, তা আসলে ছিল রাজামের মৃত্যুর পর তার নিজের অনুভূতির প্রতিফলন।[৩২]
নিজের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৪০ সালে নারায়ণ ইন্ডিয়ান থট নামে একটি পত্রিকার কাজে হাত দেন।[৩৩] গাড়িবিক্রেতা মামার সহায়তায় তিনি শুধুমাত্র মাদ্রাজ শহরেই এক হাজারেরও বেশি পাঠক জোগাড় করে ফেলেন। কিন্তু নারায়ণ বেশিদিন এই কাজ চালিয়ে যেতে পারেননি। এক বছরের মধ্যেই এই পত্রিকাটি উঠে যায়।[৩৪] তার প্রথম ছোটোগল্প সংকলন মালগুডি ডেজ প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে। এরপর ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত হয় দি ইংলিশ টিচার। এই সময় যুদ্ধের কারণে ইংল্যান্ডের সঙ্গে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেই জন্য তিনি নিজের একটি প্রকাশন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংস্থার নাম রাখেন ইন্ডিয়ান থট পাবলিকেশনস। এই প্রকাশন সংস্থাটি সাফল্য অর্জন করে। এটি এখনও সক্রিয় রয়েছে। বর্তমানে নারায়ণের নাতনি এটি চালাচ্ছেন।[১৪] অনতিবিলম্বে নারায়ণের পাঠকমহল নিউ ইয়র্ক থেকে মস্কো পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তার বইয়ে বিক্রি বেড়ে যায়। ১৯৪৮ সালে তিনি মহীশূর শহরের উপকণ্ঠে নিজের বাড়ি তৈরির কাজে হাত দেন। বাড়িটি তৈরির কাজ শেষ হয় ১৯৫৩ সালে।[৩৫]
দি ইংলিশ টিচার রচনার পর থেকে নারায়ণের রচনা তার পূর্ববর্তী আংশিক আত্মজীবনীমূলক রচনাগুলির ভঙ্গিমার চেয়ে বহুরঙ্গে অনেক বেশি কাল্পনিক ও সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠে। তার পরবর্তী রচনা মিস্টার সম্পথ এই পরিবর্তিত প্রয়াসের প্রথম নিদর্শন। যদিও এক্ষেত্রেও তিনি তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা, বিশেষত তার নিজস্ব পত্রিকা চালু করার অভিজ্ঞতা থেকেই উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন। জীবনী-সংক্রান্ত ঘটনাগুলির মিশ্রণের মাধ্যমে তিনি তার পূর্ববর্তী উপন্যাসগুলির তুলনায় এই রচনাটিকে অন্য একটি মাত্রা দিয়েছিলেন।[৩৬] এরপরই তিনি প্রকাশ করেন দ্য ফাইনান্সিয়াল এক্সপার্ট। এটিকে তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা মনে করা হয়। ১৯৫১ সালে এটি সর্বাধিক মৌলিক কথাসাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছিল।[৩৭][৩৮] এই উপন্যাসের অণুপ্রেরণা ছিলেন ‘মারগায়য়া’ নামে এক অর্থনীতি বিশারদের সত্য ঘটনা। এই ঘটনার কথা তার ভাই তাকে শুনিয়েছিলেন।[৩৯] পরবর্তী উপন্যাস ওয়েটিং ফর দ্য মহাত্মা মহাত্মা গান্ধীর কাল্পনিক মালগুডি ভ্রমণের হালকা ভিত্তির উপর উপস্থাপিত। এই উপন্যাসে দেখা যায়, নায়ক যখন মহাত্মার ভাষণ শুনতে এসেছেন, তখন একটি নারীর প্রতি তিনি আকর্ষিত হচ্ছেন। ভারতী নামে এই নারী প্রকৃতপক্ষে ভারতমাতা ও গান্ধীর বক্তব্যের ব্যঙ্গরূপ। এই উপন্যাসে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রটি গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপিত হলেও এটির মূল উপজীব্য এক সাধারণ মানুষের জীবন। এটি নারায়ণ তার স্বভাবসিদ্ধ ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতেও বর্ণনা করেছেন।[৪০]
১৯৫৩ সালে তার রচনা প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত হয়। প্রকাশক ছিল মিচিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি প্রেস। পরে ১৯৫৮ সালে তিনি তার রচনার সত্ব ভাইকিং প্রেসকে প্রদান করেন।[৪১] নারায়ণ প্রায়শই সামাজিক পরিকাঠামো ও দৃষ্টিভঙ্গির বৈষম্য নিয়ে লেখালিখি করলেও তিনি নিজে ছিলেন একজন রক্ষণশীল হিন্দু। ১৯৫৬ সালে নারায়ণ তার কন্যার বিয়ে দিয়েছিলেন প্রথাগত হিন্দুধর্মের সমস্ত রীতিনীতি মেনেই।[৪২] মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পর নারায়ণ পর্যটন শুরু করেন। রাস্তায় যেতে যেতে তিনি দিনে অন্তত ১,৫০০ শব্দ লিখতেন।[৩৫] ১৯৫৬ সালে ফোকফেলার ফেলোশিপ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের সময় তিনি দ্য গাইড রচনা করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান কালে নায়ারণ দৈনিক দিনলিপি লিখে রাখতেন। পরে সেইটি অবলম্বনেই তিনি রচনা করেন মাই ডেটলেস ডায়েরি।[৪৩] এই সময়েই ইংল্যান্ড ভ্রমণকালে তিনি তার বন্ধু ও পরামর্শদাতা গ্রাহাম গ্রিনের সঙ্গে প্রথম বার সাক্ষাৎ করেন।[২৯] ভারতে প্রত্যাবর্তনের পর দ্য গাইড প্রকাশিত হয়। এই বইটি নারায়ণের দক্ষতা ও উপাদানের শ্রেষ্ঠ প্রতিফলন। এটির ভাবে রয়েছে একটি দ্বিধাগ্রস্থতা এবং সমাপ্তিও হয়েছে ধাঁধার মতো।[৪৪] এই বইটির জন্যই ১৯৫৮ সালে তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।[৪৫]
মাঝে মাঝে নারায়ণ তার চিন্তাভাবনার কথা প্রবন্ধের আকারে ব্যক্ত করতেন। তার কিছু কিছু সংবাদপত্র ও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়ছিল। কিছু কিছু প্রকাশিত হয়নি। নেক্সট সানডে (১৯৬০) এই ধরনের কথোপকথন মূলক প্রবন্ধের প্রথম সংকলন, যেটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।[৪৬] এর পরেই তিনি তার ১৯৫৬ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেন মাই ডেটলেস ডায়েরি গ্রন্থে। এই গ্রন্থের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল দ্য গাইড রচনা-সংক্রান্ত একটি প্রবন্ধও।[৪৩][৪৭]
নারায়ণের পরবর্তী উপন্যাসটি ছিল দ্য ম্যান-ইটার অফ মালগুডি। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৬১ সালে। এই গ্রন্থের বর্ণনার ভঙ্গিটি ছিল হাস্যরসের একটি সুনিয়ন্ত্রিত ধ্রুপদি শৈল্পিক ভঙ্গিমা।[৪১] এই গ্রন্থটি প্রকাশের পরই নারায়ণ আবার পর্যটনে বেরিয়ে পড়েন এবং চলে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র[১৪] ও অস্ট্রেলিয়ায়। অ্যাডিলেইড, সিডনি ও মেলবোর্ন শহরে তিন সপ্তাহ কাটিয়ে তিনি ভারতীয় সাহিত্যের উপর বক্তৃতা দেন। এই ভ্রমণে তাকে অর্থসাহায্য করে অস্ট্রেলিয়ান রাইটার্স’ গ্রুপের একটি ফেলোশিপ।[৪৮] এই সময় সাহিত্য ও আর্থিক – উভয় ক্ষেত্রেই নারায়ণ যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছিলেন। মহীশূরে একটি বিরাট বাড়িতে তিনি বাস করতেন। তার পড়ার ঘরে অন্তত আটটি জানলা ছিল। তার মেয়ে বিয়ের পর কোয়েম্বাটোর চলে গিয়েছিলেন। মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে তিনি একটি নতুন মার্সিডিজ-বেঞ্জ গাড়ি চালিয়ে যেতেন। এই গাড়ি সেই সময় ভারতে যথেষ্ট বিলাসবহুল ছিল। ভারত ও বহির্বিশ্বে সাফল্য অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে নারায়ণ দ্য হিন্দু ও দি আটলান্টিক প্রভৃতি পত্রপত্রিকায় কলাম লিখতে শুরু করেন।[৪৯]
১৯৬৪ সালে নারায়ণ তার প্রথম পুরাণ-ভিত্তিক গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থটি ছিল গডস, ডেমনস অ্যান্ড আদার্স। এই গ্রন্থে তিনি হিন্দু মহাকাব্য থেকে নানা ছোটো গল্প অনুবাদ করেন। তার অন্যান্য অনেক বইয়ের মতো এই বইটির অলংকরণের কাজও করেছিলেন তার ছোটো ভাই আর. কে. লক্ষ্মণ। এই গ্রন্থের গল্পগুলি একটি নির্বাচিত তালিকার আকারে দেওয়া হয়েছে। এই গল্পগুলি নির্বাচন করা হয়েছে শক্তিশালী নায়কদের দেখে, যাতে পাঠকদের এগুলি সম্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকুক বা না থাকুক, এর প্রভাব তাদের উপর দীর্ঘস্থায়ী হয়।[৫০] এই গ্রন্থটি প্রকাশের পর নারায়ণ আরও একবার বিদেশ ভ্রমণে যান। আগের একটি প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন যে, আমেরিকানরা তার কাছ থেকে আধ্যাত্মিক বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন। এই ভ্রমণের সময় সুইডিশ-আমেরিকান অভিনেত্রী গ্রেটা গার্বো তার থেকে একই বিষয়ে জানতে চান। যদিও নারায়ণ বলেছিলেন যে, তিনি এই বিষয়ে কিছুই জানেন না।[৪]
এরপর ১৯৬৭ সালে নারায়ণের পরবর্তী উপন্যাস দ্য ভেন্ডার অফ সুইটস্ প্রকাশিত হয়। এটির অণুপ্রেরণা ছিল তার আমেরিকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। এতে তিনি ভারতীয় ও আমেরিকান মূলধারার বৈশিষ্ট্যগুলির চরম চরিত্রায়ন ঘটিয়েছেন। সেই সঙ্গে এই দুই ধারার অনেক সাংস্কৃতিক পার্থক্যের প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এই গ্রন্থটিতে তার হাস্যরস ও বর্ণনার নিজস্ব ভঙ্গিটি অক্ষুণ্ণ থাকলেও, সমালোচকদের মতে এই গ্রন্থে গভীরতা তেমন নেই।[৫১] এই বছর নারায়ণ ইংল্যান্ড যান। সেখানে তিনি ইউনিভার্সিটি অফ লিডসের প্রথম সাম্মানিক ডক্টরেট লাভ করেন।[৫২] এর পরের কয়েক বছর তিনি কিছু লেখেননি। তার পরবর্তী বইটি ছিল আ হর্স অ্যান্ড টু গোটস্ নামে একটি ছোটোগল্প সংকলন। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে।[৫৩] ১৯৩৮ সালে তিনি তার মৃত্যুপথযাত্রী মামাকে কথা দিয়েছিলেন যে কম্ব রামায়ণম গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ করবেন। সেই কথা মনে রেখে তিনি ১৯৭৩ সালে দ্য রামায়ণ গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। রচনার পাঁচ বছর পর প্রকাশিত হয়েছিল এটি।[৫৪] দ্য রামায়ণ প্রকাশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নারায়ণ সংস্কৃত মহাকাব্য মহাভারত অনুবাদের কাজে হাত দেন। এই গ্রন্থ নিয়ে গবেষণা ও রচনার মধ্যেই তিনি আরও একটি বই প্রকাশ করেন। এটি হল দ্য পেন্টার অফ সাইনস্ (১৯৭৭)। এই বইটি একটি অনু-উপন্যাসের চেয়ে কিছুটা বড়ো। এই বইতে নারায়ণ এমন সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন, যা তার আগের বইগুলিতে পাওয়া যায় না। এই পরিবর্তন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, যৌনতা এই গ্রন্থের অন্যতম আলোচ্য বিষয়। যদিও নায়কের চরিত্রচিত্রনে তিনি তার পূর্ববর্তী রচনাগুলির ধারাই বজায় রেখেছিলেন। দ্য মহাভারত প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে।[৫৫]
কর্ণাটক সরকার সেই রাজ্যের পর্যটন শিল্পকে উৎসাহিত করার জন্য নারায়ণকে একটি বই লেখার দায়িত্ব দেয়। ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে একটি বৃহত্তর সরকারি প্রকাশনার অংশ হিসেবে এই রচনাটি প্রকাশিত হয়।[৫৬] তিনি বইটিকে আরও ভালো ভাবে প্রকাশ করার প্রয়োজন অনুভব করেন এবং বইটি ১৯৮০ সালে দ্য এমারেল্ড রুট (ইন্ডিয়ান থট পাবলিকেশনস) নামে পুনঃপ্রকাশিত হয়।[৫৭] এই বইটিতে স্থানীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত চিন্তাধারা প্রতিফলিত হয়। কিন্তু তার গতানুগতিক চরিত্রসৃষ্টি ও কল্পনাশক্তির অনুপস্থিতির কারণে বইটিতে তার বর্ণনার দক্ষতার দিকটি অপ্রকাশিত থেকে যায়।[৪৭] এই বছরেই তিনি আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ আর্ট অ্যান্ড লেটারসের সাম্মানিক সদস্যপদ এবং রয়্যাল সোসাইটি অফ লিটারেচারের এসি বেনসন মেডেল লাভ করেন।[৫৮] এই সময়েই প্রথম নারায়ণের রচনা চীনা ভাষায় অনূদিত হতে শুরু করে।[৫৯]
১৯৮৩ সালে নারায়ণের পরবর্তী উপন্যাস আ টাইগার ফর মালগুডি প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসের উপজীব্য ছিল একটি বাঘ ও মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক।[৬০] ১৯৮৬ সালে তার পরবর্তী উপন্যাস টকেটিভ ম্যান প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন মালগুডির এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী সাংবাদিক।[৬১] এই সময়ে তিনি আরও দুটি ছোটোগল্প সংকলন প্রকাশ করেন। একটি ছিল মালগুডি ডেজ (১৯৮২)। এই গ্রন্থটি ছিল আগের বইয়ের একটি সংশোধিত সংস্করণ। এতে আরও কয়েকটি গল্প যুক্ত হয়েছিল। অপর বইটি ছিল আন্ডার দ্য ব্যানিয়ান ট্রি অ্যান্ড আদার স্টোরিজ। এটি ছিল একটি নতুন ছোটোগল্প সংকলন।[৬২] ১৯৮৭ সালে তিনি আ রাইটার’স নাইটমেয়ার নামে আরেকটি প্রবন্ধ সংকলন রচনার কাজ সম্পূর্ণ করেন। এই গ্রন্থের প্রবন্ধগুলির বিষয়বস্তু ছিল বিচিত্র ধরনের। এতে বর্ণব্যবস্থা, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, প্রেম ও বাঁদরের মতো বিষয়গুলি আলোচিত হয়েছে। ১৯৫৮ সালের পর থেকে সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রে প্রকাশিত তার প্রবন্ধগুলি এই গ্রন্থে সংকলিত হয়।[৬৩][৬৪]
মহীশূরে একা থাকার সময় নারায়ণ কৃষিকাজে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। তিনি এক একর কৃষিজমি কেনেন এবং কৃষিখামার তৈরির কাজে হাত দেন।[৬৫] প্রতিদিন বিকেলবেলা তিনি বাজার অবধি হেঁটে যেতে ভালোবাসতেন। বাজার করা তার উদ্দেশ্য ছিল না। তার উদ্দেশ্য ছিল মানুষের সঙ্গে কথা বলা। হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝেই তিনি থমকে দাঁড়িয়ে পড়তেন। দোকানদার ও অন্যান্যদের অভিবাদন জানিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলতেন। সম্ভবত নিজের পরবর্তী বইয়ের মালমশলা সংগ্রহের জন্যই তিনি এমনটা করতেন।[৬৬]
১৯৮০ সালে সাহিত্যে তার অবদানের জন্য নারায়ণ ভারতীয় সংসদের উচ্চ কক্ষ রাজ্যসভায় মনোনীত হন। তার ছয় বছরের সাংসদ জীবনে তিনি একটি বিষয় নিয়েই সোচ্চার হয়েছিলেন – বিদ্যালয়ে শিশুদের সমস্যা। বিশেষ করে, পাঠ্যবইয়ের বোঝা ও শিশুর সৃজনীশক্তির উপর শিক্ষাব্যবস্থার কুপ্রভাব নিয়ে তিনি কথা বলতে থাকেন। উল্লেখ্য, তার স্বামী অ্যান্ড ফ্রেন্ডস উপন্যাসেও তিনি একই বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলেন। তার এই উদ্যোগের ফলে অধ্যাপক যশ পালের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি বিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার সুপারিশ জানায়।[৬৭]
১৯৯০ সালে তার পরবর্তী উপন্যাস দ্য ওয়ার্ল্ড অফ নাগরাজ প্রকাশিত হয়। এটিও মালগুডির পটভূমিকায় রচিত হয়েছিল। নারায়ণের বয়স তার রচনার উপর ছাপ ফেলতে শুরু করে। তার সাহিত্যিক জীবনের প্রথম দিকের কাজগুলিতে যে বিস্তারিত বিবরণগুলি পাওয়া যেত, এখানে তা আর দেখা যায়নি।[৬৮] এই উপন্যাসটি রচনার কাজ শেষ করার পরেই নারায়ণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি মাদ্রাজে তার মেয়ের পরিবারের কাছে চলে আসেন।[৬৫] ১৯৯৪ সালে তার মেয়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। নারায়ণের নাতনি ভুবনেশ্বরী (মিনি) তার দেখাশোনা শুরু করেন। এর পাশাপাশি ভুবনেশ্বরী ইন্ডিয়ান থট পাবলিকেশনস চালানোর ভারও গ্রহণ করেন।[৪][১৪] এই সময় নারায়ণ তার শেষ বই গ্র্যান্ডমাদার’স টেল প্রকাশ করেন। এই বইটি ছিল একটি আত্মজীবঞ্জীমূলক অনু-উপন্যাস। বইটির কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন তার প্রমাতামহী। তিনি ও তার স্বামী বিয়ের অল্প দিন পরেই বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। তার দিদিমা ছোটোবেলায় তাকে সেই গল্প শোনান।[৬৯]
জীবনের শেষ দিনগুলিতে কথাবার্তায় সদা উন্মুখ নারায়ণ প্রায় প্রতিটি সন্ধ্যাই দ্য হিন্দু পত্রিকার প্রকাশক এন. রামের সঙ্গে কাটাতেন। তারা কফি খেতে খেতে মধ্য রাত পর্যন্ত নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন।[৭০] লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা তার বিশেষ পছন্দের হলেও, এই সময় তিনি সাক্ষাৎকার দেওয়া বন্ধ করে দেন। টাইম পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় সেই নিবন্ধটির অলংকরণের জন্য তাকে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে গিয়ে তার ছবি তোলা হয়েছিল। এর ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে কিছুদিন হাসপাতালে কাটান। এই জন্যই তিনি সাক্ষাৎকার দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন।[৩৩]
২০০১ সালের মে মাসে নারায়ণ হাসপাতালে ভর্তি হন। তাকে ভেন্টিলেটরে রাখার কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি তার পরবর্তী উপন্যাসের পরিকল্পনা করছিলেন। সেটি ছিল তার দাদামশাইকে নিয়ে একটি গল্প। নারায়ণ নিজের নোটবই সম্পর্কে খুব খুঁতখুঁতে ছিলেন। তিনি এন. রামকে একটি নোটবই এনে দিতে বলেন। যদিও নারায়ণ আর সুস্থ হয়ে ওঠেননি। ফলে উপন্যাসটি তিনি শুরুও করতে পারেননি। ২০০১ সালের ১৩ মে ৯৪ বছর বয়সে নারায়ণ চেন্নাই শহরে প্রয়াত হন।[১১][৭১]
১৯৬০ সালে ‘গাইড’ উপন্যাস লেখার জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত হন আর. কে. নারায়ণ। এর পরে ১৯৮০ সালে রয়্যাল সোসাইটি অফ লিটারেচারের পক্ষ থেকে বেনসেন পদক লাভ করেন তিনি। বহুবার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলেও পুরস্কার পাননি তিনি। ২০০১ সালে মৃত্যুর আগে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মবিভূষণ পুরস্কারে ভূষিত করে।
# মরণোত্তর
টেমপ্লেট:Sahitya Akademi Award for English টেমপ্লেট:Mysore topics