আরকেবুসে বা হাকেনব্যুখসে (জার্মান - Arkebuse বা Hakenbüchse) হল ১৫ ও ১৬ শতকে ব্যবহৃত এক ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র। এর আক্ষরিক অর্থ টিউবগান বা নল-বন্দুক। একে অনেকসময় হুক-বন্দুকও বলা হয়ে থাকে। এশিয়া ও ইউরোপে একসময় প্রভূত পরিমাণে ব্যবহৃত এই বন্দুকের ক্যালিবার ছিল সাধারণত ১৮ - ২০ মিলিমিটার। এই ধরনের বন্দুকে লক বা ধৃতি'র ব্যবহারও দেখতে পাওয়া যায়।[২][৩] বাস্তবিক এর পূর্বসূরী হাত-কামানের সাথে এর মূল পার্থক্যই ছিল সেফটি লক হিসেবে ম্যাচ লকের ব্যবহার। আরও পরবর্তীকালে তৈরি মাসকেটের মতো আরকেবুসেতেও একটি সরল মসৃণ নল থাকত, কিন্তু সেখানে রাইফেল প্রযুক্তি (যার ফলে আরও আধুনিক বন্দুকে গুলি নিজ অক্ষের উপর পাক খেতে খেতে সামনের দিকে এগোয়) ব্যবহৃত হয়নি। তবে এই ধরনের বন্দুক ছিল তুলনামূলকভাবে হালকা, ফলে সহজে বহনযোগ্য। স্পেনীয়দের হাতে এর বিশেষ উন্নতি ঘটে[৪]; ষোড়শ শতাব্দীতে তাদের আমেরিকা বিজয়ের পিছনে অস্ত্র হিসেবে আরকেবুসের বিশেষ অবদান ছিল।[৫]
প্রথমদিকে আরকেবুসে ছিল যথেষ্ট ভারী; আগেকার হাত-কামানের সাথে একটা বাঁট ও ম্যাচ লক জাতীয় ধৃতি যোগ করে এগুলি তৈরি করা হত। তাদের ওজনের কারণেই মূলত কোথাও এগুলিকে বসিয়ে তখন গুলি চালাতে হত। ফলে সে'সময় এগুলি আক্রমণের থেকে প্রতিরক্ষার কাজেই বেশি ব্যবহৃত হত। প্রথমদিকের কিছু আরকেবুসে শুধুমাত্র একটি বাঁট ও একটি নল দিয়ে তৈরি হত। আগেকার হাত-কামানের মতোই তাতে বাইরে থেকে একটি নির্দিষ্ট ফুটো দিয়ে বেরিয়ে আসা সলতেয় অগ্নিসংযোগ করে গুলি ছুঁড়তে হত। তবে ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকেই হাতে বহনযোগ্য আরকেবুসে তৈরি হতে শুরু করে। এগুলি ছিল পরবর্তীকালে তৈরি মাসকেটেরই কিছুটা হালকা ও সরলতর সংস্করণ। তবে সামনের দিকের ভার সামলানোর জন্য এগুলির নলের সামনের দিকেও একটি বাঁটের ব্যবস্থা রাখতে হত। এই বাঁটগুলির আকৃতি অনেকটা হুকের মতো হওয়াতেই এদেরকে অনেকসময়ই হুক-বন্দুকও বলা হয়ে থাকে। তবে হাতে বহনযোগ্য হওয়ায় বিশেষ করে অশ্বারোহী বাহিনীর প্রতিরক্ষায় এই অস্ত্র বিশেষভাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। সেই দিক থেকে একে পরবর্তীকালের কারবাইনেরও আদিযুগের পূর্বসূরী বলা চলতে পারে।[৩]
আরকেবুসে আ ক্রক (ফরাসি arquebuss à croc) হল আরকেবুসেরই একটি ভারী সংস্করণ। এগুলি ছিল খানিকটা ছোট কামানের মতো। এর জন্য সাধারণত তিন আউন্স ওজনের গোলা ব্যবহৃত হত। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকেও স্পেনের কাস্তিয়া অঞ্চলে ও বিভিন্ন ফরাসি সেনাশিবিরে এর ব্যবহার বজায় ছিল।[৬]
শব্দটির মূল উৎপত্তি জার্মান শব্দ হাকেনব্যুখসে ("Hakenbüchse") থেকে। এই ধরনের বন্দুকে একটি লোহার ব্যারেল ("Büchse" ব্যুখসে) ও তার তলায় একটি ধরবার হুকাকৃতি আঁকশি ("Haken" হাকেন) ব্যবহৃত বলেই তার এই নাম।[৩] এই নামটিই ফরাসি ভাষায় খানিকটা বিকৃত হয়ে কিছুটা মজার ছলে আরকেবুস বলে উচ্চারিত হত। তার থেকেই স্পেনীয় ও অন্যান্য ভাষায় আরকেবুস বা আরকেবুসে শব্দটির উৎপত্তি। যাইহোক, পরবর্তীকালে আরকেবুসে ও হাকেনব্যুখসে শব্দদু'টি মোটামুটি সমার্থক থাকলেও তাদের অর্থে কিছু পার্থক্যও পরিলক্ষিত হয়। কারণ প্রথম দিকের ভারী বাঁটযুক্ত অস্ত্রগুলির ক্ষেত্রে হাকেনব্যুখসে শব্দটি বেশি ব্যবহার হতে থাকে, কিন্তু পরবর্তীকালে তৈরি হালকা হাতে বহনযোগ্য অস্ত্রগুলিকে আরকেবুসে নামেই বেশি অভিহিত করা শুরু হয়। মজার বিষয় হল, যে আঁকশি বা হাকেন থেকে এই দুই নামের উৎপত্তি, পরবর্তীকালের হালকা আরকেবুসেগুলিতে সেই আঁকশিগুলিই আর ছিল না। কিন্তু আরকেবুসে নামটিই চলতে থাকে। অবশ্য এর কিছু অন্য নামও চালু হয়েছিল। যেমন ইংরেজিতে ক্যালিভার (caliver) শব্দটি অনেকসময়ই এর একটি প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হত।[৭]
আগেকার আগ্নেয়াস্ত্রের সাথে আরকেবুসের একটি লক্ষণীয় পার্থক্য হল এর অপেক্ষাকৃত বেশি বোর (নলের ব্যাস)। এছাড়া পিছনদিকে ধাক্কা সামলানোর জন্য বাঁটের ব্যবহার ও ম্যাচ লকজাতীয় নিরাপত্তা ধৃতির ব্যবহারও এর আরেক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। অবশ্য ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে এই ধরনের বন্দুকে ম্যাচ লকের বদলে হুইল লক বা চক্রাকার ধৃতির ব্যবহার শুরু হয়। এই ধরনের বন্দুকের নলটি হত সরল, সোজা ও মসৃণ। ফলে আধুনিক রাইফেলের মতো গুলি এর থেকে ঘুরতে ঘুরতে বেরিয়ে সোজা পথে প্রচণ্ড গতিতে ছুটে যেতে পারতো না। বরং নিজ অক্ষের চারপাশে ঘোরার গতিটা না থাকার ফলে তার সামনে এগনোর গতিও দ্রুত কমে আসতো, সোজা পথটাও কিছুটা বৃত্তাকার চাপের (প্রোজেক্টাইল) আকৃতি ধারণ করতো। ফলে কিছুটা দূর থেকে এর সাহায্য লক্ষ্যভেদ যথেষ্ট কঠিনই ছিল। তাছাড়া প্রথমদিকের অস্ত্রগুলি বেশ ভারী হওয়ার কারণে গুলি ছোঁড়ার সময় পিছন দিকে ধাক্কা কাঁধ দিয়ে সামলানোও ছিল বেশ কঠিন। এই কারণেই প্রথম দিকের ভারী হাকেনব্যুখসেগুলিতে বিশেষ করে নলের সামনের দিকে মুখের কাছে নিচের দিকে একটি লোহার আঁকশি লাগানো থাকতো। অস্ত্র ব্যবহারের সময় কোনও দেওয়ালে বা গাছের শক্ত ডালে এটি আটকে নিয়ে গুলি চালালে পিছন দিকের ধাক্কা সামলানো অপেক্ষাকৃত সহজ হত।[৩] যেহেতু সাধারণভাবে এই অস্ত্র বিভিন্ন কামারখানায় দক্ষ কারিগর তথা বন্দুকনির্মাতাদের হাতে তৈরি হত, এর একেবারে নির্দিষ্ট কোনও মডেল বলে কিছু ছিল না। এর ওজনেরও প্রায়শই হেরফের ঘটতো। ৭ থেকে ২৫ কিলোগ্রাম বিভিন্ন ওজনের আরকেবুসে এখন বিভিন্ন অস্ত্র মিউজিয়ামে রক্ষিত রয়েছে।
একেবারে প্রথমদিকের আরকেবুসেতে গুলি ছোঁড়ার জন্য কোনও ঘোড়ার ব্যবস্থা ছিল না। বরং তাদের থেকে গুলি ছোঁড়ার পদ্ধতির সাথে ক্রস বো থেকে তীর ছোঁড়ার পদ্ধতির কিছুটা মিল ছিল। পদ্ধতিটি কিছুটা জটিল। এক্ষেত্রে একটি সামান্য বাঁকা লিভার'এর মতো অংশ বাঁটের সমান্তরালে পিছন দিকে হেলে থাকতো। গুলি ছোঁড়ার সময় এটিকে বাঁটের সাথে চেপে ধরতে হত। এর ফলে ধীরে ধীরে জ্বলতে থাকা একটি তার বা সলতের মতো অংশে (ম্যাচ কর্ড) চাপ পড়তো। এটি বন্দুকের ফ্ল্যাশ প্যানে ভরা বারুদের কাছে নেমে এসে তার সাথে যুক্ত হতো ও তার ফলে বারুদে অগ্নিসংযোগ হত (জ্বলন্ত ফিউজ বা ম্যাচ কর্ডের সাহায্যে বারুদ জ্বালানোর এই পদ্ধতির কারণেই এই ধরনের ধৃতিকে ম্যাচ লক বলে অভিহিত করা হয়।)। ফলে গুলি ছুটতো।[৮] এই ধরনের পদ্ধতির কারণে আরকেবুসে থেকে গুলি চালানোর সময় প্রচূর ধোঁয়ার উৎপত্তি হত। ষোড়শ শতাব্দীর শেষদিকে অবশ্য দেশে দেশে বিভিন্ন বন্দুকনির্মাতারা বাঁটের সাথে লম্বভাবে যুক্ত আধুনিক ছোট ট্রিগার বা ঘোড়ার ব্যবহার শুরু করে।
আধুনিক বন্দুকের সাথে তুলনায় আরকেবুসে ছিল অবশ্যই এক ধরনের জবরজং অস্ত্র। তবু যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র হিসেবে এর অন্তর্ভুক্তি কিছুদিনের মধ্যেই এতটাই প্রভাব বিস্তার করে যে তার ফলে যুদ্ধকৌশলেই একরকম আমুল পরিবর্তনের সূচনা ঘটে। মধ্যযূগীয় সৈন্যবাহিনীর থেকে আধুনিক সৈন্যবাহিনীর উত্তরণে এই অস্ত্রেরও একটি ভূমিকা যে ছিল, তা অনস্বীকার্য। খুব দ্রুতই তাই আরকেবুসে যুদ্ধের ক্ষেত্রে নিছক একটি সাহায্যকারী অস্ত্রের থেকে অন্যতম মুখ্য অস্ত্রের মর্যাদা লাভ করে।[৯]
যেহেতু আরকেবুসে ছিল একধরনের কমগতির আগ্নেয়াস্ত্র (এর থেকে ছোঁড়া গুলির গতিবেগ ছিল অপেক্ষাকৃত কম), তাই এর সাহায্যে খুব দূরের লক্ষবস্তুকে ঠিকভাবে আঘাত করা যেত না। এর থেকে ছোঁড়া গুলির গতিরেখা একদম সোজা না হয়ে একটু বৃত্তচাপের মতো (প্রোজেক্টাইল) হওয়ায় দূর থেকে এর সাহায্যে লক্ষভেদ করাও ছিল যথেষ্ট কঠিন। পঞ্চদশ-ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে ইউরোপে যোদ্ধারা যে ধরনের লোহার বর্ম ব্যবহার করতো, দূর থেকে আরকেবুসে থেকে ছোঁড়া গুলি প্রায়শই তা ভেদ করতেও পারতো না। তবে একটা নির্দিষ্ট দূরত্বের কাছে থেকে এই অস্ত্র ছিল যথেষ্টই ভয়ঙ্কর। এইসব ক্ষেত্রে এমনকী অশ্বারোহীদের রীতিমতো ভারী বর্মও এর সামনে খুব একটা সুরক্ষিত ছিল না। অশ্বারোহী বাহিনীতে আরকেবুসের অন্তর্ভুক্তি তাই আগেকারদিনের নাইট সুলভ সমস্ত গা ঢাকা ভারী লোহার বর্মের কার্যকারিতা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাওয়ার একটি বড় কারণ। প্রথমে এই বর্মের বদলে অপেক্ষাকৃত হালকা ও ছোট থ্রি-কোয়ার্টার প্লেট বর্ম চালু করা হয়। পরে প্রায় সব ধরনের অশ্বারোহী বাহিনী থেকেই তার কার্যকারিতা হারিয়ে বর্মই একরকম বিদায় নেয়।
ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে ১৫২০ সাল নাগাদ ইউরোপীয় যুদ্ধক্ষেত্রে ওলন্দাজ সেনাবাহিনীর হাতে প্রথম ভলিফায়ার কৌশলের উদ্ভব ঘটে।[১০] প্রায় একই সময় এশিয়াতেও পর্তুগিজ ও জাপানিরা এই নতুন যুদ্ধকৌশল ব্যবহার শুরু করে। এই ধরনের যুদ্ধকৌশলে আরকেবুসেই মুখ্য অস্ত্রের ভূমিকা পালন করেছিল। এর ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে আরকেবুসের গুরুত্ব বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। ভলিফায়ারের ক্ষেত্রে দুই সারি আরকেবুসেধারী সৈন্য পরস্পর ক্রমাগত স্থান বিনিময় করে গুলি চালানোয় যুদ্ধক্ষেত্রে কোনও একটি নির্দিষ্ট অভিমুখে একটানা গুলিবর্ষণ সম্ভবপর হয়ে ওঠে। প্রথম সারির সৈন্যরা গুলি চালানোর পর সাথে সাথে দ্বিতীয় সারির সাথে স্থান বিনিময় করে পিছনে চলে গিয়ে পুনরায় আগ্নেয়াস্ত্র লোড করে নেওয়ার সুযোগ পায়; দ্বিতীয় সারির সৈন্যরা তখন সামনে এসে গুলি চালায়। এরপর আবার তারা স্থান বিনিময় করে পুনরায় গুলি চালাতে তৈরি প্রথম সারির সাথে। এইভাবে একটানা গুলিবর্ষণ জারি রাখা সম্ভব হতো। ভলিফায়ারের উদ্ভব ও কার্যকারিতা প্রমাণের ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বহুলাংশে বেড়ে যায়, তার উৎকর্ষের দিকে নজর পড়ে ও আরকেবুসে নিছক একটি সাহায্যকারী অস্ত্র থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে একটি প্রধান অস্ত্র হিসেবে পরিগণিত হতে শুরু করে।[৯]
একজন সুদক্ষ তীরন্দাজের মতো লক্ষভেদ ক্ষমতা আরকেবুসের ছিল না, এ'কথা ঠিক। কিন্তু আরকেবুসে থেকে গুলি চালানোর হার ও ক্ষমতা ছিল যেকোনও ধরনের ধনুকের (ক্রসবো ও লংবো) থেকেই বেশি। তাছাড়া এর উদ্ভবের ফলে আরও দূরের লক্ষবস্তু এখন আঘাতের আওতায় এসে যায়। আরকেবুসের আরেকটি বড় সুবিধে হল এই যে, ব্যবহারকারীর দৈহিক ক্ষমতার উপর এর কার্যকারিতা বিশেষ নির্ভরশীল ছিল না। ফলে ব্যবহারকারীর ক্লান্তি, পুষ্টির অভাব বা অসুস্থতা এর কার্যকারিতা ততটা হ্রাস করতো না। যুদ্ধক্ষেত্রে তীরন্দাজির কার্যকারিতার ক্ষেত্রে এই দু'টি বিষয়ই ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এরউপর বাতাসের ফলে তীরের গতি সবসময়েই কিছুটা প্রভাবিত হয়। আরকেবুসের উদ্ভবের ফলে এই দীর্ঘদিনের সমস্যারও অনেকটা সমাধান ঘটে। আরকেবুসের আরেকটি অতিরিক্ত সুবিধা হল এই যে, এর আওয়াজে শত্রুপক্ষের ঘোড়াগুলি ভয় পেয়ে যেত। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে বিপক্ষের মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হত।
আরকেবুসে ব্যবহারের আরও ক'টি সুবিধে ছিল। তীরন্দাজিতে দক্ষতা অর্জনের জন্য বহুদিনের দীর্ঘ প্রশিক্ষণ ও নিয়মিত অভ্যাস ছিল খুবই জরুরি। অন্যদিকে আরকেবুসের ক্ষেত্রে অল্পদিনের প্রশিক্ষণ ও অভ্যাসেই একটি নির্দিষ্ট মাত্রার দক্ষতা অর্জন সম্ভব ছিল। এরফলে নতুন রিক্রুটদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় সময় কয়েক বছর থেকে নেমে আসে মাত্র কয়েক মাসে। দ্রুত যুদ্ধক্ষম বাহিনী গড়ে তোলা এর ফলে অনেক সহজ হয়ে ওঠে। অবরোধের সময় আরকেবুসে থেকে গুলি চালানোর জন্য প্রতিরক্ষা দেওয়ালে ছোট ছোট ছিদ্রই ছিল যথেষ্ট। কিন্তু লংবো তো বটেই, এমনকী ক্রসবো ব্যবহারের জন্যও সেখানে প্রয়োজন অনেকটা উন্মুক্ত ফাঁকের। ফলে প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও আরকেবুসে ছিল পূর্ববর্তী যেকোনও ধনুকের থেকে বেশি উপযোগী। আরকেবুসের আরও সুবিধে ছিল এর গুলিবারুদ ছিল বহনের পক্ষে অনেক বেশি সুবিধেজনক। ফলে একজন তীরন্দাজের থেকে একজন আরকেবুসিয়ের অনেক বেশি গুলি বহন করতে পারতো। স্বাভাবিকভাবেই তার ফলে আরকেবুসের কার্যকারিতাও অনেকখানিই বৃদ্ধি পেয়েছিল। এইসব কারণেই সৈন্যবাহিনীতে তীরন্দাজদের ব্যবহার ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে ও ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে শেষপর্যন্ত বিভিন্ন বাহিনীতে লংবো'র ব্যবহার একরকম উঠেই যায়।[১১]
এত কিছু সুবিধে সত্ত্বেও আরকেবুসের কিছু অসুবিধের দিকও ছিল। এর মধ্যে প্রধান হল, আর্দ্র ও ভেজা আবহাওয়ায় বারুদ ভিজে গেলে এর কার্যকারিতা ভীষণভাবেই হ্রাস পেত। যেমন ১৫২১ সালের এপ্রিল মাসে স্পেনের ভিলিয়ালারের যুদ্ধে রাজা প্রথম কার্লোসের বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই'এ বিদ্রোহীদের পরাজয়ের অন্যতম কারণই ছিল বৃষ্টিতে বারুদ ভিজে গিয়ে তাদের আরকেবুসেগুলির কার্যক্ষেত্রে একরকম অকেজো হয়ে পড়া।[১২]
আরকেবুসের আরেকটি বড় অসুবিধের দিক ছিল এর থেকে বেরোনো ধোঁয়া। বারুদে অগ্নিসংযোগের সময়ে এমনকী একটিমাত্র আরকেবুসে থেকেও এত ধোঁয়া উৎপন্ন হত যে দূর থেকেও তা চোখে পড়তো। ফলে লুকিয়ে আক্রমণ হয়ে উঠেছিল একরকম অসম্ভব। এই ধোঁয়ার অন্যতম অসুবিধের দিক ছিল এই যে, যুদ্ধক্ষেত্রে উপর্যুপরি গুলিচালনার সময়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ধোঁয়াতে সবকিছু এমন ঢেকে যেত যে শত্রুপক্ষকেও আর ভালো করে দেখা যেত না। অন্যদিকে আবার এই একই ধোঁয়ার কারণে শত্রুপক্ষও দূর থেকে আরকেবুসিয়েদের ঠিকমতো দেখতে না পাওয়ায় তাদের লক্ষস্থির করে গুলি বা তীর চালাতে পারতো না। এটুকু ছিল এর সুবিধের দিক।
কিন্তু আরকেবুসিয়েরদের প্রচূর পরিমাণে বারুদ সঙ্গে রাখতে হত। সেইসঙ্গে সঙ্গে রাখতে হত জ্বলন্ত সলতেও (ম্যাচ কর্ড)। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রের গোলমালের মধ্যে মুহূর্তের অসতর্কতাও ভয়াবহ দুর্ঘটনা ডেকে আনতে পারতো। সেই হিসেবে আরকেবুসে ছিল তার চালনাকারীদের কাছেও যথেষ্ট বিপদ্দজনক। তারউপর তা লোড করার পদ্ধতিটাও ছিল এতটা দীর্ঘ ও জবরজং যে সেইসময়টায় অন্য কেউ তাকে আড়াল না করলে আরকেবুসিয়ের নিজে একেবারে অরক্ষিত হয়ে পড়তো। আর বেশ ক'বার গুলি চালনার পর বন্দুকটা নিজেই খুব গরম হয়ে যেত, বারুদের চেম্বার ঠিকমতো পরিষ্কার না করে আবার বারুদ ভরে গুলি চালাতে গিয়ে চেম্বার জ্যাম হয়ে অনেকসময় বিস্ফোরণও ঘটতো। ফলে আরকেবুসিয়েরের নিজের ও তার চারপাশের লোকেদের জীবনসংশয়ও ঘটতে পারতো। তাছাড়া এর প্রচণ্ড শব্দও ছিল আরেকটি অসুবিধের দিক। প্রায়শই তাতে কানে তালা লেগে যেত। দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে ব্যবহারকারীর শোনার ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার ঘটনাও বিরল নয় মোটেই।