আরণ্যক বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) রচিত[১][২] চতুর্থ উপন্যাস। ১৯৩৯ সালে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিহারে তার কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে উপন্যাসটি রচনা করেন। আরণ্যক উপন্যাসটির রচনাকাল ১৯৩৭-৩৯ খ্রিষ্টাব্দ। "কাত্যায়ণী বুক স্টল" থেকে তা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।[৩] বই হিসাবে প্রকাশের আগে প্রবাসী মাসিক পত্রিকায় কার্তিক ১৯৩৮ থেকে ফাল্গুন ১৯৩৯ পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। বিভূতিভূষণ এই উপন্যাসটি অকালে-লোকান্তরিতা তার প্রথমা স্ত্রী গৌরী দেবীকে উৎসর্গ করেন।
লেখক | বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় |
---|---|
দেশ | ভারত |
ভাষা | বাংলা |
আইএসবিএন | ৮১-৭২৯৩-১২০-৪ |
আরণ্যক বিভূতিভূষণের অন্যতম উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। মূল বাংলা ছাড়াও আরণ্যক সাহিত্য একাডেমির প্রচেষ্টায় ভারতের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত করা হয়েছে। যেমনঃ- ওড়িয়া, তেলুগু, গুজরাটি, মারাঠী, মালয়ালম, পাঞ্জাবী এবং হিন্দি।
'পথের পাচালী' রচনার সময় অর্থাৎ ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভাগলপুরে থাকাকালীন তিনি 'আরণ্যক' লেখার পরিকল্পনা করেন।ঐ সময় বছর চারেক পাথুরিয়িঘাটা এস্টেটের সহকারী ম্যানেজার হিসাবে ইসমাইলপুর এবং আজমাবাদের অরণ্য-পরিবেশে থাকার ফলে আজন্ম প্রকৃতির পূজারী বিভূতিভূষণ ব্যাপক পরিভ্রমণ ও নানা বিষয়ে পর্যবক্ষেণ করেন।তার প্রকৃতি প্রেম আরও প্রগাঢ় হয়।
উপন্যাসের নায়ক হলেন সত্যচরণ — একজন তরুণ যুবক, যাকে কাজের সন্ধানে কলকাতার বহু জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়। একসময় সে তার এক বন্ধুর বদলৌতে গভীর অরণ্যে একটি চাকরি পেয়ে যায়। সে তথাকথিত সভ্যজগতের সাথে বনের সেতুবন্ধন। এই চরিত্রটির উপস্থিতি ছাড়া গল্পে না বলা দুই জগতের তুলনা, যা প্রায় উপন্যাসটির প্রতি জায়গায় লুকানো ছিল তা সম্ভব হত না। সত্যচরণ এই উপন্যাসটির অন্যতম প্রধান চরিত্র। যদিও তাকে কেন্দ্রীয় চরিত্র মনে করাটা অনেক বড় ভুল হবে। সে একজন বহিরাগত, যার সাথে জঙ্গল অথবা জঙ্গলের লোকদের কোন সম্পর্ক নেই। জঙ্গলের রহস্যভরা মঞ্চে প্রতিদিন মঞ্চায়িত হওয়া নাটকের সে শুধুমাত্র একজন দর্শক। সে শুধুমাত্র বাইরে থেকে এই নাট্যাভিনয় দেখতে পারে, কিন্তু এতে যোগ দেওয়ার সক্ষমতা তার নেই। মূলত আরণ্যক উপন্যাসে কোন কেন্দ্রীয় চরিত্র নেই। জঙ্গলই হলো এর কেন্দ্রীয় চরিত্র, যা প্রতিক্ষেত্রেই নিজের সৌন্দর্য এবং এর মধ্যে লোকজনের জীবনাচার দ্বারা নিজের পরিচয় দেয়। সত্যচরণ এই সবকিছুর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। তার প্রখর মেধা ও অনুভূতি দ্বারা সে যা কিছু দেখে তা বুঝতে ও উপভোগ করতে পারে, কিন্তু সে এসব কিছুর সাথে মিশে যেতে পারেনা। কারণ সে একজন আগন্তুক, জঙ্গলে তার কোন স্থান নেই।
জঙ্গলে বহু বিচিত্র চরিত্র রয়েছে। কিন্তু কেউই রাজু পাড়েঁর মত নয়। অতি দরিদ্র,ভীষণ নিরীহ, লাজুক ব্যক্তি — যে সারাদিন পূজা অর্চনা ও গীতা পাঠ করে কাটায়। সত্যচরণ তাকে চাষের জন্য দুই বিঘা জমি দিলেও দুই বছরেও তা সে বন কেটে পরিষ্কার করতে পারেনি। সে শুধুমাত্র চীনা ঘাসের দানা খেয়ে জীবন ধারণ করত। সত্যচরণ তাকে আরও কিছু জমি দিলেও তার অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটেনা। আসলে রাজু একজন অর্থ উপার্জনকারী থেকে অনেক বেশি দার্শনিক ও কবি প্রকৃতির মানুষ।
যখন ধাতুরিয়া নামের একটি বালক কাছারিতে নাচ দেখানোর জন্য আসে, তখন তার বয়স বারো অথবা তেরোর বেশি ছিলনা। দক্ষিণে খরার কারণে দূর্ভিক্ষ দেখা দিলে ঐ অঞ্চলের লোকেরা নাচ দেখিয়ে অর্থ উপার্জনের আশায় বের হয়। ধাতুরিয়া এমনই একটি দলের সাথে এসেছিল। তাকে নাচের জন্য দল থেকে কোন অর্থ দেওয়া হতনা তাকে শুধুমাত্র চীনা ঘাসের দানা অথবা জঙ্গলের কিছু শাকসবজি খেতে দেওয়া হত। আর সে এতেই সন্তুষ্ট ছিল।
ধাওতাল সাহু নওগাছিয়া গ্রামে বাস করে। সে একজন মহাজন, লোকজনকে সুদের বিনিময়ে অর্থ ধার দেয়। সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হতে পারে ধাওতাল সাহু একজন মহাজন হওয়ায় একজন খারাপ মানুষ হতে পারে ও জোর করে অর্থ আদায় করে। কিন্তু মোটেও এমনটি নয়। সে সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের একজন দয়ালু ও নির্লোভ ব্যক্তি। জঙ্গলের প্রত্যকেই তাকে মহাজন ও লক্ষপতি মনে করে। সকলেই মনে করে তার সম্পদের কোন হিসাব নেই। কিন্তু সে একজন সরল ও নিরহংকারী ব্যক্তি, যার ময়লা জামা পরিধানে অথবা রাস্তা কিংবা গাছের নিচে বসে ছাতু খেতে কোন অসুবিধা নেই।
মটুকনাথ একজন ব্রাক্ষ্মণ পণ্ডিত, যে আগে তার গ্রামের টোলে পড়াতো। একসময় তার টোল বন্ধ হয়ে যায়, সে কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে এবং একদিন সত্যচরণের অফিসে এসে উপস্থিত হয়। সে মনে করে ম্যানেজারবাবু যদি তাকে অনুগ্রহ করে, তাহলে তার উপার্জনের একটি ব্যবস্থা হয়ে যাবে। অফিসে তার কাজের কোন ব্যবস্থা করা যায়নি কারণ সে এসবের কিছুই বোঝেনা, কিন্তু সে সেখানে কিছুদিন থেকে যায়, যদিও সত্যচরণ এতে কোন আপত্তি করেনি। কারণ হয়তো সে এই সরল এবং সুখী লোকটিকে পছন্দ করে ফেলেছে।
উপন্যাসের অন্যতম রহস্যময় চরিত্র হলো যূগলপ্রসাদ৷ সে একজন নিঃস্বার্থ প্রকৃতিপ্রেমী। তার লক্ষ্য হলো মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত জঙ্গলকে সুন্দর করে সাজানোর জন্য কাজ করা। জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে সে বিভিন্ন ফুলের বীজ রোপন করে। এতে তার সময় ও অনেক সময় অর্থ ব্যয় হয়, কিন্তু এতেই সে খুশি এবং সকল কাজের মধ্যে এতেই সবচেয়ে বেশি আনন্দ খুঁজে পায়।
লেখকের ভাষায় কুন্তা একজন সতী ও পবিত্র নারী। সে একজন বাইজীর মেয়ে ছিল। কিন্তু পরে সে একজন রাজপুতকে বিয়ে করে। বিয়ের কিছু সময় পর তার স্বামীর মৃত্যু হয়। বেশকিছুদিন পর রাসবিহারী সিং তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে সে তাকে নানা খারাপ প্রস্তাব দেয় এবং নানাভাবে তাকে নির্যাতন করে। এরপর কুন্তা সেখান থেকে পালিয়ে আসে এবং কয়েকদিন পর সত্যচরণ চাষাবাদের জন্য তাকে কিছু জমি দেয়। গল্পের শেষে সত্যচরণ চলে আসার সময় তাকে ক্রন্দনরত অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়।
ভেঙ্কটেশ্বর একজন স্থানীয় কবি, যে জঙ্গলের ধারে তার স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করে। একবার সে সত্যচরণের অফিসে এসে তাকে তার লেখা কবিতা শোনায়। এরপর সত্যচরণ তার বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করে।
মঞ্চী একজন গাঙ্গোতা তরুণী, তার বিয়ে হয় এক বৃদ্ধ সর্দার নকছেদী ভকতের সাথে। তার জীবনাচার সত্যচরণকে আকর্ষণ করে। সে মনে করে বাঙালী লোকজন (সত্যচরণ) খুব ভালো লেখক। সে সত্যচরণকে তার প্রতি একবার ঘটে যাওয়া এক অত্যাচারের কথা লিখতে বলে। সস্তা সাজগোজের জিনিসের প্রতি মঞ্চীর প্রবল আগ্রহ ছিল। একদিন দেখা যায় মঞ্চীকে আর কোথাও খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। সত্যচরণ সন্দেহ করে হয়তো কেউ তাকে সস্তা জিনিসের লোভ দেখিয়ে নিয়ে গেছে এবং তার শেষ পরিণতি হয়তো কোন চা বাগানে চা শ্রমিক হিসেবে কাজ করা। পরবর্তীতে নকছেদী ও তার প্রথম স্ত্রী এবং তাদের কন্যাসন্তান (সুরতিয়া) সত্যচরণ থেকে কিছু জমি পায়, যাতে করে তাদের যাযাবর জীবনের অবসান ঘটে।
রাজা দোবরু পান্না সত্যিকারেই স্বল্প সংখ্যক সাঁওতালদের রাজা। তিনি একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি যিনি স্বাধীনতার পর তার রাজকীয় ক্ষমতা হারিয়েছেন। তারপরও তার ব্যক্তিত্ব একজন রাজার মতই। সত্যচরণ তার সাথে দেখা করতে গেলে তিনি তাকে আন্তরিক অভ্যর্থনা জানান। দেখা করার কয়েক মাস পর রাজা দোবরু পান্না মৃত্যুবরণ করেন।
সত্যচরণ সাঁওতাল পরগণায় (দোবরুর বাসস্থান) যান। জগরু পান্না দোবরুর ছেল, যার কাহিনিতে তেমন কোনো প্রভাব নেই। কিন্তু দোবরুর নাতনী ভানুমতীর সাথে সত্যচরণের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। উপন্যাসের শেষের দিকে, সত্যচরণ যখন চিরতরে বন ত্যাগ করতে চলেছেন, তখন তিনি শেষবারের মতো ভানুমতীর কাছে যান। সেখানে দেখা যায়, সত্যচরণ ভাবেন, “আমি যদি ভানুমতীকে বিয়ে করতে পারি এবং আমাদের জন্য একটি সুখী বাসা বাঁধতে পারি… ভানু কোন কল্পনাপ্রসূত দৈত্যের কথা বলতে পারে, এবং আমি তার শ্রোতা হতাম.. কিন্তু এটি শুধুমাত্র স্বপ্ন এবং স্বপ্ন কখনো সত্য হতে পারে না...”
রাসবিহারী সিং একজন নিষ্ঠুর ও অহংকারী মহাজন, যে তার লাঠিয়াল বাহিনীর সাহায্যে গরীব গাঙ্গোতাদের থেকে নানা অত্যাচারের মাধ্যমে ঋণের অর্থ আদায় করে। সত্যচরণের সাথে তার সরাসরি কোন দ্বন্দ্ব ছিল না। কিন্তু সে নানাভাবে সত্যচরণকে তার ক্ষমতা প্রদর্শন করে। হোলি উৎসবের সময় একবার সে নিজের সম্পদ ও প্রতিপত্তি দেখানোর জন্য সত্যচরণকে তার বাড়িতে আমন্ত্রণ করে। সে কুন্তার উপরও অত্যাচার চালায়।
উপন্যাসের স্বল্পসংখ্যক খারাপ লোকের মধ্যে নন্দলাল ওঝা একজন। সে জানে নিজের সুবিধার জন্য অন্য লোকদের থেকে কীভাবে কার্যসিদ্ধি করা যায়। যে তাকে খুশি করতে পারে না সে তার শত্রুতে পরিণত হয়। প্রকৃতপক্ষেই সে একজন ভয়ানক ব্যক্তি।
এই সময়কার তার দিনলিপি-গ্রন্থ 'স্মৃতির রেখা'র কিছু উদ্ধৃতির সাথে 'আরণ্যক' উপন্যাসের ভাবগত আশ্চর্য সাদৃশ্য পাওয়া যায়। ১৯২৮ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি 'স্মৃতির রেখা'তে তিনি লিখছেন,
“ | এই জঙ্গলের জীবন নিয়ে একটা কিছু লিখবো - একটা কঠিন শৌর্যপূর্ণ, গতিশীল, ব্রাত্য জীবনের ছবি।এই বন, নির্জনতা, ঘোড়ায় চড়া, পথ হারানো অন্ধকার - এই নির্জনে জঙ্গলের মধ্যে খুপরি বেঁধে থাকা।মাঝে মাঝে, যেমন আজ গভীর বনের নির্জনতা ভেদ করে যে শুড়ি পথটা ভিটে-টোলার বাথানের দিকে চলে গিয়েচে দেখা গেল, ঐ রকম শুড়ি পথ এক বাথান থেকে আর এক বাথানে যাচ্চে - পথ হারানো, রাত্রের অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে ঘোড়া করে ঘোরা, এদেশের লোকের দারিদ্র, সরলতা, এই virile, active life, এই সন্ধ্যায় অন্ধকারে ভরা গভীর বন ঝাউবনের ছবি এই সব। | ” |
'আরণ্যক'এ উল্লিখিত গোষ্ঠবাবু মুহুরী, রামচন্দ্র আমীন, আসরফি টিন্ডেল, জয়পাল কুমার, পণ্ডিত মটুকণাথ এবং রাখাল ডাক্তারের স্ত্রীর কথা ঐ দিনলিপিতেও পাওয়া যায়।