আরব বিদ্রোহ | |||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
মূল যুদ্ধ: প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্য রণাঙ্গণ | |||||||||
'আরব মরুভূমিতে আরব বিদ্রোহের পতাকাধারী আরব বাহিনীর সৈনিকরা।' | |||||||||
| |||||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||||
হেজাজ রাজতন্ত্র যুক্তরাজ্য নজদ ও হাসা আমিরাত |
উসমানীয় সাম্রাজ্য জার্মানি জাবাল শামার আমিরাত | ||||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||||
হুসাইন বিন আলী ফয়সাল এডমন্ড এলেনবি টমাস এডওয়ার্ড লরেন্স ইবনে সৌদ |
জামাল পাশা ফখরুদ্দিন পাশা মুহিদ্দিন পাশা অটো লিমান ভন সেন্ডার্স আবদুল আজিজ বিন মিতাব | ||||||||
শক্তি | |||||||||
৩০,০০০ (জুন ১৯১৬)[১] |
৬,৫০০-৭,০০০ (১৯১৬)[২] ২৩,০০০ (সর্বমোট)[১] | ||||||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||||||
অজ্ঞাত | অজ্ঞাত |
আরব বিদ্রোহ (১৯১৬-১৯১৮) (আরবি: الثورة العربية Al-Thawra al-`Arabiyya) (তুর্কি: Arap İsyanı) শরিফ হুসাইন বিন আলী কর্তৃক সূচিত হয়। উসমানীয়দের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ এবং সিরিয়ার আলেপ্পো থেকে ইয়েমেনের এডেন পর্যন্ত বিস্তৃত একটি একক আরব রাষ্ট্র গঠন এই বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ছিল।
উসমানীয় সাম্রাজ্যে জাতীয়তাবাদের উত্থান হয় ১৮২১ সালের দিকে। আরব জাতীয়তাবাদের ভিত্তিভূমি ছিল মাশরিক (মিশরের পূর্বদিকের আরব ভূমি) বিশেষ করে শামে। আরব জাতীয়তাবাদীদের রাজনৈতিক ঝোক প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে সহনীয় ছিল। আরবদের দাবিগুলো ছিল সংস্কারবাদী ধরনের। সাধারণ স্বায়ত্বশাসন, শিক্ষায় আরবির ব্যবহার বাড়ানো ও শান্তিকালীন সামরিক বাহিনীতে যোগদানের নিয়ম পরিবর্তন এসবেই সীমাবদ্ধ ছিল।
১৯০৮ সালের ৩ জুলাই তরুণ তুর্কি বিপ্লব শুরু হয় এবং খুব দ্রুত তা সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ ১৮৭৬ সালের সংবিধান পুনঃস্থাপন ও সংসদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। এই সময়কে দ্বিতীয় সাংবিধানিক যুগ বলা হয়। ১৯০৮ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তরুণ তুর্কিরা তাদের কমিটি অব ইউনিয়ন এন্ড প্রগ্রেসের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রিন্স শাবাহাদ্দিনের দলকে পরাস্ত করতে সমর্থ হন। সিইউপি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে উদারনৈতিক ছিল। সেসাথে তারা ব্রিটিশদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ ও সুলতানের নিকটবর্তী ছিল। নতুন সংসদ ১৪২ জন তুর্কি, ৬০ জন আরব, ২৫ জন আলবেনিয়ান, ২৩ জন গ্রিক, ১২ জন আর্মেনিয়ান, ৫ জন ইহুদি, ৪ জন বুলগেরিয়ান, ৩ জন সার্ব ও ১ জন ভ্লাচ নিয়ে গঠিত হয়। উসমানীয় সংসদে সিইউপি কেন্দ্রীকরণ ও আধুনিকীকরণের উপর অধিক জোর দেয়।
এই পর্যায়ে আরব জাতীয়তাবাদ কোনো গণ আন্দোলন ছিল না। সিরিয়ায় এই ধারণা সবচেয়ে শক্ত থাকলেও সেখানের পরিস্থিতিও অনুরুপ ছিল। অধিকাংশ আরবই তাদের ধর্ম, গোত্র বা নিজেদের নিজস্ব সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করত। উসমানীয়িজম ও প্যান-ইসলামিজমের ধারণা আরব জাতীয়তাবাদের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল।
সংসদের আরব সদস্যরা ১৯০৯ সালের পাল্টা অভ্যুত্থানকে সমর্থন করেন। এই অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য ছিল সংবিধানের বিলুপ্তি সাধন ও দ্বিতীয় আবদুল হামিদের পুনরায় ক্ষমতায় আরোহণ। ক্ষমতাচ্যুত সুলতান তরুণ তুর্কিদের সেকুলার নীতি বাতিলের মাধ্যমে খিলাফত লাভ করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু ৩১ মার্চের পরিস্থিতির পর তাকে সেলোনিকায় নির্বাসনে যেতে হয়। তার ভাই পঞ্চম মেহমেদ তার স্থলাভিষিক্ত হন।
১৯১৩ সালে আরব মাশরিকের বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদরা প্যারিসে অনুষ্ঠিত প্রথম আরব কংগ্রেসে মিলিত হন। উসমানীয় সাম্রাজ্যের ভেতরে স্বায়ত্বশাসনের জন্য তারা একগুচ্ছ দাবি উত্থাপন করেন। সেই সাথে এও দাবি করেন যে বাধ্যতামূলকাভাবে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া আরবদেরকে যুদ্ধের সময় ছাড়া অন্য অঞ্চলে পাঠানো যাবে না।
প্রায় ৫০০০ জন সৈনিক আরব বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে বলে ধারণা করা হয়।[৩] তবে এখানে শুধু সিনাই ও ফিলিস্তিন অভিযান ও এডমন্ড এলেনবির মিশরীয় বাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্টদেরকেই হিসাব করা হয়। ফয়সাল ও লরেন্সের সাথে অংশগ্রহণকারী অনিয়মিত বাহিনীর সৈনিকদেরকে বিবেচনায় আনা হয়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সিরিয়ায় চূড়ান্ত অভিযানের সময় এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেত। অনেক আরব বিক্ষিপ্তভাবে বিদ্রোহে অংশ নিত। যখন অভিযানের অগ্রগতি দেখা যেত বা নিজেদের বাসভূমির এলাকায় প্রবেশ করতে তখন তারা এতে যোগ দেয়।[৪] আকাবা অভিযানের সময় প্রথমদিকে আরব বাহিনীতে মাত্র কয়েকশত সৈনিক ছিল। পরবর্তীতে স্থানীয় গোত্রগুলো থেকে এক হাজারের বেশি মানুষ আকাবায় চূড়ান্ত অভিযানের জন্য যোগ দেয়। হুসাইনের সৈন্যসংখ্যার বিভিন্ন বিবরণ পাওয়া যায়। কিন্তু ১৯১৮ সাল নাগাদ তাদের সংখ্যা ৩০,০০০ এর মত ছিল। হাশেমি সৈন্যবাহিনী দুইটি অংশ নিয়ে গঠিত ছিলঃ গোত্রীয় অনিয়মিত সৈন্য যারা উসমানীয়দের বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ করত ও উসমানীয় আরব যুদ্ধবন্দীদের মধ্য থেকে সংগৃহিতদের নিয়ে গঠিত শরিফি বাহিনী যারা নিয়মিত পদ্ধতিতে যুদ্ধ করত।[৫] যুদ্ধের প্রাথমিক দিনে হুসাইনের বাহিনী মূলত বেদুইন ও অন্যান্য মরুচারি যাযাবর গোত্রগুলোকে নিয়ে গঠিত হয়েছিল। তারা তার সাথে দুর্বল মিত্রতায় আবদ্ধ ছিল এবং সমগ্র পরিস্থিতির চেয়ে গোত্রীয় আনুগত্য তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।[৬] স্বর্ণমুদ্রায় অগ্রিম বেতন না পাওয়া পর্যন্ত তারা লড়াইয়ে অংশ নিতে চাইত না।[৭] ১৯১৬ এর শেষ নাগাদ ফরাসির ১.২৫ মিলিয়ন গোল্ড ফ্রা এবং ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ ব্রিটিশরা প্রতি মাসে ২,২০,০০০ পাউন্ড বিদ্রোহে খরচ করে।[৬] ফয়সালের ধারণা ছিল যে উসমানীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত আরবদেরকে বিদ্রোহ করতে ও নিজের পক্ষে আনতে পারবেন। কিন্তু উসমানীয় সরকার অধিকাংশ আরব সেনাদেরকে যুদ্ধের প্রথম সারিতে প্রেরণ করে। ফলে এসময় মুষ্টিমেয় কিছু পক্ষত্যাগী সৈনিক আরবদের সাথে যোগ দেয়।[৮] হাশেমি বাহিনী এসময় দুর্বলভাবে সজ্জিত ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের কাছ থেকে রাইফেল ও মেশিনগানের মত প্রয়োজনীয় অস্ত্রের সরবরাহ পায়।[৯]
১৯১৭ সালে হেজাজে প্রায় ২০,০০০ জন উসমানীয় সৈন্য ছিল।[৮] ১৯১৬ সালের জুনে বিদ্রোহ শুরু হওয়ার সময় চতুর্থ উসমানীয় আর্মির ৭ম কর্পস লেফটেন্যান্ট কর্নেল আলি নসিব পাশার অধীন ৫৮তম পদাতিক ডিভিশন, জেনারেল মেহমেদ জামাল পাশার অধীন ১ম প্রাদেশিক বাহিনীর সাথে যোগ দেয়ার জন্য হেজাজে অবস্থান করছিল। এই বাহিনীর কাজ ছিল হেজাজ রেলওয়ে ও জেনারেল ফখরুদ্দিন পাশার অধীন হেজাজের বাহিনীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা।[৮] হেজাজ রেলওয়ের উপর অব্যাহত হামলার কারণে ১৯১৭ সালে ২য় আরেকটি বাহিনী গঠন করা হয়।[৮] উসমানীয় বাহিনীতে খলিফার প্রতি অণুগত সৈনিক ছিল। তারা মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে।[৮] আধুনিক জার্মান অস্ত্র সরবরাহ থাকায় প্রথমদিকে উসমানীয়রা হাশেমিদের বিরুদ্ধে সুবিধা লাভ করে।[৮] অধিকন্তু উসমানীয়দের কাছে নিজেদের বিমানবাহিনী, জার্মান বিমান ও উসমানীয় সৈনিকদের সাহায্য ছিল।[১০] সেই সাথে তারা হাইল রাজতন্ত্রের রাজা ইবনে রশিদের সাহায্য লাভ করে। ইবনে রশিদের গোত্র বর্তমান সৌদি আরবের উত্তর অঞ্চল শাসন করত এবং হাশেমি ও সৌদি এই দুই দলের সাথে সংঘাতে লিপ্ত ছিল।[১১] সরবরাহ লাইনের শেষপ্রান্তে অবস্থান করাটা উসমানীয়দের দুর্বলতা ছিল। অবস্থানগত দুর্বলতার কারণে তাদেরকে কখনো কখনো প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ করতে হয়েছে।[৮] হাশেমিদের বিরুদ্ধে উসমানীয়দের পদক্ষেপ অধিকাংশ সময়ই শত্রুর তৎপরতার চেয়ে সরবরাহের ঘাটতি কারণে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে।[৮]
যুদ্ধে আরব বিদ্রোহের মূল অবদান ছিল দশ হাজার উসমানীয় সৈনিকদেরকে ব্যস্ত রাখা। নাহয় তারা সুয়েজ খাল আক্রমণ করতে যেত। এটি ছিল বিদ্রোহ শুরু করার জন্য একটি ব্রিটিশ বিবেচনা। একে অসম যুদ্ধ হিসেবে ধরা হয়। সামরিক নেতৃবৃন্দ ও ঐতিহাসিকরা এই বিষয়ে বহুবার অধ্যয়ন করেছেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
উসমানীয় সাম্রাজ্য উসমানীয়-জার্মান মিত্রতার অংশ হিসেবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের লড়াইয়ে অংশ নেয়। দামেস্ক ও বৈরুতের অনেক আরব জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিত্বকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করা হয়। স্যার মার্ক সাইকস প্রতিরোধ পতাকাটির নকশা প্রণয়ন করেন। বিদ্রোহের উদ্দীপক হিসেবে “আরবত্ব” প্রতিষ্ঠার জন্য এটি তৈরী করা হয়।[১২]
১৯১৬ সালের ৮ জুনের দিকে পবিত্র শহর মক্কার অভিভাবক হুসাইন বিন আলী যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের পক্ষে যোগদান করেন। প্রকৃত তারিখ জানা যায়নি। উসমানীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত তরুণ আরব অফিসার মুহাম্মদ শরিফ আল-ফারুকির সাহায্যের কারণে তারা উপকৃত হন।[১৩]
হুসাইনের অধীনে ৫০,০০০ এর মত অস্ত্রধারী লোক ছিল। কিন্তু রাইফেলধারীর সংখ্যা ছিল ১০,০০০ এর কম।[১৪] উসমানীয় সরকার যুদ্ধের পর তাকে পদচ্যুত করবে এই খবর পেয়ে তিনি ব্রিটিশ হাই কমিশনার হেনরি ম্যাকমাহনের সাথে চিঠি বিনিময় করেন। মিত্রশক্তির পক্ষাবলম্বন করলে মিশর থেকে পারস্য পর্যন্ত বিস্তৃত আরব সাম্রাজ্য দেয়া হবে বলে আশ্বাস দেয়া হয়। কুয়েত, এডেন ও সিরিয়া উপকূলের কিছু এলাকাকে এর মধ্যে ধরা হয়নি। এসময় হুসাইন কাগজ কলমে উসমানীয়দের পক্ষের হলেও মিত্রশক্তির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেন। জাইদ পরিবারের প্রধান শরিফ আলি হায়দার মক্কার শরীফের পদের জন্য উসমানীয় সরকারের সাথে আতাত করছে ও তাকে শীঘ্রই ক্ষমতাচ্যুত করা হবে এমন গুজবের কারণে তিনি এই সিদ্ধান্ত নেন।[১৫] দামেস্কে আরব জাতীয়তাবাদীদেরকে জনসম্মুখে মৃত্যুদন্ড দেয়ায় হুসাইনের মনে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ভয় বৃদ্ধি পায়।[৩] ১৯১৬ সালের ৫ জুন হুসাইনের দুই পুত্র আমির আলী বিন হুসাইন ও ফয়সাল মদীনার উসমানীয় সামরিক ঘাঁটি আক্রমণের মাধ্যমে বিদ্রোহ শুরু করেন। কিন্তু ফখরি পাশার নেতৃতাধীন তুর্কি বাহিনীর কাছে তারা পরাজিত হন।[১৬] ১৯১৬ সালের ১০ জুন হুসাইন তার সমর্থকদের মক্কার উসমানীয় ঘাটি আক্রমণের আদেশ দিলে বিদ্রোহ প্রকৃতভাবে শুরু হয়।[১৭] মক্কার যুদ্ধে সুসজ্জিত উসমানীয় সেনাদের সাথে হুসাইনের সমর্থকদের মধ্যে এক মাসের মত রক্তাক্ত লড়াই হয়।[৩] ব্রিটিশদের পাঠানো মিশরীয় সৈনিকরা মক্কার হাশেমিদের সাথে যোগ দেয় ও অস্ত্রের সরবারহ প্রদান করে। এরপর ৯ জুলাই আরব তাদের দখলে আসে।[৩] উসমানীয়দের এলোপাতাড়ি গোলাবর্ষণ মক্কার ক্ষতির কারণ হলে তা “তারা পবিত্র শহর মক্কার অমর্যাদা করেছে” এমন অপপ্রচারের সুযোগ করে দেয়।[৩] জুনের ১০ তারিখ হুসাইনের আরেক পুত্র আমির আবদুল্লাহ তাইফ আক্রমণ করেন। ২২ সেপ্টেম্বর মিশরীয় বাহিনীর গোলন্দাজদের সহায়তায় আবদুল্লাহ তাইফ দখল করেন।[৩]
ব্রিটিশ ও ফরাসি নৌবাহিনী লোহিত সাগর থেকে উসমানীয়দের তাড়িয়ে দেয়।[১৮] ব্রিটিশ যুদ্ধ্বজাহাজ ও সিপ্লেনের সহয়তায় ১০ জুন ৩৫০০ জন আরব জেদ্দা বন্দর আক্রমণ করে।[১৪] ব্রিটিশ বিমানবাহী জাহাজ এইচএমএস বেন-মাই-চেরি হাশেমিদের আকাশ থেকে সাহায্যে ভূমিকা রাখে।[১৯] ১৬ জুন উসমানীয়রা আত্মসমর্পণ করে। ১৯১৬ এর সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ আরবরা ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সহায়তায় উপকূলীয় শহর রাবেঘ, ইয়ানবো, কুনফিদা দখল করে ও ৬০০০ জন উসমানীয়কে বন্দী করা হয়।[১৪] এর ফলে ব্রিটিশরা ৭০০ জন উসমানীয় আরব যুদ্ধবন্দীকে বিদ্রোহে পাঠাতে সক্ষম হয়। তারা নুরি আস-সাইদের নেতৃত্বে বিদ্রোহে যোগ দিয়ে সম্মত হয়েছিল। সেই সাথে ফরাসি উত্তর আফ্রিকা থেকে বেশ কিছু মুসলিম সৈনিক বিদ্রোহে যোগ দেয়।[১৯] পনের হাজার সুসজ্জিত উসমানীয় সেনা হেজাজে রয়ে যায়।[১৪] কিন্তু অক্টোবরে মদীনার উপর সরাসরি হামলায় আরবদের বিতাড়িত হয়।
১৯১৬ সালের জুনে ব্রিটিশরা হেজাজের বিদ্রোহে সাহায্য করার জন্য বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে পাঠায়। কর্নেল সিরিল উইলসন, কর্নেল পিয়ার্স সি. জয়েস ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল স্টুয়ার্ট ফ্রান্সিস নিউকম্ব এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।[২০] অন্যদিকে ফরাসিরা কর্নেল এডওয়ার্ড ব্রেমেনকে ফ্রান্সের সামরিক মিশনে প্রেরণ করে।[২০] ফ্রান্স কয়েকজন মুসলিম অফিসারকে নিয়োগ করায় এক্ষেত্রে বেশি সুবিধা পায়। এই অফিসাররা হলে ক্যাপ্টেন আউল্ড আলি রাহো, ক্লড প্রস্ট ও লরেন্ট ডেপুই (শেষের দুইজন আরবে অবস্থানকালে ইসলাম গ্রহণ করেন)।[২০] ফরাসি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন রোজারিও পিসানি মুসলিম না হলেও প্রকৌশলী ও গোলন্দাজ অফিসার হিসেবে বিদ্রোহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।[২০]
১৯১৬ এর অক্টোবরে মিশরের ব্রিটিশ সরকার তরুণ অফিসার ক্যাপ্টেন টমাস এডওয়ার্ড লরেন্সকে হেজাজের হাশেমি বাহিনীর সাথে কাজ করার জন্য পাঠায়।[১৮] ইংরেজ ঐতিহাসিক ডেভিড মারফি লিখেছেন যে লরেন্স যদিও ব্রিটিশ ও ফরাসি অফিসারদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কিন্তু ঐতিহাসিক লেখায় মনে হয় যে লরেন্স নিজেই আরবে মিত্রশক্তির প্রতিনিধিত্ব করছিলেন।[২০]
আরব বিদ্রোহের সাফল্যের জন্য ডেভিড হোগার্থ গারট্রুড বেলকে কৃতিত্ব দেন। তিনি অক্সফোর্ড থেকে স্নাতক হন। ১৮৮৮ সাল থেকে শুরু করে তিনি ব্যাপকভাবে মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণ করেন। ১৯১৪ সালের জানুয়ারি বেল হাউয়িতাত গোত্রের শেখ হার্বের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং লরেন্সের আকাবা দখলের জন্য প্রয়োজন এমন তথ্য সরবরাহ করেন। ডেভিড হোগার্থ বলেন যে লরেন্স তার রিপোর্টের উপর নির্ভরশীল ছিলেন এবং যা ১৯১৭ ও ১৯১৮ সালের আরব অভিযানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।[২১]
১৯১৬ সালের ডিসেম্বরে লরেন্স ইয়ানবোতে একটি উসমানীয় হামলা প্রতিহত করার জন্য ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সহয়তা পান।[২২] আরব বিদ্রোহে লরেন্সের প্রধান অবদান ছিল ব্রিটিশ কৌশলের পক্ষে ফয়সাল ও আবদুল্লাহর মত আরব নেতাদের সমর্থন লাভ করা। লরেন্স ফয়সালের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ফয়সালের উত্তর আরব বাহিনী ব্রিটিশদের জন্য প্রধান সাহায্যকারী বাহিনী হয়ে উঠে।[২৩] অপরদিকে আবদুল্লাহর সাথে লরেন্সের সম্পর্ক ভাল ছিল না। ফলে আবদুল্লাহর আরব পূর্বাঞ্চল বাহিনী ব্রিটিশদের সাহায্য খুব একটা পায়নি।[২৪] উসমানীয়দেরকে মদীনা থেকে বের করে দেয়ার পাশাপাশি হেজাজ রেলওয়ে আক্রমণ করার ব্যাপারে লরেন্স আরবদেরকে উৎসাহিত করে। এর ফলে রেলপথের সুরক্ষায় নিয়োজিত তুর্কি সৈনিকরা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়।
১৯১৬ সালের ১ ডিসেম্বর ফখরি পাশা ইয়ানবো বন্দর দখল করার জন্য তিন ব্রিগেড সৈন্য নিয়ে অগ্রসর হন।[২৩] ফখরি পাশার সৈনিকরা বেশ কয়েকটি লড়াইয়ে হাশেমি বাহিনীকে পরাজিত করে ও বন্দর দখল করে।[২৫] কিন্তু ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনী ইয়ানবো আক্রমণ করে। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতিসহ তুর্কিরা পরাজিত হয়।[২৫] ফখরি পাশা তারপর তার বাহিনী দক্ষিণের রাবেঘ দখলের জন্য অগ্রসর হন। কিন্তু সৈনিক ও সরবরাহ লাইনের উপর গেরিলা আক্রমণ, ইয়ানবোতে নবগঠিত উড্ডয়ন কেন্দ্র থেকে হামলা এবং তার সরবরাহ দূরত্ব অধিক হয়ে যাওয়ায় তিনি ১৯১৭ সালের ১৮ জানুয়ারি মদীনায় ফিরে আসেন।[২৬]
উপকূলীয় শহর আল ওয়াজ ছিল হেজাজ রেলওয়ে আক্রমণের মূল ঘাটি।[২২] ১৯১৭ সালের ৩ জানুয়ারি ফয়সাল লোহিত সাগরের উপকূল ধরে যাত্রা শুরু করেন। তার সাথে ৫১০০ উষ্ট্রারোহী, ৫৩০০ পদাতিক, চারটি ক্রাপ মাউন্টেন গান, দশটি মেশিন গান ও ৩৮০ মালবাহী উট ছিল।[২২] এই যাত্রাপথে রাজকীয় নৌবাহিনী ফয়সালকে প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহ করে।[২৭] ১৯১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি দক্ষিণ দিক থেকে ৮০০ উসমানীয় আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হলে ৪০০ আরব ও ব্রিটিশ নৌবাহিনী উত্তর দিক থেকে আক্রমণ করে।[২৭] ওয়াজ ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে আত্মসমর্পণ করে এবং উসমানীয়রা মদীনার সুরক্ষার জন্য মক্কা ত্যাগ করে।[২৮] আরব বাহিনীতে এসময় সত্তর হাজার লোকবল ছিল এবং রাইফেলের সংখ্যা ছিল আটাশ হাজার। পুরো বাহিনীকে তিনটি প্রধান দলে ভাগ করে দেয়া হয়।[২৮] আলীর বাহিনী মদীনার উপর তৎপরতা চালান, আবদুল্লাহ ওয়াদি আইস থেকে নিজের কাজ পরিচালনা করেন এবং ফয়সাল তার বাহিনীকে নিয়ে ওয়াজে অবস্থান করেন।[২৮] উষ্ট্রারোহী আরবরা ১০০০ মাইলের মধ্যে বাধাবিপত্তি ছাড়াই যাতায়াত করতে পারত।[২৯] ১৯১৬ সালে মিত্রশক্তি উসমানীয় আরব যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে নিয়মিত আরব সেনাবিহিনী গঠন শুরু করে (একে শরিফাইন আর্মিও বলা হয়)।[২০] নিয়মিত বাহিনীর সৈনিকরা ব্রিটিশ ধাচের ইউনিফর্ম ও মাথায় "কেফিয়াহ" পরত। তারা নিয়মিত পদ্ধতিতে যুদ্ধে অংশ নিত।[১০] যুদ্ধে অংশ নেয়া উল্লেখযোগ্য উসমানীয় অফিসাররা হচ্ছেন নুরি আস-সাইদ, জাফর আল-আসকারি ও আজিজ আলি আল-মিসরি।[৩০]
১৯১৭ সালে আমির আবদুল্লাহর নেতৃত্বে আরব পূর্বাঞ্চল বাহিনী আশরাফ বের নেতৃতাধীন একটি উসমানীয় কনভয়কে আক্রমণ করেন ও ২০,০০০ পাউন্ড সমমূল্যের স্বর্ণমুদ্রা লাভ করেন। সুলতানের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য এগুলো বিভিন্ন আরব গোত্রকে প্রদানের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।[৩১] ১৯১৭ সাল থেকে শুরু করে হাশেমি যোদ্ধারা হেজাজ রেলওয়ে আক্রমণ শুরু করে।[৩২] প্রথমে নিয়মিত বাহিনীর আল-মিসরির এবং ব্রিটিশ অফিসার নিউকম্ব, লেফটেন্যান্ট হর্নবি ও মেজর এইচ. গারলেন্ড রেলপথের অরক্ষিত অংশগুলো উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেন।[৩২] ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে গারলেন্ড নিজের ডিজাইন করা একটি মাইন দিয়ে প্রথমবারের মত একটি চলন্ত রেলগাড়ি আক্রমণ করে সেটি ধ্বংস করে দেন।[৩৩][৩৩] মদীনায় ফরাসি সামরিক বাহিনীর ক্যাপ্টেন আউল্ড আলি রাহো রেলপথের উপর তার আক্রমণ পরিচালনা করেন।[৩৪] তিনি রেলপথ ধ্বংসের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি ছিলেন।[৩৪] ১৯১৭ এর মার্চে লরেন্স হেজাজ রেলওয়ের উপর তার প্রথম আক্রমণ পরিচালনা করেন।[৩৫] একই বছর নিউকম্ব ও জয়েস তাদের হামলা পরিচালনা করেন।[৩৫] ১৯১৭ এর আগস্টে একটি অভিযানে ক্যাপ্টেন রাহো হেজাজ রেলওয়ের পাঁচ কিমি পথ ও চারটি সেতু ধ্বংস করার জন্য বেদুইনদের একটি দলকে নেতৃত্ব দেন।[৩৬]
১৯১৭ এর মার্চে ইবনে রশিদের নেতৃতাধীন গোত্রীয় লোকজন উসমানীয়দের সাথে যোগ দেয়। তারা হাশেমিদের উপর হামলা চালায়।[২৬] তবে ১৯১৬ এর ডিসেম্বরে ইয়ানবো দখলে উসমানীয়রা ব্যর্থ হওয়ায় হাশেমিদের শক্তি অনেকাংশে বৃদ্ধি পায় এবং উসমানীয়দেরকে আক্রমণাত্মক অবস্থা থেকে সরে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থায় সরে যেতে হয়।[২৬] লরেন্স পরে দাবি করেন যে ইয়ানবোর পরাজয় হেজাজ পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়।[২৫]
১৯১৭ সালে লরেন্স আরব অনিয়মিত বাহিনী ও আউদা আবু তায়ির অধীন বাহিনীকে নিয়ে বন্দর নগরী আকাবা আক্রমণ করেন। লোহিত সাগরের তুর্কি বন্দরগুলোর মধ্যে তখন পর্যন্ত আকাবা টিকে ছিল।[২৯] আকাবা দখলের মাধ্যমে আরব বিদ্রোহে ব্রিটিশ সাহায্য সরবরাহের অগ্রগতি হত।[৩৭] লরেন্স ও আউদা ১৯১৭ এর ৯ মে ৪০ জন সঙ্গীসহ যাত্রা করেন। সিরিয়ান গোত্র হাউয়িতাত উটের উপর যুদ্ধের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। তাদের কাছ থেকে লোকবল সংগ্রহ করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল।[৩৭] ৬ জুলাই অল্প হতাহতের মাধ্যমে আকাবা আরবদের দখলে আসে।[৩৭] লরেন্স এরপর আকাবায় ২৫০০ জন আরব ও ৭০০ জন তুর্কি বন্দীদের জন্য খাবার ও অন্যান্য সরবরাহের জন্য ১৫০ মাইল দূরে সুয়েজ যাত্রা করেন। শীঘ্রই ইংরেজ ও ফরাসি নৌবহর এখানে অবস্থান নেয় ফলে আরবদের পক্ষে শহর দখলে রাখা সহজ হয়।[৩৭] একই বছরে জেনারেল এলেনবির সহায়তায় আরবরা উসমানীয়দের উপর বেশ কয়েকটি সফল আক্রমণ পরিচালনা করে। এর ফলে বীরশেবার যুদ্ধ সংঘটিত হয়।[৩৮] এধরনের আক্রমণ ১৯১৭ এর সেপ্টেম্বর থেকে লরেন্সের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। এতে লরেন্স তুর্কি রেলগাড়ি ধ্বংস করে দিতেন।[৩৯] নভেম্বরে এলেনবির আক্রমণকে সাহায্য করার জন্য লরেন্স ইয়ারমুক নদীর তীরে একটি অভিযান পরিচালনা করেন। এই অভিযানে তিনি তেল শিহাবের রেলসেতু ধ্বংস করতে ব্যর্থ হলেও জেনারেল মেহমেদ জামাল পাশার ট্রেনকে ধ্বংস করে দেন।[৪০] এই অভিজানে এলেনবির জয় ১৯১৭ সালের ক্রিসমাসের আগেই জেরুজালেম বিজয় ত্বরাণ্বিত করে।
আকাবা দখলের সময় অনেক অফিসার ফয়সালের অভিযানে যোগ দেয়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল স্টুয়ার্ট এফ. নিউকম্ব ও সিরিল ই. উইলসনের তত্ত্বাবধানে ব্রিটিশ অফিসার ও উপদেষ্টারা আরবদেরকে রাইফেল, বিস্ফোরক, মর্টার ও মেশিন গান সরবরাহ করে।[৪১] ঘাটতির কারণে অস্ত্র বিচ্ছিন্নভাবে সরবরাহ করা হত।[৪১] মিশরীয় ও ভারতীয় সৈনিকরা প্রথমদিকে মেশিনগানার ও বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিদ্রোহে অংশ নেয় এবং কয়েকটি রোলস রয়েস সাজোয়া যান যুদ্ধের জন্য বরাদ্দ করা হয়।[৪১][৪২] ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীও আরবদের অপারেশনে সমর্থন দেয়। সেই সাথে রাজকীয় উষ্ট্র বাহিনীও আরবদের সাথে কিছু সময়ের জন্য কাজ করে।[৪৩] ব্রেমন্ডের অধীন ফরাসি ১১০০ অফিসার হুসাইন ও তার পুত্র, বিশেষ করে আমির আলী ও আবদুল্লাহর সাথে শখ্য গড়ে তোলে। তাই আরব দক্ষিণ বাহিনীতেই ফরাসিদের তৎপরতা বেশি ছিল। আমির আলীর অধীন এই বাহিনী মদীনা অবরোধে অংশ নেয়। অন্যদিকে আবদুল্লাহর অধীন পূর্বাঞ্চল বাহিনী ইবনে রশিদের কাছ থেকে আলীর পূর্ব ভাগ রক্ষার দায়িত্বে ছিল।[২০] হাশেমি বাহিনী কখনোই মদীনা দখল করতে পারেনি। কেবল ১৯১৯ সালের ৯ জানুয়ারি তুর্কি সরকারের ঘোষণার পরই উসমানীয় কমান্ডার ফখরি পাশা আত্মসমর্পণ করেন।[৪৪] এসময় মদীনায় মোট ৪৬৫ জন অফিসার ও ৯৩৬৪ জন সৈনিক ছিল।[৪৪]
লরেন্স, উইলসন ও অন্যান্য অফিসারদের নির্দেশনায় আরবরা হেজাজ রেলওয়ের উপর সফল আক্রমণ পরিচালনা করে। এছাড়াও তারা সামরিক সরবরাহ আটক করে, ট্রেন ও ট্রাক ধ্বংস করে এবং হাজারের বেশি উসমানীয় সৈনিকদের বন্দী করে।[৪৫] যদিও এসব আক্রমণ সাফল্য সবসময় আসত না, তবুও তারা উসমানীয় সৈন্যদের বন্দী করা ও মদীনাকে বিচ্ছিন্ন করায় সফল ছিল। ১৯১৮ সালের জানুয়ারিতে আরব বিদ্রোহের অন্যতম বৃহৎ যুদ্ধে লরেন্স ও আরব সৈনিকরা তাফিলাহতে উসমানীয়দের একটি বড় সৈন্যবহরকে পরাজিত করে।[৪৬]
১৯১৮ সালের মার্চে আরব উত্তর বাহিনী নিম্নোক্তদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল:
১৯১৮ সালের এপ্রিলে জাফর আল-আসকারি ও নুরি আস-সাইদ মানের সুরক্ষিত রেলপথের উপর নিয়মিত আরব বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করেন। এতে দুই পক্ষে ব্যাপক হতাহত হয়।[৪৮] শরিফি বাহিনী মানকে বিচ্ছিন্ন করতে সমর্থ হলেও তারা ১৯১৮ এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অবস্থান বজায় রাখে।[৪৯] মানের সেনাঘাঁটিতে মাস্টার্ড গ্যাস ব্যবহারের জন্য আল-আসকারির বেশ কয়েকটি অণুরোধ ব্রিটিশরা ফিরিয়ে দেয়।[৪৯]
১৯১৮ সালের বসন্তে অপারেশন হেজহক হেজাজ রেলওয়ে ধংসের জন্য পরিচালিত হয়।[৫০] মে মাসে রেলপথের ২৫টি সেতু ধ্বংস করা হয়।[৫১] ১১ মে আরবরা জেরদুন অধিকার করে ও ১৪০ জনকে বন্দী করে। পাঁচ সপ্তাহ পর ২৪ জুলাই মেজর আর. ভি. বাক্সটনের অধীন ইমপেরিয়াল ক্যামেল কর্পস ব্রিগেডের নস. ৫ ও ৭ কোম্পানি মুদাওয়ারা স্টেশন আক্রমণের জন্য সুয়েজ খাল থেকে আকাবার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।[৫২] ইমপেরিয়াল ক্যামেল কর্পস ১৯১৮ এর ৮ আগস্টে এখানে একটি সফল হামলা পরিচালনা করে।[৫৩] তারা ১২০ জনকে বন্দী ও দুটি কামান লাভ করে সেসাথে ১৭ জন হতাহত হয়। বাক্সটনের দুই কোম্পানি ইমপেরিয়াল ক্যামেল কর্পস আম্মানের দিকে যাত্রা করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মূল সেতু ধ্বংস করে দেয়া। শহর থেকে ২০ মাইল (৩২ কিমি) দূরে তারা বিমান হামলার শিকার হয়।[৫২] মিত্রশক্তির চূড়ান্ত আক্রমণের জন্য এলেনবি আমি ফয়সাল ও তার আরব উত্তরাঞ্চল বাহিনীকে তুর্কি বাহিনীগুলোকে পূর্ব দিক থেকে আক্রমণের জন্য বলেন। এই উদ্দেশ্য ছিল লেভান্টে অবস্থানরত তুর্কি কমান্ডারদেরকে নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সন্দিহান করে তোলা।[৫৪] এখানে আমির ফয়সালের বাহিনীতে রুয়াল্লা, বনি সাখর, আজিয়াল ও হাওয়িতাত গোত্রের সদস্যরা ছিল।[৫৫] পাশাপাশি ফয়সালের সাথে গুর্খা সৈনিক, ব্রিটিশ সাজোয়া যান, মিশরীয় ক্যামেল কর্পস, ক্যাপ্টেন পিসানির অধীন আলজেরিয়ান গোলন্দাজ সৈনিক ও ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর সাহায্য ছিল।[৫৬]
১৯১৮ তে আরব অশ্বারোহীদের শক্তিবৃদ্ধি পায় এবং এসময় জয় হাতের নাগালে বলে মনে হচ্ছিল। এসময় তারা এলেনবির সেনাবাহিনীকে উসমানীয় সেনাদের অবস্থান সংক্রান্ত গোয়েন্দা তথ্য দিতেও সক্ষম ছিল। তারা উসমানীয় সরবরাহ ব্যবস্থা, ছোট ঘাঁটি ও রেলপথ ধ্বংস করে। ২৭ সেপ্টেম্বর উসমানীয়, অস্ট্রিয়ান ও জার্মান সৈনিকরা মেজেরিব থেকে পিছু হটার সময় তাফাসের নিকট একটি যুদ্ধে আরবরা বড় বিজয় অর্জন করে। এসময় কথিত তাফাস গণহত্যা সংঘটিত হয়।[৫৭] লরেন্স তার ভাইকে লেখা এক চিঠিতে দাবি করেন যে এসময় “বন্দী না রাখা”র আদেশ দেয়া হয়েছিল। তাফাস গ্রামে উসমানীয়দের গণহত্যার বদলা হিসেবে এই আদেশ দেয়া হয়। এখানে মোট ২৫০ জন জার্মান ও অস্ট্রিয়ান যুদ্ধবন্দী ও অগণিত তুর্কিদের গুলি করে হত্যা করা হয়।[৫৭] পরবর্তীতে লরেন্স তার “সেভেন পিলার্স অব উইজডম” বইয়ে তাফাসের ঘটনার উল্লেখ করেন।[৫৮] এসব যুদ্ধের অন্যতম মেগিড্ডোর যুদ্ধে এলেনবি সাফল্য লাভ করেন।[৫৯] ১৯১৮ এর সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের দিকে উসমানীয় সৈনিকরা পিছু হটতে ও ব্রিটিশদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে থাকে।[৬০] ১৯১৮ এর ২৭ সেপ্টেম্বর লরেন্সের অধীন অনিয়মিত বাহিনী দেরা দখল করে।[৬১] উসমানীয় বাহিনী ১০ দিনের মধ্যেই পরাজিত হয়। এলেনবি জয়ের জন্য ফয়সালের ভূমিকার প্রশংসা করে বার্তা পাঠান।[৬২]
১৯১৮ এর ৩০ সেপ্টেম্বর দামেস্ক পৌছানো প্রথম আরব বিদ্রোহী বাহিনী হল শরিফ নাসেরের হাশেমি উষ্ট্রারোহী বাহিনী ও নুরি শালানের অধীন রুয়াল্লা গোত্রের অশ্বারোহী বাহিনী। এসব সৈনিকরা শহরের বাইরে ফয়সালের আগমনের অপেক্ষা করছিল। অল্প কয়েকজনের একটি দলকে শহরের ভেতর প্রেরণ করা হয় এবং তারা দেখতে পায় যে শহরের আরব জাতীয়তাবাদী অধিবাসীরা আরব বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করেছে। এরপর সেদিন অস্ট্রেলিয়ান লাইট হর্স সৈনিকরা দামেস্কে প্রবেশ করে। আউদা আবু তায়ি, লরেন্স ও আরব সৈনিকরা পরের দিন ১ অক্টোবর শহরে প্রবেশ করেন। যুদ্ধের শেষে ইজিপশিয়ান এক্সপিডিশনারি ফোর্স ফিলিস্তিন, ট্রান্সজর্ডান, লেবানন, আরব উপদ্বীপের বিরাট এলাকা ও দক্ষিণ সিরিয়া অবরোধ করে। সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও ১৯১৯ এর জানুয়ারি পর্যন্ত মদীনা আত্মসমর্পণ করেনি।
উসমানীয়দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে আরবদের স্বাধীনতাকে সমর্থন করা হবে – এই মর্মে যুক্তরাজ্য হুসাইন-ম্যাকমোহন চুক্তিতে রাজি হয়েছিল। চুক্তির বিষয়ে উভয়পক্ষের নিজস্ব অভিমত ছিল। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স মূল চুক্তি পরিত্যাগ করে এবং অত্র এলাকাকে ১৯১৬ সালের সাইকস-পিকট চুক্তি মোতাবেক বিভক্ত করার পরিকল্পনা করে। আরবদের কাছে এটি অসন্তোষজনক ছিল। ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণা আরো সন্দেহের সৃষ্টি করে। এই ঘোষণায় ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনে রাষ্ট্র ঘোষণার কথা বলা হয়। আরবের পশ্চিম অংশের হেজাজ অঞ্চল হুসাইন বিন আলীর নেতৃত্বে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং ১৯২৫ সাল পর্যন্ত স্বাধীনতা বজায় রাখে। এরপর ব্রিটিশরা তাদের সমর্থন সৌদ পরিবারের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। সৌদিরা হেজাজ দখল করে নেয়।