আরব–ইসরায়েল সংঘর্ষ (১৯৬৭–১৯৭০) | |||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
আরব–ইসরায়েল দ্বন্দ্ব এবং স্নায়ুযুদ্ধের অংশ | |||||||||
![]() মিশর–ইসরায়েল সংঘর্ষের কেন্দ্রস্থলে ছিল সুয়েজ খাল | |||||||||
| |||||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||||
![]() |
![]() ![]() ![]() | ||||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||||
![]() ![]() ![]() ![]() ![]() ![]() |
![]() ![]() ![]() ![]() ![]() ![]() | ||||||||
শক্তি | |||||||||
![]() |
![]() ![]() | ||||||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||||||
![]() ২,৬৫৯ সৈন্য আহত (৯৯৯ জন মিসরীয় রণাঙ্গনে)[৭] ১৪[৯]–৩০[১০] টি যুদ্ধবিমান ধ্বংসপ্রাপ্ত |
![]() ২,৫০০ যোদ্ধা ধৃত[১৬] ![]() ১০৮–২৫০ সৈন্য আহত ৪ সৈন্য ধৃত ৩০টি ট্যাঙ্ক ধ্বংসপ্রাপ্ত ![]() | ||||||||
![]() ![]() |
আরব–ইসরায়েল সংঘর্ষ (১৯৬৭–১৯৭০) বা ক্ষয়কারক যুদ্ধ (আরবি: حرب الاستنزاف হারব আল-ইসতিনজাফ, হিব্রু ভাষায়: מלחמת ההתשה মিলহেমেত হাহাতাশাহ) ছিল ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ইসরায়েল এবং আরব রাষ্ট্রসমূহ (মিশর, জর্ডান, পিএলও ও সিরিয়া) ও তাদের মিত্ররাষ্ট্রগুলোর (সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কিউবা) মধ্যে সংঘটিত একটি যুদ্ধ।
১৯৬৭ সালের আরব–ইসরায়েল যুদ্ধে আরবদের শোচনীয় পরাজয়েরও পর আরব–ইসরায়েলি সংঘাত সমাধান করার কোনো বাস্তবিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানো হয় নি। ১৯৬৭ সালের সেপ্টেম্বরে আরব রাষ্ট্রসমূহ খার্তুম ঘোষণার মাধ্যমে তিন 'না'-এর নীতি অনুসরণ করে এবং ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি স্থাপন, স্বীকৃতি প্রদান ও সমঝোতা থেকে বিরত থাকে। মিশরীয় রাষ্ট্রপতি গামাল আব্দেল নাসের বিশ্বাস করতেন যে, কেবল সামরিক বল প্রয়োগের মাধ্যমেই ইসরায়েলকে সিনাই উপদ্বীপ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে বাধ্য করা সম্ভব[১৭]। ফলে শীঘ্রই সুয়েজ খাল বরাবর সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়।
প্রথমদিকে এসব সংঘর্ষ গোলন্দাজ বাহিনীর দ্বন্দ্ব এবং ক্ষুদ্রমাত্রার অনুপ্রবেশ অভিযানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু ১৯৬৯ সালের দিকে মিশরীয় সেনাবাহিনী বড়মাত্রার অভিযানের জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত মনে করতে থাকে। ১৯৬৯ সালের ৮ মার্চ নাসের আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে 'ক্ষয়কারক যুদ্ধ' ঘোষণা করেন। এই যুদ্ধের বৈশিষ্ট্য ছিল সুয়েজ খাল বরাবর গোলাবর্ষণ, ব্যাপক হারে আকাশযুদ্ধ এবং কমান্ডো হামলা[১৮]। ১৯৭০ সালের আগস্ট পর্যন্ত সংঘর্ষ চলতে থাকে। এরপর সীমান্তের কোনোরূপ পরিবর্তন কিংবা শান্তি স্থাপনের কোনো দৃঢ় প্রতিশ্রুতি ব্যতীতই যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষরিত হয় এবং সংঘর্ষের অবসান ঘটে।
১ জুলাই ১৯৬৭: একটি মিশরীয় কমান্ডো বাহিনী পোর্ট ফুয়াদ থেকে দক্ষিণে অগ্রসর হয় এবং রাস এল 'ইশে অবস্থান নেয়। অঞ্চলটি সুয়েজ খালের পূর্ব তীরে পোর্ট সৈয়দ থেকে ১০ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত। ১৯৬৭ সালের ৯ জুনের যুদ্ধবিরতির সময় থেকে অঞ্চলটি ইসরায়েলিদের দখলে ছিল। একটি ইসরায়েলি আর্মার্ড পদাতিক কোম্পানি মিশরীয় কমান্ডোদের আক্রমণ করে। সংঘর্ষে ১ জন ইসরায়েলি সৈন্য নিহত এবং ১৩ জন আহত হয়, কিন্তু মিশরীয় বাহিনীটি পিছু হটতে বাধ্য হয়[১৯]। তবে ভিন্ন সূত্র অনুযায়ী, পোর্ট ফুয়াদে একটি ইসরায়েলি আক্রমণ মিশরীয়রা প্রতিহত করে দেয়।
২ জুলাই ১৯৬৭: ইসরায়েলি বিমানবাহিনী রাস এল 'ইশে কমান্ডোদের সহায়তাকারী মিশরীয় গোলন্দাজ বাহিনীর অবস্থানের ওপর বোমাবর্ষণ করে[২০]।
৪ জুলাই ১৯৬৭: মিশরীয় বিমানবাহিনী সিনাইয়ে বেশ কয়েকটি ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুর ওপর বিমান হামলা চালায়। ইসরায়েলিরা একটি মিশরীয় মিগ-১৭ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে[২১]।
৮ জুলাই ১৯৬৭: এল-কানাত্রায় একটি পর্যবেক্ষণ অভিযান পরিচালনার সময় ইসরায়েলি বিমান প্রতিরক্ষা বাহিনী মিশরীয় বিমানবাহিনীর একটি মিগ-২১ যুদ্ধবিমানকে ভূপাতিত করে। এরপর মিশরীয়রা ক্যামেরাসজ্জিত দুইটি এসইউ-৭ প্রেরণ করে এবং বিমান দুইটি কোনো বাধার মুখোমুখি না হয়েই পর্যবেক্ষণ অভিযানটি সম্পন্ন করে। কয়েক ঘণ্টা পরে আরেকটি পর্যবেক্ষণ অভিযানে প্রেরিত অন্য দুইটি এসইউ-৭ বিমান ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হয়, এবং একটি এসইউ-৭ ভূপাতিত হয়[২১]।
১১–১২ জুলাই ১৯৬৭: রুমানি উপকূলের যুদ্ধ - আইএনএস এইলাত নামক ইসরায়েলি নৌবাহিনীর একটি ডেস্ট্রয়ার ও ২টি টর্পেডো বোট রুমানি উপকূলের নিকটে দুইটি মিশরীয় টর্পেডো বোটকে ডুবিয়ে দেয়। মিশরীয় টর্পেডো বোটগুলোর কোনো ক্রু বাঁচতে পারে নি, এবং অন্যদিকে ইসরায়েলিদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয় নি[২২]।
১৪ জুলাই ১৯৬৭: সুয়েজ খালের নিকটে মিশরীয় ও ইসরায়েলিদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি গোলাবর্ষণ এবং বিমানযুদ্ধ হয়। ৭টি মিশরীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়[২৩]।
১৫ জুলাই ১৯৬৭: একটি মিশরীয় মিগ-২১ যুদ্ধবিমান ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর একটি মিরেজ ৩ যুদ্ধবিমানকে ভূপাতিত করে[২৪]।
২১ অক্টোবর ১৯৬৭: মিশরীয় নৌবাহিনী জাহাজ-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের সাহায্যে ইসরায়েলি ডেস্ট্রয়ার আইএনএস এইলাতকে ডুবিয়ে দেয়। এ ঘটনায় ৪৭ জন ইসরায়েলি নাবিক নিহত হয়[২৫]।
অক্টোবর ১৯৬৭: আইএনএস এইলাত ধ্বংসের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ইসরায়েলি গোলন্দাজ বাহিনী সুয়েজের নিকটবর্তী মিশরীয় তেল সংশোধনাগার এবং ডিপোগুলোর ওপর গোলাবর্ষণ করে। অক্টোবরব্যাপী কয়েক দফা পাল্টাপাল্টি গোলাবর্ষণের ফলে বেশকিছু বেসামরিক মিশরীয় নিহত হন। মিশরীয় কর্তৃপক্ষ খাল অঞ্চল থেকে বহুসংখ্যক বেসামরিক মানুষকে সরিয়ে নেয়[২৬]।
২১ মার্চ ১৯৬৮: ইসরায়েলি বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুর ওপর পিএলওর আক্রমণের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ইসরায়েল জর্দানের কারামেহ শহর আক্রমণ করে। শহরটিতে পিএলও-এর একটি বড় ঘাঁটি ছিল। এই আক্রমণের লক্ষ্য ছিল কারামেহের পিএলও ঘাঁটিটির ধ্বংসসাধন এবং ইয়াসির আরাফাতকে বন্দি করা[২৭][২৮]। আক্রমণকারী ইসরায়েলি বাহিনীর বিশালত্ব দেখে জর্দান সরকার ধারণা করে যে, গোলান মালভূমির অনুরূপ একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য ইসরায়েল জর্দানের বালকা প্রদেশ দখলের পরিকল্পনা করছে[২৯][৩০]। ইসরায়েলিদের ধারণা ছিল যে, জর্দানিরা এই আক্রমণ উপেক্ষা করবে। কিন্তু জর্দানি সামরিক বাহিনী ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের পাশাপাশি যুদ্ধ করে এবং তাদের ব্যাপক গোলাবর্ষণের ফলে ইসরায়েলিদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়[৩১]। এই সংঘর্ষের সময় ফিলিস্তিনিরা প্রথমবারের মতো আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীদের ব্যবহার করে[৩২]। সারাদিন যুদ্ধের পর ইসরায়েলিরা পশ্চাৎপসরণে বাধ্য হয়। অবশ্য পশ্চাৎপসরণের সময় তারা প্রায় ১৪১ জন ফিলিস্তিনি যোদ্ধাকে বন্দি করে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়[৩৩]। উভয়পক্ষই এই যুদ্ধে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করে, কিন্তু যুদ্ধে ইসরায়েলিদের তুলনামূলক বেশি ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী হতবাক হয়[৩৪][৩৫][৩৬]।
জুন ১৯৬৮: "আনুষ্ঠানিকভাবে" যুদ্ধ শুরু হয়, এবং মিশরীয়রা সুয়েজ খালের পূর্ব তীরে ইসরায়েলি ঘাঁটিগুলোর ওপর বিক্ষিপ্ত গোলাবর্ষণ আরম্ভ করে। পরবর্তী মাসগুলোতে আরো বেশি গোলাবর্ষণের ফলে ইসরায়েলিদের কিছু সৈন্য হতাহত হয়[৩৭]।
৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬৮: মিশরীয় গোলাবর্ষণের ফলে ১০ জন ইসরায়েলি সৈন্য নিহত এবং ১৮ জন আহত হয়। প্রত্যুত্তরে ইসরায়েল সুয়েজ ও ইসমাইলিয়ায় গোলাবর্ষণ করে[২১]।
৩০ অক্টোবর ১৯৬৮: ইসরায়েলি কমান্ডোরা একটি বিশেষ অভিযান চালিয়ে একটি মিশরীয় বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার, নীলনদের দুইটি বাঁধ এবং একটি সেতু ধ্বংস করে দেয়[২১]। এর ফলে সৃষ্ট বিদ্যুৎ সঙ্কটের ফলে নাসের কয়েক মাসের জন্য আক্রমণ বন্ধ করতে বাধ্য হন। এই সময়ে ইসরায়েলিরা তাদের শত শত গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুর আশেপাশে সুরক্ষাবেষ্টনী নির্মাণ করে। এছাড়া, সুয়েজ খালের পূর্ব তীরে বার লেভ লাইন নির্মাণের মাধ্যমে ইসরায়েল অঞ্চলটিতে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করে[৩৮]।
৩ নভেম্বর ১৯৬৮: মিশরীয় মিগ-১৭ যুদ্ধবিমানের একটি বহর ইসরায়েলি অবস্থানের ওপর বোমাবর্ষণ করে এবং ইসরায়েলি বিমানবহরের মুখোমুখি হয়। বিমানযুদ্ধে একটি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়[২১]।
১ ডিসেম্বর ১৯৬৮: ইসরায়েলি কমান্ডোরা জর্দানের রাজধানী আম্মানের নিকটে ৪টি সেতু ধ্বংস করে[২১]।
৩ ডিসেম্বর ১৯৬৮: ইসরায়েলি বিমানবাহিনী জর্দানের পিএলও ঘাঁটিগুলোর ওপর বোমাবর্ষণ করে। রাজকীয় জর্দানি বিমানবাহিনীর হকার হান্টার যুদ্ধবিমানগুলো ইসরায়েলি বিমানবহরের মুখোমুখি হয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সংক্ষিপ্ত এই বিমানযুদ্ধে একটি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়[২১]।
৮ মার্চ ১৯৬৯: মিশর ইসরায়েলের বার লেভ লাইনের ওপর গোলাবর্ষণ করে ও বিমান হামলা চালায়, এর ফলে প্রচুর ইসরায়েলি সৈন্য হতাহত হয়। প্রত্যুত্তরে ইসরায়েল মিশরের গভীরে আক্রমণ চালায় ও মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে[৩৭]।
৯ মার্চ ১৯৬৯: সুয়েজ খাল বরাবর যুদ্ধাঞ্চল পরিদর্শনকালে মিশরীয় সেনাবাহিনীর চীফ অফ স্টাফ জেনারেল আব্দুল মুনিম রিয়াদ ইসরায়েলি মর্টার হামলায় নিহত হন।
মে–জুলাই ১৯৬৯: মিশরীয় ও ইসরায়েলি সৈন্যদের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষে ৪৭ জন ইসরায়েলি সৈন্য নিহত এবং ১৫৭ জন আহত হয়। মিশরীয় সৈন্যদের হতাহতের সংখ্যা হয় আরো অনেক বেশি।
১৮ জুলাই ১৯৬৯: মিশরীয় কমান্ডোরা সিনাইয়ে ইসরায়েলি সামরিক স্থাপনাগুলোতে আক্রমণ চালায়[২১]।
১৯–২০ জুলাই ১৯৬৯: ইসরায়েলি কমান্ডোরা মিশরের গ্রিন আইল্যান্ডে আক্রমণ চালায় এবং সেখানকার মিশরীয় স্থাপনা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়। এ ঘটনায় ৬ জন ইসরায়েলি এবং ৮০ জন মিশরীয় সৈন্য নিহত হয়। মিশরীয়দের গোলাবর্ষণের ফলেই তাদের নিজেদের বেশকিছু সৈন্য হতাহত হয়।
২০–২৮ জুলাই ১৯৬৯: প্রায় সমগ্র ইসরায়েলি বিমানবাহিনী সুয়েজ খালের উত্তর ভাগ আক্রমণ করে, মিশরীয় বিমান-প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ট্যাঙ্ক ও আর্টিলারি ধ্বংস করে এবং ৮টি মিশরীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে। এই আক্রমণে প্রায় ৩০০ মিশরীয় সৈন্য নিহত হয়, এবং মিশরীয় সামরিক অবস্থানসমূহের মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ইসরায়েলিরা ২টি যুদ্ধবিমান হারায়। এই আক্রমণের ফলে ইসরায়েলিদের ওপর মিশরীয়দের গোলাবর্ষণ কিছুটা হ্রাস পায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও মিশরীয়রা হালকা অস্ত্রশস্ত্র, বিশেষত মর্টার দিয়ে ইসরায়েলিদের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখে।
আগস্ট ১৯৬৯: ইসরায়েলি বিমানবাহিনী মিশরের বিরুদ্ধে প্রায় ১,০০০টি বিমান হামলা চালায়, এবং মিশরের অসংখ্য স্যাম সাইট ধ্বংস করে দেয়। বিমানযুদ্ধে ২১টি মিশরীয় এবং ৩টি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়[২১]।
৯ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯: ইসরায়েলি নৌ কমান্ডোরা একজোড়া মিশরীয় টর্পেডো বোট ডুবিয়ে দেয়। এরপর ইসরায়েলি বাহিনী মিশরের লোহিত সাগর উপকূলে আক্রমণ চালায়। ইসরায়েলিদের একটি বিস্ফোরক আকস্মিকভাবে বিস্ফোরিত হলে ৩ জন ইসরায়েলি কমান্ডো নিহত হয়। ইসরায়েলি সেনা ও বিমানবাহিনী মিশরীয় আর্মার দখর করে, এবং ১২টি মিশরীয় সেনাঘাঁটি ধ্বংস করে। এই আক্রমণে ১০০–২০০ মিশরীয় সৈন্য হতাহত হয়, এবং একজন সোভিয়েত জেনারেলও (যিনি মিশরীয় সেনাবাহিনীতে সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত ছিলেন) প্রাণ হারান। অন্যদিকে, ১ জন ইসরায়েলি সৈন্য সামান্য আহত হয়। আক্রমণটির সময় ১টি ইসরায়েলি বিমান ভূপাতিত হয়, এবং বিমানটির পাইলট নিখোঁজ থেকে যায়।
১১ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯: ১৬টি মিশরীয় যুদ্ধবিমান ইসরায়েলিদের ওপর আক্রমণ চালায়। ইসরায়েলি মিরেজ যুদ্ধবিমানসমূহ ৮টি মিশরীয় মিগ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে, এবং আরো ৩টি মিশরীয় এসইউ-৭ যুদ্ধবিমান ইসরায়েলি বিমান-বিধ্বংসী কামান ও হক ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ধ্বংস হয়[৩৯]।
১৭ অক্টোবর ১৯৬৯: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সংঘর্ষটি সমাপ্ত করার জন্য আলোচনা আরম্ভ করে।
৯ ডিসেম্বর ১৯৬৯: মিশরীয় বিমানবাহিনী সদ্যপ্রাপ্ত পি-১৫ রাডারের সাহায্যে ইসরায়েলিদেরকে একটি বিমানযুদ্ধে পরাজিত করে এবং ২টি ইসরায়েলি মিরেজ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে। একই দিন সন্ধ্যায় লেফটেন্যান্ট আহমেদ আতেফ চালিত একটি মিশরীয় ফাইটার বিমান একটি ইসরায়েলি এফ-৪ ফ্যান্টম ২ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে। লেফটেন্যান্ট আতেফ প্রথম মিশরীয় পাইলট যিনি যুদ্ধে একটি এফ-৪ যুদ্ধবিমান ধ্বংস করতে সক্ষম হন[৪০]। একই দিনে 'রজার্স পরিকল্পনা' প্রকাশিত হয়। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী সিনাই উপদ্বীপ থেকে ইসরায়েলি সৈন্য প্রত্যাহারের পরিবর্তে মিশরকে শান্তি স্থাপনের আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু উভয় পক্ষই তীব্রভাবে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। নাসের ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো ধরনের সরাসরি আলোচনা করতে অস্বীকৃতি জানান। নাসের তার বহু ভাষণ ও বক্তব্যে এটি স্পষ্ট করে দেন যে, ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো ধরনের সরাসরি শান্তি আলোচনা তার নিকট আত্মসমর্পণের নামান্তর[৪১]। এর পরিবর্তে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণ প্রতিহত করার জন্য নাসের সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে আরো উন্নত অস্ত্রশস্ত্র লাভের জন্য আবেদন করেন। সোভিয়েতরা প্রথমদিকে অস্ত্র সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানায়[৪২]।
২৬–২৭ ডিসেম্বর ১৯৬৯: ইসরায়েল মিশরের অভ্যন্তরে ছত্রীসেনা নামায়। ইসরায়েলি ছত্রীসেনারা রাস ঘারিবে একটি মিশরীয় পি-১২ রাডার দখল করে এবং ২টি সিএইচ-৫৩ সি স্ট্যালিয়ন হেলিকপ্টারে করে ইসরায়েলে নিয়ে যায়। এর ফলে ইসরায়েলি ও মার্কিনরা সর্বাধুনিক সোভিয়েত রাডার প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে সক্ষম হয়। এই অভিযানটি মিশরীয়দের মনোবলে মারাত্মক চিড় ধরিয়ে দেয়।
২২ জানুয়ারি ১৯৭০: মিশরের রাষ্ট্রপতি নাসের পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য গোপনে মস্কোয় যান। ৩এম৯ কুব এবং স্ট্রেলা-২সহ সর্বাধুনিক ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র মিশরকে সরবরাহ করার জন্য নাসের অনুরোধ সোভিয়েত সরকার রক্ষা করে। কিন্তু এসব ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের জন্য দক্ষ সৈন্য ও রক্ষা করার জন্য কয়েক স্কোয়াড্রন যুদ্ধবিমানের প্রয়োজন ছিল। এজন্য নাসেরের প্রচুরসংখ্যক সোভিয়েত সৈন্যের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সোভিয়েত সরকার মিশরে সৈন্য প্রেরণ করতে আগ্রহী ছিল না। তখন নাসের পদত্যাগ করার হুমকি দেন এবং ভবিষ্যতে মিশর সহযোগিতার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী হবে বলে ইঙ্গিত করেন। সোভিয়েতরা মিশরে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছিল, এজন্য সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ শেষ পর্যন্ত নাসেরের অনুরোধ রক্ষা করেন। মিশরে সোভিয়েত সৈন্যসংখ্যা ২,৫০০–৪,০০০ থেকে ১০,৬০০–১২,১৫০-এ উন্নীত করার এবং একই সঙ্গে ১০০–১৫০ জন সোভিয়েত পাইলট প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
২২ জানুয়ারি ১৯৭০: ইসরায়েলি ছত্রীসেনা ও কমান্ডোরা শাদওয়ান দ্বীপে অবতরণ করে। এরপর ইসরায়েলি ও মিশরীয়দের মধ্যে সংঘর্ষে ৭০ জন মিশরীয় সৈন্য নিহত ও ৬২ জন বন্দি হয়, অন্যদিকে ৩ জন ইসরায়েলি সৈন্য নিহত ও ৭ জন আহত হয়। ইসরায়েলি সৈন্যরা একটি মিশরীয় রাডার ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম দখল করে ইসরায়েলে নিয়ে যায়। অভিযানটি চলাকালে ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর আক্রমণে ২টি মিশরীয় পি-১৮৩ টর্পেডো বোট ডুবে যায়[৪৩]।
ফেব্রুয়ারি ১৯৭০: একটি মিশরীয় কমান্ডো দল মিতলা গিরিপথে ইসরায়েলি সৈন্যদের ওপর চোরাগোপ্তা আক্রমণের চেষ্টা করে, কিন্তু ধরা পড়ে যায়। দলটির সকল সদস্য নিহত অথবা বন্দি হয়[৩৯]।
৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০: এইলাত বন্দরে মিশরীয় নৌ কমান্ডোদের আক্রমণে কয়েকটি ইসরায়েলি জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়[৪৪]।
৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০: মিশরীয় ও ইসরায়েলিদের মধ্যে একটি বিমানযুদ্ধ সংঘটিত হয়, এবং এতে উভয়পক্ষের ১টি করে যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়[২১]।
১৫ মার্চ ১৯৭০: মিশরে প্রথম কার্যক্ষম স্যাম সাইট নির্মিত হয়। এটি মিশরে প্রেরিত সোভিয়েত ইউনিয়নের ৩টি ব্রিগেডের অংশ ছিল[৪৫]। ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানসমূহ সিনাইয়ে মিশরীয় অবস্থানগুলোর ওপর বারবার বোমাবর্ষণ করে।
৮ এপ্রিল ১৯৭০: ইসরায়েলি বিমানবাহিনী মিশরীয় সামরিক স্থাপনাগুলোর ওপর বিমান হামলা চালায়। সুয়েজ খাল থেকে ৩০ কি.মি. দক্ষিণে অবস্থিত বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটির ওপর বোমাবর্ষণ করা হয়। এছাড়া ইসরায়েলিরা ভ্রান্তিবশত মিশরের বাহর এল-বকর শহরের একটি স্কুলের ওপর বোমাবর্ষণ করে। ইসরায়েলি বোমাবর্ষণের ফলে স্কুলটির ৪৬ জন শিক্ষার্থী নিহত ও ৫০ জনের বেশি আহত হয়[৪৬][৪৭]। এই ঘটনার ফলে ইসরায়েলের এই ধরনের অভিযানের অবসান ঘটে, এবং ইসরায়েলিরা সুয়েজ খালের নিকটবর্তী স্থাপনাগুলোর ওপর মনোযোগ দেয়। এই ফাঁকে মিশরীয়রা খালের নিকটে স্যাম ব্যাটারিগুলো পুনর্নির্মাণের সুযোগ পায়। সোভিয়েত পাইলটদের দ্বারা চালিত মিগ যুদ্ধবিমান বহর প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা প্রদান করে। ১৯৭০ সালের এপ্রিলের দিকে সোভিয়েত পাইলটরা ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলোকে আক্রমণ করতে শুরু করে, কিন্তু ইসরায়েলি পাইলটদের ওপর সোভিয়েত যুদ্ধবিমানগুলোকে আক্রমণ না করার নির্দেশ থাকায় ইসরায়েলি পাইলটরা পাল্টা আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকে।
এপ্রিল ১৯৭০: কুয়েতি সশস্ত্রবাহিনী মিশরীয় ফ্রন্টে প্রথম ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়[৪৮]।
মে ১৯৭০: মাসটির শেষদিকে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী পোর্ট সৈয়দের ওপর বড় ধরনের আক্রমণ চালায়। ১৬ তারিখে একটি মিগ-২১ যুদ্ধবিমান একটি ইসরায়েলি বিমানকে ভূপাতিত করে[৪৯]।
৩ মে ১৯৭০: জর্দানে ইসরায়েলি সৈন্যদের আক্রমণে ২১ জন ফিলিস্তিনি গেরিলা নিহত হয়[৪৪]।
জুন ১৯৭০: সিরীয় সামরিক অবস্থানগুলোর ওপর ইসরায়েলি আর্মার্ড আক্রমণের ফলে কয়েক শত সিরীয় সৈন্য হতাহত হয়[১]।
২৫ জুন ১৯৭০: সুয়েজ খাল অঞ্চলে মিশরীয় বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালানোর সময় একটি ইসরায়েলি এ-৪ স্কাইহক যুদ্ধবিমানকে একজোড়া সোভিয়েত মিগ-২১ বিমান পশ্চাদ্ধাবন করে এবং ইসরায়েলি বিমানটি ভূপাতিত হয়[৪৫]।
২৭ জুন ১৯৭০: মিশরীয় বিমানবাহিনী খাল অঞ্চল জুড়ে বিমান হামলা অব্যাহত রাখে। ২৭ জুন ৮টি মিশরীয় এসইউ-৭ এবং মিগ-২১ যুদ্ধবিমান সিনাইয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। ২টি মিশরীয় যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়। একটি ইসরায়েলি মিরেজ যুদ্ধবিমানও ধ্বংস হয়, এবং বিমানটির পাইলট বন্দি হয়[৫০]।
জুন ১৯৭০: মিশরীয় ফ্রন্টে সংঘর্ষে ১৬ জন কুয়েতি সৈন্য নিহত হয়[৪৮]।
১৮ জুন ১৯৭০: মিশরে একটি ইসরায়েলি বিমান হামলায় বেশকিছু সোভিয়েত সৈন্য হতাহত হয়।
৩০ জুন ১৯৭০: সোভিয়েত আকাশ-প্রতিরক্ষা বাহিনীর সৈন্যরা ২টি ইসরায়েলি এফ-৪ ফ্যান্টম যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে। দুইজন ইসরায়েলি পাইলট ও একজন নেভিগেটর বন্দি হয়, অন্যদিকে আরেকজন নেভিগেটরকে পরের দিন রাতে ইসরায়েলি হেলিকপ্টার উদ্ধার করে[২১]।
৩০ জুলাই ১৯৭০: সুয়েজ খালের পশ্চিমে ইসরায়েলি ও সোভিয়েতদের মধ্যে একটি বড় ধরনের বিমানযুদ্ধ হয়। ইসরায়েলিরা ৪টি সোভিয়েত যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে, এবং আরেকটি সোভিয়েত যুদ্ধবিমান ফেরার সময় বিধ্বস্ত হয়। ৪ জন সোভিয়েত পাইলট নিহত হয়। অন্যদিকে, একটি ইসরায়েলি মিরেজ যুদ্ধবিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়[৪৫]। সোভিয়েতরা পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে ২টি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে[৫১] এবং মিশরে আরো বেশিসংখ্যক যুদ্ধবিমান মোতায়েন করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক সরাসরি ইসরায়েল আক্রমণের আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সংঘর্ষটির শান্তিপূর্ণ সমাপ্তির লক্ষ্যে দ্বিগুণ উদ্যমে কূটনৈতিক তৎপরতা আরম্ভ করে।
আগস্ট ১৯৭০: সোভিয়েত ও মিশরীয়রা সুয়েজ খালের নিকটে বিমান-প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করতে সক্ষম হয়, এবং সোভিয়েতরা বেশ কয়েকটি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে। স্যাম ব্যাটারিগুলোর সহায়তায় মিশরীয়রা তাদের আর্টিলারি বার লেভ লাইনের সন্নিকটে জড়ো করতে সক্ষম হয়, যা লাইনটিকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়।
৭ আগস্ট ১৯৭০: একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী উভয় পক্ষকে যুদ্ধবিরতি রেখার ৫০ কি.মি. পূর্বে ও পশ্চিমে সামরিক অবস্থা পরিবর্তনে নিষেধ করা হয়। যুদ্ধবিরতির কয়েক মিনিট পরই মিশর চুক্তি লঙ্ঘন করে অঞ্চলটিতে স্যাম ব্যাটারি স্থাপন করতে আরম্ভ করে। অক্টোবরের মধ্যে অঞ্চলটিতে প্রায় ১০০টি স্যাম সাইট স্থাপিত হয়।
২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭০: মিশরীয় রাষ্ট্রপতি নাসের মৃত্যুবরণ করেন, এবং উপ-রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাত তার স্থলাভিষিক্ত হন।
In dozens of speeches and statements, Nasser posited the equation that any direct peace talks with Israel were tantamount to surrender. His efforts to forestall any movement toward direct negotiations...