আর্স কনজেঞ্জি (ল্যাটিন এই নামটির ইংরেজি "The Art of Conjecturing"; বাংলায়ঃ "অনুমানের শৈল্পিকতা") গাণিতিক সম্ভাবনা ও গুচ্ছ-বিন্যাসতত্ত্বের উপর লিখিত একটি বই। বইটি লেখেন জ্যাকব বার্নোলি। তার মৃত্যুর আট বছর পর ১৭১৩ সালে তার ভ্রাতুষ্পুত্র নিকলস বার্নোলি বইটি প্রকাশ করেন। গণিতের এই অনন্য ও নতুন সৃষ্টকর্মটি শুধু গুচ্ছ-বিন্যাসতত্ত্বেরই নয়, সম্ভাবনার বিধিমালারও ভিত্তি-স্থাপনে অবদান রেখেছে, যেমনঃ বড় সংখ্যাসমূহের বিধি (law of large numbers), প্রকৃতপক্ষে,বিস্তরভাবে এই বিষয়ে এই বইটিকে একটি বুনিয়াদি অবদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমান সময়ের টুয়েলভফোল্ড ওয়ে নামে উপস্থাপিত সমস্যাগুলো সম্পর্কেও এই বইয়ে আলোচনা করা হয়েছে। একইসাথে, অসংখ্য গণিত ঐতিহাসিকগণ এই বইটিকে সম্ভাবনার পাশাপাশি গুচ্ছ-বিন্যাসতত্ত্বেরও এক ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসবে চিহ্নিত করেছেন। একদম শুরুর দিকের এই কাজটি তদানিন্তন ও বর্তমান- উভয় সময়ের গণিতবিদদের মাঝেই অত্যন্ত গূরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে ও ফেলে চলেছে, উদাহরণঃ আব্রাআম দ্য মোয়াভ্র্।
বার্নোলি ১৬৮৪-১৬৮৯ এর মধ্যে পান্ডুলিপিটি লেখেন, যাতে তিনি ক্রিস্টিয়ান হাইগেনস, জিরোলামো কার্দানো, পিয়ের দ্য ফের্মা ও ব্লেইজ প্যাসকেলের মতো গণিতবিদদের কাজসমূহ অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি গুচ্ছ-বিন্যাসের মৌলিক বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করেন যেমনঃ বিন্যাস ও সমাবেশ সম্পর্কিত তার সুত্র (পূর্বোল্লিখিত টুয়েলভ ফোল্ড ওয়ের সমস্যাগুলো), এর সাথে সাথে কিছু ক্ষেত্রে সেগুলোকে আরো গভীরে বার্নোলি সংখ্যার উৎপত্তি ও বৈশিষ্ট্যের বিষয়টির সাথে সংযুক্ত মনে হয়। সম্ভাবনার মৌলিক বিষয়বস্তু যেমনঃ কাঙ্ক্ষিত ফল, তার এ গূরুত্বপূর্ণ কাজেরই বিশেষ অংশ।
ইউরোপে, সম্ভাবনা বিষয়টি সর্বপ্রথম নিয়মমাফিকভাবে গড়ে উঠতে থাকে ১৬শ শতকে জিরোলামো কার্দানোর কাজের মাধ্যমে। মূলত জুয়ার অভ্যাসের কারণেই গণিতের এ শাখায় তার আগ্রহ বেশি ছিলো।[১] বর্তমানে সম্ভাবনার ক্ল্যাসিক্যাল সংজ্ঞা হিসেবে প্রচলিত সংজ্ঞাটি তিনি প্রদান করেনঃ যদি কোনো ঘটনার সংখ্যক সম্ভাব্য ফল থাকে এবং তার মধ্যে থেকে আমরা যদি যেকোনো ঘটনা গ্রহণ করি যেন, হয়, তাহলে উক্ত ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা হবে । কিন্তু, গণিতে তার অবদান খুব একটা নয়। এই বিষয়ে ১৫২৫ সালে তিনি মাত্র একটি বই লিখেছেন, যার নামঃ লিবার দ্যে ল্যুদো অ্যালে (Liber de ludo aleae, ইংরেজিঃ Book on Games of Chance)। তার মৃত্যুর পর ১৬৬৩ সালে বইটি প্রকাশিত হয়।[২][৩] ঐতিহাসিকগণ যে সময়টাকে আধুনিক সম্ভাবনার উন্নয়নের শুরু হিসেবে বলেন তা হলো ১৬৫৪, যখন দুইজন প্রসিদ্ধ গণিতবিদ ব্লেইস প্যাসকেল ও পিয়েরে ডে ফার্মা এই বিষয় নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা করতে শুরু করলেন। তারা দুইজন এই যোগাযোগ শুরু করেন কারণ, সে বছর শুরুর দিকে, প্যারিসের একজন জুয়াড়ি আন্টনি গমবউড প্যাসকেল ও অন্যান্য গণিতবিদদের এই তত্ত্বগুলোর বাস্তবভিত্তিক কিছু সমস্যা পাঠান। এগুলো ছিলো বিন্দু সমস্যা বা প্রবলেম অফ পয়েন্টস, অর্থাৎ একটি খেলা যেখানে খেলোয়াড় দুইজন, ও এতে পারিপার্শ্বিক নানা বিপত্তির কারণে খেলোয়াড়দের পুরস্কার ভাগ করে দেয়ার তত্ত্বের ভিত্তিতে। প্যাসকেলের এই সৃষ্টিকর্ম ও ফার্মার পত্রবিনিময় অন্যান্য গণিতবিদদের আগ্রহী করে তোলে, যেমনঃ ক্রিস্টিয়ান হাইগেনস, যার De ratiociniis in aleae ludo ভ্যান স্কূটেনের Exercitationes Matematicae এর শেষ অধ্যায় হিসেবে ১৬৫৭ তে আবির্ভূত হয়। প্যাসকেলের মৃত্যুর পর ১৬৬৫ সালে তার আবিষ্কৃত বিখ্যাত প্যাস্কেলের ত্রিভূজ প্রকাশিত হয়। তিনি তার এই আবিষ্কারকে Traité du triangle arithmétique (Traits of the Arithmetic Triangle) বইয়ে "বীজগাণিতিক ত্রিভুজ" হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
১৬৬২ সালে, La Logique ou l’Art de Penser বইটি প্যারিসে অজ্ঞাতভাবে প্রকাশিত হয়। বইটির লেখক ছিল যৌথভাবে অ্যান্টোনি আরনল্ড ও পিয়েরে নিকোল, দুইজন অগ্রবর্তী জ্যানসেনিস্ট। তারা একত্রে ব্লেইজ প্যাসকেলের সাথেও কাজ করেছেন। বইটির ল্যাটিন নাম ছিলো Ars cogitandi। সে সময়ের যুক্তি বিষয়ে এটি ছিলো সফল একটি বই। এটি ছিলো মোট চারটি বইয়ের সমষ্টি। চতুর্থ বইটি ছিলো জুয়ার নানাদিক বিশ্লেষণে অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিষয়ক। এবং এতে তিনি স্পষ্টভাবে সাংখ্যিক সম্ভাবনার ধারণা তুলে ধরেন।
পরিসংখ্যান ও ফলিত সম্ভাবনার ঘরানায়, জন গ্রান্ট জনসংখ্যাতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৬৬২ সালে Bills of Mortality বইয়ের উপর নির্ভর করে প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণসমূহ (Natural and Political Observations) প্রকাশ করেন। এই কাজটি, অন্যান্যগুলোর সাথে, লন্ডনের জনসংখ্যার পরিসংখ্যান দাঁড় করায়। জীবন সারণি উপস্থাপন করে, নানা বয়সের লোকের টিকে থাকার সম্ভাবনা উপস্থাপন করে, মৃত্যুর নানা কারণ পরীক্ষা করে, এটা নির্ণয় করে যে বার্ষিক আত্মহত্যা ও দূর্ঘটনার হার ধ্রুবক, এবং লিংগের অনুপাতে নানা স্তর ও সুস্থিতির নানা অবস্থা উল্লেখ করে। ১৬৬৭ সালে গ্রান্টের সারণির উপকারিতা ও প্রয়োগ সম্পর্কে ধারাবাহিক ভাবে কাজ করেছেন লুডউইগ ও ক্রিস্টিয়ান হাইগেনস। সেখানে তারা গড় ও মধ্যকের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারেন এবং ক্রিস্টিয়ান প্রথম সম্ভাবনা বিন্যাস তৈরি করে এটিকে একটি বক্ররেখা (smooth curve) দ্বারা উপস্থাপন করেন। কিন্তু তাদের এ কাজ পরে প্রকাশিত হয়নি। পরবর্তীতে,১৬৭১ সালে তৎকালীন ডাচ রিপাব্লিকের প্রধানমন্ত্রী জোহান দে উইট তারই একইরকমের একটি কাজ Waerdye van Lyf-Renten (A Treatise on Life Annuities) প্রকাশ করেন। এতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল নির্ণয়ে পরিসংখ্যানের ধারণা ব্যবহার করা হয়েছে। এটি দেখায় যে গণিতের এই শাখার বাস্তব জীবনভিত্তিক প্রয়োগও আছে! দে উইটের কাজ ডাচ রিপাব্লিকের বাইরে তেমন প্রচারিত হয়নি, কারণ ১৬৭২ সালে তিনি ক্ষমতা হারান। এই কাজ দুটির বাস্তভিত্তিক অবদান ছাড়াও, এগুলো একটি মৌলিক ধারণা উন্মোচন করেছে যে, কাঠামোগত প্রতিসাম্যতাহীন বস্তু বা ঘটনাতেও সম্ভাবনা প্রয়োগ করা যায়, যেমনঃ কোনো নির্দিষ্ট বয়সে মৃত্যুর সম্ভাবনা। এটি একটি ছক্কা বা কয়েন ঘুরিয়ে কোনো ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নির্ণয়ের থেকে আলাদা। তাই সম্ভাবনা শুধু বিন্যাসতত্ত্বের থেকেও অনেক বেশি কিছু।
১৬৮৪ থেকে ১৬৮৯ সালে অগ্রদূতদের জাগরণের এই সময়ে বার্নোলি নানারকম ফলাফল, যেগুলো আর্স কনজেঞ্জিতে আছে, সংগ্রহ করতে থাকেন ও সেগুলো তার ডায়েরি মেডিটেশনসে লিপিবদ্ধ করতে থাকেন। ১৬৮৪ সালে ৩০ বছর বয়সে যখন তিনি এই কাজ করতে শুরু করলেন, গুচ্ছ-বিন্যাসতত্ত্ব ও সম্ভাবনা সম্পর্কিত সমস্যাগুলো দেখে যখন তিনি নানাভাবে রোমাঞ্চিত হচ্ছিলেন, ততক্ষনেও তিনি প্যাসকেলের "বীজগাণিতিক ত্রিভূজ" বা ডে উইটের সম্ভাবনা তত্ত্বে প্রয়োগের কিছুই পড়েন নি। তিনি তার সমসাময়িক গটফ্রিড লাইবনিৎসের কাছে চেয়েছিলেন কিন্তু লাইবনিৎস তা দিতে পারেননি। কিন্তু যেকোনোভাবে পরবর্তীতে তিনি প্যাসকেল ও হাইগেনের কাজগুলো পেয়েছিলেন এবং এগুলোর উপরেই আর্স কনজেঞ্জির ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত। এগুলো ছাড়াও, সম্ভবত বার্নোলি La Logique ou l’Art de Penser ও গ্রন্টের Bills of Mortality পেয়েছিলেন নয়ত এগুলোর বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানতেন, কেননা তিনি এগুলো থেকেও অনেক উদ্ধৃতি দিয়েছেন।
সময়ের সাথে বার্নোলির কাজের অগ্রগতি তার ডায়েরি মেডিটেশনস থেকে বোঝা যায়। তার আবিষ্কারের পুরো সময়টা উদ্দেশ্যে ও সময়ের ভিত্তিতে তিন ভাগে বিভক্ত ছিলো। প্রথমভাগ ছিলো ১৬৮৪-১৬৮৫, এই সময়ে তিনি ক্রিস্টিয়ান হাইগেনসের গেইমস অফ চান্স ও এর নানা ধরনের সমস্যা সম্পর্কে অধ্যয়ন করেন। দ্বিতীয়ভাগ ১৬৮৫-১৬৮৬ সালে, তার পর্যবেক্ষণসমূহ বিস্তৃত হতে থাকে সেসব ব্যাপারগুলোতে যেগুলোতে সম্ভাবনা আগে থেকে ছিলো না, তবে পরবর্তী সময়ে নির্ণীত হয়। এবং সর্বশেষ ১৬৮৭-১৬৮৯ সালের সময়টুকুতে সম্ভাবনা পরিমাপের সমস্যাগুলোর সমাধান হয়।
আর্স কনজেঞ্জি প্রকাশের পূর্বে, বার্নোলি সম্ভাবনা বিষয়ক বেশ কিছু পুস্তিকা প্রকাশ করেনঃ
১৭০৩ থেকে ১৭০৫ এর মাঝে, লাইবনিৎস জোহানের কাছ থেকে জ্যাকবের সম্ভাবনা সম্পর্কিত আবিষ্কারের বিষয়টি জানার পর জ্যাকবের সাথে কাজ করেন। বার্নোলির ল অফ লার্জ নাম্বারের উপর তিনি সুচিন্তিত সমালোচনা করেন কিন্তু তিনি বার্নলিকে দে উইটের বার্ষিক বৃত্তির উপর কাজটি দিতে পারেননি, যেটি তিনি খুব চেয়েছিলেন। এর বাইরে, বার্নোলি তার কাজের উপর আশ্বস্ত ছিলেন যে, গুচ্ছ-বিন্যাসতত্ত্ব ও সম্ভাবনা তত্ত্ব সমাজের অসংখ্য বাস্তবভিত্তিক সমস্যার সমাধান আনবে। যেমনঃ গ্রন্ট ও ডে উইটের কাজের মতো করেই, কম তথ্য-উপাত্ত সংবলিত ঘটনার যেমনঃ নানা বিচারকার্যে বা কোর্টে, ক্ষেত্রে এগুলো একটা যুক্তিভিত্তিক পদ্ধতি হিসেবে কাজ করবে। আরো আশা করা হতো যে, এই সম্ভাবনা তত্ত্ব একটি ব্যাপক ও ধারাবাহিক কারণ উত্থাপন পদ্ধতি হিসেবে আবির্ভুত হবে, যেখানে সাধারণ পদ্ধতিগুলো হয়তো কোনো পরিস্থিতির জটিলতার কারণে কাজই করবে না। আর এজন্যই আর্স কনজেঞ্জির শিরোনাম এভাবে নির্ধারণ করা হয়েছিলঃ প্রাতিষ্ঠানিক চিন্তাপদ্ধতির (স্কলাস্টিজম) আর্স ইনভেনিএন্ডির ধারণার সাথে একটি যোগসূত্র, যেটি তার কাঙ্ক্ষিত বাস্তবাদিতার সাথে একটি সাংকেতিক যোগসুত্র স্থাপন করে এবং পূর্ববর্তী আর্স কজিটেন্ডির একটি বিস্তৃত রূপ।
বার্নোলির নিজের ভাষাতেই, চতুর্থ খণ্ডের দ্বিতীয় অধ্যায়ে "art of conjecture"কে তিনি সংজ্ঞায়িত করেছেনঃ
যতটা সুক্ষ্মভাবে সম্ভব, নানা ঘটনার সম্ভাবনা পরিমাপ করার দক্ষতা, যেনো গৃহীতব্য সিদ্ধান্তটি তুলনামূলক ভালো, অধিক সন্তোষজনক, নিরাপদ ও সুবিধাব্যঞ্জক হয়।
১৭০৫ সালে বার্নোলির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বইটির উন্নয়ন বন্ধ হয়ে যায়। তাই বার্নোলির মূল দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে তুলনা করলে বইটিকে অসম্পূর্ণ মনে হয়। জ্যাকবের কাজকে পূর্ণতা দেয়ার সবচেয়ে যোগ্য লোক ছিলো তার ছোটভাই জোহান। কিন্তু তার সাথে ঝগড়ার কারণে পান্ডুলিপিটি তাকে দেননি বড়ভাই জ্যাকব বার্নোলি। আবার বার্নোলির ছেলে-মেয়েরা কেউই গণিতবিদ নয়, তাই তারা এর সম্পাদনা বা প্রকাশনার সাথে সম্পৃক্ত বা উপযুক্ত কোনোটায় ছিলো না। অবশেষে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র নিকোলাস, তার মৃত্যুর ৭ বছর পর, ১৭১৩ সালে পান্ডুলিপিটি প্রকাশ করেন।
বার্নোলির কাজ মূলত ল্যাটিন ভাষায় প্রকাশিত হয়। এটি চারভাগে বিভক্ত। এতে বিশেষ করে আলোচনা করা হয়েছে তার বিন্যাস ও সমাবেশের তত্ত্ব; বর্তমানের আদর্শ গুচ্ছ-বিন্যাসতত্ত্বের ভিত্তি ও মৌলিক সমস্যাগুলোর উপসেট, যেগুলো বর্তমানে টুয়েলভফোল্ড ওয়ে নামে পরিচিত। এতে আরো আলোচিত হয়েছে সংখ্যার এক ধরনের ধারার প্রয়োগ ও নানা অনুপ্রেরণা, যা সম্ভাবনার চেয়ে সংখ্যাতত্ত্বের সাথেই বেশি সম্পর্কিত; তার নামেই সে সংখ্যাগুলোর নামকরণ, সংখ্যাগুলোকে বলা হয় বার্নোলি সংখ্যা। এটি তার অন্যতম অর্জন।
প্রথম ভাগে হাইগেনের De ratiociniis in aleae ludo -এর গভীরভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। হাইগেনের দেয়া পাঁচটি সমস্যার সমাধান তিনি এতে উল্লেখ করেছেন। এর সাথে সাথে তিনি আংশিকভাবে হাইগেনের "কাঙ্ক্ষিত ফল-একটি ঘটনার সম্ভাব্য ফলের গূরুত্বযুক্ত গড়" -এর ধারণাও গড়ে তুলেছেন। হাইগেন নিম্নোক্ত সূত্রটি গড়ে তুলেছেনঃ
সূত্রটিতে, E হলো কাঙ্ক্ষিত মান, pi হলো প্রত্যেক মান পাওয়ার সম্ভাবনা, এবং ai হলো প্রাপ্য মান। বার্নোলি কাঙ্ক্ষিত ফলকে সাধারণ করে নিয়ে আসেন। তিনি ধরেন, pi হলো মানসমূহের নিশ্ছেদ ফল এবং তিনি প্রয়োগ করেন p0 + p1 + ... + pn = 1। এই খণ্ডে আরেকটি তত্ত্ব উন্নিত হয়। তা হলো- বাইনারি ঘটনার অন্তত একটি সফলতা অর্জনের সম্ভাবনা, বর্তমানে যার নাম বের্নুই পরীক্ষা বা দ্বিপদী পরীক্ষা। বার্নোলি গাণিতিক আরোহী পদ্ধতির মাধ্যমে দেখান যে, যদি প্রতি ঘটনার সম্ভাব্য ফল a দেয়া থাকে, b যদি হয় প্রতি ঘটনার মোট ফল, d যদি হয় কাঙ্ক্ষিত সফল ফল, e যদি হয় ঘটনার সংখ্যা, তবে d সংখ্যক সফলতার সম্ভাবনা হবেঃ
প্রথম খণ্ডের ইতি টানা হয়েছে প্রচলিত বার্নোলি বিন্যাসের মাধ্যমে।
দ্বিতীয় ভাগে আলোচিত হয়েছে গণনামূলক গুচ্ছ-বিন্যাসতত্ত্ব বা বস্তুর নিয়মানুগ গণনা। টুয়েলভ ফোল্ড ওয়ের খুব গূরুত্বপূর্ণ দুটি অংশ - এই বিষয়ের ভিত্তি বিন্যাস-সমাবেশ - এই ভাগে বিস্তার পেয়েছে। এর আগের ভাগে এই বিষয় দুটিকে উপস্থাপন করা হয়েছে সম্ভাবনা তত্ত্বের জন্য। কম্বিনেটোরিয়াল আর্গুমেন্টস ব্যবহার করে তিনি পূর্ণসাংখ্যিক ঘাতের প্রথম দ্বিপদী বিস্তৃতির অ-আরোহী প্রমাণ উপস্থাপন করেন। দ্বিতীয় ভাগে পূর্ণসাংখ্যিক ঘাতের সমষ্টির সাধারণ সূত্র প্রদান করেন; আর তাই এই সূত্রের মুক্ত সহগগুলোকে বার্নোলি সংখ্যা বলা হয়, যেটি পরবর্তীতে আব্রাহাম ডে মোয়াভ্রর কাজকে অনুপ্রাণিত করে। সংখ্যা তত্ত্বে এর অসংখ্য প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।
তৃতীয় ভাগে, কার্ড বা ছক্কা দিয়ে খেলা হয় এমন বিভিন্ন খেলায় বার্নোলি প্রথম ভাগের সম্ভাবনার বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। তিনি কার্ড গেমের নিয়ম বা পদ্ধতির তার নিজস্ব ব্যাখ্যা বর্ণনা করার প্রয়োজন বোধ করেন নি। তিনি এখানে সম্ভাবনা সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে এসেছেন। এবং যখন কোনো একটা পদ্ধতি প্রমাণ করেছেন তারপরই সেটিকে সার্বজনীন করে নিয়ে এসেছেন। যেমনঃ "কোর্ট কার্ড"-এর কাঙ্ক্ষিত সংখ্যার একটি সমস্যা- জ্যাক, কুইন, কিং - আদর্শ ৫২ তাসের ১২ কোর্ট কার্ড থেকে একজন পাঁচ কার্ডের হাত নিবে, এটাকে সাধারণ করে বলা যায়, b কোর্ট কার্ড সংবলিত a তাস থেকে একটি c কার্ডের হাত।
চতুর্থ ভাগেও তিনি বাস্তবভিত্তিক প্রয়োগের ধারা বজায় রেখেছেন। তিনি আলোচনা করেছেন, civilibus, moralibus, and oeconomicis এর সম্ভাবনা। আবার, ব্যক্তিগত, বিচারকার্যের ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের সম্ভাবনাও আলোচনা করেছেন। এই ভাগে, বার্নোলি প্রচলিত চিন্তাধারা, ফ্রিকুয়েন্টিজমের সম্ভাবনার গবেষণামূলক উপস্থাপনা থেকে একটু ভিন্নভাবে কাজ করেছেন। এর বিপরীতে বৃহৎ সংখ্যার তত্ত্বের ভিত্তিতে তিনি একটি ফলাফল উপস্থাপন করেন, যেটিকে তিনি ধারণা করেছেন পর্যবেক্ষণের ফলাফল তত্ত্বীয় ফলাফলের তত বেশি নিকটবর্তী হবে যত বেশিবার সেটিকে প্রয়োগ করা হবে, কিন্তু অন্যদিকে তৎকালীন লোকেরা সাবেক পদ্ধতিতে সম্ভাবনাকে সজ্ঞায়িত করতো। বার্নোলি তার ফলাফল নিয়ে যথেষ্ট গর্বিত ছিলেন। তিনি একে বলেছেন, "গোল্ডেন থিওরেম"। এটির সম্পর্কে তিনি বলেন, "এই সমস্যার পিছনে আমি বিশ বছর সময় দিয়েছি।" এই তত্ত্বের প্রথম দিকের রূপকে বর্তমানে বার্নোলি তত্ত্ব বা বৃহৎ সংখ্যার দূর্বল তত্ত্ব বলা হয়, কারণঃ এটির আধুনিক রূপের চেয়ে পুরনোটি অনেক কম কার্যকরী ও সাধারণ।
এই প্রাথমিক ব্যাখ্যামূলক চার ভাগের পর, বার্নোলি আর্স কনজেঞ্জিতে ক্যালকুলাসের বিস্তার যোগ করেন, এতে অসীম ধারাও আলোচিত হয়েছে। ১৬৮৬ থেকে ১৭০৪ সালের মধ্যে এটি পাঁচ ভাগে পুনঃপ্রকাশিত হয়।
আর্স কনজেঞ্জিকে গুচ্ছ বিন্যাস তত্ত্বের ও গাণিতিক সম্ভাবনার মৌলিক ও বুনিয়াদি কাজের মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্যদের মধ্যে,আইভর গ্রাটান-গিনেসের সম্পাদনায় এলসেভিয়ার থেকে গণিত সম্পর্কিত সেরা লেখাগুলোর একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। এটি ১৮ থেকে ১৯ শতকের মধ্যে সকল গণিতবিদের কাজের একটি সংকলন। প্রায় তিন শতক ধরে বইটি সকল গণিতবিদের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। পরিসংখ্যানবিদ অ্যান্থনি এডওয়ার্ডস আর্স কনজেঞ্জি বইটির যুগান্তকারী বিষয়বস্তুর পাশাপাশি বইটির বিন্যাস ও রচনাশৈলি এবং গুচ্ছবিন্যাসতত্ত্বের সাথে মিল রেখে বার্নোলির রচনারও প্রশংসা করেছেন। বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় গণিত ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডানহাম বার্নোলির এই বইটিকে বলেছেন, "(কার্ডানোর পর) সম্ভাবনা তত্ত্বের পরবর্তী মাইলফলক" ও "জ্যাকব বার্নোলির মাস্টারপিস"। এর প্রভাব দেখে এটিকে ডানহাম বলেছেন "বার্নোলির আজীবন সম্মাননা"।
বার্নোলির কাজ সমসাময়িক ও পরবর্তী গণিতবিদদের অনুপ্রাণিত করেছে। এমনকি পরবর্তী চিন্তা যেমনঃ ক্যালকুলাসের ট্রাক্ট বা বিস্তৃতি বরাবরই উদ্ধৃত করে থাকেন বিশেষ করে কলিন ম্যাকলরিন। জ্যাকবের কনজেকচার বা অনুমানের দক্ষতা বাস্তব জীবনে প্রয়োগের চর্চা, ১৭০৫ সালে তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হ্য। কিন্তু পরবর্তীকালে নিকোলাস বার্নোলি সেটি চালিয়ে যান। তার নিজস্ব রচনা De Usu Artis Conjectandi in Jure এর জন্য তিনি Ars Conjectandi থেকে সরাসরি কিছু অংশ নেন ও ১৭০৯ সালে প্রকাশ করেন। অবশেষে ১৭১৩ সালে নিকোলাস আর্স কনজেঞ্জি সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে নিকোলাস আবার জ্যাকব বার্নোলির এই রচনাটি সম্পাদনা করেন ও বার্নোলির ডায়েরি থেকে প্রাপ্ত ফলাফলসমূহও এতে অন্তর্ভুক্ত করেন।
পিয়েরে রেমন দে মন্টমর্ট ও নিকোলাস বার্নোলি যৌথভাবে সম্ভাবনার উপর একটি বই লেখেন, যার নাম Essay d'analyse sur les jeux de hazard। এটি ১৭০৮ সালে প্রকাশিত হয়। এটিকে আর্স কনজেঞ্জির ৩য় অংশের বিস্তৃতি হিসেবে দেখা যায়, কেননা এতেও গুচ্ছ-বিন্যাসতত্ত্ব ও সম্ভাবনা ব্যবহার করে সেসময়ের সম্ভাবনামূলক খেলাগুলোকে বিশ্লেষন করা হয়েছে। আব্রাআম দ্য মোয়াভ্র্ও ১৭১১ সালে তার বই De mensura sortis: Seu de Probabilitate Eventuum in Ludis a Casu Fortuito Pendentibus ও ১৭১৮ সালের বই The Doctrine of Chances or, a Method of Calculating the Probability of Events in Play -এ। দ্য মোয়াভ্রর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জন হলো সেন্ট্রাল লিমিট থিওরেমের আবিষ্কার। এটি দ্বারা তিনি প্রায় সঠিকভাবে নরমাল ডিস্ট্রিবিউশনের সাথে বাইনমিয়াল ডিস্ট্রিবিউশন নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এটি করতে দ্য মোয়াভ্র ফ্যাক্টোরিয়াল ফাংশনের একটি অ্যাজিম্পটোটিক সিকুয়েন্স বা ধারা বের করেন, যাকে আমরা বর্তমানে স্টিরলিংস অ্যাপ্রোক্সিমেশন বলে থাকি, ও বার্নোলির সংখ্যার ঘাতের সমষ্টির সূত্র ব্যবহার করেন। মন্টমর্ট ও দ্য মোয়াভ্র উভয়েই প্রোবাবিলিটি বা সম্ভাবনা শব্দটি জ্যাকব বার্নোলির থেকে নিয়েছেন কারণ তার আগে জুয়া বা গ্যাম্বেলিং সম্পর্কিত কোনো রচনাতেই এই শব্দটির ব্যবহার কেউ করেনি। তাদের উভয়ের রচনাই ব্যপকভাবে জনপ্রিয়।
তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক সম্ভাবনার অভিসৃতির ক্ষেত্রে বার্নোলির গোল্ডেন থিওরেমের পরিমার্জনা পরবর্তীতে অনেক গণ্যমান্য গণিতবিদ করেছেন যেমনঃ দে মোয়াভ্র, ল্যাপলেস, পয়সন, চেবিশেভ, মারকভ, বোরেল, ক্যনটেলি, কলমোগরভ ও কিনচিন। অবশেষে ২০ শতকের প্রথমার্ধে অ্যারবিটরেরি রেনডম চলকের জন্য ল অফ লার্জ নাম্বার পূর্ণাংগভাবে প্রমাণ করা হয়।
একজন পরোক্ষ প্রভাব বিস্তার করেছেন, তিনি হলেন থমাস সিম্পসন। তিনি একটি ফলাফল নিয়ে আসেন যেটি দ্য মোয়াভ্রের কাজকে নতুন করে সাজিয়েছে। সিম্পসনের রচনার ভূমিকা অনুযায়ী, তার রচনাটির বিরাট অংশ দ্য মোয়াভ্রের রচনার উপর নির্ভর করেছে। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি বলেন যে এই রচনাটি মূলত তারই রচনার সংশোধিত ও বিস্তৃত রূপ। অবশেষে থমাস বেইজ দ্য মোয়াভ্রর ফলাফলের ধর্মতত্ত্ব প্রয়োগ সম্পর্কে একটি নিবন্ধ রচনা করেনঃ কোনো ঘটনার রিলেটিভ ফ্রিকুয়েন্সির মাধ্যমে সম্ভাবনা নির্ণয়ের একটি সমস্যার দ্য মোয়াভ্রর সমাধানের মাধ্যমে বেইজ স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। অবশেষে ১৮১২ সালে, পিয়েরে সাইমন লেপলেস প্রকাশ করেন Théorie analytique des probabilités। এতে তিনি সম্ভাবনা ও পরিসংখ্যানের অনেক মৌলিক ফলাফল একত্রিত ও লিপিবদ্ধ করেন যেমনঃ দ্য মোমেন্ট জেনারেটিং ফাংশন, মেথড অফ লিস্ট স্কয়ার্স, ইনডাকটিভ প্রোবাবিলিটি, হাইপোথিসিস টেস্টিং ইত্যাদি। এভাসে ক্যাসিক্যাল সম্ভাবনার উন্নয়নের শেষ দশা পূর্ণতা পায়। প্রকৃতপক্ষে, এসকল কিছুর আলোকে বলা যায়, বার্নোলির কাজের এত প্রশংসার যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে। এর দ্বারা তিনি শুধু নিজের প্রভাবই রেখে যাননি, গণিতবিদদের গুচ্ছ বিন্যাসতত্ত্বের অধ্যয়নকে আরো ত্বরান্বিত করেছেন, এমনকি ধর্মতত্ত্বেও প্রভাব ফেলেছেন।
|title=
এ বহিঃসংযোগ দেয়া (সাহায্য)