শিয়া ইসলাম |
---|
ধারাবাহিকের অংশ |
ইসলাম প্রবেশদ্বার |
আল-রিসালাত আল-যাহাবিইয়াত (আরবি: الرسالة الذهبیة, "সোনালি গ্রন্থ") হচ্ছে চিকিৎসাবিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট একটি গবেষণামূলক নিবন্ধ গ্রন্থ যাতে রোগের প্রতিকার ও সুস্বাস্থ্য বিষয়ক লেখা রয়েছে। তৎকালীন খলিফা আল-মামুনের নির্দেশে শিয়াদের অষ্টম ইমাম আলি ইবনে মুসা আল-রিদাহ (৭৬৫–৮১৮) এটি রচনা করেন।[২][৩] এই গ্রন্থটিকে ইসলামি চিকিৎসাশাস্ত্রের সবচেয়ে মূল্যবান গ্রন্থের সম্মান দেয়া হয়। খলিফা মামুন স্বর্ণের কালি দিয়ে এই গ্রন্থ লেখার আদেশ দেয়ায় একে “সোনালি গ্রন্থ” বলা হত। [৩] এই গ্রন্থের তথ্য বর্ণনাকারীদের ধারা মুহাম্মদ ইবনে জুমহুর অথবা আল-হাসান ইবনে মুহাম্মদ আল-নাওফালি (যাকে আল-নাজ্জাশি “অত্যন্ত সম্মানিত ও বিশ্বস্ত” হিসেবে বর্ণনা করেন) পর্যন্ত পৌঁছেছিল।[৪]
আলি আল-রিদাহ- শারীরস্থান, শারীরবিদ্যা, রসায়ন এবং রোগণিরূপণবিদ্যা-এর উপর গ্রন্থটি লিখেছেন যদিও চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কে সেসময় মানুষের জ্ঞান প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। গ্রন্থের তথ্যানুসারে- চারটি বস্তুর রস দ্বারা একজন মানুষের স্বাস্থ্য বোঝা যায়। এগুলো হল- রক্ত, হলুদ পিত্ত, কালো পিত্ত এবং কফ; যারা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ দেহে উপস্থিত থেকে স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণ করে। যকৃৎ স্বাস্থ্য রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় বস্তু উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আলি আল-রিদাহ দেহকে একটি রাজ্যের সাথে তুলনা করেন যার রাজা হৃৎপিণ্ড এবং প্রজারা হচ্ছে (রক্ত) নালী, অঙ্গ এবং মস্তিষ্ক।
গ্রন্থটি রচনা করেছেন আলি আল-রিদাহ্ যিনি মুসলিম নবী মুহাম্মাদ-এর ৭ম বংশধর এবং বার ইমামের মধ্যে ৮ম ইমাম। তার নাম দেয়া হয়েছিল ‘আলি ইবন মুসা ইবন জাফর’। ১১ জ্বিলকদ, ১৪৮ হিজরি (ডিসেম্বর ২৯, ৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দ) তারিখে মদীনায় শিয়া ইসলামের দ্বাদশবাদি ইমামের ৭ম ইমাম মুসা আল-কাযিমের বাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাকে খুরাসানে পাঠানো হয় এবং সেখানে মামুনের উত্তরাধিকারী হওয়ার জোরাজোরি করলে তিনি অনিচ্ছাসত্ত্বেও তা মেনে নেন।[৩][৫] তবে তিনি মামুনের আগেই মৃত্যুবরণ করেন। পারস্য ভ্রমণে ভ্রমণসঙ্গী হওয়ার পর মামুন তাকে বিষাক্ত আঙ্গুর দেন এবং তিনি মে ২৬, ৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে ইরানের তুস নগরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে ইরানের মাশহাদে ইমাম রিদাহ মসজিদে সমাহিত করা হয়।[৩][৬]
মামুনের প্রাসাদ ছিল দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার কেন্দ্র যেখানে অনেক বৈজ্ঞানিক সভার আয়োজন হত।[৫] একটি উল্লেখযোগ্য সভা হয়েছিল মানবদেহের উপর যাতে অনেক বিখ্যাত মনীষী ও নেতা অংশ নেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- আলি আল-রিদাহ্, মামুন, জাবরিল ইবনে বুখতিশু (শারীরতত্ত্ববিদ), মাসাওয়িহ (শারীরতত্ত্ববিদ) এবং সালিহ ইবনে সালহামা (ভারতীয় দার্শনিক)। তারা দেহের গঠন ও বিভিন্ন খাদ্যের গুণাগুণ নিয়ে কথা বলছিলেন কিন্তু আলি আল-রিদাহ নীরব থাকেন। অতঃপর, মামুন তাকে শারীরতত্ত্ব ও পুষ্টি বিষয়ে নিজের জ্ঞান উপস্থাপন করতে বলেন এবং ইমাম রিদাহ বলেনঃ[২]
আমি এ বিষয়ে যা জানি তা নিজ উদ্যোগে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জানতে পেরেছি এবং অভিজ্ঞতার আলোকে এই জ্ঞানের শুদ্ধতা বুঝতে পেরেছি এবং সময়ের সাথে এর সাথে যুক্ত হয়েছে সেসমস্ত তথ্য যা আমার পূর্বপুরুষদের নিকট থেকে পেয়েছি, যা অবহেলা ও করা যায় না আবার বাতিল করার অজুহাত ও দেয়া যায় না। আমি এসমস্ত তথ্যকে এমনরূপ দেব যাতে সেগুলো সকলেই জানতে পারে।[২]
এরপর মামুন বালখ রওনা দেন এবং ইমামকে দেহ ও এর স্বাস্থ্যের উপর একটি গ্রন্থ লিখে নিজের প্রতিজ্ঞা সম্পন্ন করতে বলেন। অতঃপর, মামুনের অণুরোধে ইমাম “সোনালি গ্রন্থ” রচনা করেন।[২]
আলি আল-রিদাহ শারীরস্থান, শারীরবিদ্যা, রসায়ন এবং রোগণিরূপণবিদ্যা-এর উপর গ্রন্থটি লিখেছেন যদিও চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কে সেসময় মানুষের জ্ঞান প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল।[৭] গ্রন্থটির সূচনা বক্তব্য:
পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে। জান, যখন আল্লাহ তাঁর কোন গোলামকে রোগাক্রান্ত করেন, তখন তিনি রোগ প্রতিকারের জন্য একটি ওষুধ ও দেন এবং প্রত্যেক প্রকার রোগের জন্য কোন না কোন প্রকারের ওষুধ, নিয়ম ও ব্যবস্থাপত্র রয়েছে।[৮]
আলি আল-রিদাহ তার গ্রন্থে লিখেছেন যে একজন ব্যক্তির স্বাস্থ্য রক্ত, হলুদ পিত্ত, কালো পিত্ত এবং কফ এর ভারসাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত; এই ভারসাম্য নষ্ট হলে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। পুষ্টি এবং প্রথাগত ওষুধের সাহায্যে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। যকৃৎ স্বাস্থ্য রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় বস্তু উৎপাদনে এবং নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে[৮]
আলি আল-রিদাহ দেহকে একটি রাজ্যের সাথে তুলনা করেন যার রাজা হৃৎপিণ্ড এবং প্রজারা হচ্ছে (রক্ত) নালী, অঙ্গ এবং মস্তিষ্ক। এরপর তিনি লিখতে থাকেন এভাবেঃ
রাজার প্রাসাদ হচ্ছে তার হৃৎপিণ্ড; দেহ হচ্ছে তার ভূমি; আর তার হাত, পা, চোখ, ঠোঁট, জিহ্বা হচ্ছে তার সাহায্যকারী; পাকস্থলী হচ্ছে তার ভাণ্ডার-রক্ষক এবং তার ব্যবস্থাপক হচ্ছে তার বুক। অতঃপর হাত দুটি হচ্ছে সাহায্যকারী যারা (বস্তুকে) কাছে নিয়ে আসে, (সেগুলোকে) দূরে নিয়ে যায় এবং রাজার নির্দেশ মোতাবেক কাজ করে। পা দুটি রাজার বাহন যা তাকে তার ইচ্ছামত যেকোনো জায়গায় নিয়ে যায়। চোখগুলো রাজাকে সেসবের দিকে নিয়ে যায় যা রাজার থেকে অদৃশ্য হয়।[৮]
ইমাম আল-রিদাহ দেহের প্রধান অঙ্গ হিসেবে হৃৎপিণ্ড, স্নায়ু, মস্তিষ্ক, হাত ও পা, কান ও চোখকে চিহ্নিত করেন। তিনি এগুলোর বৈশিষ্ট্য ও কার্যকলাপের বিস্তারিত বর্ণনা দেন। মানবদেহের তন্ত্র ও কোষ সম্পর্কে তিনি বলেনঃ
তুমি কি মনে কর যে তুমি খুব ক্ষুদ্র দেহের অধিকারী, যখন বৃহত্তম বিশ্ব নিজেই তোমার মধ্যে গুচ্ছিত রয়েছে।[৮]
গ্রন্থের অন্য অংশে তিনি কোন মৌসুমে, কোন সময়ে, কোন বিষয়ে কি খাওয়া উচিত সে বিষয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেনঃ
গ্রীষ্মকালে ঠাণ্ডা (খাদ্য), শীতকালে গরম (খাদ্য) এবং তোমার শক্তি ও ক্ষুধার ভিত্তিতে পরিমিত (খাদ্য); এবং দেহকে এর অবস্থা, সামর্থ্য, কর্মক্ষমতা এবং সময়মাফিক অর্থাৎ প্রতি ৮ ঘণ্টায় ১ বার সাধারণ খাদ্য বা প্রতি দুই দিনে ৩ বার পর্যাপ্ত খাদ্য গ্রহণ কর...[৯]
অন্যান্য অংশে তিনি দেহের রোগ, মাস এবং বছরের মৌসুমের প্রভাব আলোচনা করেন। [৪]
আলি ইবনে মুসা আল-রিদাহ তার রচিত গ্রন্থটি মামুনকে পাঠালে মামুন অত্যন্ত আনন্দিত হন এবং গ্রন্থটি স্বর্ণের কালি দিয়ে লেখার আদেশ দিয়ে তার আগ্রহ ব্যক্ত করেন। অতঃপর এই গ্রন্থ “স্বর্ণ গ্রন্থ” নামে পরিচিতি পায়[২] মা’মুন এর প্রশংসা করে বলেন:
আমি আমার জ্ঞানী ভাইয়ের গবেষণামূলক গ্রন্থটি পর্যালোচনা করেছি, যা একটি প্রিয় ও গুণী গ্রন্থ, যুক্তিবাদী শারীরতত্ত্ববিদ, যা দেহের কল্যাণে নিয়জিত, যা পরিচ্ছন্নতার নিয়ম, যা পুষ্টির ভারসাম্য রক্ষা করে, এবং আমি বুঝেছি যে এটি খুবই গোছানো এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ। আমি সতর্কভাবে এটি পড়েছি, পরীক্ষা করেছি; যতক্ষণ পর্যন্ত না এর জ্ঞান আমার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে এবং এর উপকারিতা স্পষ্ট হয়েছে এবং এটি আমার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে, তাই আমি এটি হৃদয় দিয়ে অধ্যয়ন করেছি এবং মস্তিষ্ক দিয়ে অণুধাবন করেছি, যেহেতু আমি একে এক মূল্যবান স্থানের অধিকারী পেয়েছি, একটি অসাধারণ সম্পদ এবং একটি অতি প্রয়োজনীয় বস্তু, সেহেতু এটি মূল্যবান হওয়ায় আমি এটিকে স্বর্ণ দিয়ে লেখার নির্দেশ দিয়েছি এবং জ্ঞানভাণ্ডারে একে সংরক্ষণ করেছি এবং এর আগে এর অনুলিপি তৈরি করিয়েছি হাসিমের উত্তরাধিকারীদের দ্বারা, যারা দেশের তরুণ। সঠিক পরিমাণে খাবার গ্রহণে শরীর সুস্থ থাকে এবং রোগ প্রতিরোধ করে জীবনকে সম্ভব করে তোলে এবং জীবনের মাধ্যমেই জ্ঞান অর্জন সম্ভব এবং জ্ঞানের মাধ্যমেই স্বর্গ অর্জন করা যায় এবং এটি(গ্রন্থটি) নিরাপদ ও সম্পদশালী রাখার যোগ্য, একটি মূল্যবান ও সম্মানিত বস্তু এবং একজন নির্ভরযোগ্য শারীরতত্ত্ববিদ এবং একজন উপদেষ্টা এবং বিভিন্ন বিষয়ে বাধাদানকারী ও নিষেধকারী জ্ঞানী বস্তু। যেহেতু এটি এসেছে তাদের গৃহ থেকে যাঁদের জ্ঞানের উৎপত্তি হয়েছে তার থেকে যিনি নির্বাচিত, নবীর প্রেরিত, নবীর উত্তরাধিকারী থেকে প্রাপ্ত প্রমাণাদি, জ্ঞানীদের ব্যবহার, অজ্ঞতা ও অন্ধত্ব থেকে মানুষের অসুস্থতা ও হৃদয়ের অসুস্থতার প্রতিকার..., ঈশ্বর তাদের উপর সন্তুষ্ট হন, আশীর্বাদ করুন এবং করুণা করুন, তাদের প্রথম জনকে ও এবং তাদের শেষ জনকে ও, তরুণকে ও এবং বৃদ্ধকে ও, আমি এটি আমার অতি নিকটের প্রশিক্ষকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠদের দেখিয়েছি যারা তাদের জ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞানে জ্ঞান, বিভিন্ন বইয়ের লেখক হিসেবে পরিচিত, যারা জ্ঞানী এবং জ্ঞান দ্বারা বর্ণিত বলে গণ্য এবং তাদের প্রত্যেকে এর প্রশংসা করেছেন এবং এটি সম্পর্কে উচ্চ ধারণা ব্যক্ত করেছেন, মর্যাদা দিয়ে এর স্থান উঁচু করেছেন এবং এর লেখকের প্রতি ন্যায় করতে এর প্রশংসা করেছেন, তিনি এর মধ্যে যে জ্ঞান প্রদান করেছেন তাতে বিশ্বাস করে তাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।[১০]
এই গ্রন্থের উপর বিভিন্ন ব্যাখ্যা রচিত হয়েছে যার কয়েকটি হচ্ছে:[২]