আলী রীয়াজ একজন বাংলাদেশী-মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও লেখক। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।[১] তিনি ২০০২ সালে ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।[২] তিনি বর্তমানে ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও সরকার বিভাগের বিশিষ্ট অধ্যাপক (ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর)।[২] তিনি আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের সভাপতি। তার বেশিরভাগ গবেষণা ও প্রকাশনা ধর্ম এবং রাজনীতি বিষয় নিয়ে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি এবং ইসলামী রাজনীতি সম্পর্কিত। তিনি বাংলাদেশী রাজনীতি এবং দক্ষিণ এশিয়ার মাদ্রাসাগুলি নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন। তিনি ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মিড-ওয়েস্টার্ণ কনফারেন্স অন এশিয়ান এফেয়ার্সের ষান্মাসিক জার্নাল স্টাডিজ অন এশিয়ার সম্পাদক ছিলেন। তিনি ২০১৩ সালের ওয়াশিংটন ডিসিতে উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলার্স-এ জননীতি বিশেষজ্ঞ ছিলেন।[৩]
রীয়াজ ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার মাতার নাম মাতা বিলকিস আরা এবং পিতার নাম মোহাব্বত আলী, তিনি বাংলাদেশের উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী ছিলেন।তিনি ১৯৭৯- ৮৯ সালের ডাকসু এর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে ১৯৮১ সালে স্নাতক ও ১৯৮৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৮৭ সালে হাওয়াইয়ের হুনলুলুতে ইস্ট ওয়েস্ট সেন্টারের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী হিসাবে ফেলোশিপ লাভ করেন। এরপর তিনি হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যোগাযোগ (১৯৮৯) এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে (১৯৯১) স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। ১৯৯৩ সালে তিনি বাংলাদেশের বেসামরিক -সামরিক সম্পর্কের বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডক্টর অব ফিলোসফি ডিগ্রী অর্জন করেন। এই গবেষণা কর্মে ১৯৭২-১৯৮১ সালের প্রথম দশকে বাংলাদেশের সামরিক শাসনের কারণ ও উপাদানগুলোর কাঠামোগতভাবে ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা আছে।[৪]
রীয়াজ ১৯৮৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে প্রভাষক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন যেখানে তিনি ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ডক্টরাল ডিগ্রি শেষ করার পর তিনি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় ফিরে আসেন। ১৯৯৪ সালে তিনি সিঙ্গাপুরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ইনস্টিটিউট অফ সাউথইস্ট এশিয়ান স্টাডিজ (আইএসইএএস) এর দক্ষিণ-দক্ষিণ এশিয়া ফেলোশিপ পান যেখানে তিনি সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক বিকাশে টেলিযোগাযোগের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে তিনি লন্ডনে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে সিনিয়র ব্রডকাস্ট সাংবাদিক ছিলেন। পরে তিনি ইংল্যান্ডের লিংকন বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকার দক্ষিণ ক্যারোলিনার ক্ল্যাফলিন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ২০০২ সালে ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটিতে রাজনীতি ও সরকার বিভাগে যোগদান করেন। ২০০৮ সালে তিনি অধ্যাপক হয়েছিলেন এবং ২০১২ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি প্রফেসর হিসেবে নিযুক্ত হন।[৫]
তার বইগুলোতে রাজনৈতিক ইসলাম এবং বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতির উত্থান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তার বই গড উইলিং: পলিটিক্স অফ ইসলামিজম ইন বাংলাদেশ (২০০৪) এবং ইসলামিস্ট মিলিট্যান্সি ইন বাংলাদেশ: এ কমপ্লেক্স ওয়েব (২০০৮) এমন একটি দেশের রূপান্তরকে কেন্দ্র করে যা একটি ধর্মনিরপেক্ষ নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু কিন্তু এক দশকেরও কম সময়কালে শতাব্দীর পুরনো ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ঐতিহ্যকে ত্যাগ করে এবং ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসাবে গ্রহণ করেছে। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের রাজনৈতিক কুশীলব, তাদের কৌশল এবং ইসলামকে ব্যবহারের পদ্ধতিগুলি কীভাবে এবং কেন ইসলামপন্থী রাজনীতির আদর্শকে আবেদনময় করে করে এবং কীভাবে আভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক ঘটনাগুলি তার উপর প্রভাব ফেলে তা আলোচিত হয়েছে ।তিনি দেখান ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সালের মধ্যে আফগানিস্তানের যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পঞ্চাশ বছরের আঞ্চলিক বৈরিতা এই পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে। এর সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতর ভুমিকা আলোচিত হয়েছে যাতে করে যেসব বিশ্লেষক দারিদ্র্য বা মুসলিম ব্যতিক্রমবাদকে কারণ হিসাবে সরল ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন তাঁদের পুনর্বিবেচনা করতে হচ্ছে।[৬]
দক্ষিণ এশিয়ার মাদ্রাসাগুলো বিষয়ে রীয়াজের কাজ শিক্ষাবিদ ও নীতি নির্ধারকদের সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মুসলিম সমাজগুলিতে মাদ্রাসাগুলি (ইসলামী মাদ্রাসাগুলি) "জিহাদের বিদ্যালয়" এবং "সন্ত্রাসীদের প্রজনন ক্ষেত্র" বলে নীতি বিশ্লেষকরা ২০০১-এর পরে যে ধারণা দিচ্ছিলেন রীয়াজ প্রভাবশালী সেই ধারনাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। মার্কিন সরকারের বিভিন্ন ধরনের নীতি নির্ধারনী দলিলপত্রের আলোচনা করে তিনি দক্ষিণ এশীয় মাদ্রাসাগুলির প্রতি মার্কিন নীতির ত্রুটিগুলি তুলে ধরেন তাঁর বই ফেইথফুল এডুকেশন : মাদ্রাসা ইন সাউথ এশিয়া (২০০৮)-এ। বইটিতে এই প্রতিষ্ঠানগুলির ইতিহাস, সমসাময়িক সমাজ ও রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা এবং পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশ স্থানীয় জঙ্গিবাদ ও ট্রান্সন্যাশনাল সন্ত্রাসবাদের সাথে সম্পর্ক অনুসন্ধান করা হয়েছে। এই বইটিতে এই সব প্রতিষ্ঠানের ঐতিহাসিক এবং সমসাময়িক উভয় পাঠ্যক্রমের বিশ্লেষণও করা হয়েছে। এই বইটি এই সব প্রতিষ্ঠানের ঐতিহাসিক এবং সমসাময়িক উভয় পাঠ্যক্রমের বিশ্লেষণও করা হয়েছে। সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপরে গুরুত্বারোপের সাথে সাথে এই গবেষণাটিতে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যে এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে প্রাসঙ্গিক করতে কীভাবে অগ্রসর হতে হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের নীতিনির্ধারকরা কী করতে পারে তার পরামর্শ দেয়া হয়েছে ।[৭]
রীয়াজ রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে সম্পর্ক নিয়েও অধ্যয়ন করেছেন এবং এ বিষয়ে ব্যাপকভাবে লিখেছেন। তার সহ-রচিত বই, প্যারাডাইজ লস্ট? স্টেট ফেইল্যুর ইন নেপাল (২০০৭) নেপালে এই সম্পর্ক নিরীক্ষা করে এবং তার বইটি আনফোল্ডিং স্টেট; দ্য ট্রান্সফরমেশন অফ বাংলাদেশ (২০০৬) প্রথম ২৫ বছরে বাংলাদেশের কাঠামোগত রূপান্তর বিষয়ে আলোচনা করে। প্যারাডাইস লস্ট দেখিয়েছে যে রাষ্ট্রের প্রকৃতি, রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে বিভক্তি এবং নেপালের শাসক শ্রেণীর আদর্শিক আধিপত্যের অবসান এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেছে যেখানে বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলি এবং রাষ্ট্রটি দ্রুত ভেঙ্গে পড়ছে। এই গবেষণায় সমাজে অসন্তোষ তৈরি এবং শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে মাওবাদীদের উত্থানে জাতিস্বত্বা, আত্মপরিচয় এবং বঞ্চনার ভূমিকাকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।[৫]
ইংরেজিতে এক ডজনেরও বেশি বইয়ের পাশাপাশি তিনি বাংলা ভাষায় দশটি বই রচনা করেছেন। ২০১০ সাল থেকে রীয়াজ প্রতি মাসে শীর্ষস্থানীয় বাংলাদেশি দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো, দ্য ডেইলি স্টার-এ বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় নিয়মতিভাবে লেখেন।[৮][৯][১০] বিবিসি বাংলা, আল-জাজিরা[১১] [ভিওএ] বাংলা বিভাগ, ডয়েচে ভেলে রেডিও,[১২] জুরিখের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক (আইএসএন) এর মতো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তার প্রায়শই সাক্ষাৎকার দেওয়া হয়।[১৩] তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার যেমন: সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা কাউন্সিল (এসএসআরসি), উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারস, ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনডিপি), যুক্তরাজ্যের ডিএফআইডি, ইউএসএআইডি, ফিনিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় এবং বার্টেলসম্যান ফাউন্ডেশন (জার্মানি)-এর পরামর্শদাতা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। রীয়াজ বিশেষজ্ঞ হিসেবে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের কমিশনের স্বাক্ষ্য দিয়েছেন। জানুয়ারী ২০১৪-তে নির্ধারিত বাংলাদেশ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক গোলযোগের বিষয়ে রীয়াজ ২০ শে নভেম্বর ২০১৩-তে, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় হাউস সাবকমিটির সামনে সাক্ষ্য দেন।[১৪] তিনি ২৯ এপ্রিল ২০১৫ এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরের হাউস সাবকমিটির সামনে আবারও সাক্ষ্য দিয়েছেন।[৫]
রীয়াজ তার স্ত্রী সেগুফতা জাবিন এবং তাঁদের একমাত্র কন্যা ইলা স্রুতি সহ ইলিনয় রাজ্যের নরমাল শহরে বাস করেন।তিনি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য।