আশা ভোসলে | |
---|---|
মারাঠি: आशा भोसले | |
জন্ম | আশা মঙ্গেশকর ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৩৩ |
পেশা | গায়িকা, নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী |
কর্মজীবন | ১৯৪৩ - বর্তমান |
দাম্পত্য সঙ্গী | রাহুল দেব বর্মন |
সন্তান | ৩ (হেমন্ত ভোঁসলে, বর্ষা ভোঁসলে, আনন্দ ভোঁসলে) |
আত্মীয় | লতা মঙ্গেশকর (বোন) |
সঙ্গীত কর্মজীবন | |
ধরন | পপ, লোকসংগীত, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত |
আশা ভোসলে (মারাঠি: आशा भोसले; জন্ম: আশা মঙ্গেশকর, ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৩৩) একজন ভারতীয় নেপথ্য সঙ্গীতশিল্পী, উদ্যোক্তা, অভিনেত্রী ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব। তিনি মূলত হিন্দি চলচ্চিত্রে নেপথ্য সঙ্গীত গাওয়ার জন্য বিখ্যাত। তার বহুমুখী প্রতিভার কারণে গণমাধ্যমে তাকে হিন্দি চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা ও প্রভাবশালী সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৯৪৩ সাল থেকে আরম্ভ করে তিনি আট দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতের বিভিন্ন ভাষার চলচ্চিত্র ও অ্যালবামের জন্য গান গেয়েছেন। তিনি দুটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১৮টি মহারাষ্ট্র রাজ্য চলচ্চিত্র পুরস্কার, চারটি বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার, আজীবন সম্মাননা-সহ নয়টি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অর্জন করেছেন এবং দুটি গ্র্যামি পুরস্কারের মনোনয়ন লাভ করেছেন। তিনি ২০০০ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার এ ভূষিত হন। ২০০৮ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মবিভূষণ পদকে ভূষিত করে।[১] এছাড়া তিনি ২০১৮ সালে বঙ্গবিভূষণ,[২] ও ২০২১ সালে মহারাষ্ট্র ভূষণ পদকে ভূষিত হন।
প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিবার মঙ্গেশকর পরিবারের সদস্য আশা ভোসলের বোন লতা মঙ্গেশকর ভারতের প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী। সোপরানো কণ্ঠ[৩] ও বহুমুখী প্রতিভার[৪][৫][৬] জন্য খ্যাত ভোসলের রেকর্ডকৃত গানের তালিকায় রয়েছে চলচ্চিত্রের সঙ্গীত, পপ, গজল, ভজন, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, লোকসঙ্গীত, কাওয়ালি, ও রবীন্দ্রসঙ্গীত। হিন্দি ভাষা ছাড়াও তিনি ২০টি ভারতীয় ও বিদেশি ভাষায় গান গেয়েছেন।[৭] ২০১৩ সালে মাই চলচ্চিত্র তিনি অভিনয়ের নাম লেখান এবং তার অভিনয় সমাদৃত হয়। ২০০৬ সালে ভোসলে বলেন দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি ১২০০০ এরও বেশি গান গেয়েছেন।[৮] বিভিন্ন উৎসেও এই সংখ্যার উল্লেখ পাওয়া যায়।[৭][৯] ২০১১ সালে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস তাকে সর্বাধিক সংখ্যক গান রেকর্ডকারী হিসেবে ঘোষণা করে।[১০][১১]
আশা ভোঁসলে ১৯৩৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর সঙ্গিল রাজ্যের (বর্তমান মহারাষ্ট্রে অবস্থিত) সঙ্গিল জেলার গৌড়ে এক সঙ্গীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা দীনানাথ মঙ্গেশকর ছিলেন মারাঠি ভাষী গোমন্থক মারাঠা সমাজের সদস্য এবং মারাঠি সঙ্গীত মঞ্চের একজন অভিনেতা ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী। ভোঁসলের যখন নয় বছর বয়স, তখন তাঁর পিতা মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পরিবার পুনে থেকে কোহলাপুর এবং পরে মুম্বইয়ে চলে আসে। তিনি ও তাঁর বড় বোন লতা মঙ্গেশকর তাঁদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য চলচ্চিত্রে গান গাওয়া ও অভিনয় শুরু করেন। তাঁর গাওয়া প্রথম গান হল মারাঠি ভাষার মাঝা বল (১৯৪৩) চলচ্চিত্রে "চল চল নব বল"। গানটির সুর দেন দত্ত দবজেকর। তাঁর হিন্দি চলচ্চিত্রের গানে অভিষেক হয় হংসরাজ বেহলের চুনারিয়া (১৯৪৮)-এ "সাবন আয়া" গানে কণ্ঠ প্রদানের মাধ্যমে।[১২] তার প্রথম একক হিন্দি চলচ্চিত্রের গান ছিল রাত কী রানী (১৯৪৯) চলচ্চিত্রের জন্য।
তাঁর গায়িকা জীবনকে খতিয়ে দেখলে চারটি সিনেমাকে চিহ্নিত করা যায়। এগুলো তাঁর কেরিয়ারের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে স্বীকৃত। এ ছবিগুলো হলো: নয়া দৌড় (১৯৫৭), তিসরি মঞ্জিল (১৯৬৬), উমরাও জান (১৯৮১) এবং রঙ্গীলা (১৯৯৫)।
ও. পি. নয়্যারের সাথে আশার প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৯৫২ সালে "ছম ছম ছম" গানের রেকর্ডিঙে।[১৩] নয়্যার প্রথম আশাকে মঙ্গু (১৯৫৪) চলচ্চিত্রের গানের জন্য ডাকেন এবং সিআইডি (১৯৫৬) চলচ্চিত্রের গানের মাধ্যমে তাঁকে সুযোগ দেন। যাই হোক, নয়া দৌড় (১৯৫৭) চলচ্চিত্রের গান দিয়ে এই যুগল জনপ্রিয়তা অর্জন করে।[১৪] ১৯৫৯ সালের পর তাঁরা দুজনে প্রেম ও পেশাদারী সম্পর্কে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েন।
নয়্যার ও ভোঁসলে যুগল মনোমুগ্ধকর গানের মাধ্যমে স্মরণীয় হয়ে আছেন। এই যুগলের রেকর্ডকৃত কয়েকটি গান হল হাওড়া ব্রিজ (১৯৫৮) ছবিতে মধুবালার উপর চিত্রায়িত "আইয়ে মেহেরবান", মেরে সনম (১৯৬৫) ছবিতে মুমতাজের উপর চিত্রায়িত "ইয়ে হ্যায় রেশমি জুলফোঁ কা আন্ধেরা"। কিসমত ছবির "আও হুজুর তুমকো" এবং মেরে সনম ছবির "যাইয়ে আপ কাহাঁ" গানগুলোও জনপ্রিয়তা লাভ করে। এছাড়া তারা তুমসা নহীঁ দেখা (১৯৫৭), এক মুসাফির এক হাসিনা (১৯৬২) ও কাশ্মীর কী কলি (১৯৬৪) ছবির জন্য গান রেকর্ড করেন। নয়্যার আশা ভোঁসলে-মোহাম্মদ রফি যুগলকে তার কয়েকটি জনপ্রিয় গানে ব্যবহার করেন, সেগুলো হল নয়া দৌড় ছবির "উড়ে জব জব জুলফেঁ তেরি", এক মুসাফির এক হাসিনা ছবির "ম্যাঁয় প্যায়ার কা রাহি হুঁ" এবং কাশ্মীর কি কলি ছবির "দিওয়ানা হুয়া বাদল" ও "ইশারোঁ ইশারোঁ মেঁ"। নয়্যারের জন্য গাওয়া আশার শেষ গান ছিল প্রাণ যায়ে পার বচন না যায়ে (১৯৭৪) ছবির জন্য।
আশার প্রারম্ভিক কর্মজীবনে অপর একজন সঙ্গীত পরিচালক তাঁকে সুযোগ দেন, তিনি হলেন মোহাম্মদ জহুর খৈয়াম। এই যুগলের প্রথম কাজ ছিল বিবি (১৯৪৮) ছবিতে। ১৯৫০-এর দশকে আশা খৈয়ামের সঙ্গীত পরিচালনায় বেশ কিছু কাজ করেন, তন্মধ্যে রয়েছে দর্দ ও ফির সুবাহ হোগি। এই যুগল উমরাও জান ছবির গানের জন্য সবচেয়ে বেশি স্মরণীয়।[১৫]
সুরকার রবি আশাকে তাঁর অন্যতম প্রিয় সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে গণ্য করেন। আাশা তাঁর বেশ কিছু জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের জন্য গান রেকর্ড করেন, সেগুলো হল ওয়াক্ত, চৌধবীঁ কা চাঁদ, গুমরাহ, বহু বেটি, চায়না টাউন, আদমি অউর ইনসান, ধুন্দ ও হামরাজ। চৌধবীঁ কা চাঁদ ছবির জন্য রবি চেয়েছিলেন গীতা দত্ত (চলচ্চিত্রটির অভিনেতা ও প্রযোজক গুরু দত্তের স্ত্রী) গানগুলো গাইবেন। কিন্তু তিনি অস্বীকৃতি জানালে গুরু দত্তের অনুরোধে আশাকে দিয়ে গানগুলো গাওয়ানো হয়।[১২]
১৯৫৭ থেকে ১৯৬২ সালের মধ্যে বলিউডের অন্যতম প্রখ্যাত সুরকার শচীন দেববর্মণ ও তার প্রিয় সঙ্গীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকরের বিরূপ সম্পর্ক চলাকালীন শচীন তার গানের প্রধান নারী কণ্ঠের জন্য আশাকে ব্যবহার করেন।[১৬] এই যুগল একাধিক চলচ্চিত্রে হিট গান উপহার দেন, তন্মধ্যে রয়েছে কালা পানি, কালা বাজার, ইনসান জাগ উঠা, লাজয়ন্তী, সুজাতা ও তিন দেবিয়াঁ।
আশা ও রাহুল দেববর্মণের প্রথম সাক্ষাৎ হয় যখন আশা দুই সন্তানের জননী এবং সঙ্গীত নিয়ে কর্মজীবন শুরুর লক্ষ্যে স্কুল থেকে ছিটকে পড়েন। তাঁদের প্রথম কাজ ছিল তিসরি মঞ্জিল (১৯৬৬) ছবিতে।[১৪] এই যুগল পরবর্তীকালে ক্যাবারে, রক, ডিস্কো, গজন ও শাস্ত্রীয়সহ বিভিন্ন ধারার গান রেকর্ড করেন।
১৯৭০-এর দশকে আশা ও রাহুল বলিউডে পশ্চিমা ধারার গান নিয়ে আসেন ক্যারভান ছবিতে হেলেনের উপর চিত্রায়িত "পিয়া তু আব তো আজা", হরে রাম হরে কৃষ্ণ (১৯৭১) ছবিতে "দম মারো দম", আপনা দেশ (১৯৭২) ছবিতে "দুনিয়া মেঁ" এবং ইয়াদোঁ কি বারাত (১৯৭৩) চলচ্চিত্রতে "চুরা লিয়া হ্যায় তুমনে" গানের মধ্যে দিয়ে।
এ আর রহমানকে রঙ্গিলা (১৯৯৪) ছবির গানের মাধ্যমে আশাকে ফিরিয়ে আনার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রদান করা হয়। এই ছবির "তানহা তানহা" ও "রঙ্গিলা রে" গান দুটি বিভিন্ন তালিকায় শীর্ষ স্থান দখল করেছিল। রহমানের সাথে তাঁর অন্যান্য গানগুলো হল তক্ষক ছবির "মুঝে রং দে, লগান ছবিতে উদিত নারায়ণের সাথে "রাধা ক্যায়সে না জলে", তাল ছবির "কাহিঁ আগ লাগে", দাউদ ছবিতে কে জে ইয়েসুদাস সাথে "ও ভাঁওরে", ইরুভার ছবিতে "ভেনিলা ভেনিলা", আলাইপায়ুদে (২০০০) ছবিতে "সেপ্টেম্বর মাধম" এবং মীনাক্ষী (২০০৪) ছবিতে "ধুঁয়া ধুঁয়া।[১২]
আশা ভোঁসলে বাংলা সিনেমার জন্য বহু ছবিতে নেপথ্য সঙ্গীত গেয়েছেন। এছাড়া তিনি বাংলা আধুনিক গান এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতও গেয়েছেন অনেক। আশা ভোঁসলের বাংলা আধুনিক গানের তালিকা:
|}
আশার দিদি বা বড় বোন হচ্ছেন তাঁর মতোই আরেক জনপ্রিয় গায়িকা লতা মঙ্গেশকর।
খ্যাতিমান গায়ক এবং সুরকার শচীন দেববর্মনের পুত্র ও বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক এবং সুরকার রাহুল দেববর্মন ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় স্বামী। তাঁদের সংসারে তিন সন্তান রয়েছে। তন্মধ্যে ২য় সন্তান বর্ষা ভোঁসলে ৮ অক্টোবর, ২০১২ তারিখে লাইসেন্সকৃত আগ্নেয়াস্ত্র মাথায় ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করেন।[১৭]
সঙ্গীতজীবনে দীর্ঘ ৫ দশক সেরা শিল্পীর দৌড়ে ছিলেন এই দুই বোন। ১৯৫৭ সালে নয়া দৌড়, আশা, নবরঙ্গ, মাদার ইন্ডিয়া, দিল দেকে দেখো, পেয়িং গেস্ট প্রমুখ চলচ্চিত্রে একেরপর এক হিট গান গেয়ে লতাকে হটিয়ে রাতারাতি বলিউডের শীর্ষস্থান পেয়ে যান আশা, যার পুরোটাই ওপি নায়ারের বদৌলতে। ১৯৫৮ সালে হাওড়া ব্রিজ, কাগজ কে ফুল, ফাগুন প্রমুখ ছবির মাধ্যমে জয়যাত্রা অব্যাহত রাখেন। তবে বেশিদিন শীর্ষস্থান ধরে রাখতে পারেননি তিনি। কারণ, ওপি নায়ার ছাড়া বাকি সব প্রথমসারির সুরকারদের প্রথম পছন্দ ছিল লতা। তাই, ১৯৫৯ সালেই পুর্বের ছন্দ ফিরে পান লতা।তবে, ১৯৭০এর দশকে লতাকে একেবারে হাড্ডাহাড্ডি টক্কর দেন আশা। কারণ, লক্ষ্মীকান্ত পেয়ারেলাল যেমন লতাকে সব ছবিতেই প্রাধান্য দিতেন তেমনি আর ডি বর্মন আর কল্যাণজি আনন্দজী প্রাধান্য দিতেন আশাকে। এছাড়া লতা যেমন হেমা মালিনী, রাখী, মুমতাজ, মৌসুমী চ্যাটার্জির জন্য চিরস্থায়ী কন্ঠ ছিলেন তেমনি আশার কন্ঠ আরোপ করা হত জীনাত আমান, পারভীন ববি, রেখা ও শর্মিলা ঠাকুরের প্রতিটি ছবিতে।
১৯৭৭ সাল পর্যন্ত আশা ভোঁসলে সাতবার ফিল্মফেয়ার সেরা নেপথ্য গায়িকার পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৭৭ সালের পর তিনি জানান যে তাঁর নাম যেন আর ফিল্মফেয়ার পুরস্কারের জন্য গণ্য করা না হয়। ২০০১ সালে তিনি 'ফিল্মফেয়ার আজীবন সম্মাননা পুরস্কার' পান।