ইনুকসুক (বহুবচনে ইনুকসুইট)[১] বা ইনুকশুক[২] (ᐃᓄᒃᓱᒃ, বহুবচনে ᐃᓄᒃᓱᐃᑦ থেকে; বিকল্পে ইনুইনাকতুন ভাষায় inukhuk,[৩] ইনুপিয়াক ভাষায় iñuksuk, আইসল্যান্ডীয় ভাষায় inussuk) হলো পাথরনির্মিত স্থলচিহ্ন বা পাথরস্তুপ, যা উত্তর আমেরিকার সুমেরু অঞ্চলের ইনুইট, ইনুপিয়াট, কালালিট, ইউপিক ও অন্যান্য জনগোষ্ঠী নির্মাণ ও ব্যবহার করেন। উত্তর কানাডা, গ্রিনল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা অঞ্চলে এগুলো পাওয়া যায়। সুমেরু বৃত্তের উত্তরে অবস্থিত এই সম্পূর্ণ অঞ্চল তুন্দ্রা জীবভৌগোলিক অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত এবং এতে খুব অল্পই প্রাকৃতিক স্থলচিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়।
ঐতিহাসিকভাবে পথচালনা, দিকনির্দেশনা, ভ্রমণপথ, মাছ ধরা ও শিকারের জায়গা, ক্যাম্প, পবিত্র ধর্মীয় স্থান, শিকারের জন্য পশুপাখির পথনিয়ন্ত্রক বেষ্টনী,[৪] বা খাদ্য সংরক্ষণাগার ইত্যাদি চিহ্নিত করতে ইনুকসুক ব্যবহৃত হয়েছে।[৫] উত্তর আলাস্কার ইনুপিয়াট জাতি হত্যার উদ্দেশ্যে সীমানা ঘেরা অঞ্চলে কারিব্যু ঢোকানোর জন্য ইনুকসুইট ব্যবহার করে।[৬] আকার ও আকৃতিতে পার্থক্যবিশিষ্ট ইনুকসুইট ইনুইট সংস্কৃতিতে ঐতিহাসিক মূলাবদ্ধ।[৭]
ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে সাধারণ ধরনের ইনুকসুইট হলো পাথরের ওপর পাথর সাজিয়ে তৈরি ইনুকসুইট। সবচেয়ে সহজ প্রকার হলো উল্লম্বভাবে একের উপর আরেক পাথর সাজিয়ে তৈরি ইনুকসুইট।[৮] তবে ইনুইট সংস্কৃতিতে মানুষ বা ক্রুশ আকারের ইনুকসুইট নির্মাণের প্রথা ইউরোপীয় পরিব্রাজক ও মিশনারিদের আগমনের পূর্ব থেকে ছিল কি-না, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিছু কিছু ইনুকসুইটের আকার থেকে একে সম্প্রদায়ের সামগ্রিক প্রচেষ্টায় নির্মিত হয়েছে বলে বোঝা যায়।[৪]
ব্যাফিন দ্বীপের ইনুকসুক পয়েন্টে (এনুকসো পয়েন্ট) প্রায় শতাধিক ইনুকসুইট পাওয়া যায়। স্থানটি ১৯৬৯ সালে কানাডার জাতীয় ঐতিহাসিক স্থানের স্বীকৃতি পায়।[৯][১০]
inuksuk শব্দের অর্থ “যা মানুষের সামর্থ্যে কাজ করে”।[১১] শব্দটি inuk (“ব্যক্তি”)[১২] এবং -suk (ersatz, “বিকল্প, প্রতিরূপ”) শব্দাংশদ্বয়ের সমন্বয়ে গঠিত। নুনাভিক এবং ব্যাফিন দ্বীপের দক্ষিণাংশে একে inutsuk হিসেবে উচ্চারণ করা হয়। (ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের জন্য ইনুইট ধনিতত্ত্ব দেখুন।) নুনাভুটের মধ্যাঞ্চলের উপভাষায় এর নাম inuksugaq (বহুবচনে inuksugait), যা ইনুকসুকের সাথে ব্যুৎপত্তিগতভাবে সম্পর্কিত।
ইংরেজি ভাষায় inukshuk বানানটি প্রধানত ব্যবহৃত হলেও, নুনাভুট সরকার[১৩] এবং ক্রাউন–ইন্ডিজেনাস রিলেশনস অ্যান্ড নর্দার্ন অ্যাফেয়ার্স কানাডার মাধ্যমে কানাডা সরকার[১৪] ইনুইটদের পছন্দের বানান inuksuk ব্যবহারকে উৎসাহিত করে।
ইনুকসুকের মতোই আরেক ধরনের কাঠামোকে বলা হয় ইনুঙ্গুয়াক (inunnguaq, ᐃᓄᙳᐊᖅ, “মানুষের অনুকরণ”, বহুবচনে ইনুঙ্গুয়াট, inunnguat), যা অনেকটা মানুষের দেহকাঠামোর অনুরূপ। ইনুঙ্গুয়াক প্রধানত গ্রিনল্যান্ডে পাওয়া যায় এবং ইনুইট জাতির বাইরে এটি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছে।[১৫] তবে, এটি ইনুকসুকের সবচেয়ে পরিচিত কাঠামো নয়। সাধারণভাবে এটি ইনুকসুইট থেকে আলাদা।
কুইবেকের উঙ্গাভা উপদ্বীপের থরের হাতুড়ি স্তম্ভকে ইনুকসুক বলে মনে করা হয়।
ইনুকসুইট ইনুইট সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইনুকসুক কানাডার কানাডার অধীনস্থ অঞ্চল নুনাভুটের পতাকা এবং কোট অব আর্মস এবং নুনাটসিয়াভুটের পতাকার কেন্দ্রীয় বস্তু। ইক্যালুইটের ইনুকসুক উচ্চ বিদ্যালয় এই ইনুকসুকের নামে নামকৃত।
ইনুঙ্গুয়াকসহ ইনুকসুক মূলধারায় কানাডার জাতীয় প্রতীক হিসেবে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ১৯৯৯ সালে ইনুকসুককে কানাডার কুইবেক, অন্টারিও, নুনাভিক ও নুনাভুট প্রদেশ এবং গ্রিনল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক ও নরওয়েতে আর্বসের আন্তর্জাতিক সুমেরু শিল্প ও সঙ্গীত প্রকল্পের নাম হিসেবে ঘোষণা করা হয়।[১৬]
২০০৫ সালের ১৩ জুলাই কানাডার সেনা সদস্যরা হ্যানস দ্বীপে একটি ইনুকসুক নির্মাণ করে সেখানে একটি ফলক স্থাপন করেন এবং কানাডার জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। সুমেরু অঞ্চলের এই দ্বীপটি নিয়ে কানাডার সাথে ডেনমার্কের দীর্ঘদিনের বিবাদ রয়েছে।[১৭] এছাড়ার দেশটির বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে বিভিন্ন পর্যটক আকর্ষণস্থলের প্রতীকী প্রবেশদ্বার হিসেবে ইনুকসুক নির্মাণ করা হয়েছে। টরন্টোয় অন্টারিও হ্রদের পাশে ৯ মি (৩০ ফু) লম্বা এমনই একটি ইনুকসুক নির্মাণ করা হয়েছে। ব্যাটারি পার্কে অবস্থিত এই ইনুকসুকটি ২০০২ সালের জুলাই মাসে টরন্টোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব যুব দিবস ২০০২-এর স্মারক হিসেবে এখনও বিদ্যমান।
ইনুঙ্গুয়াক ২০১০ শীতকালীন অলিম্পিকের লোগো হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ভ্যানকুভারের শিল্পী এলিনা রিভেরা ম্যাকগ্রেগর এই লোগোর নকশা করেছিলেন। লোগোতে ইনুঙ্গুয়াকের ব্যবহার নিয়ে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার প্রথম জাতি এবং ইনুইটদের মধ্যে বিতর্ক দেখা দেয়। এর নকশা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলেও এটি ভ্যানকুভারের ইংলিশ বেতে অবস্থিত অ্যালভিন কানাকের ১৯৮৬ সালে নির্মিত ইনুকশুককে উপলক্ষ করে আঁকা হয়েছিল বলে মনে করা হয়। বন্ধুত্ব এবং পৃথিবীকে স্বাগত জানানোই ছিল ইংলিশ বের প্রস্তর কাঠামো এবং ২০১০ শীতকালীন অলিম্পিক লোগো উভয়ের উদ্দেশ্য।
২০১০ শীতকালীন অলিম্পিকের লোগো এবং বিশ্বজুড়ে ইনুকসুইটের নির্মাণ এদের পরিচিতি বৃদ্ধি করেছে। সুমেরু অঞ্চলের বাইরে কানাডা সরকার সম্পূর্ণ অথবা আংশিক নিজ অর্থায়নে পাঁচটি প্রকৃত ইনুকসুইট দান করেছে। এগুলো যথাক্রমে অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন,[১৮] মেক্সিকোর মন্টেরেই, নরওয়ের অসলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন, ডি.সি. এবং গুয়াতেমালার গুয়াতেমালা সিটিতে অবস্থিত।[১৯]
২০০৭ সালের অক্টোবর মাসে মেক্সিকোর মন্টেরেইয়ে কানাডা সরকার একটি ইনুকসুক দান করে। ইনুভিয়ালুইট শিল্পী বিল নাসোগালুয়াক এটি নির্মাণ করেন। উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ নুয়েভো লিওনে কানাডার চেম্বার অব কমার্সের মন্টেরেই শাখার দশম বছর পূর্তিতে মেক্সিকোর কানাডীয় চেম্বার অব কমার্স এবং কানাডা সরকার এটি উপহার হিসেবে দান করেন। ইনুকসুকটি সান্তা লুসিয়া রিভারওয়াকের পাশে অবস্থিত। টাক্টইয়াক্টাকের অধিবাসী নাসোগালুয়াক এটি নির্মাণের জন্য মন্টেরেইয়ের স্থানীয় কোয়ারি থেকে পাথর সংগ্রহ করেন। এই ভাস্কর্যে ব্যবহারের জন্য শিল্পী কানাডার দুই প্রান্ত (একটি উচ্চ সুমেরু অঞ্চল এবং অপরটি শিল্পীর নিজের শহর টরন্টো) থেকে দুইটি পাথর নিয়ে যান। এই দুইটি পাথর একসাথে ইনুকসুকের মূল অংশ গঠন করে।
ইনুকসুক সামিট অব দি আমেরিকাসের প্রতীক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। কারণ, ইনুকসুক “সাধারণ উদ্দেশ্যের দিকে... পথনির্দেশনা এবং ঐক্য” নির্দেশ করে।[২০]
কানাডাব্যাপী বিভিন্ন পার্কের কর্তৃপক্ষ নিয়মিতভাবে হাইকার ও ক্যাম্পারদের তৈরি ইনুকসুক ভাঙার কাজ করে। অন্যথায়, তা পার্কে ঘুরতে আসা অন্য হাইকারদের জন্য পার্কের নির্দেশক পাথর এবং হাইকিং পথ সম্পর্কে বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে। এই পার্কগুলোতে ইনুকসুক তৈরির প্রবণতা এত গুরুতর হয়ে দেখা দিয়েছে যে, ২০০৭ সালে অন্টারিওর জর্জিয়ান উপসাগরের উত্তর তীরে অবস্থিত কিলারনি প্রাদেশিক পার্ক কর্তৃপক্ষ আগন্তুকদের ইনুকসুক না বানানোর নির্দেশনা জারি করে।[২১]
উত্তর অন্টারিওসহ ট্রান্স-কানাডীয় মহাসড়কের পাশে বেশ অনেকগুলো ইনুকসুইট নির্মাণ করা হয়েছে। ২০১০ সালে সাডবারির নর্দার্ন লাইফ পত্রিকার সাংবাদিক সাডবারি থেকে প্যারি সাউন্ড পর্যন্ত অন্টারিও মহাসড়ক ৬৯ বরাবর ৯৩টি ইনুকসুইট গণনা করেন। এই সাংবাদিক এই সড়কে দুইটি ইনুকসুইট নির্মাণকারী ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে সক্ষম হন।[২২]
২০১৫ সালে অন্টারিওর হ্যামিল্টনের এক দল নারী নিখোঁজ ও নিহত আদিবাসী নারীদের স্মৃতিতে এবং সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য চেডক রেললাইন বরাবর ১,১৮১টি ইনুকসুইট নির্মাণ করে। এটি কানাডাব্যাপী ইনুকসুক ব্যবহার করে করা অনেকগুলো আন্দোলনের অন্যতম। সেই বছর কানাডার নবনির্মিত সরকার পরবর্তীতে জাতীয়ভাবে এই সংক্রান্ত জিজ্ঞাসাবাদ সম্পন্ন করে।[২৩]
গিনেস বিশ্ব রেকর্ড অনুযায়ী সবচেয়ে লম্বা ইনুকসুক কানাডার অন্টারিওর শমবার্গে অবস্থিত। ২০০৭ সালে নির্মিত ইনুকসুকটি ১১.৩৭৭ মিটার (৩৭.৩৩ ফু) লম্বা।[২৪]
রোম সন্ধির ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের (আইসিসি) প্রতি কানাডার সমর্থন প্রকাশের জন্য[২৫] এবং প্রথম জাতিসমূহের সাথে সমঝোতায় কানাডার প্রতিশ্রুতির স্মারক হিসেবে কানাডীয় আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল জোডি উইলসন-রেবুল্ড ২০১৮ সালের ৭ মার্চ আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতকে একটি ইনুকসুক উপহার হিসেবে দান করেন। তিনি এবং আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের প্রধান বিচারক সিলভিয়া ফের্নান্দেজ দে গুর্মেন্দি হেগে আদালত প্রাঙ্গণে ইনুকসুকটির উদ্বোধন করেন।[২৬]
কানাডার রক ব্যান্ড রাশ ১৯৯৬ সালে তাদের অ্যালবাম টেস্ট ফর ইকো-এর প্রচ্ছদে ইনুকসুককে চিত্রায়িত করে।