ইরাকের অভিবাসীরা হলেন ইরাকের নাগরিক যারা যুদ্ধ অথবা নিপিড়নের কারণে ইরাক ছাড়তে বাধ্য হন। বিগত ত্রিশ বছরে ইরাক ছেড়ে আশ্রয় নেওয়া অভিবাসীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমানহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এই অভিবাসনের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হল ইরাক যুদ্ধ, কুর্দি বিদ্রোহ, ইরাক-ইরান যুদ্ধ (১৯৮০-১৯৮৮ সাল), ইরাকের কুয়েত আক্রমণ (১৯৯০) এবং উপসাগরীয় যুদ্ধ (১৯৯১), বিভিন্ন সময়ে ইরাকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ও যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইরাক আক্রমণের ফলে লক্ষ লক্ষ লোক ইরাক ছাড়তে বাধ্য হন। অন্যান্য অভিবাসী থেকে ব্যতিক্রমভাবে ইরাকিরা আশ্রয় শিবিরের পরিবর্তে বিভিন্ন দেশের শহুরে এলাকায় বসতি স্থাপন করে।
২০০৭ সালের এপ্রিলের এক হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ৪ মিলিয়ন ইরাকি অভিবাসীর কথা জানা যায়, যাদের মধ্যে ১.৯ মিলিয়ন ইরাকের অভ্যন্তর, ২ মিলিয়ন মধ্যপ্রাচ্যে ইরাকের বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশে এবং ২ লক্ষ লোক মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে বিভিন্ন দেশে আশ্রয়গ্রহণ করেছিলেন।[১][২][৩][৪][৫] জাতিসংঘের অভিবাসী বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) ইরাকি অভিবাসীদের মানবিক সহায়তা দিয়েছিল।[৪] ইরাকের বাস্তুচ্যুত হওয়া নাগরিকদের সংখ্যা মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি, যা ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের জন্ম হওয়ার পর বাস্তুচ্যূত ফিলিস্তিনের নাগরিকদের থেকেও বেশি।[৪][৬]
১৯৯০ সালের ২রা আগস্ট ইরাক কুয়েত আক্রমণ করে।[৭] ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের ফলে প্রায় ৩ মিলিয়ন লোক অভিবাসী হন, যাদের অধিকাংশই ছিলেন ইরাকের নাগরিক।[৭] তাদের মধ্যে প্রায় সবাই যুদ্ধ শুরুর আগে অথবা অপারেশন ডেসার্ট স্টর্ম শেষ হওয়ার পরে ইরাক এবং কুয়েত ছাড়েন।[৭] ফিলিস্তিনিদের পাশাপাশি এদের একটি বিশাল অংশ হলো কূর্দি ও শিয়া জনগোষ্ঠীর লোক যারা সাদ্দাম হোসেইন এর বিরুদ্ধে ব্যর্থ গণ-অভ্যূল্থানের পর ইরাক থেকে পালাতে বাধ্য হন। ফিলিস্তিনিরা হলেন দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী যারা উপসাগরীয় যুদ্ধের ফলে বাস্তুচ্যূত হন এবং এদের মধ্যে প্রায় ৩ লক্ষ লোক জর্ডানে আশ্রয়গ্রহণ করেন। এছাড়া প্রায় ৩৭ হাজার আরব ইরাক, যাদের অধিকাংশ শিয়া, সৌদি আরবে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং প্রায় ১ লক্ষ ইরাকি জর্ডান ও সিরিয়ায় পালিয়ে যান।[৭]
ইরাকের মোট জনসংখ্যার ৫৫% শিয়া জনগোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও সুন্নি আরব কর্তৃক সরকার থেকে তাদের ছাঁটাই করা হয়।[৭] ১৯৯১ সালের মার্চে শিয়া জনগোষ্ঠী কর্তৃক ইরাকে এক ব্যর্থ গণ-অভ্যূল্থান সংঘটিত হয়। সাদ্দাম হোসেইন মার্চের মধ্যভাগে শিয়া অধ্যুষিত দক্ষিণাঞ্চল পুনরায় তার নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং তার চাচাত ভাই আলি হাসান মজিদ সেখানে গণহত্যা ও বোমাবর্ষণ করে এবং বহু মসজিদ ও ঘরবাড়ি ধ্বংস করে। ১৯৯১ সালের মার্চ ও সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে সহিংসতার জন্য দক্ষিণের প্রায় ২ লক্ষ লোক নিহত হন। ২০০৩ সালে ৫ লক্ষ ৩০ হাজার ইরাকি ইরানে আশ্রয় নেয়।[৭][৮]
১.৮৫ মিলিয়ন কূূর্দি তুরস্ক ও ইরান সীমান্তে পালিয়ে যায়।[৭] শিয়া দের থেকে ব্যাতিক্রমিভাবে কুর্দিরা রাজনৈতিকভাবে কিছুটা হলেও প্রভাবশালী ছিল। কুর্দি নেতৃত্বাধীন দুইটি রাজনৈতিক দল প্যাট্রিওটিক ইউনিয়ন অব কুর্দিস্তান (পিইউকে) এবং কুর্দিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (কেডিপি)। এই রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে শিয়াদের দক্ষিণের তুলনায় কুর্দিদের উত্তরে কম সহিংসতার ঘটনা ঘটে এবং এখান থেকে তুলনামূলকভাবে কম মানুষ অভিবাসী ও অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যূত হন।[৭]
১৯৯১ সালের মার্চের শেষভাগে জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ প্রশাসন ইরাক সরকারকে কুর্দিদের বিরুদ্ধে হেলিকপ্টার ব্যবহারের অনুমতি দেয়। একে কূর্দি জনগণকে সন্ত্রস্ত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। প্রায় ৪ লক্ষ ৫০ হাজার কুর্দি জনগণ তুরস্ক ও ইরানের সীমান্তে পালিয়ে যায় এবং সাদ্দাম হোসেইন সরকার ৩ এপ্রিল ১৯৯১ সালে পুনরায় কুর্দি অধ্যুষিত শহরগুলো পুনরায় নিয়ন্ত্রণে আনে।[৭] তুরস্ক সরকার তাদের দেশে কুর্দিদের আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানায়, কিন্তু এই অভিবাসী জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।[৭] ইরান সীমান্তে আশ্রয়গ্রহণকারী কুর্দিরা আরও বেশি বিচ্ছিন্ন ছিল এবং গণমাধ্যমের কম দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল, কিন্তু ইরান স্বীকার করেছিল যে, কিছু অভিবাসীর শারিরীক অবস্থা তুর্কি সীমান্তে আশ্রয়গ্রহণকারীদের তুলনায় কম খারাপ।[৭]
এই মানবিক বিপর্যয়ের প্রতিক্রিয়ায় এপ্রিল ৮, ১৯৯১ সালে জাতিসংঘ উত্তর ইরাকের নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তুলতে সম্মত হয়।[৯] এর দুই দিন পর যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা উত্তর ইরাকের নো ফ্লাই জোন প্রতিষ্ঠা করে।
এই মানবিক বিপর্যয়ের প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র উত্তর ইরাকে নিরস্ত্র সাহায্যকর্মী মোতায়েন করতে চেয়েছিল কিন্তু কুর্দিরা ফেরত আসতে অস্বীকৃতি জানায়।[৭] তখন তুরস্ক, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডসএবং যুক্তরাষ্ট্র আমাদিয়া, দিহক এবং জাকহো শহরের মাঝে নিরাপদ আশ্রয়স্থল তৈরী করে এবং ঐ এলাকায় কোন ইরাকি সেনাবাহিনী অথবা পুলিশের উপস্থিতি ছিলনা। জাকহো শহরের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী অভিবাসীদের জন্য একটি তাবুর শহর তৈরী করে, কিন্তু এটি তেমন ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়নি।[৭] অবশেষে কুর্দিরা নিরাপদ এলাকায় স্থানান্তরিত হয়।
ফেব্রুয়ারি ১৫, ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ ইরাকি জনগণকে সাদ্দাম হোসেইনকে উৎখাতের আহ্বান জানান, যা ২০০৩ সালে তার পুত্র জর্জ ডব্লিউ বুশের শাসনামলের আগ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।[৭]
২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নেতৃত্বে ইরাক আক্রমণের পর ইরাক থেকে অভিবাসী সংখ্যা বাড়তে থাকে। ঐ বছর সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর প্রায় ৩০ হাজার অভিবাসী ২ বছরের মধ্যে দেশে ফিরে আসে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কারণে ২০০৬ সালে অভিবাসী সংখ্যা আবারও বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ঐ বছরের ফেব্রুয়ারিতে আল-আসকারি মসজিদে বোমা বর্ষণের ফলে সহিংসতা চরম মাত্রায় পৌছায়।[১][৩][৮] যুক্তরাষ্ট্রের দখলদারিত্ব ও ইরাকিদের মধ্যে জাতিগত সংঘাত সংখ্যালঘু সন্নি শাসনের অবসান ঘটায় এবং সংখ্যাগুরু শিয়াদের ক্ষমতা দখলের সুযোগ করে দেয়, যার ফলে সৌদি আরব-সহ সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরাকের প্রতিবেশী দেশগুলো চিন্তিত হয়ে পড়ে। আল কায়দার মত জঙ্গি সংগঠনগুলো ইরাকে তাদের উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য এই সংঘর্ষ ও বিশৃঙ্খলার সুযোগ নেয়।[৪]
ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০০৭ নাগাদ তৎকালীন অভিবাসীদের জন্য জাতিসংঘ হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) এ্যান্টোনিও গুতেরেজ বলেন যে, যুদ্ধের ফলে ইরাক থেকে বাইরের দেশে আশ্রয় নেওয়া অভিবাসীরা সংখ্যা ২ মিলিয়নে পৌঁছেছে এবং ইরাকের অভ্যন্তরে বাস্তুহারা জনগণের সংখ্যা প্রায় ১.৭ মিলিয়ন।[১০][১১] ২০০৬ সালে ইরাকের গৃহযুদ্ধের ফলে দেশের বাইরে ইরাকি অভিবাসীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।[১০][১২]
প্রায় ১ লক্ষ ১০ হাজার ইরাকি যৌথবাহিনীর সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিল।[১৩] মে ২৫, ২০০৭ সালে প্রকাশিত এক নিবন্ধ অনুযায়ী গত ৭ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মাত্র ৬৯ জন লোককে অভিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল।[১৪] মনে করা হয় যে, প্রায় ৪০% মধ্যবিত্ত ইরাকি পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল।[১][১৫][১৬] নির্যাতনের কারণেই এদের অধিকাংশ দেশ ত্যাগ করে এবং তাদের পুনরায় ফিরে আসার কোন ইচ্ছা ছিলনা।[১৫]
ইরাকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অভ্যান্তরিনভাবে বাস্তুচ্যূত জনগোষ্ঠী রয়েছে।[৮] অন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার ২০১৭ সালের এপ্রিলের এক হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৩ মিলিয়ন ইরাকি দেশের অভ্যান্তরে বাস্তুচ্যূত হন।[১৭] আইএস-এর দখলকৃত এলাকা পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াইয়ের সময় কয়েক হাজার লোক প্রায় প্রতিদিনই বাস্তুহারা হতেন।[১৮] বহু অভ্যন্তরীণ বাস্তুহারা লোক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হন এবং চলমান অস্থিরতার কারণে তাদের ঘরে ফেরা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
২০০৭ এর জুলাইয়ের শেষের দিকে ইরাকের এনজিও সমন্বয়ক কমিটি (এনসিসিআই) এবং অক্সফার্ম ইন্টারন্যাশনাল, রাইসিং টু দ্য হিউম্যানেটেরিয়ান চ্যালেঞ্জ ইন ইরাক, শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়েছে যে, এক তৃতীয়াংশ জনগণের সাহায্য প্রয়োজন। এনসিসিআই হলো প্রায় ৮০টি আন্তর্জাতিক ও ২০০টি ইরাকি এনজিওর জোট। তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনটি ২০০৩ সালে চালানো একটি জরিপের ওপর ভিত্তি করে প্রকাশিত হয়, জরিপ অনুসারে ৭০ শতাংশ ইরাকি পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ পায়না। মোট জনসংখ্যার মাত্র ২০ শতাংশের যথাযথ পয়নিষ্কাসন ব্যবস্থা রয়েছে এবং ৩০ শতাংশ শিশু কোন না কোন সময় অপুষ্টির স্বীকার হয়েছে। প্রায় ৯২ শতাংশ শিশু শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। ২০০৩ সালের পর থেকে এসব সমস্যা আরও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।[১৯]
ইরাকি অভিবাসীরা আশ্রয় শিবিরের পরিবর্তে মুলত শহুরে এলাকায় বসতি গড়েছে।[৮] প্রায় ২ মিলিয়ন ইরাকি প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয়গ্রহণ করেছে।[৪][৫] এবং তাদের ৯৫ শতাংশই মধ্যপ্রাচ্যে বসবাস করছে যদিও ইউরোপের দেশগুলো ইরাকি অভিবাসীদের গ্রহণ করতে শুরু করেছে। [৩] মধ্যপ্রাচ্যের দপশগুলোতে তাদের “অভিবাসীর” বদলে অস্থায়ী অতিথি হিসেবে দেখা হয় এবং এসব দেশে অভিবাসীদের জন্য আইনগতভাবে বৈধতা পাওয়া খুবই কঠিন।[৪] বর্তমানে ঐ অঞ্চলের আশ্রয়দানকারী দেশগুলো হল সিরিয়া, জর্ডান, মিশর, কুয়েত, ইরান, তুরস্ক এবং উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো। [৪] শুধুমাত্র মিশর ও তুরস্ক ইউএনএইচসিআর অভিবাসী সম্মেলনে চুক্তি স্বাক্ষর করে।[৪]
যুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে জর্ডান ও ইরাকের মধ্যে ইতিবাচক সম্পর্ক ছিল, বিশেষ করে অর্থনৈতিক দিক থেকে।[৪] ২০০৯ সাল পর্যন্ত জর্ডান প্রায় ৭ লক্ষ ইরাকি অভিবাসীকে আশ্রয় দেয় যা ৬০ লক্ষ জনসংখ্যার দেশটির জন্য অনেক বেশি।[৪] ২০০৫ সাল পর্যন্ত জর্ডানে ইরাকিরা ৩-৬ মাসের জন্য অতিথি হিসেবে বসবাসের জন্য নিবন্ধিত হতে পারত, কিন্তু তাদের কাজ করার অনুমোদন দেওয়া হতনা।[৪] ২০০৫ সালের পর ইরাকি জঙ্গীরা আল কায়দার সাথে জর্ডানের একটি হোটেলে বোমা হামলা চালালে অভিবাসীদের জন্য নিবন্ধন নবায়ন করা আরও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে, ফলে জর্ডানে অনিবন্ধিত ইরাকি অভিবাসীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।[৪] ২০০৬ সালে, জর্ডানে ১৭-৩৫ বছর বয়সী একক পুরুষ ও বালকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে, তারপর জর্ডান সরকার সকল ইরাকিদের জন্য নতুন ইস্যূ করা পাসপোর্ট বাধ্যতামূলক করে।[৪] ফেব্রুয়ারি ২০০৮ সালে, জর্ডান সরকার ইরাকি অভিবাসীদের জন্য সীমান্তে আবেদনের পরিবর্তে ইরাকে ভিসার জন্য আবেদন করা বাধ্যতামূলক করে।[৮] শুধুমাত্র সেসব ইরাকি জর্ডানে দীর্ঘমেয়াদে বসবাস, সন্তানদের স্কুলে পাঠানো ও অন্যান্য সুবিধা পেয়েছিল, যারা জর্ডানের ব্যবসায় বিনিয়োগ এবং জাতীয় স্বার্থে অবদান রাখতে পেরেছিল।[৪]
জর্ডানের রাজধানী আম্মানের অধিবাসীরা আবাসনের মূল্য বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতির জন্য ইরাকিদের দায়ী করে।[৪]
সিরিয়া ইরাকি অভিবাসীদের ঐতিহাসিকভাবে সহযোগীতা করে আসছে।[২০] ২০০৭ সালের শুরুতে ইউএনএইচসিআর এর হিসাব অনুযায়ী সিরিয়ায় ইরাকি অভিবাসীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১.২ মিলিয়ন।[৮][২০] সিরিয়ায় ইরাকি অভিবাসীদের ৮০-৯০% রাজধানী দামেস্কে বসবাস করে।[৪] ২০০৭ সাল পর্যন্ত সিরিয়া যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ ইরাকের অভিবাসীদের জন্য মুক্ত দরজা নীতি গ্রহণ করে।[৮]
সিরিয়ায় বহু ইরাকি দরিদ্র জীবনযাপন করেএবং এক হিসাব অনুযায়ী ৫০ হাজার ইরাকি কিশোরী ও মহিলা, যাদের মধ্যে অনেকেই বিধবা, টিকে থাকার জন্য পতিতাবৃত্তিতে জড়াতে বাধ্য হচ্ছে।[২১][২২] ইউএনএইচসিআর অনুসারে, সিররিয়ায় প্রায় ২৭% ইরাকি অভিবাসী পরিবারে জীবিকা উপার্জনে সক্ষম ব্যক্তি নেই।[২০]
১.২ মিলিয়ন ইরাকি অভিবাসী ১৮ মিলয়ন জনসংখ্যার দেশ সিরিয়ায় একটি বিশাল জনগোষ্ঠী।[২০] এই বিশাল জনগোষ্ঠীর চাপ সিরিয়ায় জিবনযাত্রর ব্যয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা পালন করে।[৮][২০] পানি, বিদ্যুৎ ও তেলের যোগানের চেয়ে চাহিদা বহুগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। [২৩] সিরিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান যে, সেখানে খাদ্যের দাম ৩০%, সম্পত্তির দাম ৪০% এবং বাড়ি ভাড়া ১৫০% বৃদ্ধি পেয়েছে।[৮][২০] পানি ব্যবহারের পরিমান ২১% বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ২০০৬ সালে সিরিয় সরকারের প্রায় ৬.৮ মিলিয়ন ডলার ব্যায় হয়।[২০] ইরাকি অভিবাসীরা সিরিয়ার শ্রমবাজারেও প্রভাব বিস্তার করেছিল, ফলে ২০০৬ সালে সিরিয়ায় বেকারত্বের হার ছিল ১৮%।[২০] অভিবাসীদের কারণে সিরায়ায় স্বাস্থ্যসেবা (সিরিয়ায় য বিনামূল্যে প্রদান করা হয়) ও পাবলিক স্কুলগুলোতে চাপ বাড়তে থাকে।[২০] ২০০৫ ও ২০০৬ সালে সিরিয় সরকার ইরাকি অভিবাসীদের সাহায্যের জন্য $১৬২ মিলিয়ন ডলার ব্যায় করে।[২০]
সিরিয়া একসময় আরব অভিবাসীদের জন্য সীমান্ত খুলে দিয়েছিল এবং ইরাকি অভিবাসীদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। অক্টোবর ১, ২০০৭ সালে ইউএনএইচসিআর-এর এক মুখপাত্রকে উদ্ধৃত করে গণমাধ্যমগুলো জানায় যে, সিরিয়া প্রবেশের ক্ষেত্রে ইরাকি অভিবাসীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সিরিয়ার নতুন নিয়ম অনুসারে সিরিয়ার দূতাবাস থেকে ভিসা সংগ্রহের মাধ্যমে শুধুমাত্র ইরাকি বণিক, ব্যবসায়ী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিরিয়ায় প্রবেশ করতে পারবে।[৮][২৪][২৫][২৬]
২০১২-১৩ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ তীব্ররুপ ধারণ করলে বহু ইরাকি অভিবাসী চলমান সহিংসতার কারণে পালাতে বাধ্য হয়। দামেস্কে ইরাকি দূতাবাস অনুযায়ী ২০১২ সালে সিরিয়ায় ২ লক্ষের কম অভিবাসী অবশিষ্ট ছিল। ইরাকি সরকার বিনামূল্যে বিমান ও বাসের টিকিট সরবরাহ করে বহু অভিবাসীকে ইরাকে ফেরত আসতে সাহায্য করেছিল। প্রায় ১০ হাজার ইরাকি নিজেদের দেশে ফেরত এসেছিল, যদিও সেখানে তখনও অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছিল এবং প্রায় প্রতিদিনই বোমা হামলার মত ঘটনা ঘটত।[২৭]
ইরাকের অভিবাসন মন্ত্রনালয়ের এক মুখপাত্র জানান যে, সিরিয়া থেকে পালানো অভিবাসীদের অধিকাংশই ছিল শিয়া জনগোষ্ঠী। ২০১২ সালের জুলাইয়ে ১৭ মাসের যুদ্ধের সবচেয়ে তীব্র লড়াই শুরু হয়। বিদ্রোহীরা দামেস্কের আশেপাশের এলাকাগুলো দখল করে নেয়, ফলশ্রুতিতে সরকারী বাহিনীও আক্রমনাত্মক প্রতিক্রিয়া করে। লড়াইয়ে বিদ্রোহীরা ইরাকিদের তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত করে। জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী, সাত সদস্যের এক ইরাকি পরিবারকে দামেস্কে তাদের অ্যাপার্টমেন্টে গুলো করে হত্যা করা হয়। এক প্রতিবেদন অনুযায়ী জুলাইয়ে ২৩ জন ইরাকি অভিবাসীকে হত্যা করা হয়, যাদের অনেকেরই শিরশ্ছেদ করা হয়েছিল।[২৮]
১৯৯০ এর দশকে ইরাকি শিয়াদের অনেকেই সাদ্দাম হোসেইনের ভয়ে লেবাননে পালিয়ে যান। ২০০৭ সালে মিডল ইস্ট রিপোর্ট-এর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয় লেবানন প্রায় ৪০ হাজার ইরাকি অভিবাসীকে আশ্রয় দিয়েছে।[৬] লেবাননে ইরাকি অভিবাসীর ৮০% রাজধানী বৈরুতে বসবাস করে।[৬] লেবানন সরকারের গৃহীত নীতি অনুসারে লেবাননে বসবাসকারী অভিবাসীদের জোর করে তাদের নিজের দেশে পাঠানো যাবেনা, যদি সেখানে তাদের জীবননাশের আশঙ্কা থাকে।[৬] মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর মতো লেবাননে ওয়ার্ক ভিসা না পাওয়ায় ইরাকি অভিবাসীরা সেখানে বেকারত্ব ও দারিদ্রতার কারণে নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়।[৬]
মিশরের সাথে ইরাকের কোন সীমান্ত না থাকলেও ২০০৬ সালে ইরাকি অভিবাসীদের অন্যতম প্রধান গন্তব্য ছিল মিশর। ইরাকিরা খুবই দ্রুত মিশরে প্রবপশ করতে থাকে। ২০০৩ সালে মিশরে মাত্র ৮০০ জন অভিবাসী ছিলেন, কিন্তু ২০০৬ সালে ইরাকি অভিবাসীদের জন্য এই সংখ্যা ১ লক্ষ ৫০ হাজারে গিয়ে পৌঁছায়।[৬][২৯] ২০০৭ সালে মিশর নতুন করে অভিবাসী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
২০০৬ সাল থেকে শিল্পন্নোত দেশগুলোতে আশ্রয় প্রত্যাশিতদের মধ্যে ইরাকিরা ছিল অন্যতম।[৩] মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি ও আরব রাষ্ট্রগুলোতে ইরাকিদের অস্থায়ী অতিথি হিসেবে দেখার জন্য আশ্রয়প্রার্থীদের গন্তব্য আরও দুরের দেশ পর্যন্ত প্রসারিত হতে থাকে।[১]
বর্তমানে সুইডেন ইউরোপে মোট ইরাকি আশ্রয় প্রত্যাশীদের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়েছে। ২০০৬ সালে ৯ হাজারের বেশি ইরাকি অভিবাসী তাদের নিজ থেকে পালিয়ে সুইডেনে আশ্রয় প্রার্থনা করে, যা ২০০৫ সালে সুইডেনে আশ্রয়প্রার্থীর ৪গুন ছিল। ২০০৭ সালে সুইডেনের অভিবাসী কর্তৃপক্ষ ৪০ হাজার ইরাকি অভিবাসীকে গ্রহণ করে। এক হিসাব অনুযায়ী ৭৯,২০০ ইরাকি সুইডেনকে নিজেদের ঘর বানিয়ে নিয়েছে। ৯০-এর দশকেও বহু ইরাকি সুইডেনে আশ্রয় নিয়েছিল। বহু অভিবাসনপ্রত্যাশী সুইডেনকে পছন্দ করে কারণ সেখানে তাদের আত্মীয় রয়েছে এবং সুইডেন অভিবাসীবান্ধব নীতিগ্রহণ করেছে।[৩০]
২০০৮ সালে এউএনএইচসিআর ১৭,৮০০ জন ইরাকি অভিবাসীকে মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে তৃতীয় পক্ষের দেশগুলোতে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে।[১]
জার্মানিতে ইরাকি অভিবাসীদের ৫০% হল কুর্দি।[৩১] আশ্রয় নেওয়া অভিবাসীদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ৬৫-৭০%, তুরস্কে ৭০% এবং ইরানে ১৫% ছিল কুর্দি।[৩২]
খ্রিস্টানরা ইরাকের মোট জনসংখ্যার ৫% এর কম হলেও এউএনএইচসিআর-এর মতে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে ইরাকের বসবাসকারী ইরাকি অভিবাসীর ৪০% হলো খ্রিস্টান।[৩৩] ২০০৩ সালের অক্টোবর ও ২০০৫ সালের মার্চে দেশ ত্যাগ করা ৭ লক্ষ ইরাকিদের মধ্যে ৩৬% ছিল অ্যাসিরিয়ান ও অন্যান্য খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী।[৩৪][৩৫][৩৬][৩৭][৩৮]
ম্যান্ডিয়ানরা হল দক্ষিণ ইরাকের এক প্রাচীন সম্প্রদায়। মনে করা হয় ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণের পূর্বে প্রায় ৪০ হাজার ম্যান্ডিয়ান জনগণ বাস করত। তারা সাম্প্রদায়িক মিলিশিয়া কর্তৃক বহু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বাগদাদে বসবাসকারী ম্যান্ডিয়ানদের একটি বিশাল অংশ বাগদাদ ছেড়ে যায়; অনেকেই সিরিয়া, জর্ডান অথবা অন্য দেশে পালিয়ে যায়।[৩৯]
৩৮ হাজার জনসংখ্যার ক্ষুদ্র একদল ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠী বাগদাদের পাশে আল-বালাদিয়ায় বসবাস করত এবং অন্যদের মত তারাও ইরাক ছাড়তে বাধ্য হন।
সিরিয়া আশ্রয় দিতে অসম্মতি জানালে ৩৫০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি সিরিয়া সীমান্তে অমানবিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। পরে সিরিয়া তাদের প্রবেশের অনুমতি দেয়। তারা বেশি খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হন কারণ অধিকাংশ ফিলিস্তিনি ইরাকের নাগরিক ছিলেন না, ফলে তাদের ইরাকি পাসপোর্টও ছিল না।
২০০৭ সালে ইয়াজিদি সম্প্রদায় অনেকগুলো সহিংস ঘটনার শিকার হন। ২০০৭ সালের ২৩ এপ্রিল একদল মুখোশধারি আততায়ী মসুলের নিকট ২৩ জন ইয়াজিদিকে গুলো করে হত্যা করে। আগস্ট ১৪, ২০০৭ সালের সিরিজ বোমা হামলায় ইয়াজিদিদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়।
এপ্রিল ১৭, ২০০৭ সালে ইরাকি অভিবাসী সংকট নিয়ে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর প্রতিনিধিদল, যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারী অব স্টেট পওলা ডবরিনস্কি, জাতিসংঘের অভিবাসী বিষয়ক হাই কমিশনার ও অন্য ৬০ টি বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। [৪০] জুলাই ২৯, ২০০৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সিরিয়ার দামেস্কে বৈঠক আরম্ভ করে। বৈঠকে ২ ইরাকের মিলিয়নেরও বেশি অভিবাসীর স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়। বৈঠকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পাশাপাশি রেডক্রস, রেডক্রিসেন্ট এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা অংশগ্রহণ করে।[৪১]
সেপ্টম্বর ১৮, ২০০৭ সালে ইউএনএইচসিআর, ডব্লিওএইচও, ইউনিসেফ, ইউএনএফএ এবং ডব্লিউএফপি $৮৪.৮ মিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তার জন্য আহ্বান জানায়, যা ইরাকি অভিবাসীদের আশ্রয়দানকারী দেশকে অভিবাসীদের জন্য ক্লিনিক ও চিকিৎসা সরঞ্জামে ব্যায় করার জন্য প্রদান করা হবে।[৪] ২০০৭ সালে জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন, মিশর, তুরস্ক, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং বিভিন্ন এনজিও ইরাকি অভিবাসীদের সাহায্য করার জন্য $৬০ মিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা পায়।[৫] জাতিসংঘের যৌথ স্বাস্থ্য উদ্যোগের অংশ হিসেবে $২৭ মিলিয়ন ডলার স্বাস্থ্যসেবার কাজে বরাদ্দ কর হয়।[৫] ২০০৭ সালে ইরাকি অভিবাসীদের সহায়তা করার জন্য ইইউ $ ৫০ মিলিয়ন ডলার ও যুক্তরাষ্ট্র $ ১৮ মিলিয়ন ডলার প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়।[৫]