ইলুমিনাতি (বাংলা: [ɪˌlumɪˈnat̪i]), ঐতিহাসিক নাম ব্যাভারীয় ইলুমিনাতি, একটি গুপ্ত সংগঠন। ১৭৭৬ সালের ১ মে জার্মানির ব্যাভারিয়াতে অ্যাডাম ভাইসহাউপ্ট কর্তৃক এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।[১] এর লক্ষ্য ছিল কুসংস্কার, অস্পষ্টতা, জনজীবনে ধর্মীয় প্রভাব এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরোধিতা করা। তারা তাদের সাধারণ বিধিতে লিখেছিল, "অন্যায়ের প্রবর্তকদের ষড়যন্ত্রের অবসান ঘটানো, তাদের উপর কর্তৃত্ব না করে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা।"[২] সমাজ ও জাতির জন্য হুমকিস্বরূপ ভেবে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের অধীনস্থ ব্যাভারিয়ার তৎকালীন শাসক চার্লস থিওডোর তাঁর শাসিত অঞ্চলের সকল গুপ্ত সংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ১৭৮৫ সালের ২ মার্চ এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়। অ্যাডাম পালিয়ে যান আর ইলুমিনাতির প্রচুর গোপন নথিপত্র সরকারের হাতে এসে যায়, এবং দু’বছর বাদে সরকার সেগুলো প্রকাশ করে দেয়।[৩][৪]
১ মে ১৭৭৬ সালে জার্মানির দক্ষিণপূর্বের রাজ্য ব্যাভারিয়াতে এই গুপ্ত সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানের ইঙ্গলস্টাট বিশ্ববিদ্যালয়ের "ক্যাথলিক চার্চ আইন" বিভাগের প্রথম অধ্যাপক আডাম ভাইসহাউপ্ট এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়টি তখন সম্পূর্ণই জেসুইট প্রভাবে চালিত হতো, অর্থাৎ পুরোপুরিভাবে খ্রিস্টীয় আইনকানুন মেনে চলতো। যেই খ্রিস্টধর্মের প্রতি আনুগত্য কিছুটা কম দেখাতো তাকেই নানা সমস্যা পোহাতে হতো। আডাম তখন চিন্তা করলেন এমন এক গুপ্ত সংগঠনের, যার মাধ্যমে তিনি সমাজকে নতুন পথে চালনা করতে পারবেন।[১]
আরেকটি গুপ্ত সংগঠন ছিলো, যার নাম ফ্রিমেসনরি। কিন্তু আডাম দেখলেন ফ্রিমেসনদের সাথে যোগ দেয়াটা অনেক খরচের ব্যাপার। তাছাড়া তাঁর নিজের ধ্যানধারণার সাথে এই সংগঠনে মতবাদের মিল নেই। তাই তিনি নিজের ধ্যানধারণা মোতাবেক এক সংগঠন প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করলেন।[১] প্রথমে তিনি তাঁর সংঘের নাম রাখলেন “বুন্ট ডা পের্ফেক্টিবিলিস্টেন” (Bund der Perfektibilisten); কিন্তু অদ্ভুত শুনায় বিধায় নামটি পরিবর্তন করেন।[৫] আডাম আর তাঁর চার ছাত্র মিলে এই সংগঠন শুরু করলেন। আর "আউল অফ মিনার্ভা" ছিলো তাদের প্রতীক।[৩][৪] আডাম সদস্যদের জন্য ছদ্মনামের ব্যবস্থা করেন। আডামের নিজের নাম হলো স্পার্টাকাস। তাঁর চার ছাত্র- মাসেনহাউসেনের (Massenhausen) নাম হলো আজাক্স, মের্ৎসের (Merz) নাম হলো আগাথন এবং সুটোরের (Sutor) নাম হলো ইরাসমাস রোটারোডেইমাস। কিন্তু সুটোরকে তিনি পরে বহিষ্কার করে দেন, কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয় যে সে ছিলো অলস।[৬][৭] ১৭৭৮ সালের এপ্রিল মাসে এয় সংঘের নাম পরিবর্তন করে নাম রাখা হয় "ইলুমিনাতি"।[৮] এটি একটি লাতিন শব্দ, যার অর্থ “যারা কোনো বিষয়ে বিশেষভাবে আলোকিত বা জ্ঞানার্জনের দাবি করে”। সে সময় সংঘের ১২ জন সদস্য ছিলো।[৬] কিন্তু পরবর্তীকালে এই সদস্য সংখ্যা বেড়ে ২৭ জনে দাঁড়ায়।[৬]
সাধারণত চূড়ান্ত পর্যায়ের বুদ্ধিজীবী, সচ্চরিত্র খ্রিস্টানরা এই সোসাইটির সদস্য হতেন এবং সকল প্রকার ইহুদী এবং মূর্তিপূজকদের সদস্যপদ নিষিদ্ধ ছিলো। এমনকি নারী, ধর্মগুরু এবং অন্যান্য গুপ্ত সংগঠনের সদস্যরাও নিষিদ্ধ ছিলো। স্বাগত জানানো হত ধনী, শিক্ষানবিশ আর ১৮-৩০ বছরের তরুণদের।[৯][১০]
ধীরে ধীরে ইউরোপ জুড়ে ইলুমিনাতির শাখা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কিন্তু পরবর্তীকালে ইলুমিনাতির অভ্যন্তরে ধর্মবিদ্বেষের সূচনা হয়। ১৭৮২ সালের দিকে ইলুমিনাতিতে তিনটি শ্রেণির সূচনা করা হয়। প্রথম শ্রেণিতে সেসকল সদস্যদের রাখা হলো যারা নতুন নতুন এই সংগঠনে যোগ দিয়েছিলো। দ্বিতীয় শ্রেণিতে তাঁদের থেকে একটু উচ্চ পর্যায়ের যারা রয়েছে তাঁদের রাখা হলো। তৃতীয় শ্রেণীতে যারা গোপনীয় জ্ঞানের অধিকারী সেই সকল সদস্যদের রাখা হলো।
১৭৮৪ সালের শেষে মোট সদস্য ৬৫০ জন হয়ে যায়। যদিও আডাম দাবি করেন যে সংখ্যাটি আড়াই হাজার। কারণ আডাম চেয়েছিলেন ইলুমিনাতি গুপ্ত সংগঠনের কথা খুবই গোপন রাখতে যেন রসিক্রুসিয়ানরা তা না জানে। রসিক্রুসিয়ান হলো আরেক গুপ্ত সংগঠন এবং ইলুমিনাতির সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ ইলুমিনাতি বিশ্বাস করতো ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে, আর রসিক্রুসিয়ানদের বিশ্বাস জাদুবিদ্যায় বিশ্বাস করতো। কিন্তু তারপরেও রসিক্রুসিয়ানরা জেনে গেলো। ফলে ইউরোপে রটে গেলো যে, ইলুমিনাতি একটি নাস্তিক এবং ধর্ম ও প্রচলিত সমাজব্যবস্থা-বিদ্বেষী সংগঠন।
১৭৮২ সালের দিকে ইলুমিনাতি-তে তিনটি শ্রেণীর সূচনা করা হয়।
১৭৯৭ এবং ১৭৯৮ সালের মধ্যে, অগাস্টিন ব্যারুয়েলের Memoirs Illustrating the History of Jacobinism এবং জন রবিসন নামে Proofs of a Conspiracy এক বই লিখেন যেখানে দাবি করা হয় ইলুমিনাতি এখনও জোরসে বেঁচে আছে, বহাল তবিয়তে। অসম্ভব জনপ্রিয় হয় সে বই গুলো। দুটো বই প্রচুর বিক্রি হয়। বইতে বলা হয় অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগের সেই ফ্রেঞ্চ বিপ্লবের পেছনের কলকাঠি নাকি আসলে ইলুমিনাতিই নেড়েছে। [১৩] এ বই দুটো সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে রেভারেন্ড মোর্স ও অন্যান্যরা প্রচার করলেন ইলুমিনাতির বিরুদ্ধে।[১৪]
ইলুমিনাতি ব্যাভারিয়াতে না টিকলেও, ব্যারুয়েল এবং রবিসনের বইতে দাবি করা হয় ইলুমিনাতি এখনও বহাল তবিয়তে আছে।[১]
ষড়যন্ত্রতাত্ত্বিক এবং লেখক মার্ক ডাইস যুক্তি দিয়েছেন যে ইলুমিনাতি আজ পর্যন্ত টিকে আছে।[১৫]
প্রচুর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব মতে, ইলুমিনাতিই মূলত এ বিশ্বের সকল ভূরাজনৈতিক কার্যক্রম "পরোক্ষভাবে" নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। উদাহরণস্বরূপ-ফরাসি বিপ্লবের সূচনা ইলুমিনাতির হাতে। নেপোলিয়নের ওয়াটারলু যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণ করে ইলুমিনাতি। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট কেনেডির গুপ্তহত্যা আসলে ইলুমিনাতিই করিয়েছে, কারণ তিনি বাধা দিচ্ছিলেন তাদের কাজে। শয়তানের উপাসনার মাধ্যমে স্বার্থ হাসিল করে ইলুমিনাতি। হলিউডের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ইলুমিনাতির দখলে। এর মাধ্যমে ইলুমিনাতি আপনার অবচেতন মনে তাদের বিশ্বাসগুলো ঢুকিয়ে দিচ্ছে।[১৬][১৭] ইহুদি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব মতে, ইলুমিনাতির এক চোখা প্রতীক প্রমাণ করে যে, ইলুমিনাতি হলো সেই সংগঠন যারা একচোখা দাজ্জাল (কিংবা বাইবেল মতে ৬৬৬ বা এন্টিক্রাইস্ট) এর আগমনের পথ সুগম করছে। তবে ইলুমিনাতি যে আসলেই শয়তানের পূজা করে বা এখন রয়েছে এর পোক্ত কোন প্রমান আজও পাওয়া যায়নি।
ইলুমিনাতির সঠিক উদ্ভব কারণ এখনও বিশ্লেষকদের কাছে পরিষ্কার নয়। তথাকথিত নতুন পৃথিবী গড়া তাঁদের মূল লক্ষ্য হলেও আপাতদৃষ্টিতে তাঁরা ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছান্ন সমাজের বিরুদ্ধে গুপ্তভাবে সোচ্চার। বিশেষভাবে ধারণা করা হয় মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার ধর্মীয় নৈতিক স্খলনগুলো এদের দ্বারাই প্রকাশ্যে আসে। ধারণা করা হয়, এই ঘটনাগুলির সূত্রপাত থেকে ঘটনাপ্রবাহে জনসম্মুখে আসা- সকল ক্ষেত্রেই অদৃশ্যভাবে ভূমিকা পালন করে। কিছু বিশেষজ্ঞ এরকম সংগঠনকে এবং এদের কার্যক্রমকে কাল্পনিক মনে করেন।
নতুন করে বর্তমান সময়ে এটি আবার আলোচিত হতে শুরু করেছে ড্যান ব্রাউন এর "অ্যাঞ্জেলস অ্যান্ড ডিমনস" উপন্যাসের মাধ্যমে। মানুষ মনে করে থাকে ইলুমিনাতি সদস্যরা পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করে। তবে তাঁর কোনো বাস্তব প্রমাণ নেই।[১৮]
সাম্প্রতিক এবং বর্তমান সময়ের বেশ কিছু ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন দাবি করে যে তারা আসল ব্যাভারিয়ান ইলুমিনাতি থেকে এসেছে এবং প্রকাশ্যে "ইলুমিনাতি" নামটি ব্যবহার করছে। এই গোষ্ঠীগুলির মধ্যে কিছু তাদের নিজস্ব সংস্থার নামে "দ্য ইলুমিনাটি অর্ডার" নামের একটি ভিন্নতা ব্যবহার করে।[১৯] এবং অন্যরা, যেমন অর্ডো টেম্পলি ওরিয়েন্টিস তাদের সংস্থার শ্রেণিবিন্যাসের মধ্যে একটি গ্রেড হিসাবে "ইলুমিনাতি" রয়েছে। যাইহোক, ঐতিহাসিক আদেশের সাথে বর্তমান সময়ের এই গোষ্ঠীগুলির কোন প্রকৃত সংযোগ রয়েছে এমন কোন প্রমাণ নেই। তারা উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ক্ষমতা বা প্রভাব সংগ্রহ করেনি এবং বেশিরভাগই গোপন থাকার চেষ্টা করার পরিবর্তে সদস্যপদ আকর্ষণ করার উপায় হিসাবে বাভারিয়ান ইলুমিনাতির সাথে অপ্রমাণিত সংযোগগুলি প্রচার করে। [১৮]
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়; RLF3.3
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়; আলাদা বিষয়বস্তুর সঙ্গে "McKeown" নামটি একাধিক বার সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে