ইসকান্দার মুদা (১৫৮৩?[১] – ২৭ ডিসেম্বর ১৬৩৬[২]) ছিলেন আচেহ সালতানাতের দ্বাদশ সুলতান। তার শাসনামলে আচেহর সীমানা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছায়। এছাড়াও এই রাজ্য পশ্চিম ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জ ও মালাক্কা প্রণালী অঞ্চলে সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী হয়। "ইসকান্দার মুদা" নামের আক্ষরিক অর্থ "তরুণ আলেক্সান্ডার"। তার বিজয় অভিযানকে কখনো কখনো আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের সাথে তুলনা করা হত।[২] বিজয় অভিযান ছাড়াও তার শাসনামলে আচেহ ইসলামি জ্ঞান ও বাণিজ্যের আন্তর্জাতিক কেন্দ্র হয়ে উঠে।
ইসকান্দার মুদা ১৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।[৩] তার বাবা মনসুর শাহ ছিলেন সুলতান আলাউদ্দিন আল-কাহারের নাতি। তার মা পুতেরি রাজা ইন্দেরাবাংসা ছিলেন সুলতান আলাউদ্দিন রিয়ায়াত শাহ সাইয়িদ আল-মুকাম্মালের কন্যা। পিতামাতার দিক থেকে একারণে তিনি আচেহর দুইজন সুলতানের বংশধর ছিলেন। হিকায়াত আচেহ এ তার বাল্যকাল ও যৌবনের বিবরণ বিস্তারিত রয়েছে। এতে তার ব্যক্তিগত গুণাবলির উল্লেখ রয়েছে। তিনি বেশ কিছু নাম ও উপাধিতে পরিচিত ছিলেন বিশেষত পেরকাসা আলম নামে। এই নাম তিনি তার ক্ষমতারোহণের পরও ব্যবহার করতেন। ইসকান্দার মুদা নামটি তার মৃত্যু পরবর্তী সময় আরোপিত হয় বলে কদাচিৎ ধারণা করা হলেও তথ্যটি সঠিক নয়, কারণ তার মুদ্রায় এই নাম অঙ্কিত রয়েছে।[৪] ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তার চাচা সুলতান তৃতীয় আলি রিয়ায়াত শাহর কাছে পরাজিত হয় পিদি পালিয়ে যান। সেখানে তার আরেক চাচা হুসাইন শাসক ছিলেন। তারা দুজনে মিলে সুলতান আলির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেন। পেরকাসা আলম পিদির সৈন্যদলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত তারা লড়তে অস্বীকার করে এবং সুলতান তাকে কারাবন্দী করেন। তবে ১৬০৬ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজরা আচেহ আক্রমণ করলে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে লড়াই করে তিনি কৃতিত্ব লাভ করেন। আক্রমণকারীদের তাড়িয়ে দেয়া হয়। ফলে পেরকাসা আলম দরবারে সম্মানজনক স্থান লাভ করেন। ১৬০৭ খ্রিষ্টাব্দের ৪ এপ্রিল সুলতান আলি হঠাত মৃত্যুবরণ করলে পেরকাসা আলম ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি তার আরেক চাচা হুসাইনকে বন্দী করেন। পরে তাকে হত্যা করা হয়।[৫]
সামরিক শক্তি ইসকান্দার মুদার সাফল্যে ভূমিকা রেখেছে। তার নৌবাহিনীর যুদ্ধ্বজাহাজগুলোর প্রত্যেকটিতে ৬০০-৮০০ লোক ছিল। এছাড়াও সেনাবাহিনীতে ছিল পারস্যের ঘোড়া সংবলিত ঘোড়সওয়ার দল, একটি যুদ্ধ হাতির দল, সৈনিক হিসেবে যোগ দেয়া পদাতিক বাহিনী[৬] এবং সুমাত্রা ও ইউরোপীয় উৎসের ২০০০ এর বেশি কামান ও বন্দুক।[৭] ক্ষমতালাভের পর তিনি উত্তর সুমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করেন। ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দেলি সালতানাত জয় করেন। পরের বছর ১৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আরু ও জহর সালতানাত জয় করেন। জহর বিজয়ের পর এর সুলতান তৃতীয় আলাউদ্দিন রিয়ায়াত শাহ ও রাজপরিবারের অন্যান্য সদস্যদের আচেহ নিয়ে আসা হয়। তাদের সাথে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকদের একটি দলও আচেহ আসে। তবে সে বছরের পরের দিকে জহর থেকে আচেহ সেনাদল বিতাড়িত হয়। এরপর ইসকান্দার মুদা এই অঞ্চলের উপর স্থায়ী নিয়ন্ত্রণ লাভে সমর্থ হননি। আচেহর বিপক্ষে জহর এরপর পাহাং, পালেমবাং, জামবি, ইন্দ্রগিরি, কাম্পার ও সিয়াকের মিত্রতা করে। [৬]
ইসকান্দার মুদার অভিযান চালু থাকে। তিনি ১৬১৪ খ্রিষ্টাব্দে বিনতানে পর্তুগিজ নৌবহরকে পরাজিত করেন। ১৬১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পাহাং জয় করেন এবং এর সুলতান আহমেদ শাহকে আচেহ নিয়ে আসা হয়। এর মাধ্যমে তিনি মালয় উপদ্বীপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।[৬] ১৬১৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কেদাহ জয় করেন। এসময় রাজধানী ধ্বংস করা হয় এবং বেঁচে থাকা অধিবাসীদের আচেহ নিয়ে আসা হয়।[৮] ১৬২০ খ্রিষ্টাব্দে পেরাকে একই ধরনের ঘটনা ঘটে। এতে প্রায় ৫,০০০ অধিবাসীকে বন্দী করে আচেহ নিয়ে আসা হয়।[৭] ১৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আবার জহর আক্রমণ করেন এবং ১৬২৪/৫ খ্রিষ্টাব্দে নিয়াস দখল করেন। এসময় আচেহর কারণে মালাক্কার পর্তুগিজ অঞ্চল হুমকির মুখে পড়ে। ১৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে মালাক্কা আক্রমণের জন্য তিনি কয়েকশ্ত জাহাজ পাঠান। তবে এই অভিযান ব্যর্থ হয়। পর্তুগিজ সূত্রগুলো অনুযায়ী ১৯,০০০ লোকসহ তার সব জাহাজ ডুবে যায়। এই ব্যর্থতার পর তিনি আর মাত্র দুইটি সমুদ্র অভিযান প্রেরণ করেছিলেন। ১৬০০/১ ও ১৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রেরিত এই অভিযানগুলো পাহাঙের বিদ্রোহ দমনের জন্য পাঠানো হয়েছিল। তার সালতানাত উত্তর সুমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। তবে প্রণালী বা গোল মরিচ উতপাদনকারী লামপাঙে তিনি আধিপত্য বিস্তার করতে পারেননি। এই অঞ্চল বানতিন সালতানাতের নিয়ন্ত্রণে ছিল।[৯]
মসলা বাণিজ্য ছিল সালতানাতের অর্থনৈতিক ভিত্তি। বিশেষত গোলমরিচের বাণিজ্য বেশি হত। আচেহ, জহর, পর্তুগিজ মালাক্কা ও গোলমরিচ উৎপাদনকারী অন্যান্য বন্দরগুলোর মধ্যে সংঘাতের কারণে সামরিক সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়।[১০] লবঙ্গ, জায়ফল, সুপারি বাদামও রপ্তানি পণ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আফ্রিকার কাছে পর্তুগিজদের নিয়ন্ত্রিত বাণিজ্যপথের বদলে উসমানীয়দের কাছে রপ্তানি করতে উসমানীয়রা উৎসাহ প্রদান করেছিল যার ফলে সালতানাতের সম্পদ বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও ইসকান্দার মুদার বিভিন্ন অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত যেমন সুদের নিম্ন হার ও ব্যাপকভাবে ছোট স্বর্ণমুদ্রা ব্যবহারের কারণে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হয়।[১১] তবে সামরিক ও বাণিজ্যিক প্রয়োজনে অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে সমস্যার সৃষ্টি হত। অন্যান্য সালতানাতগুলোও একইরকম সমস্যার সম্মুখীন হয়। এ সমস্যা নিরসনে যুদ্ধবন্দীদের দাস হিসেবে কৃষি উৎপাদনের কাজ লাগানো হয়।[১২]
আচেহর অভিজাত ব্যক্তিবর্গকে নিজের নিয়ন্ত্রণের আনতে পারার কারণে ইসকান্দার মুদার সাফল্যের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। এই অভিজাতরা ওরাং কারা নামে পরিচিত ছিলেন। বাণিজ্যের উপর তার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তিনি তাদেরকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসেন।[১২] তাদেরকে দরবারে হাজির হতে বাধ্য করা হয়। সামরিক প্রয়োজনে কোনো অবকাঠামো নির্মাণের অণুমতি তাদের ছিল না।[১৩] তিনি যুদ্ধ নেতা নামক নতুন অভিজাত শ্রেণী তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তাদেরকে বিভিন্ন জেলার জায়গীর করা হয়। তার শাসনামলের পর অভিজাতরা প্রায়শই নিজ স্বায়ত্তশাসন টিকিয়ে রাখার জন্য দুর্বল সুলতানদের সমর্থন করতেন।[১২] এছাড়াও তিনি আচেহর রাজপুত্রদের বদলে রাজকীয় কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেন যাতে তারা বার্ষিক ভিত্তিতে তার কাছে রিপোর্ট করে। প্রাসাদের জন্য উচ্চশ্রেণীর রক্ষীদল গঠন করা হয়। এতে ৩,০০০ নারী সদস্য ছিল। ইসলামি আইনের ভিত্তিতে তিনি আইন ব্যবস্থার সংস্কার করেন। এর আওতায় আদালতগুলোর মধ্যে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়।[১৩] তার প্রশাসন ও আইন ব্যবস্থা অন্যান্য ইন্দোনেশীয় ইসলামি রাজ্যগুলোর জন্য মডেল হয়ে উঠে।[১০]
সমৃদ্ধি থাকলেও তার শাসনামলে সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে। বিদ্রোহী প্রজাদের নানাভাবে দমন করা হয়। তিনি তার ধনী প্রজাদেরও মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন এবং তাদের সম্পদ জব্দ করা হয়। ১৬২০ এর দশকে এক ফরাসি পর্যটক লিখেছেন যে ছোট ছোট ঘটনার জন্য প্রতিদিন রাজার আদেশে মানুষের নাক, চোখ, হাত, পা ইত্যাদি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা হত।[১৩] তিনি তার পুত্র মেরাহ পাপুককে হত্যা করেন এবং তার জামাতা ও পাহাঙের ধৃত সুলতানের পুত্র ইসকান্দার থানিকে তার উত্তরসুরি ঘোষণা করেছিলেন।[১২]
ইসকান্দার মুদার শাসনামলে ইসলামি পন্ডিতগণ আচেহকে ইসলামি পান্ডিত্যের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলেন। ইসকান্দার মুদা সুফি হামজা ও শামসউদ্দিনের ঐতিহ্য উৎসাহিত করেন। তারা দুজনেই আচেহ দরবারের সদস্য ছিলেন। তাদের রচনাবলী ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য ভাষাগুলোতেও অনূদিত হয়েছিল। সমগ্র উপদ্বীপে তাদের উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল। পরবর্তীতে ইসকান্দার থানির সময় আচেহর দরবারে আগত নুরউদ্দিন আর-রানিরি তাদের চিন্তাধারাকে খারিজ করেছিলেন এবং তাদের গ্রন্থ পুড়িয়ে ফেলা হয়।[১৪]
হিকায়াত আচেহ ("আচেহর গল্প") নামক বিবরণী ইসকান্দার মুদার সময় লিখিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।[১৫] তবে কারো কারো মতে এটী আরো পড়ে লেখা হয়।[২] এতে সালতানাতের ইতিহাস ও ইসকান্দার মুদার যৌবনকালের প্রশংসা করা হয়েছে।[১৬] মুঘল সম্রাট আকবরের উপর রচিত ফারসি গ্রন্থ আকবরনামা দ্বারা এই গ্রন্থ প্রভাবিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।[১৫] এতে ইসকান্দার মুদাকে আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের বংশধর বলে বর্ণনা করা হয়েছে। যেহেতু আলেক্সান্ডারকে মালাক্কা, জহর, পেরাক ও পাহাঙের পূর্বপুরুষ বলে দাবি করা হত তাই এই বক্তব্যের মাধ্যমে আচেহকেও মালয়ভুক্ত হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।[১৭]
আচেহর জনগণের কাছে ইসকান্দার মুদা একজব বীর হিসেবে গণ্য হন। তাকে আচেহর মহত্বের একজন প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।[১৮] মৃত্যুর পর তাকে পু তেওহ মেওরেওহুম ("আমাদের ভালবাসাসিক্ত মৃত অধিপতি")[২] বা মারহুম মাহকুতা আলম উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
বান্দা আচেহর নিকটে তার নামে বেশ কয়েকটি দালান ও অবকাঠামো রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সুলতান ইসকান্দারমুদা বিমানবন্দর ও সুলতান ইসকান্দার মুদা বিমান ঘাটি। আচেহ প্রদেশ তদারককারী সামরিক কমান্ডের নাম কোদাম ইসকান্দার মুদা।
পূর্বসূরী তৃতীয় আলি রিয়ায়াত শাহ |
আচেহর সুলতান ১৬০৭-১৬৩৬ |
উত্তরসূরী ইসকান্দার থানি |