ইসলামি সন্ত্রাসবাদ হল এক ধরনের ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ যা ধর্মের নামে বিভিন্ন উদ্দেশ্য অর্জন করতে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দ্বারা চর্চা করা হয়।[১] এরা গণহত্যা, আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ, সাধারণ মানুষকে হত্যা[১] প্রভৃতি হিংস্র কাজকর্মের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড করে থাকে।
ইসলামি সন্ত্রাসবাদীরা সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড যা ন্যায়সঙ্গত করার উদ্দেশ্যে ইসলাম ধর্মের নাম ব্যবহার করে থাকে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠী তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ইসলাম রক্ষা কিংবা ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠার নাম করে নিরীহ মানুষ হত্যা, আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ কিংবা ধ্বংসাত্মক যে সকল কর্মকাণ্ড করে থাকে তাকে সার্বিক ভাবে ইসলামি সন্ত্রাসবাদ বলা হয়। সাম্প্রতিক কালে ইরাকি আধিপত্যবাদি ইসলামি ষ্টেট তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে খিলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয় এবং ইসলামে নিষিদ্ধ হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড যেমন বিনাবিচারে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ হত্যা, শিরশ্ছেদ ও আগুনে পুড়িয়ে প্রতিপক্ষ ও বেসামরিক ব্যক্তিদের হত্যা ,প্রাচীন পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংস করার মাধ্যমে ইসলামি স্টেট ইসলাম বিরোধী বা ইসলামের শত্রু সংগঠন হিসাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে বিবেচিত হয়েছে।[২]
সাম্প্রতিক কালে ইসলামি সন্ত্রাসের প্রভাব সারা বিশ্বে প্রসারিত হয়েছে। আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ছাড়াও ইউরোপ, রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর প্রভাব দেখা গেছে, এবং এই সমস্ত আক্রমণের শিকার হয়েছে মুসলিম ও অ-মুসলিম উভয়েই।[৩] সর্বাধিক আক্রান্ত মুসলিম-অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে এই সন্ত্রাসবাদীরা সশস্ত্র স্বাধীন প্রতিবাদী সংগঠন,[৩] রাষ্ট্রীয় প্রতিরোধ ও রাজনৈতিকভাবে উদারপন্থী মুসলিম প্রতিবাদের মুখোমুখি হয়েছে।[৪]
আক্ষরিকভাবে ইসলামি সন্ত্রাসবাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে সংশয়ের অবকাশ না থাকলেও কেউ কেউ এই শব্দবন্ধের যথেচ্ছ প্রয়োগের সমালোচনা করেছেন। বিভিন্ন পাশ্চাত্য রাজনৈতিক বক্তৃতায় এর যথোচিত বিবেচনারহিত ব্যবহারকে "অ-সৃষ্টিশীল", "অসুবিধাজনক", "তীব্র রাজনৈতিকীকরণ সঞ্জাত ও যুক্তিগতভাবে তর্কযোগ্য" এবং "সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিপন্থী" হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।[৪] আবার, এই শেষোক্ত মতবাদটিকেও অনেকে পলায়নপর মানসিকতার চিহ্ন হিসেবে সমালোচনা করেছেন।[৫]
২০১৫ সালের গ্লোবাল টেরোরিজম ইনডেক্স রিপোর্ট ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর হামলার পর থেকে জঙ্গিবাদের কারণে মৃত্যুর সংখ্যার বৃদ্ধি এই ছকটিতে তুলে ধরেছে:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে, মুসলিম অভিবাসীরা প্রচুর সংখ্যায় পশ্চিমা দেশগুলিতে অভিপ্রায়ণ করেছে কারণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে অধিকতর ভাল অবস্থায় থাকা মুসলিম রাষ্ট্রগুলো তাদেরকে গ্রহণ করে না। ৫৭টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের মধ্যে মাত্র দুটো রাষ্ট্র (তুরস্ক ও মালয়েশিয়া) অভিবাসীদের জন্য জন্মস্থান, ধর্মীয় বিশ্বাস, বৈবাহিক অবস্থা বা জাতিসত্তা নির্বিশেষে স্বীকৃত নাগরিকে পরিণত হওয়ার জন্য একটি আনুষ্ঠানিক উপায় প্রস্তাব করে। এমনকি তেল সমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশগুলিও অভিবাসীদের নাগরিকত্ব প্রদান করে না, তা সেই অভিবাসীরা সেইসব দেশে যতদিন ধরেই বসবাস করুক। বিষয়গুলি আরো কঠিন হয়ে ওঠে কেননা, উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোতে কঠোর আইন রয়েছে যা স্পষ্টভাবে বলে যে একজন অভিবাসী বা প্রবাসী ব্যক্তি সেই রাষ্ট্রের নাগরিক হতে পারে যদি তার পিতা সেই রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে থাকে, অথবা কিছু ক্ষেত্রে যদি কোন অভিবাসী নারী সেই রাষ্ট্রের কোন পুরুষ, অর্থাৎ আরব পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এই আইনগুলি নাগরিকত্ব অর্জনের জন্য বহিরাগতদের (মুসলিম ও অমুসলিম উভয়) প্রায় অসম্ভব করে তোলে।[৬][৭]
২০১৪ সালে, অস্বীকৃত ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্টের নেতা স্বঘোষিত খলিফা আবু বকর আল-বাগদাদি অন্যান্য আরব রাজ্যে বসবাসকারী কিছু মুসলমানদের মধ্যে এই অসন্তোষের সদ্ব্যবহার করেছিলেন এবং মুসলমানদের নতুন ইসলামি রাষ্ট্রে অভিবাসনের আহ্বান জানিয়েছিলেন।[৮] আইএসআইএল ("ইসলামিক স্টেট" নামেও পরিচিত) তাদের রাষ্ট্রে আগমনের পরপরই সমস্ত মুসলিম অভিবাসীদেরকে "নাগরিকত্বের" প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এমনকি তারা নবীন অভিবাসীদের কাছে "খিলাফত পাসপোর্ট" পর্যন্ত প্রদান করেছিল।[৯]
মুসলিম বিশ্ব অনেক শতাব্দী ধরে আর্থিকভাবে নিশ্চলতার কারণে দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে আছে।[১০][১১] ২০১১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছিলেন যে, অশোধিত তেল ব্যতীত ৪০০ মিলিয়ন জনসংখ্যার সমগ্র বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের রপ্তানি মোটামুটিভাবে সুইজারল্যান্ডের সমান।[১২] এটিও অনুমান করা হয়েছে যে, মাত্র পাঁচ মিলিয়ন জনসংখ্যার ইউরোপীয় দেশ ফিনল্যান্ডের রপ্তানি সমগ্র ৩৭০ মিলিয়ন জনসংখ্যার সমগ্র আরব বিশ্বের তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যতীত অন্যান্য রপ্তানির তুলনায় বেশি।[১৩] ঐতিহাসিক ডেভিড ফ্রমকিন তার "এ পিস টু এন্ড অল পিস" গ্রন্থে লেখেন, মুসলিম বিশ্বের এই আর্থিক নিশ্চলতা ১৯২৪ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের সাথে শুরু হয়, সেসময় বাণিজ্যিক জাল বিপর্যস্ত হয় এবং সমাজগুলো নতুন নতুন জাতিরাষ্ট্রের সৃষ্টির সাথে বিদীর্ণ হয়ে যায়। যদিও অটোমান সাম্রাজ্যকে ইউরোপের রুগ্ন ব্যক্তি হিসাবে উল্লেখ করা হতো, তবুও অটোমান শাসনের অধীনে মধ্য প্রাচ্যের অংশগুলোর বৈচিত্র্যময় এব সুস্থিতভাবে বর্ধিষ্ণু অর্থনীতি ছিল, যার সমৃদ্ধি বর্তমানের তুলনায় আরও বেশি ছিল।[১৪]
পশ্চিমা দেশগুলির বিরুদ্ধে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইসলামবাদ-ভিত্তিক মৌলবাদী সন্ত্রাসবাদের অনেকগুলো প্রেরণা রয়েছে এবং এটি 'পশ্চিম' এবং আরব ও মুসলিম 'বিশ্বের'[১৫] মধ্যকার একটি জটিল ও তীব্র সম্পর্কের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে সংঘটিত হয়। সামাজিক পরিচয় তত্ত্ব, সামাজিক-শ্রেণীকরণ তত্ত্ব বা সামাজিক বিভাগ তত্ত্ব এবং সাইকোডাইনামিক্স সহ পরিচয়-ভিত্তিক তাত্ত্বিক কাঠামোগুলি সন্ত্রাসবাদের কারণ ব্যাখ্যা করার জন্য ব্যবহার করা হয়।[১৬]
কারিনা কোরোস্টেলিনা সামাজিক পরিচয়কে ব্যাখ্যা করেছেন, "একটি সামাজিক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হবার অনুভূতি হিসাবে, সামাজিক বিভাগের সাথে দৃঢ় সংযোগ হিসাবে, এবং আমাদের মনের এমন গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে আমাদের সামাজিক উপলব্ধি এবং আচরণকে প্রভাবিত করে"।[১৭] ওসামা বিন লাদেনের ক্ষেত্রে এই সংজ্ঞাটি প্রয়োগ করা যেতে পারে, এই তত্ত্ব অনুসারে তার মধ্যে একজন মুসলিম হিসেবে নিজের সামাজিক পরিচয় নিয়ে একটি উচ্চমাত্রার লক্ষণীয় ধারণা ছিল, মুসলিম উম্মাহ বা "সম্প্রদায়" এর সামাজিক বিভাগের সাথে তার দৃঢ় সংযোগ ছিল, যা তার সামাজিক উপলব্ধি ও আচরণকে প্রভাবিত করে।[১৮] সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ও সৌদি আরবে সেনা মোতায়েন এবং ইজরায়েলে মার্কিন সমর্থনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে উপলব্ধ হুমকির প্রতিক্রিয়ায় বিন লাদেনের ইসলামপন্থী চিন্তাধারা ও ইসলামের ব্যাখ্যার কারণে আল-কায়দার সৃষ্টি হয়।[১৯] ইসলামি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আল-কায়েদার একটি গোষ্ঠী পরিচয় রয়েছে, যার মধ্যে "সাধারণ অভিজ্ঞতা, মনোভাব, বিশ্বাস, এবং দলের সদস্যদের সাধারণ স্বার্থ" অন্তর্ভুক্ত এবং "এই সংগঠনটিকে বর্ণনা করা হয় একে তৈরি করার জন্য একটি যৌথ উদ্দেশ্য অর্জনের মাধ্যমে" যেটা হল, "মুসলিম দেশগুলোকে বিদেশী প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করা, এবং একটি নতুন ইসলামি খিলাফত সৃষ্টি করা"।
সামাজিক শ্রেণীকরণ তত্ত্বকে সনাক্তকরণের তিনটি পর্যায়ের প্রক্রিয়া হিসাবে আলোচনা করা হয়, যেখানে "ব্যক্তিগণ নিজেদেরকে একটি সামাজিক গোষ্ঠীর সদস্য হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেন, দলের স্টিরিওটাইপ এবং নিয়মগুলি শেখেন, এবং গোষ্ঠী বিভাগগুলি একটি বিশেষ কাঠামোয় তাদেরকে সকল পরিস্থিতিকে দেখতে ও বুঝতে প্রভাবিত করে।"[১৭] এই সংজ্ঞাটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে সনাক্তকরণের তিন পর্যায়ের প্রক্রিয়ার দ্বারা প্রভাবিত সামাজিক শ্রেণীকরণ তত্ত্ব অনুসারে এখানে যুক্তরাষ্ট্র বিরোধিতার মতো[২০] এবং পাশ্চাত্য রাষ্ট্রসমূহ, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র[২১] ও ইজরায়েলের[২২] বিরুদ্ধে ইরান ও আফগানিস্তানের মতো অ-আরব রাষ্ট্রের দ্বারা হেজবোল্লাহ[২৩] ও আল-কায়দা[২৪] ইত্যাদি সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে অর্থায়ন ও আশ্রয় প্রদানের মত সংঘাতময় বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। সনাক্তকরণের এই তিন-স্তরীয় প্রক্রিয়ায়, আরব ও মুসলিম বিশ্ব(সমূহ) হচ্ছে সামাজিক গোষ্ঠী(সমূহ), যেখানে তাদের সদস্যরা সেই সব স্টেরিওটাইপ ও সামাজিক রীতি-নীতি শেখে যেগুলো তাদের মধ্যে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে তাদের সামাজিক গোষ্ঠীকে শ্রেণীকৃত বা বিভাগায়িত করে।[২৫] এই সামাজিক শ্রেণীকরণ প্রক্রিয়া আরব ও মুসলিমদের মধ্যে উচ্চ মাত্রার অন্তর্গোষ্ঠী সমর্থন এবং আনুগত্য তৈরি করে, এবং এই শ্রেণীকরণ প্রক্রিয়ার ফলে সেই বিশেষ কাঠামো তৈরি হয় যার মধ্যে থেকে আরব ও মুসলিম বিশ্বের সামাজিক গোষ্ঠীর সদস্যগণ পাশ্চাত্যের সাথে জড়িত সকল পরিস্থিতিকে দেখে থাকে ও বুঝে থাকে। বিশ্লেষণের জন্য একটি অবকাঠামো হিসেবে সামাজিক শ্রেণীকরণ তত্ত্ব গোষ্টী সনাক্তকরণ প্রক্রিয়া এবং সংঘাত পরিস্থিতির বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যকার কার্যকারণ সম্পর্কগুলোকে নির্দেশ করে।[২৬]
ইসলামের নাম ব্যবহার করে সন্ত্রাসবাদে ভূমিকা পালন করে থাকে এমন একটি মতাদর্শ হচ্ছে ওয়াহাবী আন্দোলন।[২৭][২৮][২৯][৩০][৩১] ওয়াহাবী আন্দোলন এবং সালাফিবাদ (সালাফি জিহাদবাদ) সহ তাদের মিত্র আন্দোলনগুলো তাদের মত নয় এমন সকলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সমর্থন করে। ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভ্যান্ট, আল-কায়েদা, আল-শাবাব (জঙ্গি সংগঠন), বোকো হারাম, ইন্দোনেশিয়ান মুজাহিদীন কাউন্সিল, তালিবান, সিপাহ সাহাবা, লস্কর-ই-জাংভি এবং হিজবুল মুজাহিদীন ওহাবী বা সালাফি মতাদর্শ অনুসরণ করে যা সাধারণত অন্যান্য মুসলিমরা বিরোধিতা করে।[৩১][৩২] অমুসলিম, সুফি এবং শিয়াগণ কট্টরপন্থী ওয়াহাবী, দেওবন্দী এবং জামাতীদের দ্বারা একইভাবে আক্রমণের শিকার হয়, যেভাবে সমাজতন্ত্রী ও অন্যান্য বামপন্থী সর্বহারা শ্রেণী মুসোলিনির দস্যুদের দ্বারা, ইহুদী ও অন্যান্যরা নাৎসিদের দ্বারা, এবং "বুর্জোয়া", "কুলাক" "বুদ্ধিজীবী", "ইহুদি", "মেনশেভিক" এবং" ট্রটস্কিপন্থী" বিরোধীরা স্ট্যালিনবাদীদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়েছিল।[৩৩] ভারতবর্ষে দেওবন্দী আন্দোলনের নামে ওয়াহাবি আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল।[৩৪]
আন্তর্জাতিক ইসলামবাদী মতাদর্শগুলো, বিশেষ করে জঙ্গি ইসলামপন্থীদের মতাদর্শগুলো জোর দিয়ে বলছে যে, পশ্চিমা নীতিসমূহ এবং সমাজ সক্রিয়ভাবে ইসলাম-বিরোধী। আবার কখনও বর্ণনা করা হচ্ছে যে, "ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ" ঘোষণা করা হয়েছে। ইসলামপন্থীরা এখন যা দেখছে সেগুলোকে তারা প্রায়শই ক্রুসেডস এর সময় থেকে শুরু করে ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের মধ্যকার ঐতিহাসিক সংঘাত হিসেবে দেখে। উদাহরণস্বরূপ, ওসামা বিন লাদেন প্রায়শই তার শত্রুদেরকে আক্রমণাত্মক বলে অভিহিত করেছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে তার ব্যবস্থা নেওয়াকে প্রতিরক্ষামূলক হিসাবে বর্ণনা করেছেন। প্রতিরক্ষামূলক জিহাদ আক্রমণাত্মক জিহাদ থেকে আলাদা। প্রতিরক্ষামূলক জিহাদকে "ফার্দ আল-আইন" বা সকল মুসলমানের জন্য ব্যক্তিগত বাধ্যবাধকতা হিসেবে ধরা হয়, যা "ফার্দ আল-কিফায়া" বা সাম্প্রদায়িক বাধ্যবাধকতা থেকে ভিন্ন, যা কিছু মুসলমান সম্পাদন করতে পারে কিন্তু সকলের করতে হয়না। অতএব, একটি লড়াইকে প্রতিরক্ষা হিসাবে দেখানোতে একই সাথে নিজেদেরকে আক্রমণকারীর বদলে শিকার হিসেবে দেখানোর সুবিধা এবং সকল ভাল মুসলিমদের মধ্যে এই সংঘাতকে খুব উচ্চ ধর্মীয় অগ্রাধিকার হিসেবে প্রতিপন্ন করার সুবিধা লাভ করা যায়।
বেশ কয়েকটি সহিংস সন্ত্রাসবাদী দল কিছু পশ্চিমা দেশ ও ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য জিহাদের নাম ব্যবহার করে। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে বিন লাদেনের আল-কায়েদা, যা "ইহুদী ও ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য আন্তর্জাতিক ইসলামি ফ্রন্ট" হিসাবেও পরিচিত। বেশিরভাগ জঙ্গি ইসলামপন্থী ইসরাইলের নীতির বিরোধিতা করে এবং তারা প্রায়ই দেশটির অস্তিত্বের বিরোধিতা করে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর কর্নেল ডেল সি. আইকমেয়ার অনুসারে, আলকায়দা এবং সম্পর্কিত সংগঠনগুলোর "ভরকেন্দ্র" কোন ব্যক্তি বা দল নয়, বরং তাদের "মতাদর্শ"। আর তাদের মতাদর্শ হচ্ছে "সহিংস ইসলামি চিন্তাধারার সমষ্টি যার নাম কুতুববাদ"।[৩৫] তার মতে কুতুববাদের মতবাদগুলো হচ্ছে:
ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ঐতিহাসিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাও প্রায়শই ভারতের সবচেয়ে মারাত্মক সন্ত্রাসী হামলাগুলোর কয়েকটির পিছনে প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একটি রিপোর্ট অনুসারে, ইসলামি সন্ত্রাসবাদ দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত দেশগুলির তালিকায় ভারত শীর্ষে অবস্থান করছে।
উপরন্তু, ইসলামি জঙ্গি, পণ্ডিত ও নেতারা পশ্চিমা সমাজকে অনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষতা হিসেবে দেখে ও বিরোধিতা করে। ইসলামবাদীগণ দাবি করেছে যে, এই ধরনের অবাধ বাকস্বাধীনতা পর্নোগ্রাফি, অনৈতিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমকামিতা, নারীবাদ এবং এমন অনেক ধারণা বিস্তারের দিকে পরিচালিত করেছে যা ইসলামবাদীরা প্রায়শই বিরোধিতা করে। যদিও বিন লাদেন প্রায় সবসময়ই তার বার্তাগুলোতে আমেরিকা ও ইহুদিদের দ্বারা কথিত নির্যাতনকেই জোড় দিয়েছিলেন, তিনি তার "লেটার টু আমেরিকা"-তে "আমরা তোমাদেরকে কী হতে আহ্বান করি, এবং আমরা তোমাদের থেকে কী চাই" এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছিলেন। বিন লাদেন সেখানে বলেন:
আমরা তোমাদেরকে বিনয়, নীতি, সম্মান, এবং বিশুদ্ধতা মানুষ হতে আহ্বান করি; ব্যভিচার, সমকামিতা, মাদকাসক্তি, জুয়া, এবং সুদ নিয়ে বাণিজ্যকে পরিত্যাগ করতে আহ্বান করি।(...) তোমরা ধর্মকে নিজেদের নীতিমালা থেকে পৃথক করছ, (...) তোমরা এমন জাতি, যে সুদকে অনুমোদন করে, যা সব ধর্মেই নিষিদ্ধ, (...) তোমরা এমন একটি জাতি যে মাদকদ্রব্য উৎপাদন, বাণিজ্য এবং ব্যবহারের অনুমতি দেয়,(...) তোমরা এমন একটি জাতি যা অনৈতিকতার কাজগুলোর অনুমতি দেয়, (...) তোমরা এমন একটি জাতি যা সকল রকমের জুয়া খেলার অনুমতি দেয়। (...) তোমরা যাত্রী, পরিদর্শক এবং অপরিচিতদেরকে সেবা দেয়ার জন্য নারীকে ব্যবহার অরো যাতে তোমাদের মুনাফা বৃদ্ধি পায়। এরপর তোমরা গলাবাজি করো যে তোমরা নারী স্বাধীনতার সমর্থন করো।[৩৬]
তাদের ধর্ম নিয়ে এত ভক্তির পরেও, দ্য টাইমস এর তদন্তে উঠে আসে যে, শিশু পর্নোগ্রাফি বণ্টনের করতে নেটওয়ার্কের দ্বারা পূর্বে পরিচয় লুকনোর কাজ করা হত, জিহাদিরাও একই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছে।[৩৭] আবার রয়টার্স এর প্রতিবেদনে উঠে আসে, ইউএস নেভি সিল ওসামা বিন লাদেনের এবোটাবাদ কম্পাউন্ডে রেইড করার সময় যেসব বস্তুকে জব্দ করা হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে পর্নোগ্রাফিও পাওয়া যায়।[৩৮]
২০০৬ সালে ব্রিটেনের এমআই৫ এর তদকালীন প্রধান এলিজা ম্যানিংহাম-বুলার আল-কায়েদা সম্পর্কে বলেন, "এটি একটি মতাদর্শ গড়ে তুলেছে যা দাবি করে যে ইসলাম আক্রমণের মুখে রয়েছে এবং এটি রক্ষা করা দরকার"। তিনি বলেন, "এটি একটি শক্তিশালী ন্যারেটিভ যা সমস্ত বিশ্বব্যাপী সংঘাতের জাল বুনন করে, এটি ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন ও কাশ্মিরের মত দীর্ঘ দিন চলা সমস্যাগুলো থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সমস্যা পর্যন্ত বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় ও জটিল সমস্যায় পাশ্চাত্যের প্রতিক্রিয়াকে বিশ্বজুড়ে ইসলামকে ধ্বংস করা ও অপমান করার সংকল্পের সাক্ষ্যপ্রমাণ বলে মনে করে।"[৩৯] তিনি বলেন, "ব্রিটিশ আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীদের ভিডিও উইলগুলি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, তারা মনে করত মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী এবং দীর্ঘস্থায়ী অবিচার হচ্ছে, আর এই অবিচারের দ্বারাই তারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। মুসলমানদের বিরুদ্ধে এই বিশ্বব্যাপী ও দীর্ঘস্থায়ী অবিচার হচ্ছে কিছু প্রচারক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারা প্রচারিত ইসলামের চরম ও স্বল্প সংখ্যক মানুষের দ্বারা গৃহীত ব্যাখ্যা। তাদের এই ব্যাখ্যায় যুক্তরাজ্যের বৈদেশিক নীতি, বিশেষ করে ইরাক ও আফগানিস্তানে যুক্তরাজ্যের জড়িত হওয়াটি মুসলিম-বিদ্বেষী আচরণ।"[৩৯] তিনি এই বিষয়েও সতর্ক করে দেন যে, একটি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করা কতটা কঠিন। তিনি বলেন, যদিও কোনরকম হুমকি অনুভব না করেই প্রতিদিন জঙ্গিবাদের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিপদগুলোর মুখোমুখি হচ্ছে, যেমন জলবায়ুর পরিবর্তন, সড়ক দুর্ঘটনা। আর যদিও জঙ্গিবাদের ফলে মৃত্যু খুব কম হয়, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কিছু সম্ভাব্য বড় বড় জঙ্গি হামলাকে প্রতিরোধ করেছে, এবং এই ব্যাপারে আরও সতর্কতা জরুরি।[৩৯]
কর্নেল আইকমেয়ার দেখান, "অনেক ইসলামি তাত্ত্বিক, বা "কুতুববাদীরই" ধর্মীয় যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ, যা তাদের ও তাদের বার্তাকে চ্যালেঞ্জ করার উপায় হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।" তিনি বলেন:
সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী এবং আবদুল্লাহ ইউসুফ আজ্জাম ছাড়া কুতুববাদের কোন তাত্ত্বিকই ইসলামের কোন স্বীকৃত শিক্ষাকেন্দ্রে প্রশিক্ষিত হন নি। হাসান আল-বান্না, সাইয়েদ কুতুব, মুহাম্মদ আব্দ-আল-সালাম ফারাজ, আয়মান আল-জাওয়াহিরি ও ওসামা বিন লাদেন - এরা সবাই ধর্মপ্রাণ মুসলিম হলেও, এদের প্রথমজন (হাসান আল-বান্না) ছিলেন একজন শিক্ষক ও কমিউনিটি এক্টিভিস্ট, দ্বিতীয়জন (সাইয়েদ কুতুব) ছিলেন একজন সাহিত্য সমালোচক, তৃতীয়জন (মুহাম্মদ আব্দ-আল-সালাম ফারাজ) ছিলেন একজন ইলেকট্রিশিয়ান, চতুর্থজন আইমান আল-জাওয়াহিরি) ছিলেন একজন চিকিৎসক, ও পঞ্চমজন (ওসামা বিন লাদেন) ব্যাবসায়ী হবার শিক্ষা লাভ করেছিলেন।[৩৫]
ড্যানিয়েল বেঞ্জামিন এবং স্টিভেন সাইমন তাদের লেখা গ্রন্থ দ্য এজ অফ স্যাক্রেড টেরর-এ যুক্তি দিয়েছেন যে, ইসলামি সন্ত্রাসী হামলাগুলি সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয়। তাদেরকে দেখা হয় একটি "ধর্মসংস্কারক হিসেবে ... তারা জগতের নৈতিক শৃঙ্খলাকে ফিরিয়ে আনতে চান যা ইসলামের শত্রুদের দ্বারা দূষিত হয়েছে।" এটি কোনও রাজনৈতিক বা কৌশলগত নয় বরং "মুক্তির কাজ" যেখানে "যারা ঈশ্বরের আধিপত্যকে তুচ্ছজ্ঞান করেছে তাদেরকে অপমান ও হত্যা করতে হবে"।[৪০]
শার্লি এবদো শুটিংয়ের জন্য দায়ী কোয়াচি ভাইদের মধ্যে একজন ফরাসি সাংবাদিককে বলেছিলেন, "আমরা নবী মুহাম্মদের রক্ষাকর্তা।"[৪১]
ইউরোপের মুসলিম সন্ত্রাসীদের নিয়ে দুটি গবেষণায় (যুক্তরাজ্যের একটি এবং ফ্রান্সের একটি) ধর্মে ভক্তি ও সন্ত্রাসবাদের মধ্যে সামান্য সংযোগ পাওয়া যায়। যুক্তরাজ্যের কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স সংস্থা এমআই৫ এর শত শত কেস স্টাডির একটি "সীমাবদ্ধ" প্রতিবেদন অনুসারে,
জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত বিশাল সংখ্যক মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা ধর্মান্ধ তো নয়ই, বরং নিজেদের ধর্মকে নিয়মিত পালনও করেনা। এদের অনেকেরই অক্ষরজ্ঞানের অভাব আছে, এবং এদেরকে ধর্মজ্ঞানহীন হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এদের খুব কম সংখ্যক মানুষই শক্তিশালী ধার্মিক পরিবারে বড় হয়েছে, আর এদের মধ্যে গড় অনুপাতের চাইতেও বেশি সংখ্যায় ধর্মান্তরিত মুসলিম রয়েছে। এদের কেউ কেউ পূর্বে মাদক গ্রহণের সাথে জড়িত ছিল, মদ্যপান করত, এবং বেশ্যালয়ে গমন করত। এমআই৫ বলে, এরও প্রমাণ আছে যে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় পরিচয় আসলে সহিংস মৌলবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।[৪২]
ফরাসী রাজনৈতিক বিজ্ঞানী অলিভিয়ের রয় ২০১৫ সালে ফ্রান্সে বসবাসরত মানুষের ইসলামি মৌলবাদীতে (জঙ্গি বা ভাবি-জঙ্গি) পরিণতও হওয়ার শর্ত ও পরিস্থিতির সাধারণ চিত্র নিয়ে আলোচনা করেন। সেখানে তিনি বলেন, এই মৌলবাদিকরণ "মুসলিম সম্প্রদায়ের বৃদ্ধির কারণে হয় নি, যারা দারিদ্র্য ও বর্ণবাদের শিকার, কেবল তরুণরাই জঙ্গিবাদে জড়িত হয়, যাদের মধ্যে ধর্মান্তরিতরাও রয়েছে।"[৪৩]