ইসলাম |
---|
বিষয়ক ধারাবাহিক নিবন্ধের অংশ |
ইসলামি সংস্কৃতিতে পুরুষদের মধ্যে খৎনা বা ত্বকচ্ছেদ প্রথা প্রচলিত,[১] যা আরবি ভাষায় খিত্না (ختنة) বা খিতান্ (ختان) নামে প্রচলিত।[২][৩] পুরুষ খৎনা মুসলিম সমাজে ব্যপক প্রচলিত এবং আইনত ইসলামের সকল মাযহাব কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত অনুশাসন হিসাবে গৃহীত হয়েছে।[৪][৫] এটি বৃহত্তর ইসলামি সম্প্রদায়ের (উম্মাহ) অন্তর্ভুক্ত হওয়ার চিহ্ন হিসাবে বিবেচিত হয়।[৬]
ইসলামে পুরুষদের সুন্নত সমাসীন, তবে ইহুদিদের খৎনার মতো নয়। ইসলাম বর্তমানে বৃহত্তম একক ধর্মীয় গোষ্ঠী যেখানে এটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে,[৬] যদিও খৎনার কথা কুরআনে বর্ণিত হয়নি তবে এটি হাদিসে উল্লেখ আছে এবং এটি সুন্নাহ।[২][৩][৪][৭] ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার পরে এটি করা উচিত কিনা তা নিয়ে ওলামাদের মধ্যে মতভেদ আছে।[৮][৯][১০][১১]
কুরআনে কোনো আয়াতে সুন্নতে খাতনার কথা উল্লেখ নেই।[২][৩][৪][৭] ইসলামের নবি মুহাম্মদ (সা.) এর সময়ে পৌত্তলিক আরব গোত্রের বেশিরভাগ পুরুষদের এবং কিছু মহিলাদের খৎনা করা হতো এবং ধর্মীয় কারণে ইহুদী পুরুষরা খৎনা করত।[১২] এটি আল-জাহিজ,[১৩] পাশাপাশি জোসেফাস[১৪] দ্বারাও প্রমাণিত হয়েছে।
কিছু ঐতিহ্য অনুসারে, মুহাম্মাদ লিঙ্গত্বক ছাড়া (খৎনা করা) জন্মগ্রহণ করেন, আবার কেউ কেউ বলেন যে তাঁর দাদা আবদুল মুত্তালিব সাত দিন বয়সে তাঁর খৎনা করেছিলেন।[১৫][১৬] প্রাথমিক ইসলামি সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁদের অন্তর্ভুক্তির প্রতীক হিসাবে তাঁর প্রথম দিকের অনেক শিষ্যকে খৎনা করানো হয়েছিল।[১৭] কিছু বিবরণে জানা যায় যে বাইজানটিয়ামের সম্রাট হেরাক্লিয়াস মুহাম্মদকে "খৎনা করা লোকদের নেতা" হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন।[১৮]
কিছু হাদিস ফিতরা[২] নামে পরিচিত অনুশীলনের একটি তালিকায় খৎনার উল্লেখ করেছে। মুহাম্মদের একজন সাহাবি আবু হুরায়রা হতে বর্ণিত, মুহাম্মাদ বলেছেন: "পাঁচটি জিনিস হলো ফিতরা: খৎনা, ক্ষুর দিয়ে গর্ভের চুল কামানো, গোঁফ ছেঁটে ফেলা, নখ কেটে ফেলা এবং বগলের চুল উপড়ে ফেলা" (হাদিসে বর্ণিত হয়েছে: সহিহ আল-বুখারি ও সহিহ মুসলিম)।[২] যাইহোক, অন্যান্য আরও হাদিস আছে যেখানে ফিতরার বৈশিষ্ট্যের অংশ হিসেবে খৎনার নাম নেই,[৩][১৯] এবং আরেকটি হাদিস যেখানে ফিতরার দশটি বৈশিষ্ট্যের নাম উল্লেখ আছে সেখানে আবার ফিতরার নাম নেই;[৩] সহিহ মুসলিমে মুহাম্মাদের স্ত্রী আয়িশা কর্তৃক বর্ণিত, "রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: ফিতরা অনুযায়ী দশটি কাজ: গোঁফ কাটা, দাড়ি বড় করা, টুথপিক ব্যবহার করা, নাকে পানি দেওয়া, কাটা নখ ধৌত করা, আঙ্গুলের সন্ধি ধৌত করা, বগলের নিচের চুল উপড়ে ফেলা, গর্ভের লোম মুণ্ডন করা এবং পানি দিয়ে গোপনাঙ্গ পরিষ্কার করা। বর্ণনাকারী বললেন: আমি দশমটি করতে ভুলে গেছি, তবে এর মুখ কেটে ফেলতে পারি (খৎনা করা অর্থে)।"[২০] খৎনা ফিতরার অংশ কি-না সে বিষয়ে বিভিন্ন হাদিস একমত নয়।[৩]
মুহাম্মদের স্ত্রী আয়িশা কর্তৃক বর্ণিত, মুহাম্মদ বলেছেন যে, "দুটি খৎনাকৃত অংশ যদি একে অপরের সংস্পর্শে থাকে তবে গোসল আবশ্যক"।[২][৭][২১][২২] অন্য কিছু হাদিস অনুসারে, মুহাম্মদ অনুমিতভাবে তাঁর নাতি হাসান ইবনে আলী এবং হোসাইন ইবনে আলীকে তাদের জন্মের সপ্তম দিনে খৎনা করেছিলেন।[২৩] সহিহ আল-বুখারি ও সহিহ মুসলিমে উদ্ধৃত হয়েছে যে নবি ইব্রাহিম আশি বছর বয়সে তাঁর নিজের হাতেই নিজের খৎনা করেন।[৩][২৪] এটি আবু দাউদ এবং আহমদ বিন হাম্বল দ্বারাও বর্ণিত হয়েছে যে মুহাম্মদ বলেছেন, খৎনা "পুরুষদের জন্য আইন এবং মহিলাদের জন্য সম্মান রক্ষা"।[২][২৫]
খিলাফতে রাশিদার অধীনে প্রাথমিক যুগের মুসলিম বিজয়ের পর ইসলামের মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার অনেক দেশে খৎনা চালু করা হয়েছিল, যেখানে বিজয়ী কমান্ডাররা ছিলেন মুহাম্মদের সাহাবী ও সমসাময়িক ব্যক্তিবর্গ।[৭] একটি উদাহরণ হলো ফার্সিরা, যাঁরা ইসলামের আবির্ভাবের আগে পুরুষ বা মহিলা খৎনা করতো না। ইসলাম-পরবর্তী ধর্মান্তরিত ব্যক্তিরা যেমন রাশিদুন কমান্ডার আফশিনকে খৎনাবিহীন থাকার বিচারে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল।[৭][২৬]
মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলিতে খৎনার সাধারণ অনুশীলন চালু থাকা সত্ত্বেও একে সুন্নাহ হিসাবে বিবেচনা করা হয় যেটি আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত অত্যাবশ্যক (ফরজ) নয়। ধর্মের ইতিহাসবিদ এবং ধর্মীয় অধ্যয়নের পণ্ডিতদের মতে, খৎনার ইসলামি ঐতিহ্য প্রাক-ইসলামি আরবের পৌত্তলিক প্রথা এবং আচার-অনুষ্ঠান থেকে উদ্ভূত হয়েছিল[৭] এবং কুরআনে এর কোনো উল্লেখ নেই।[২][৩][৪] যদিও শিয়া ঐতিহ্যে, যেমন ইরানে প্রচলিত, পুরুষদের খৎনার জন্য সবচেয়ে কঠোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, যেহেতু এটিকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার দীক্ষার পরিবর্তে খ্রিস্টান বাপ্তিস্মের মতো শুদ্ধিকরণের আচার হিসেবে দেখা হয়।[২৭]
সুন্নি ইসলামি শাখার চারটি মাযহাবের মাঝে খৎনা নিয়ে ভিন্ন মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান:[২] কেউ কেউ বলে যে এটি সুপারিশযোগ্য, অন্যরা এটি অনুমোদিত কিন্তু বাধ্যতামূলক নয় হিসেবে আখ্যায়িত করেন, বাকিরা এটিকে আইনি বাধ্যবাধকতা হিসাবে বিবেচনা করে।[৩] ওলামাদের মধ্যে ইসলামি আইন (শরিয়া) অনুযায়ী খৎনার বাধ্যতামূলক বা অবাধ্যবাধকতা সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মতামত রয়েছে।[৩][৪] আহমদ বিন হাম্বল (হাম্বলি মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা) আবু হানিফা আল-নুমান (হানাফি মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা) এবং মালিক ইবনে আনাস (মালিকি মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা)-এর মতে, খৎনা করা সুন্নতে মু'আক্কাদাহ — এটি বাধ্যতামূলক নয়, তবে গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে শাফিঈ মাযহাব এটিকে সমস্ত মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক হিসাবে দেখেছে।[২][৩][২৮] শাফিঈ ও হাম্বলি আইনবিদদের মতে পুরুষ ও মহিলা উভয়ের খৎনা মুসলমানদের জন্য আইনত বাধ্যতামূলক,[২][৩] যদিও হানাফি আইনবিদরা জন্মের সপ্তম দিনে খৎনা করাকে বিশেষভাবে মুসলিম পুরুষদের জন্য সুপারিশযোগ্য বলে মনে করেন।[৩] কিছু সালাফিরা যুক্তি দিয়েছেন যে ইসলামে ইব্রাহিমের উপর পাঠানো শরিয়ার ভিত্তিতে ধর্মীয় পরিচ্ছন্নতা প্রদানের জন্য খৎনা করা প্রয়োজন, অন্যদিকে মুসলিম মহিলাদের জন্য নারী খৎনার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাঁদের যৌন আকাঙ্ক্ষা "নিয়ন্ত্রন" ও হ্রাস করা।[২৯]
বাঙালি মুসলিমরা সুন্নতে খাতনার পর সাধারণত ভোজের আয়োজন করে। ইন্দোনেশিয়াতেও শিশুর খৎনা করার পর পেরাইয়ান সুনাতান নামে একটি ভোজের আয়োজন করা হয়, তবে ইন্দোনেশিয়ার কিছু ওলামা বলেন যে এটি বিদআত, তবে বেশিরভাগ ওলামা মনে করেন যে এটি বিদআত নয়। তুরস্কেও এটি ব্যাপকভাবে উদ্যাপন করা হয় এবং এটি "সুন্নেত তোরেনি" "সুন্নেত মেভলুদু" নামে পরিচিত।
তথ্যমূলক টীকা
উদ্ধৃতিসমূহ