উইলিয়াম জেমস ডুরান্ট | |
---|---|
![]() ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে উইল ডুরান্ট | |
জন্ম | উইলিয়াম জেমস ডুরান্ট ৫ নভেম্বর ১৮৮৫ নর্থ অ্যাডামস্, ম্যাসাচুসেটস যুক্তরাষ্ট্র |
মৃত্যু | ৭ নভেম্বর ১৯৮১ লস অ্যাঞ্জেলেস ক্যালিফোর্নিয়া | (বয়স ৯৬)
পেশা | |
শিক্ষা | সেন্ট পিটার্স বিশ্ববিদ্যালয় (বিএ, ১৯০৭) কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় (পিএইচডি, ১৯১৭) |
বিষয় | ইতিহাস, দর্শন, ধর্মশাস্ত্র |
দাম্পত্যসঙ্গী | অ্যারিয়েল ডুরান্ট (বি.১৯১৩) |
সন্তান | এথেল ডুরান্ট (কন্যা) লুই ডুরান্ট (পুত্র) |
উইলিয়াম জেমস ডুরান্ট বা 'উইল ডুরান্ট' (৫ নভেম্বর ১৮৮৫ - ৭ নভেম্বর ১৯৮১) ছিলেন একজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিখ্যাত, ইতিহাসবিদ, দার্শনিক, লেখক ও শিক্ষাবিদ। তার সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ গ্রন্থ : দ্য স্টোরি অফ সিভিলাইজেশন। এগারো খণ্ডে রচিত মহাগ্রন্থটি, ইতিহাস ও দর্শনের সবচেয়ে জনপ্রিয় সিরিজ হিসাবে পরিচিত। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতার বিস্তৃত ইতিহাস তার স্ত্রী, অ্যারিয়েল ডুরান্টের (১৮৯৮-১৯৮১) সহযোগিতায় রচনা ও প্রকাশ করতে দীর্ঘ চল্লিশ বৎসর (১৯৩৫-১৯৭৫) সময় লেগেছিল।[১] এর আগে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি 'দ্য স্টোরি অফ ফিলোসফি' রচনার জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এটি এক যুগান্তকারী গ্রন্থ হিসাবে দর্শনকে জনপ্রিয় করেছিল। [২] তাদের সাফল্যের ফলস্বরূপ, তিনি এবং তার স্ত্রী যৌথভাবে ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে সাধারণ প্রকৃত তথ্যভিত্তিক সাহিত্য তথা ননফিকশনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুলিৎজার পুরস্কার এবং ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রপতির স্বাধীনতা পদক লাভ করেন।
উইলিয়াম জেমস ডুরান্ট ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের নর্থ অ্যাডামসে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা জোসেফ ডুরান্ট এবং মাতা মেরী অ্যালার্ড ছিলেন ফরাসি কানাডীয় ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কুইবেকের প্রবাসী ছিলেন। [৩][৪] ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে নিউ জার্সির জার্সি সিটির সেন্ট পিটার্স প্রিপারেটরি স্কুল থেকে বিদ্যালয়ের পাঠ শেষে, ডুরান্ট নিউ জার্সির সেন্ট পিটার্স কলেজে (অধুনা সেন্ট পিটার্স ইউনিভার্সিটি) ভর্তি হন এবং ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে স্নাতক হন। [৫]
ইতোমধ্যে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে, ডুরান্ট সমাজতান্ত্রিক দর্শন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে, তিনি মানলেন যে, সব ধরনের রাজনৈতিক আচরণ" ক্ষমতার প্রতি লালসা"-র কারণেই। [৬]
উইল ডুরান্ট শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করে প্রথমদিকে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নিউ জার্সির সাউথ অরেঞ্জের সেটন হল ইউনিভার্সিটিতে ল্যাটিন এবং ফরাসি বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। [৪] সেটন হল ছাড়ার পর, ডুরান্ট ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ফেরার মডার্ন স্কুলে শিক্ষক ছিলেন। [৪] প্রসঙ্গত, ফেরার স্কুল ছিল বিশ শতকের প্রথমদিকে ইউরোপে ফ্রান্সিসকো ফেরার ই গার্দিয়ার আদর্শে সংগঠিত 'স্বাধীনতাবাদী তথা মুক্ত শিক্ষার লক্ষে এক আন্দোলন' যা ফেরার আন্দোলন।[৪] এই ধরনের ফেরার মডার্ন স্কুলের সমর্থক আলডেন ফ্রিম্যান ডুরান্টের ইউরোপ সফরের সমস্ত ব্যবস্থা করেন।[৭]
১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি শিক্ষকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং পনের বছর বয়সী এরিয়েল কাউফম্যানকে বিবাহ করেন।তাদের একটি কন্যা, এথেল এবং পালিত পুত্র, লুই (যার মাতা ছিলেন ফ্লোরা - এরিয়েলের ভগিনী)।[৪] তাদের প্রতিপালনের জন্য তিনি প্রেসবিটারিয়ান চার্চে বক্তৃতা দিয়ে ৫ ডলার ১০ ডলার পেতেন। তার এই বক্তৃতার উপাদানই গুলিই পরবর্তীতে "দ্য স্টোরি অফ সিভিলাইজেশন" এর বিষয়বস্তু হয়ে যায়।
উইল ডুরান্ট ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নিউ ইয়র্ক সিটির লেবার টেম্পল স্কুলের পরিচালক এবং প্রভাষক ছিলেন। পাশাপাশি দর্শনের উপর গবেষণা করে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং দর্শনের প্রশিক্ষক হিসাবে কাজ করেন।[৪]
উইল ডুরান্টের লেখালেখির কাজ শুরু হয় ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দেই যখন তিনি 'আর্থার ব্রিসবেন'-এর সান্ধ্য পত্রিকা 'নিউ ইয়র্ক জার্নাল- আমেরিকান' এর রিপোর্টার ছিলেন।
তবে 'দর্শন ও সামাজিক সমস্যা'-র উপর তার প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে যে সময় তিনি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে 'ডক্টরেট' পান।
তার দ্বিতীয় গ্রন্থ, 'দ্য স্টোরি অফ ফিলোসফি' প্রকাশিত হয় ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে। বইটি 'বেস্ট সেলারের' তকমায় তিন দশকেরও কম সময়ে দুই মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রিত হয় এবং বেশ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়। পরের বছর প্রকাশিত হয় তার একমাত্র উপন্যাস ট্রানজিশন। এটি মূলত তার নিজের প্রাথমিক সামাজিক, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক মোহভঙ্গের একটি আত্মজীবনীমূলক বিবরণ।
'দ্য স্টোরি অফ ফিলোসফি' গ্রন্থটি তাকে আর্থিক সচ্ছলতা দিলে অধ্যাপনা ছেড়ে তিনি বেশ কয়েকবার বিশ্ব ভ্রমণ করেন আর শুরু করেন দ্য স্টোরি অফ সিভিলাইজেশন রচনার।
উইল ডুরান্ট ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ভারত ভ্রমণে ছিলেন তার 'দ্য স্টোরি অফ সিভিলাইজেশন' গ্রন্থের জন্য তথ্য সংগ্রহে।[৮]
তিনি তার 'দ্য কেস ফর ইন্ডিয়া' গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন যে, ইংল্যান্ড বছরের পর বছর ধরে শোষণে দারিদ্রের মুখে ঠেলে দিয়েছে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের আগে ভারতে কোন বড় দুর্ভিক্ষ ছিল না। ব্রিটিশরা যখন ভারতে আসে, তখন ভারত ছিল রাজনৈতিকভাবে দুর্বল, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। ইউরোপ বা এশিয়ার অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় ভারত ছিল অনেক বড় শিল্প ও উৎপাদনকারী দেশ। তার টেক্সটাইল পণ্য— তার তাঁতের সূক্ষ্ম পণ্য, তুলা, উল, লিনেন এবং সিল্ক - সভ্য বিশ্বে বিখ্যাত ছিল; তার সূক্ষ্ম গহনা এবং তার মূল্যবান পাথর প্রতিটি মনোরম আকারে কাটা ছিল; তার মৃৎপাত্র, চীনামাটির বাসন, সব ধরণের সিরামিক, গুণমান, রঙ এবং সুন্দর আকৃতি ছিল; ধাতু-লোহা, ইস্পাত, রৌপ্য এবং সোনায় তার সূক্ষ্ম কাজ ছিল। তার দক্ষ প্রকৌশলে দুর্দান্ত স্থাপত্য ছিল— বিশ্বের যেকোনও সৌন্দর্যের সমান। তার ছিল মহান ব্যবসায়ী, মহান শিল্পোদ্যোগী মানুষ, মহান ব্যাঙ্কার এবং অর্থদাতা। ভারত কেবল সর্বশ্রেষ্ঠ জাহাজ-নির্মাণকারী জাতিই ছিল না, স্থল ও সমুদ্রপথে তার বাণিজ্য ছিল যা বিশ্বের সমস্ত পরিচিত সভ্য দেশে বিস্তৃত ছিল। এমনই ভারতে ব্রিটিশরা এসে প্রায় দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসনে, প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে ঠেলে দিয়েছে। উনিশ শতকে ব্রিটেন ভারতে ১১১টি যুদ্ধ বাঁধিয়েছিল। হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা বাঁধিয়ে বিভেদ বাড়িয়ছিল।
বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে অদ্যাবধি যত হিন্দু ধর্মপ্রচারকের আবির্ভাব হয়েছে, তাদের যে কোন জনের মতবাদের চেয়ে অধিকতর শক্তি সম্পন্ন মতবাদ স্বামী বিবেকানন্দ তার দেশবাসীর উদ্দেশ্যে প্রচার করেছেন। [১] উইল ডুরান্ট ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে তার 'দ্য স্টোরি অফ সিভিলাইজেশন' গ্রন্থের 'আওয়ার ওরিয়েন্টাল হেরিটেজ' তথা প্রথম খণ্ডে উল্লেখ করেছেন—
আমরা চাই সেই ধর্ম যা মানুষ তৈরী করে...দুর্বল-কারী অতীন্দ্রিয়বাদগুলো পরিত্যাগ কর, সাহসী হও... পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের জন্য... অন্যান্য সব অর্থহীন দেবতা আমাদের মন থেকে বিদায় নিক। একমাত্র দেবতা যিনি জাগ্রত সে আমাদের জাতি, সর্বত্র তাঁর হাত, সর্বত্র তাঁর পা, সর্বত্র তাঁর কান; তিনি সর্বব্যাপী...। আমাদের চারিদিকে যাঁরা আছেন তাঁদের পূজা সর্বাগ্রে প্রয়োজন...। এঁরাই আমাদের ভগবান, এঁরা সকলে—মানুষ এবং ইতর জীব-জন্তুরা; এবং প্রথম আমাদের যে দেবতাদের পূজা করতে হবে তাঁরা হলেন আমাদের স্বদেশবাসী।
গান্ধীজি প্রকৃতপক্ষে এই আদর্শই অনুসরণ করেছিলেন।[৯]
উইল ডুরান্টের সম্পূর্ণ গ্রন্থপঞ্জি অনলাইনে পাওয়া যায় [১০]