উড্ডয়ন নিন্দা

আকাশযান কর্তৃক বায়ুমণ্ডল দূষণ এবং পরিবেশগত প্রভাব হ্রাস করতে অভ্যন্তরীণ ভ্রমণে আকাশযানের পরিবর্তে অন্যান্য মাধ্যম (যেমন: রেল,জাহাজ প্রভৃতি) ব্যবহার করার পক্ষে আন্দোলন হচ্ছে ‘উড্ডয়ন নিন্দা বা ত্রপা’ ও উড্ডয়ন বিরোধী আন্দোলন[] এটি ২০১৮ সালে সুইডেনে সংগঠিত হয় এবং সমগ্র ইউরোপপৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।[] সুইডিশ শব্দ ‘flygskam’ যার ইংরেজি অসম্পূর্ণ অনুবাদ ‘flight shame’ এবং বাংলায় ‘উড্ডয়ন ত্রপা বা নিন্দা’। [] মূলত আকাশযানের জ্বালানি থেকে সৃষ্ট গ্যাস দ্বারা বায়ুমণ্ডল দূষিত হয়। যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ফেলে তাই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় উড্ডয়নে নিরুৎসাহিত করাতে এ আন্দোলন[]

সুইডেনের একটি অভ্যন্তরীণ যাত্রীবাহী বিমান

একজন সুইডিশ গায়ক স্টাফান লিন্ডবার্গ ২০১৭ সালে এ দিকটি প্রথমে জ্ঞাপিত করেন। [][] অলিম্পিক ক্রীড়াবিদ বিজন ফারিও এই ধারণা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়ে ছিলেন।[] বিখ্যাত অপেরা গায়িকা ও কিশোরী পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গের মা মালেনা এরম্যান ঘোষণা করেন যে তিনি অভ্যন্তরীণ পথে উড্ডয়ন বন্ধ করবেন।[].[] থুনবার্গ এই আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তোলেন এবং তাঁর মাধ্যমে এটি পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। [][][]

গ্রেটা থুনবার্গ

এই ধারণাটি সুইডিশ আরো অনেক যশস্বী অনুধাবন করলে এই আন্দোলনটির জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। মাজা রোজেন ২০১৮ সালে ‘আমরা স্হলে থাকি’ আন্দোলন সুইডেনে সংগঠিত করেছিলেন। যেখানে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ একবছরের জন্য অভ্যন্তরীণ যাতায়াতে আকাশযান ব্যবহার করবেননা অঙ্গীকার করেন।[] আন্দোলনটি ২০১৯ সালে ইংরেজি বক্তাদের বক্তব্যের মূল ইস্যু হয়।[]

রেল যাতায়াতে উদ্বুদ্ধকরণ

[সম্পাদনা]

সুইডিশ শব্দ ‘tagskryt’ যার বাংলা অর্থ হচ্ছে রেলমূখী হও। এ কথার কারণ হচ্ছে দেশের অভ্যন্তরে এবং কাছাকাছি দেশ ভ্রমণে বিমানের পরিবর্তে নিরাপদ রেল ভ্রমণে করা। সামাজিক মাধ্যমে #tagskryt শব্দটি আন্দোলনের ধারণাকে গ্রহণযোগ্য করে তোলে এবং আন্দোলন বেগবান করে।[] ‘Att smygguga’ শব্দটিও ছড়িয়ে পড়ে এসময়ে যার বাংলা অর্থ হচ্ছে নিরাপদ ভ্রমণ করা।[]

প্রভাব

[সম্পাদনা]

পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ২.৫-৫% কার্বন ডাইঅক্সাইড(CO2) নিঃসরণ হচ্ছে আকাশযান গুলো থেকে।[][].[] এছাড়াও আকাশযান গুলো অন্যান্য গ্যাস যেমন: নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড (NO2) এবং জলের ভাপ কৃত্রিম মেঘ হিসেবে নিঃসরণ করছে যা বায়ুমণ্ডলের জন্য ক্ষতিকর।[].[] যখন উড্ডয়ন নিন্দা আন্দোলন তখন বিমান পরিসেবা হ্রাস হবে বলে ধারণা করা হয় যদিও বিমান শিল্প গুলি তাৎক্ষণিক দূষণ হ্রাস করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছিল।[]

স্বতন্ত্র সিদ্ধান্ত

[সম্পাদনা]

এসময়ে সুইডেনে মানুষ রেলমূখী হয় এবং অভ্যন্তরীণ পথে বিমানযাত্রী পরিবহন হ্রাস পায়।[].[][] সুইডেনের প্রধান রেলপরিবহন কর্তৃপক্ষ রেকর্ড সংখ্যক টিকিট বিক্রি করেছিল।[][] সুইডেনের সবচেয়ে ব্যস্ততম বিমান বন্দর ‘সুইডেবিয়া এয়ারপোর্ট’ কর্তৃপক্ষের মতে অভ্যন্তরীণ পথে এসময় পূর্বের বছরের তুলনায় ৯% যাত্রী হ্রাস পেয়েছিল।[][] পূর্বের বছরের গ্রীষ্মকাল থেকে ঐ সময়ের গ্রীষ্মে যাত্রী প্রায় ৫% হ্রাস পেয়েছিল।[১০] জার্মানিতে ২০১৯ এ ২০১৮ এর তুলনায় অভ্যন্তরীণ পথে বিমানযাত্রী প্রায় ১২% যাত্রী কমেছিল।[১১] একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র,ফ্রান্সইংল্যান্ডে অভ্যন্তরীণ পথে উড্ডয়নে প্রায় ২১% যাত্রী নিরুৎসাহিত হয়েছিল। [][১২] নেদারল্যান্ডবেলজিয়ামে অভ্যন্তরীণ পথে যথাক্রমে ৩% ও ০.৫% যাত্রী হ্রাস পায়। [১৩][১৪] কিছু যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বিমান পরিবহন সংস্থা অভিমত ব্যক্ত করেন যে গ্রেটা থুনবার্গ আন্দোলন করা ও ধারণাটি ছড়িয়ে দেয়ার কারণে অভ্যন্তরীণ বিমান পরিসেবা ৪% হ্রাস পায় যা গত দশকের অনুপাতে ৫% পাচ্ছে। [][]

সাময়িক উড্ডয়ন নিষিদ্ধকরণ

[সম্পাদনা]

২০১৯-এ উড্ডয়ন নিন্দা আন্দোলকালে ডজন খানেক প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ধুদ্ধ হয় অভ্যন্তরীণ পথে তাদের কর্মীদের ও পড়ুয়াদের যাতায়াতে বিমান পরিসেবা ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে। ‘ক্লারনা ব্যাংক এবি’ তাদের চাকরিজীবিদের প্রাতিষ্ঠানিক কাজে ইউরোপের অভ্যন্তরে উড্ডয়ন‌ নিষিদ্ধ করে।[১৫]

বিমান শিল্প ও পরিবহন সংস্থার প্রতিক্রিয়া

[সম্পাদনা]

বিমান শিল্প গুলো দেখলো এই আন্দোলনটি তাদের ব্যবসায় হুমকিতে পরিণত হয়েছে ‌।[১৬]সিওল ভিত্তিক আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সংস্থা (IATA) সংস্হার আলোচনায় উড্ডয়ন নিন্দা বিরোধী আলোচনা করেছিল।[] বিভিন্ন বিমান পরিসেবা প্রতিষ্ঠান দূষণ রোধে এবং কমাতে বিভিন্ন প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছিল। যেমন: ইজিজেট দশ মিলিয়ন যুক্তরাজ্যীয় পাউন্ড ব্যায় করে কার্বন পরিশোধন যন্ত্র কিনেছিল। [১৬]

এপ্রিল ২০২০-এ কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাসটি বৈশ্বিক বিস্তৃতি হয় দ্রুত বিমান পরিবহনের কারণে ‍‌।এটি অতিমারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার ৯৫% কারণ হচ্ছে দেশান্তরে দ্রুত বিমান পরিবহন ব্যবস্থা।উড্ডয়ন নিন্দা আন্দোলনের যৌক্তিক কারণ এটি একটি। [১৭] হার্ভার্ড ব্যবসা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর পৃথ্বীরাজ চৌধুরী এবং লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন ও কর্মশক্তি বিশেষজ্ঞ জিল্লিয়ান অ্যানেবল মনে করেন যে অতিমারিকালে সৃষ্ট বিমান খাতের এই সংকট অতিমারির প্রকটতা কেটে গেলেও জলবায়ু পরিবর্তনে উড্ডয়ন নিন্দার উপলব্ধি হয়ে মানুষের উড্ডয়ন ভীতি হবে এবং বিমান খাত পূর্বের ন্যায় অবস্হায় ফিরতে দূরহ হবে।[১৭]

কার্বন নিঃসরণ হ্রাস কার্যক্রম বিভিন্ন পৃথক ক্রিয়াকলাপে প্রভাব

সর্বজনীন বিতর্ক

[সম্পাদনা]

২০০৯ সালে জার্মান ওয়াচ নামের একটি অলাভজনক সংস্থাদ্যা বিলশিরোনামে একটি ছোট পরিসংখ্যান তুলনামূলক ভিডিও প্রকাশ করে। যেখানে দেখানো হয় কীভাবে আকাশ ভ্রমণের প্রভাব নিত্যদিনে দেখা যায় এবং আশেপাশে তা কেমন প্রভাব ফেলে।[১৮] ইংরেজ লেখক জর্জ মার্শাল অন্বেষণ করেন যে ব্যক্তিগত শখ বা পছন্দ ভ্রমণ কমাতে এবং ভ্রমণ গুলো ন্যায়সঙ্গত করতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তিনি একটি গবেষণা প্রকল্পে ‘ একজন আপনিও, আমাদের আলোচনায় যুক্ত হতে স্বাগতম’ শিরোনামে বিতর্ক ও ধারণা ব্যক্ত করার প্রকল্প আয়োজন করেন যেখানে তিনি জলবায়ু পরিবর্তন সচেতন লোকদের সাথে আলোচনা করেন এবং তাদের সাম্প্রতিক অভ্যন্তরীণ পথে আকাশ ভ্রমণের ন্যায়সঙ্গতা তাদের দ্বারা যাচাইয়ে সাহায্য করেন। তিনি দেখেন তাদের অনেকে তাদের ভ্রমণের যৌক্তিকতা হারিয়েছে এবং অনেকে বেসুরো হয়েছেন।এর কারণ তাদের বেশিরভাগেরই এমন চাকরি রয়েছে যাদের সময় সীমাবদ্ধ এবং অন্যান্য মাধ্যম ব্যবহারে প্রচুর অর্থ হাতছাড়া হয়। তাই তাদের উপর উড্ডয়ন‌ নিন্দার ধারণা একটুও প্রভাব ফেলতে পারেনি।[১৯] ২০১১-এ এস. কোহেন বিমান ভ্রমণে ন্যায়সঙ্গতা বিবেচনা করা এবং সচেতনতা উভয় জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব প্রশমন করছে আর নতুন পরিশোধন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ব্যবহারের সচেতনতা এসেছে উড্ডয়ন নিন্দা আন্দোলনের কারণে।[২০]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. https://www.bbc.com/future/article/20190909-why-flight-shame-is-making-people-swap-planes-for-trains
  2. Coffey, Helen (2019-06-05). "What is 'flygskam'? Everything you need to know about the environmental movement that's sweeping Europe". The Independent. Retrieved 2020-05-29.
  3. https://www.forbes.com/sites/jamesasquith/2020/01/13/the-spread-of-flight-shame-in-europe-is-greta-thunberg-the-reason-why/
  4. Cerullo, Megan (2019-10-03). ""Flight shame" could hurt airlines as travelers shun air travel". CBS News. Retrieved 2020-05-29.
  5. "Sweden's air travel falls as flight-shaming rises". BBC News. 2020-01-10. Retrieved 2020-05-29.
  6. "Sweden's air travel falls as flight-shaming rises". BBC News. 2020-01-10. Retrieved 2020-05-29
  7. Greta Thunberg, la paladina del clima: "Mamma non vuole ma salverò il pianeta""। Repubblica.it (ইতালীয় ভাষায়)। ১১ মার্চ ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ১৯ এপ্রিল ২০১৯। Ho smesso di usare l'aereo, ho smesso di mangiare carne e latticini
  8. Pesce, Nicole Lyn (2019-12-19). "How Greta Thunberg and 'flygskam' are shaking the global airline industry". MarketWatch. Retrieved 2020-05-29.
  9. Irfan, Umair (2019-11-30). ""Air travel is a huge contributor to climate change. A new global movement wants you to be ashamed to fly". Vox. Retrieved 2020-10-22.
  10. "The Greta effect". The Economist. 2019-08-19
  11. Wilkes, William; Weiss, Richard (2019-12-19). "German Air Travel Slump Points to Spread of Flight Shame". Bloomberg. Retrieved 2020-05-29.
  12. 'Flight shame' could halve growth in air traffic". BBC News. 2019-10-02
  13. Cathy Galle (4 January 2020). "Vliegschaamte? Geen sprake van in België". De Morgen (in Dutch)
  14. vliegtuig". de Volkskrant (in Dutch). "Vliegschaamte of niet, vliegtuig haalt auto in bij reizen naar buitenland". NOS (in Dutch). 15 January 2020
  15. William Wilkes (26 September 2019). "Flight Shaming Puts a Dent in European Travel". Bloomberg. Retrieved 21 October 2020. Elena Berton (2 October 2019). "Flight shaming hits air travel as 'Greta effect' takes off". Reuters. Retrieved 21 October 2020.
  16. Hook, Leslie (2019-12-29). "Year in a word: Flygskam". Financial Times. Retrieved 2020-05-29
  17. Kusmer, Anna (2020-04-03). "Coronavirus has changed how we transport goods and ourselves. But will it last?". The World from PRX. Retrieved 2020-05-29.
  18. "The Bill", by Peter Wedel, distributed by GermanWatch. 23 June 2009.
  19. Marshall, G. (2009, 24-July). Why We Still Don’t Believe In Climate Change
  20. Cohen S, Higham J, Cavaliere C (2011), "Binge flying: Behavioural addiction and climate change" (PDF), Annals of Tourism Research, doi:10.1016/j.annals.2011.01.013