উপক্ষার (ইংরেজি: Alkaloids) প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত এক শ্রেণীর জৈব যৌগ যেগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষারীয় নাইট্রোজেন অণু ধারণ করে থাকে বিষম চক্রের অংশ হিসেবে এবং শারীরিক প্রতিক্রিয়া তৈরিতে সক্ষম।[২] উপক্ষার উদ্ভিদদেহে নাইট্রোজেন ঘটিত বর্জ্য পদার্থ হিসেবে তৈরি হয়। অনুমান করা হয় প্রোটিন বিয়োজনের ফলেই এরা তৈরি হয়। এদের সাধারণত পাওয়া যায় মূলে, পাতায়, বাকলে, কাঠে এবং বীজে। এদের স্বাদ তেতো এবং অনেক উপক্ষারই বেশ বিষাক্ত। এরা সাধারণত জলে অদ্রবণীয় কিন্তু অ্যালকোহলে সহজেই গুলে যায়। উদ্ভিদের পক্ষে এদের প্রয়োজনীয়তা কতখানি তা সঠিক জানা নেই, কিন্তু কিছু উপক্ষার মানুষের চিকিৎসায় বহুদিন ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
ল্যাটিন alkali শব্দটির অর্থ ক্ষার এবং গ্রিক οειδής(like) শব্দটির অর্থ সাদৃশ্য। সুতরাং উপক্ষার শব্দটির অর্থ ক্ষার সাদৃশ্য। জার্মান রসায়নবিদ কার্ল ফ্রিডরিখ উইলহেম(Carl Friedrich Wilhelm Meißner) ১৮১৯ সালে সর্বপ্রথম উপক্ষার(Alkaloid) শব্দটি ব্যবহার করেন।
উপক্ষারের নামকরণের কোন সুনির্দিষ্ট ধরা বাঁধা নিয়ম নেই। তবে প্রত্যেক উপক্ষারের নামের শেষে “ine” বিদ্যমান থাকবে। যেমন মরফিন(Morphine), কুইনাইন(Quinine), ক্যাফেইন(Caffeine) ইত্যাদি। এছাড়াও কমপক্ষে ৮৬টি উপক্ষার আছে যাদের নামের শুরুতে “vin” থাকে। যেমন ভিনক্রিসটিন(Vincristine), ভিনব্লাস্টিন (Vinblastine)।[৩]
উপক্ষার প্রধানত পাওয়া যায় উচ্চশ্রেণীর উদ্ভিদে সেকেন্ডারি মেটাবোলাইট রূপে।পূর্বে ধারণা করা হত, স্তন্যপায়ীদের যেমন নাইট্রোজেন বিপাকের শেষ পরিণতি হল ইউরিয়া ঠিক তেমনি উদ্ভিদের নাইট্রোজেন বিপাকের শেষ পরিণতি হল উপক্ষার । কিন্তু বর্তমানে এই ধারণাটি অনুপস্থিত কারণ উদ্ভিদে এর ঘনমাত্রা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়।
বীজ (Strychnine tree),ফল(কোকোয়া),পাতা(চা)[৪],বাকল (সিনকোনা) এবং শিকড়ে (সর্পগন্ধা) উল্লেখযোগ্য পরিমাণে এবং অন্যান্য উদ্ভিদ কলাতে সামান্য পরিমাণে পাওয়া যায়।
ইহা সাধারণত উদ্ভিজ্জ্জ জৈব এসিডের লবণ যেমন অ্যাসিটিক এসিড, ল্যাকটিক এসিড, টারটারিক এসিড, ম্যালিক এসিড, সাইট্রিক এসিড ইত্যাদি এসিডের লবণ রূপে উৎপন্ন হয়। উদ্ভিদ ছাড়াও কতক ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক(যেমন Psilocybe গণের ছত্রাক থেকে psilocybin) এবং প্রাণীতে (যেমন ব্যাঙের চামড়া থেকে bufotenin) উপক্ষার পাওয়া যায়।
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই উপক্ষার সমৃদ্ধ উদ্ভিদ ব্যবহারিত হয়ে আসছে চিকিৎসা এবং বিনোদনের উদ্দেশ্যে। উদাহরনস্বরূপ, খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০সালেও মেসপটমিয়ায় ঔষুধী বৃক্ষের পরিচয় পাওয়া যায়। অন্ধ কবি হোমারের মহাকাব্য ওডিসিতে রানী হেলেনকে মিশরীয় রানীর দেয়া উপহারটি এক ধরনের উপক্ষার “অপিয়াম” সমৃদ্ধ ঔষুধ ছিল বলে ধারণা করা হয় যা কিনা বিস্মৃতি আনায়নে সক্ষম।
বন্য মানুষেরা বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত উপক্ষার যেমন একোনাইটিন (aconitine), টবুকুরারিন(tubocurarine) ইত্যাদি তীরের আগায় লাগিয়ে শিকারকে ঘায়েল করতে ব্যবহার করত। খ্রিষ্টপূর্ব ১ম থেকে ৩য় শতকের চীনা বইগুলোতে চিকিৎসাক্ষেত্রে এফিড্রা ও অপিয়াম পপ্পি উদ্ভিদ ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়।
উপক্ষার নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু হয় উনিশ শতকের দিকে। ১৮০৪ সালে জার্মান কেমিস্ট ফ্রিডরিখ সার্টারনার সর্বপ্রথম অপিয়াম থেকে মরফিন পৃথক করেন এবং এর নামকরণ করেন গ্রিক স্বপ্ন দেবতা “মরফিয়াসের” নাম অনুসারে। মরফিনই সর্বপ্রথম পৃথকীকৃত উপক্ষার।
গাঠনিক বৈচিত্র্যতার জন্য উপক্ষারের কোন সুনির্দিষ্ট শ্রেণিবিভাগ নেই। একে বিভিন্ন ভাবে শ্রেণী বিন্যাস্ত করা হয়। যেমন- রাসায়নিক গঠনের উপর ভিত্তি করে, জীবের উপর প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে, জৈব-সংশ্লেষ পথের উপর ভিত্তি করে।
সাধারণ উপক্ষারকে নিম্নোক্ত তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করে হয়ঃ
১. ট্রু অ্যালকালয়েড - এদের রাসায়নিক গঠনে নাইট্রোজেন অণু থাকে যা বিষম চক্রের অন্তর্গত এবং এরা অ্যামিনো এসিড হতে উদ্ভূত। যেমন অ্যাট্রোপিন(atropine), নিকটিন(nicotine),মরফিন(morphine)
২. প্রোটো অ্যালকালয়েড - এদের রাসায়নিক গঠনে নাইট্রোজেন অণু থাকে তবে তা বিষম চক্রের অন্তর্গত নয় এবং এরাও অ্যামিনো এসিড হতে উদ্ভূত। যেমন মেসকালিন(mescaline), এফিড্রিন(ephedrine), আড্রেনালিন(adrenaline)
৩. সিউডো অ্যালকালয়েড - এদের রাসায়নিক গঠনে নাইট্রোজেন ঘটিত বিষম চক্র থাকে কিন্তু এরা অ্যামিনো এসিড হতে উদ্ভূত নয়। যেমন ক্যাফেইন(caffeine), থিওব্রমিন(theobromine), থিওফাইলিন(theophylline)
জৈব-সংশ্লেষ পথের উপর ভিত্তি করে অর্থাৎ কোন অ্যামিনো এসিড হতে জৈব-সংশ্লেষ হয় তার উপর ভিত্তি করে অ্যালকালয়েড বা উপক্ষারকে নিম্নোক্ত ছয়টি শ্রেণীতে ভাগ করে হয়ঃ[৫]
১. ফিনাইল এলানিন (Phenylalanine) অ্যামিনো এসিড হতে উদ্ভূত অ্যালকালয়েড যেমন এফিড্রিন(ephedrine),নরসিউডোএফিড্রিন বা ক্যাথিন (norpseudoephedrine or cathine) and ক্যাপসাসিন (capsaicin)।[৬]
২. ট্রিপটোফেন (Tryptophan) অ্যামিনো এসিড হতে উদ্ভূত অ্যালকালয়েড- যেমন ইনডোল (Indole) বিষমচক্র সমৃদ্ধ অ্যালকালয়েড সেরোটোনিন (serotonin), সিলোসিন (psilocin), সিলোসাইবিন (psilocybin), ইয়োম্বিন (Yohimbine), রেসারপিন (Reserpine), রেসসিনামিন (Rescinnamine), ভিনব্লাস্টিন (Vinblastine), ভিনক্রিস্টিন (Vincristine) এবং স্ট্রিকনিন (Strychnine); কুইনোলিন(quinoline) বিষমচক্র সমৃদ্ধ অ্যালকালয়েড কুইনিন (Quinine), সিনকোনিন (Cinchonine), সিনকোনিডিন (Cinchonidine), কুইনিডিন (Quinidine); পাইরোলইনডোল (Pyrroloindole) বিষমচক্র সমৃদ্ধ অ্যালকালয়েড ফাইসোস্টিগমিন (Physostigmine); আরগোট অ্যালকালয়েড(যাদের মধ্যে অবশ্যই বিষমচক্রিক ইনডোল নিউক্লিয়াস থাকে ) আরগোনোভিন (ergonovine), আরগোটামিন (ergotamine) এবং লাইসারররজামেড (lysergamde) বা আরজিন (ergine)[৭]
৩. অরনিথিন(Ornithine) অ্যামিনো এসিড হতে উদ্ভূত অ্যালকালয়েড - যেমন পাইরোলিডিন (pyrrolidine) অ্যালকালয়েড সমূহ- হাইগ্রিন (hygrine), কুসোহাইগ্রিন (cuscohygrine) এবং স্টাচাইড্রিন (stachydrine); ট্রপেন অ্যালকালয়েড সমূহ- এট্রপিন (atropine), কোকেন (cocaine), সিনামাইল কোকেন (cinnamoyl cocaine), ইকগোনিন (ecgonine) এবং হায়োসসায়ামিন (hyoscyamine); পাইরোলিজিডিন (pyrrolizidine) অ্যালকালয়েড সমূহ- রেট্রোনেসিন (Retronecine) এবং সেনেসিওনিন (Senecionine)[৮][৯][১০]
৪. হিসটিডিন (Histidine) অ্যামিনো এসিড হতে উদ্ভূত অ্যালকালয়েড-এমাইনো এসিড হিস্টিডিনের গঠনের মধ্যে বিষমচক্রিক ইমিডাজল নিউক্লিয়াস থাকে। তাই, ইমিডাজল অ্যালকালয়েড সমূহ যেমন যেমন পিলোকারপিন (pilocarpine), আইসো পিলোকারপিন (isopilocarpine এবং পিলোসিন (pilosene) হিসটিডিন (Histidine)- অ্যামিনো এসিড হতে উদ্ভূত অ্যালকালয়েড।[১১][১২][১৩]
৫. লাইসিন (Lysine) অ্যামিনো এসিড হতে উদ্ভূত অ্যালকালয়েড- (Piperidine) অ্যালকালয়েড, (Quinolizidine) অ্যালকালয়েড এবং (Indolizidine) অ্যালকালয়েড এমাইনো এসিড লাইসিন (Lysine) থেকে উদ্ভূত অ্যালকালয়েড। (Coniine), (Lobeline), (Lobelanine) and (Piperine) -Piperidine অ্যালকালয়েড; (lupinine), (lupanine) and (sparteine) Quinolizidine অ্যালকালয়েড এবং (castanospermine) এবং (swansonine) Indolizidine অ্যালকালয়েড।[১৪]
৬. এনথ্রানিলিক এসিড(Anthranilic Acid) অ্যামিনো এসিড হতে উদ্ভূত অ্যালকালয়েড
১. প্রাণী ও পোকামাকড়ের আক্রমণ প্রতিরোধী উপাদান হিসেবে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ টিউলিপ ঊদ্ভিদের লিরিওডেনিন(Liriodenine) উপক্ষার পরজীবী ছত্রাকের আক্রমণ থেকে উদ্ভিদকে রক্ষা করে।
২. প্রাণীদেহে হরমোনের মতোই উদ্ভিদের বৃদ্ধি, বিপাক এবং প্রজননের নিয়ন্ত্রক পদার্থ রূপে কাজ করে।
৩. প্রোটিন সংশ্লেষের জন্য আঁধার(reserver) হিসেবে কাজ করে।
অতি প্রাচীনকাল থেকে আদ্যবধি উপক্ষারের সমৃদ্ধ উদ্ভিদসমূহ চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহারিত হয়ে আসছে। এগুলোর মধ্যে নিম্নোক্তগুলো উল্লেখযোগ্যঃ
উপক্ষার | প্রতিক্রিয়া |
---|---|
আজমালিন | অ্যান্টি-অ্যারিদমিক |
অ্যাট্রোপিন, | অ্যান্টিকোলিনারজিক |
ক্যাফেইন | উদ্দীপক, রেচক, অ্যাডিনোসিন রিসেপ্টর অ্যান্টাগোনিস্ট |
কোডেইন | কফ নিরাময়ক, ব্যাথা নাশক |
মরফিন | ব্যাথা নাশক |
নিকোটিন | উদ্দীপক |
টিউবোকুরারিন | মাংসপেশী শিথিলকারক |
ভিনক্রিস্টিন, ভিনব্লাস্টিন | টিউমার প্রতিরোধী |
আধুনিককালে পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হ্রাস এবং আকাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া বৃদ্ধি জন্য উপক্ষারের গাঠনিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সংশ্লেষিত ও অর্ধ-সংশ্লেষিত ঔষধ তৈরি করা হচ্ছে।