উমাইয়া মসজিদ جامع بني أمية الكبير | |
---|---|
ধর্ম | |
অন্তর্ভুক্তি | ইসলাম |
অঞ্চল | লেভান্ট |
অবস্থা | সক্রিয় |
অবস্থান | |
অবস্থান | দামেস্ক, সিরিয়া |
স্থাপত্য | |
ধরন | মসজিদ |
স্থাপত্য শৈলী | উমাইয়া |
সম্পূর্ণ হয় | ৭১৫ |
বিনির্দেশ | |
মিনার | ৩ |
উপাদানসমূহ | পাথর, মার্বেল, টাইলস, মোজাইক |
উমাইয়া মসজিদ, দামেস্ক গ্রেট মসজিদ হিসেবেও পরিচিত (আরবি: جامع بني أمية الكبير, রোমানীকরন:Ğāmi' Banī 'Umayya al-Kabīr)। এই মসজিদটি দামেস্কের পুরাতন শহরে অবস্থিত, যা বিশ্বের বৃহত্তম ও প্রাচীন মসজিদগুলোর মধ্যে অন্যতম। মুসলমানদের একটি অংশের মতে এটি ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের চতুর্থ পবিত্র স্থান।[১][২][৩][৪][৫]
৬৩৪ সালে আরব যুদ্ধে দামেস্ক বিজয়ের পর, জন দ্য বাপটিস্ট (খ্রিস্টান দীক্ষা দান গুরু) ইয়াহিয়া এর খ্রিস্টানদের উৎসর্গকৃত স্থানে এই মসজিদটি স্থাপিত হয়। এই মসজিদে এখনো যাতে এখনো জন দ্য মাপটিস্ট এর মাথা আছে বলে ধারণা করা হয়। এই স্থানটি খ্রিস্টান ও মুসলিম উভয়ই ধর্মাবলম্বীদের জন্য পবিত্র ও সম্মানজনক স্থান। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করে যে “যীশু” তার শেষের দিনগুলোতে এখানে আগমণ করেন। সালাহউদ্দিনের মাজার মসজিদের উত্তরদিকের প্রাচীরের সাথে লাগানো একটি ছোট্ট বাগানে অবস্থিত।
লৌহ যুগে দেমাস্কাস অ্যারাম-দামেস্কের অ্যারামিয়ান স্টেটের রাজধানী ছিল। পশ্চিম সিরিয়ার অ্যারামিয়ানরা হাদাদ-রাম্মান এর সংস্কৃতির অনুসারী ছিল, এই হাদাদ-রাম্মান হল বৃষ্টি ও বজ্রপাতের প্রভু। এই হাদাদ-রাম্মান –কে উৎসর্গকৃত একটি মন্দিরের স্থানে নির্মিত আজকে উমাইয়া মসজিদ। এইটা ঠিকভাবে জানা যায় যে, তৎকালীন মন্দিরটি দেখতে ঠিক কেমন ছিল, কিন্তু এইটা বিশ্বাস করা হয় যে মন্দিরটি ঐতিহ্যবাহী সিমিটিক-কানানিট স্থাপত্যশৈলী অনুসরণ করে স্থাপিত হয়েছিল, জেরুজালেম মন্দির নামে পরিচিত ছিল। এই অ্যারামিয়ান মন্দিরটির একটি পাথর এখনো দামেস্কের জাতীয় যাদুঘরে এখনো সংরক্ষিত আছে।[৬]
৬৩৪ সালে মুসলিম আরব শাসক খালিদ-ইবন-ওয়ালিদ দামেস্ককে নতুনভাবে নির্মাণ ও অন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। এই দশকের পরে, ইসলামী খিলাফত শাসন উমাইয়া রাজবংশের অধীনে আসে। তখন দামেস্ক –কে মুসলিম বিশ্বের প্রশাসনিক রাজধানী হিসেবে নির্বাচন করা হয়। ষষ্ঠ উমাইয়া খলিফা আল-ওয়ালিদ (৭০৫-৭১৫) ৭০৬ সালে বায়জানাইথ ক্যাথেড্রাল এর পাশে একটি মসজিদ নির্মাণের জন্য একটি কমিশন গঠন করেন।[৭] এর পূর্বে, ক্যাথেড্রাল গির্জাটি স্থানীয় খ্রিস্টানরা ব্যবহার করত, যা এখনো ব্যবহৃত হয়, কিন্তু এই গির্জাটির দক্ষিণ-পূর্ব দিকে মুসলমানদের জন্য প্রধান প্রার্থনা কক্ষ (মুসাল্লা) ছিল। আল-ওয়ালিদ মুসাল্লা সহ ক্যাথেড্রাল গির্জাটির বেশিরভাগ অংশ ভেঙে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে মসজিদ নির্মাণ করেন, যার নির্মাণকাজ তিনি ব্যক্তিগত ভাবে পরিদর্শন করেন। এই নতুন মসজিদটি প্রধান মসজিদ হিসেবে ভূমিকা রাখে যা, দামেস্ক শহরের নাগরিকদের প্রার্থনার জন্য ব্যবহৃত হত। খ্রিস্টানদের আন্দোলনের মুখে আল-ওয়ালিদ দামেস্ক শহরের সব গির্জা খ্রিস্টানদের ফিরিয়ে দেয়া হয়। মসজিদের নির্মাণকাজ শেষ হয় ৭১৫ খ্রিষ্টাব্দে, তার উত্তরাধিকার, সুলায়মান ইবন আব্দ-আল-মালিক (৭১৫-৭১৭) এর শাসনামলে।[৮]
দশম শতাব্দীর পারস্য ইতিহাসবিদ ইবন-আল-ফাকিহ্ এর মতে, এই নির্মাণকাজে তৎকালীন ৬,০০,০০০ থেকে ১০,০০,০০০ দিনার ব্যয় হয়। পারস্য, ভারতীয়, গ্রীক এবং মরক্কোর শ্রমিকদের সমন্বয়ে প্রায় ১২,০০০ শ্রমিক এই নির্মাণকাজে নিয়োজিত হয়।[৯]
১০৭৮ সালে সুন্নী মুসলিম সেলজুক তার্ক এই শহরের শাসনাভার গ্রহণ করেন এবং তিনি আব্বাসিয় খেলাফতের শাসন পুনরুদ্ধার করেন। সেলজুক রাজা তুতুশ (১০৭৯-১০৯৫) ১০৬৯ সালের অগ্নিকান্ডে মসজিদের ধ্বংসপ্রাপ্ত অংশ ঠিক করেন।[১০] এরপর দামেস্কের সেলজুক আতাবেগ, তথিকিং (১১০৪-১১২৮), মসুলের সেলজুক আতাবেগ, শরফ আল-দীন মওদুদ (১১০৯-১১১৩) এর আমলে উমাইয়া মসজিদের পুনঃনির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়।
In Damascus there is a mosque that has no equal in the world, not one with such fine proportion, nor one so solidly constructed, nor one vaulted so securely, nor one more marvellously laid out, nor one so admirably decorated in gold mosaics and diverse designs, with enamelled tiles and polished marbles.
Muhammad al-Idrisi, 1154[১১]
১৪৮৮ সালে মামলুক সুলতান মামলুক কাইতবাঈ –এর নামানুসারে মসজিদের কাতিবায় মিনার নির্মিত হয়। এই মামলুক শাসনামলে এই মসজিদের অনেক উন্নতকরণের কাজ করা হয়। মামলুক শাসনাওলে এই মসজিদের বিভিন্ন স্থানে মার্বেল পাথর দ্বারা সুশোভিত করা হয়। এই সময় মসজিদের অনেক অংশ পুনরুদ্ধার করা হয়। এই পুনরুদ্ধার কাজে সিরিয়া ও মিশরের মামলুক শাসনামলের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।[১২][১৩]
১৫১৬ সালে উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে প্রথম সেলিম মামলুক রাজপরিবারের কাছ থেকে দামেস্ক বিজয় করেন। উমাইয়া মসজিদে তার শাসনামলের প্রথম জুমা’র নামাযে সুলতান নিজে উপস্থিত ছিলেন।[১৪][১৫] উসমানীয় সম্রাট এই ধর্মীয় স্থানটিকে কেন্দ্রীয় পরিষদের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের জন্য উন্মুক্ত সম্পত্তি (ওয়াক্ফ) হিসেবে ঘোষণা করেন। এই ওয়াক্ফ স্টেটটি শহরের সর্ববৃহৎ স্টেট যেখানে ৫৯৬ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছিল।[১৬]
উমাইয়া মসজিদের প্রধান পুনরুদ্ধার কাজ শুরু হয় ১৯২৯ সালে সিরিয়ায় ফরাসী শাসনামলে এবং ১৯৬৩ সালে সিরিয়া প্রজাতন্ত্রের সময়ে।[১৭]
১৯৮০’র দশকে ও ১৯৯০ দশকের শুরুতে, সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি হাফেজ আল-আসাদ উমাইয়া মসজিদের বিনির্মাণের জন্য বিশাল পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।[১৮] হাফেজ আল-আসাদের এই ধারণা ও কর্মপদ্ধতিকে ইউনেস্কো সমালোচনা করে। কিন্তু সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিতে এই মসজিদটি ঐতিহ্য রক্ষার চেয়ে শহরের প্রতীক হিসেব গ্রহণীয় হত, তাই এর বিনির্মাণ কাজ আরো কমিয়ে আনা হয়। এর বিনির্মাণ কাজ করা হয় শুধুমাত্র এর ঐতিহ্যের প্রতীককে আরেকটু বৃদ্ধির লক্ষ্যে।[১৯]
২০০১ সালে পোপ দ্বিতীয় জন পল মসজিদটি পরিদর্শন করেন, বিশেষত তিনি জন দ্য বাপটিস্ট এর সংরক্ষিত স্মৃতিচিহ্ন পরিদর্শন করেন। এই প্রথম কোন মসজিদ কোন পোপ পরিদর্শনে করেন।[২০]
২০১১ সালের ১৫ মার্চ, সিরিয়ান গৃহযুদ্ধের সাথে সম্পর্কযুক্ত প্রথম আন্দোলন শুরু হয়। এই সময় উমাইয়া মসজিদ কমপ্লেক্সের বাইরে ৪০-৫০ মুসল্লী জড়ো হয়ে প্রাক-গণতন্ত্রের জন্য শ্লোগান দিতে থাকে। সিরিয়ান নিরাপত্তা কর্মীরা দ্রুত আন্দোলনকারীদের দমন করেন এবং এরপর থেকে ঐ এলাকা শুক্রবারের জুমা’র নামাযের সময় নিরাপত্তা কর্মীরা একটি অস্থায়ী ব্যারিকেড দিয়ে রাখে বিক্ষোভ দমন করার জন্য।[২১][২২]
উমাইয়া মসজিদটি আকারে আয়তক্ষেত্র যার আয়তন দৈর্ঘ্যে ৯৭ মিঃ (৩১৮ ফুট) ও প্রস্থে ১৫৬ মিঃ (৫১২ ফুট)। একটি বিশাল উঠান মসজিদ কমপ্লেক্সের উত্তরাংশ জুড়ে অবস্থিত এবং হারাম (পবিত্র স্থান) কমপ্লেক্সের দক্ষিণাংশে। এর উঠান ও আশপাশ এলাকা চারদিকে দেয়ালের সীমানা দিয়ে ঘেরা করা। এই দেয়ালের পাথরের বিন্যাস উচু নিচু, যা মসজিদের ইতিহাসে বিভিন্ন সংস্কারের চিহ্ন বহন করছে। কিন্তু বর্তমান সংস্কার কাজ এই মসজিদের পূর্বের উমাইয়া যুগের স্থাপত্য শৈলী পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। এই প্রাচীরকে ঘিরে আছে তৌরণ যা দাঁড়িয়ে আছে অতিরিক্ত পাথরের কলাম ও জোড়-স্তম্ভ দ্বারা। প্রত্যেক দুই কলামের মধ্যে একটি জোড়-স্তম্ভ বিদ্যমান। কারণ ১৭৫৯ সালের ভূমিকম্পে এর প্রাঙ্গনের উত্তরাংশ ধ্বসে যায়।[২৩] এই ধরনের তিনটি তোরণ দ্বারা প্রধান কক্ষের অভ্যন্তর গঠিত।
এই মসজিদের সর্ববৃহৎ গম্বুজটি “ডোম্ব অব ঈগল” ("Dome of the Eagle") নামে পরিচিত। যার আসল নাম কুব্বাত আন-নিস্র (Qubbat an-Nisr) এবং এটি প্রধান কক্ষের উপরে কেন্দ্রীয়ভাবে অবস্থিত।[২৪] ১৮৯৩ সালের অগ্নিকান্ডের পর এর কাঠের তৈরী গম্বুজটির স্থানে পাথরের তৈরী গম্বুজটি তৈরী হয়। এর উচ্চতা ৩৬ মিঃ (১১৮ ফুট)। এই গম্বুজটি কেন্দ্রীয় অভ্যন্তরীণ তৌরণের উপর অবস্থিত।[২৩]
উমাইয়া মসজিদ কমপ্লেক্সে মোট তিনটি মিনার আছে।
মুহাম্মাদ এর পরিবার উপস্থিতি ও এখান থেকে ইরাক গমণ এবং কারবালার জিহাদ তারসাথে এই স্থানে তার পরিবারবর্গ ষাট দিন কারাবস ছিলেন, এই কারণে উমাইয়া মসজিদটি শিয়া ও সুন্নী মুসলিমদের নিকট অতীব গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় তাৎপর্য বহন করে।[২৯]
মসজিদের বিভিন্ন অংশের গঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বহন করেঃ
"প্রবেশদ্বার"' ("Bāb as-Sā‘at" নামে পরিচিত)- এই দরজাটি একটি স্থানকে নির্দেশ করে, যেখানে কারবালা’র যুদ্ধের সৈনিকদের বন্দী করে রাখা হয়।[৩০]
"জন বাপটিস্ট"' এর সমাধী (Arabic: Yahyā)[৩১]
একটি কাচের ঘরে একটি নামাজের কার্পেট ও মিহরাব- যা “হোসেইন ইবন আলী” কারবালা’র যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বন্দী থাকা অবস্থায় নামাজ আদায়ের চিহ্ন নির্দেশ করে। একটি ধাতব অংশ, ঘনাকৃর্তির প্রতিকৃতি- যা এজিদের দর্শনের জন্য হোসেইন ইবন আলী এর শির রাখা হয়। একটি লোহার খাচা- যা কারবালা যুদ্ধের অন্যান্যদের শির রাখা হয়।