এক অঞ্চল, এক পথ[২] (চীনা ভাষায় 一带一路 ই তাই ই লু) গণচীন সরকারের গৃহীত একটি উন্নয়ন কৌশল ও কাঠামো। এটি ইংরেজিতে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ নামেও পরিচিত। চীনের রাষ্ট্রপতি শি চিনফিং দ্বারা প্রস্তাবিত এ কাঠামো দেশসমূহ, বিশেষ করে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এবং প্রধান দুটি উপাদান- ভূমি-ভিত্তিক রেশম পথ অর্থনৈতিক বলয় (সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট) এবং সামুদ্রিক রেশম পথ নিয়ে গঠিত অবশিষ্ট ইউরেশিয়ার মধ্যে যোগাযোগ ও সহযোগিতার উপর গুরুত্ব দেয়। এই কৌশল বিশ্বব্যাপী বিষয়সমূহে চীনের একটি বড় ভূমিকা নেওয়ার পথ সুগম করে। একইসাথে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে, যেমন ইস্পাত উৎপাদন, চীনের অগ্রাধিকার ধারণক্ষমতা সহযোগিতার প্রয়োজন তুলে ধরে।[৩][৪]
এটা ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবরে যথাক্রমে এসআরইবি এবং এমএসআর এর আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে উন্মোচিত হয়। প্রধানমন্ত্রী লি খছিয়াং এশিয়া এবং ইউরোপ এ রাষ্ট্রীয় সফর এর সময় প্রচার করেছিলেন।
এই উদ্যোগের পরিধি প্রাথমিকভাবে এশিয়া ও ইউরোপের প্রায় ৬০ টি দেশ। ওশেনিয়া এবং পূর্ব আফ্রিকাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অনির্দিষ্টকাল সময়সীমা ধরে আনুমানিক ক্রমসঞ্চিত বিনিয়োগ ৪ থেকে ৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বিবেচনা করা হয়।[৫][৬] ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড দুই মার্কিন-কেন্দ্রিক ট্রেডিং ব্যবস্থার বিপরীতে রয়েছে, ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ এবং দি ট্রান্স-আটলান্টিক ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পার্টনারশিপ.[৬]
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর মাসে চীনের নেতা শি চিনফিং যখন মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সফর করেছিলেন, তখন তিনি যৌথভাবে সিল্ক রোড অর্থনৈতিক বলয় এবং একুশ শতাব্দীর উপকূলবর্তী সিল্ক রোড নির্মাণের উদ্যোগ উত্থাপিত করেছিলেন। মূলত, 'বলয়' মধ্য এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপে প্রকৃত সিল্ক রোড এর উপর অধিষ্ঠিত দেশসমূহকে অন্তর্ভুক্ত করে। উদ্যোগটি অবকাঠামো নির্মাণ, সাংস্কৃতিক বিনিময় বৃদ্ধি, এবং বাণিজ্য বাড়ানোর মাধ্যমে এই অঞ্চলটিকে একটি সংযোজক অর্থনৈতিক এলাকার মধ্যে একীকরণের জন্য আহ্বান জানায়। মূলত ঐতিহাসিক সিল্ক রোডের অনুরূপ এই অঞ্চলটি ছাড়াও, অন্য একটি এলাকা যেটি এই 'বেল্ট' সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেটি হলো দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। এই বেল্টের অংশ এমন অনেক দেশ চীন নেতৃত্বাধীন এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) এরও সদস্য। উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ বেল্ট প্রস্তাব করা হয়েছে। উত্তর বেল্ট মধ্য এশিয়া, রাশিয়া এবং ইউরোপ এর মধ্য দিয়ে যাবে। কেন্দ্রীয় বেল্ট মধ্য এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া হয়ে পারস্য উপসাগর এবং ভূমধ্যসাগরে যাবে। দক্ষিণ বেল্ট চীন থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া মধ্য দিয়ে গিয়ে ভারত মহাসাগরে শেষ হবে। কেন্দ্রীয় বেল্ট জটিল ধর্ম সমস্যা ও বেল্ট বরাবর বিচ্ছেদ আন্দোলনের কারণে কম উচ্চারিত হয়ে আসছে।
উপকূলবর্তী সিল্ক রোড, যা "টুয়েন্টি-ফার্স্ট সেঞ্চুরি মেরিটাইম সিল্ক রোড" নামেও পরিচিত (চীনা ভাষায় 世纪 海上 丝绸之路 ) একটি পরিপূরক বিনিয়োগ যার লক্ষ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ওশেনিয়া, এবং উত্তর আফ্রিকায় বিভিন্ন জল-সংলগ্ন এলাকা – দক্ষিণ চীন সাগর, দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর, এবং ব্যাপকতর ভারত মহাসাগর এলাকার মাধ্যমে সহযোগিতা পরিবেষ্টন এবং লালন করা।[৭][৮][৯]
উপকূলবর্তী সিল্ক রোড উদ্যোগ ২০১৩ সালের অক্টোবরে ইন্দোনেশিয়ান পার্লামেন্টে বক্তৃতা দানকালে শি চিনফিং দ্বারা সর্বপ্রথম প্রস্তাবিত হয়।[১০] সিল্ক রোড অর্থনৈতিক বলয় উদ্যোগের মতো, এই এলাকার বেশিরভাগ দেশ চীন নেতৃত্বাধীন এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক যোগদান করেছে।
স্থানীয় বন্দর উন্নয়ন ও নাইরোবি এবং কাম্পালার মধ্যে একটি আধুনিক মান-গেজ রেললাইন নির্মাণের পর, পূর্ব আফ্রিকা, বিশেষত জানজিবার, মেরিটাইম সিল্ক রোডের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ গঠন করবে।
২০১৪ সালের মে মাসে, প্রধানমন্ত্রী লি খছিয়াং কেনিয়ার সরকারের সঙ্গে একটি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করতে কেনিয়া পরিদর্শন করেন। এই চুক্তির আওতায়, মোম্বাসা এবং নাইরোবির সংযোগকারী একটি রেলপথ লাইন নির্মাণ করা হবে। নির্মাণের পর, রেলপথটি প্রায় ২,৭০০ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তার করবে (১৬৭৭.৭০ মাইল) এবং প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে এতে।[১১][১২]
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে, চীন এর সিনোম্যাক, জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানির সঙ্গে একটি কৌশলগত, সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। সমঝোতা চুক্তিটি বায়ু টারবাইন গড়ে তুলা, পরিচ্ছন্ন শক্তি প্রোগ্রাম প্রচার করা, এবং সাব-সাহারান আফ্রিকায় শক্তি ভোক্তাদের সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করে।[১৩]
শি'আন জিয়াওতং বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একটি বিশ্ববিদ্যালয় জোট গবেষণা ও প্রকৌশলের মাধ্যমে ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড উদ্যোগকে সহায়তা করার লক্ষ্যে কাজ করছে। উদ্যোগটির সাথে সঠিক বোঝাপড়া বজায় রাখা এবং শিক্ষাগত বিনিময়ও এই জোটের উদ্দেশ্য।[১৪][১৫] নেটওয়ার্কটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের ঊর্ধ্বে প্রসারিত হয়ে একটি আইন স্কুল জোটকে অন্তর্ভুক্ত করেছে "আইনি উদ্দীপনা এবং আইনি সংস্কৃতির মাধ্যমে বেল্ট ও রোড উন্নয়নে সহায়ক হতে"।[১৬]
চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি) এবং বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার (বিসিআইএম) অর্থনৈতিক করিডোরকে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয় "বেল্ট ও রোড সূচনার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত"।[১৭] সংবাদ মাধ্যমে এই পার্থক্য অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং নেটওয়ার্কগুলো উদ্যোগের উপাদান হিসাবে গণনা করা হয়েছে। বিশেষত, গোয়াদার বন্দর সিপিইসি প্রকল্পে জটিল সমস্যা সৃষ্টি করলেও সিপিইসি প্রায়ই চীন সমুদ্র এবং স্থলপথে সিল্ক রোডের মধ্যে যোগসূত্র হিসাবে গণ্য করা হয়।
অক্টোবর, ২০১৩ সালে চীন দ্বারা প্রথম প্রস্তাবিত, এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক একটি উন্নয়ন ব্যাংক যা অবকাঠামো সংক্রান্ত প্রকল্পের জন্য ঋণদানে নিবেদিত। ২০১৫ সালের হিসাবে, চীন ঘোষণা করে যে এক ট্রিলিয়নের বেশি ইউয়ান (১৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) পরিকাঠামো প্রকল্পের পরিকল্পনা বা নির্মাণের খাতে ছিল।[১৮]
২০১৫ সালের ২৯ জুন বেইজিং এ এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক এর চুক্তির প্রবন্ধ, আইনি কাঠামো স্বাক্ষরিত হয়। প্রস্তাবিত বহুপাক্ষিক ব্যাংকের ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূলধন রয়েছে, যার ৭৫ শতাংশ এশীয় ও ওসেনিয়ান দেশ থেকে আসবে। চীন একক বৃহত্তম অংশীদার হবে, তাদের ভোটের অধিকার ২৬ শতাংশ অধিষ্ঠিত থাকবে। ব্যাংকটি বছরের শেষ নাগাদ অপারেশন শুরু করার পরিকল্পনা করছে।[১৯]
২০১৪ সালের নভেম্বরে, শি চিনফিং ৪০ বিলিয়ন ডলার উন্নয়ন তহবিল তৈরি করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেন, যা উদ্যোগের জন্য নির্মিত ব্যাংক থেকে আলাদা করা হবে। একটি তহবিল হিসাবে এটির ভূমিকা হবে প্রকল্পের জন্য ঋণ প্রদানের বদলে ব্যবসায় বিনিয়োগ করা। পাকিস্তানে কারোট জলবিদ্যুৎ স্টেশন, সিল্ক রোড ফান্ডের প্রথম বিনিয়োগ প্রকল্প।[২০] এবং এর চেয়ে অনেক বড় সিপিইসি এই বিনিয়োগের অংশ নয়।
জানুয়ারী ২০১৬ সালে সানশিয়া নির্মাণ কর্পোরেশন ইসলামাবাদ থেকে ৫০ কিলোমিটার (৩১.০৬ মাইল) দূরে কারোট জলবিদ্যুৎ স্টেশনের উপর কাজ শুরু করেন। এটি সিল্ক রোড তহবিলের প্রথম বিদেশী বিনিয়োগ প্রকল্প। চীনা সরকার ইতোমধ্যে জলবিদ্যুৎ স্টেশন অর্থায়ন করার জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে পাকিস্তানকে অন্তত ৩৫০ মিলিয়ন ডলার প্রদান করার অঙ্গীকার করেছে।[২১]
ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড উন্নয়ন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রধান দল ২০১৪ সালের শেষদিকে কোন এক সময়ে গঠন করা হয়, এবং তার নেতৃত্বদানকারী দল ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ তে প্রকাশ করা হয়। এই পরিচালনা কমিটি সরাসরি চীনের গণপ্রজাতন্ত্রী রাজ্য পরিষদকে সরাসরি প্রতিবেদন দেয় এবং বিভিন্ন শক্তিশালী রাজনৈতিক সঙ্ঘ নিয়ে গঠিত যা সরকারের নিকট এই কর্মসূচির গুরুত্বের প্রমাণ বহন করে।সহ-প্রধানমন্ত্রী ঝাং গাওলি কে প্রধান করে ৭ সদস্যের পলিটব্যুরো স্ট্যান্ডিং কমিটি গঠন করা হয় যার মধ্যে ওয়াং হানিং, ওয়াং ইয়াং, ইয়াং জিং, এবং ইয়াং চিয়ে ছি তাদেরকে উপনেতা হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।[২২]
২০১৪ সালের মার্চ মাসে, চীনের প্রধানমন্ত্রী লি খছিয়াং দেশটির আইনসভার বার্ষিক সভায় উপস্থাপিত তার সরকারের কাজের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর এবং চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর এর পাশাপাশি "ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড" উদ্যোগ ত্বরান্বিত করার আহ্বান জানান।
ফিচ রেটিং এর একটি প্রতিবেদনে সন্দেহ প্রকাশ করা হয় যে অনুন্নত ইউরেশিয়া এবং আফ্রিকায় বন্দর, সড়ক ও রেলপথ নির্মাণের জন্য চীনের এই পরিকল্পনার পিছনে পরিকাঠামোর জন্য বাস্তব চাহিদার বদলে রয়েছে রাজনৈতিক প্রেরণা। এছাড়াও ফিচ চীনের ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে দক্ষতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে কারণ নিজ দেশেই তারা দক্ষতার সাথে সম্পদ বন্টণে সুনাম বজায় রাখতে পারেনি। এর ফলে বেশিরভাগ অর্থায়ন যেখানে চীনা ব্যাংক থেকে আসার কথা, সেখানে নতুন সম্পদ মানের সমস্যা দেখা দিতে পারে।[২৩]
হংকংএর প্রধান নির্বাহী সি ওয়াই লিউং তার ২০১৬ পলিসি আড্রেস অব হংকং এর সময় একটি উপকূলবর্তী কর্তৃপক্ষ স্থাপনের জন্য তার উদ্দেশ্য ঘোষণা করেন যার লক্ষ্য হবে বেইজিং-এর অর্থনৈতিক নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে হংকং এর সামুদ্রিক সরবরাহ জোরদার করা।[২৪] লিউং তার পলিসি অ্যাড্রেসের সময় অন্তত ৪৮ বার "ওয়ান বেল্ট,ওয়ান রোড" এর কথা উল্লেখ করেন,[২৫] কিন্তু বিস্তারিত তথ্য খুব অল্প পরিমাণ উপস্থাপন করা হয়। এছাড়াও "ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড" এর সাথে সম্পর্কিত সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাগুলো মন্তব্যকারীদের এমন অভিযোগ করার দিকে চালনা করে যে এই পলিসি অ্যাড্রেস হংকং এর জনগণের জন্য অপ্রাসঙ্গিক কারণ এটা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর প্রতিনিধিত্ব করে না।[২৬][২৭] লিউং এর আপাত মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্বপ্রদান শি চিনফিংয়ের ধারণার একটি চাটুকার প্রচার হিসেবে দেখা হয়, এবং ব্যাপকভাবে ব্যঙ্গ করা হয়। টিভি মোস্ট (হংকং) এর উপস্থাপক, দোং ফং সিং (東方 昇), লিউং এর একটি ছবি যেখানে তিনি একটি ব্লাউজ পড়ে আছেন এবং একটি স্তন উন্মুক্ত, সেটি দেখিয়ে "ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড" এর পরিবর্তে একটি চীনা বুলি- "একটি আচ্ছাদিত, একটি উদ্ভাসিত" (一 戴 一 露) বলে লিউংকে ব্যঙ্গ করেন।[২৮] ওয়েন ওয়েই পো বলেন ছবিটি দ্বারা সিওয়াই লিউং এর ভয়াবহ রকমের সুনামহানি হয়েছিল, যা অশোভন হিসাবেই বিবেচিত।[২৯]