এক্লাম্পসিয়া(ইংরেজি: Eclampsia) প্রি-এক্লাম্পসিয়ায় আক্রান্তগর্ভবতী মহিলাদের খিঁচুনি হওয়াকে এক্লাম্পসিয়া বলে।[১] প্রি-এক্লাম্পসিয়া হলোগর্ভবতী মহিলাদের এমন এক রোগ যেখানে রক্তচাপ বেড়ে যায় এবং হয় প্রস্রাবেরসাথে প্রচুর প্রোটিন নির্গত হয় নতুবা অন্যান্য অঙ্গের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়।[৭][৮] এটা শুরু হতে পারে সন্তান প্রসবের পূর্বে, প্রসবের সময় বা এর পরে।[১] প্রায়শ এটা গর্ভাবস্থার দ্বিতীয়ার্ধে ঘটে।[১] টনিক-ক্লনিক ধরনের খিঁচুনি হয় যা প্রায় এক মিনিট স্থায়ী হয়।[১]
খিঁচুনির পরে সাধারণত চিত্তবিভ্রম বা গাঢ় নিদ্রাচ্ছন্নতা ঘটে।[১]
জটিলতাসমূহের মধ্যে রয়েছে অ্যাসপিরেশন নিউমোনিয়া,মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ,বৃক্কীয় অক্ষমতা,হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধহয়ে যাওয়া ইত্যাদি। [১] গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপজনিত অনেক রোগরয়েছে, এক্লাম্পসিয়া ও প্রি-এক্লাম্পসিয়া তারই অংশ।[১]
উচ্চ ঝুঁকিতে যারা রয়েছে তাদের অ্যাসপিরিন খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়, এছাড়া পরিপূরক খাদ্য হিসেবে ক্যালসিয়াম খাওয়া, পূর্ববর্তী উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা করার মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ করার সুপারিশ করা হয়।[২][৩] গর্ভাবস্থায় শারীরিক ব্যায়াম কিছুটা উপকারী হতে পারে।[১] শিরাপথে বা মাংসপেশিতে ম্যাগনেশিয়াম সালফেটের ব্যবহার এক্লাম্পসিয়াতে ফলদায়কও নিরাপদ।[৪][৯] এটা উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয়দেশের জন্যই সত্য।[১] অন্যান্য চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ যেমন হাইড্রালাজিনের প্রয়োগ ও জরুরি ভিত্তিতে যোনিপথে বা সিজারিয়ান সেকশন অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বাচ্চা প্রসব করানো।[১]
প্রি-এক্লাম্পসিয়া হয় ৫% ক্ষেত্রে ও এক্লাম্পসিয়া হয় প্রায় ১.৪% ক্ষেত্রে।[৫]
উন্নত বিশ্বে উন্নত চিকিৎসাসেবার কারণে এর হার অনেক কম। সেখানে প্রায় প্রতি ২০০০ সন্তান প্রসবে একবার এই ঘটনা ঘটে।[১] গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপজনিত রোগই হল গর্ভকালীন মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। [১০] ২০১৫ সালে এই রোগে প্রায় ৪৬,৯০০ জনের মৃত্যু হয়।[৬] এক্লাম্পসিয়ায় আক্রান্ত মহিলাদের মধ্যে প্রায় এক শতাংশ মৃত্যুবরণ করে।[১] এক্লাম্পসিয়া শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক ভাষা থেকে সেখানে এর অর্থ বিজলি চমক বা বজ্র।[১১] খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীতে হিপোক্রেটিস প্রথম এই রোগের বর্ণনা দেন।[১১]
এক্লাম্পসিয়া গর্ভকালীন একটি সমস্যা যেখানে প্রি-এক্লাম্পসিয়ায় আক্রান্তগর্ভবতী মায়েদের খিঁচুনি হয়।[১২] সাধারণত খিঁচুনির পূর্বে গর্ভবতী মহিলাদের উচ্চ রক্তচাপওপ্রোটিনিউরিয়া(প্রসাবের মাধ্যমে প্রোটিন বের হওয়া) হয়।[১৩]
দীর্ঘস্থায়ী(অবিরাম) মাথাব্যথা।
চোখে ঝাপসা দেখা।
ফটোফোবিয়া (অর্থাৎ উজ্জ্বল আলোতে অস্বস্তি)
পেটব্যথা
হয় এপিগ্যাস্ট্রিক অঞ্চলে (নাভির উপরে উদরের মধ্যভাগ)
এবং/অথবা ডানদিকের ঊর্ধ্ব চতুর্থাংশে বা ডানদিকের বক্ষপিঞ্জরের নিচে
পরিবর্তিত মানসিক অবস্থা(চিত্তবিভ্রম)
এই উপসর্গগুলোর যেকোনোটি খিঁচুনির পূর্বে বা পরে ঘটতে পারে।[১৪]
আবার এগুলোর কোনোটিই ঘটবে না এমনও হতে পার।
অন্যান্য মস্তিষ্কের লক্ষণসমূহ যেমন বমনেচ্ছা, বমন, মাথাব্যথা ও অন্ধত্ব ঠিক খিঁচুনির পূর্বমুহূর্তে হতে পারে। বিভিন্ন অঙ্গের কার্যক্ষমতানষ্ট হলে আরো অনেক লক্ষণ প্রকাশ পায় যেমন পেটব্যথা, জন্ডিস, ঘনঘন শ্বাস ও প্রস্রাবের পরিমাণ হ্রাস পাওয়া।
এক্লাম্পসিয়ার খিঁচুনি সাধারণত গর্ভকালীন ও সন্তান প্রসবের পূর্বে হয়ে থাকে তবে তা প্রসববেদনা ও প্রসবের সময় বা সন্তান প্রসবের পরেও হতে পারে।[১২][১৪][১৫] যদি সন্তান প্রসবের পরে খিঁচুনি হয় তাহলে তা সাধারণত প্রসবের প্রথম ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হয় তবে কখনো কখনো তা সন্তান প্রসবের ৪ সপ্তাহ পরেও হতে পারে।[১২][১৪]
এক্লাম্পসিয়ার ক্ষেত্রে গর্ভধারিণী মা ও গর্ভস্থ সন্তান উভয়েরই ঝুঁকি থাকে।এক্লাম্পসিয়ায় আক্রান্ত মায়েদের গর্ভের সন্তান স্বাভাবিকের তুলনায় ধীর গতিতে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় ফলে সন্তান গর্ভধারণ সময়ের তুলনায় আকারে ছোট হয় অথবা কম ওজন নিয়ে জন্মায়।[১৬] এক্লাম্পসিয়াতে অমরা বা গর্ভফুলেও সমস্যা হয়।গর্ভফুল হতে রক্তক্ষরণ হতে পারে অথবা এটা জরায়ু প্রাচীর হতে পৃথক হওয়া শুরু হতে পারে।[১৭] সন্তান প্রসবের সময় গর্ভফুল জরায়ু প্রাচীর হতে আলাদা হয়ে যাওয়া একটি স্বাভাবিক ঘটনা কিন্তু প্রসবের পূর্বে গর্ভফুল খসে পড়া অস্বাভাবিক এবং গর্ভস্থ সন্তানের জন্য খুব ঝুঁকিপূর্ণ।[১৮] এই রোগে গর্ভফুলের রক্তসরবরাহ কমে যাওয়ার কারণে ভ্রূণে অক্সিজেন ও পুষ্টির ঘাটতি হয় ফলে ভ্রূণের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।[১৭] খিঁচুনির সময় ভ্রূণের হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিকের চেয়ে মন্থর হয়ে যায়।[১৬][১৯] এই জটিলতাগুলোর যেকোনোটি ঘটলে তা ভ্রূণের জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়।যদি ভ্রূণ বা মায়ের স্বাস্থ্য ঝুঁকি অনেক বেশি হয় তাহলে ৪০ সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা না করে দ্রুত বাচ্চা প্রসব করানো নিরাপদ হতে পারে।[১৭][২০]
এক্লাম্পসিয়ার ফলে মায়েদের দৃষ্টিশক্তির সমস্যা হয় যেমন চোখে ঝাপসা দেখা, এক চোখ অন্ধ হওয়া বা উভয় চোখে স্থায়ী অন্ধত্ব।[২১][২২]
ফুসফুসেও সমস্যা হয়। ধীরে ধীরে ফুসফুসে পানি জমা হতে থাকে যেটি পালমোনারি ইডিমা নামে পরিচিত।[১৭] খিঁচুনির সময় পাকস্থলীয় খাদ্যাংশ বমি হয়ে বের হওয়ার সময় কিছু অংশ ফুসফুসে প্রবেশ করতে পারে। এটি পালমোনারি অ্যাস্পিরেশন নামে পরিচিত।[১৬] অ্যাস্পিরেশন হলে শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হতে পারে বা পরে ফুসফুসে সংক্রমন হতে পারে যাকে অ্যাস্পিরেশন নিউমোনিয়া বলে।[১৪][২৩] এমনও সম্ভব যে খিঁচুনির সময় শ্বাস সময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যাবে বা অপর্যাপ্ত হবে এবং রোগিণীর শরীর ও মস্তিষ্কে অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দিবে যা হাইপোক্সিয়া নামে পরিচিত।[১৪][২৪]
শ্বাস নিতে কষ্ট হলে সাময়িকভাবে সহায়ক যন্ত্রপাতির সাহায্যে কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রয়োজন হতে পারে যেই প্রক্রিয়াটি মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশন বা যান্ত্রিক শ্বাস-প্রশ্বাস নামে পরিচিত।পরিস্থিতি আরো জটিল হলে মা দুর্বল ও নিশ্চেষ্ট এমনকি গাঢ় নিদ্রাচ্ছন্ন হতে পারে[২২] যা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা সেরিব্রামের স্ফীতির লক্ষণ।[১৭][২২]
এক্লাম্পসিয়ার ঝুঁকি কমানোর জন্য সঠিক সময়ে প্রি-এক্লাম্পসিয়া রোগ শনাক্ত করা ও এর যথাযথ চিকিৎসা জরুরি।গর্ভধারণের পুরো সময়টা নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপ করা প্রয়োজন।.[২৫]
↑ কখAbalos, E; Cuesta, C; Grosso, AL; Chou, D; Say, L (সেপ্টেম্বর ২০১৩)। "Global and regional estimates of preeclampsia and eclampsia: a systematic review."। European journal of obstetrics, gynecology, and reproductive biology। 170 (1): 1–7। ডিওআই:10.1016/j.ejogrb.2013.05.005। পিএমআইডি23746796।
↑McDonald, SD; Lutsiv, O; Dzaja, N; Duley, L (আগস্ট ২০১২)। "A systematic review of maternal and infant outcomes following magnesium sulfate for pre-eclampsia/eclampsia in real-world use."। International journal of gynaecology and obstetrics: the official organ of the International Federation of Gynaecology and Obstetrics। 118 (2): 90–6। ডিওআই:10.1016/j.ijgo.2012.01.028। পিএমআইডি22703834।
↑Arulkumaran, N.; Lightstone, L. (ডিসেম্বর ২০১৩)। "Severe pre-eclampsia and hypertensive crises"। Best Practice & Research Clinical Obstetrics & Gynaecology। 27 (6): 877–884। ডিওআই:10.1016/j.bpobgyn.2013.07.003। পিএমআইডি23962474।
↑ কখগঘঙGabbe MD, Steven G. (২০১৭)। "Chapter 31: Preeclampsia and Hypertensive Disorders"। Obstetrics : Normal and Problem Pregnancies। Jennifer R. Niebyl MD, Joe Leigh Simpson MD, Mark B. Landon MD, Henry L. Galan MD, Eric R.M. Jauniaux MD, PhD, Deborah A. Driscoll MD, Vincenzo Berghella MD and William A. Grobman MD, MBA (Seventh সংস্করণ)। Philadelphia, PA: Elsevier, Inc.। পৃষ্ঠা 661–705। আইএসবিএন9780323321082। ওসিএলসি951627252।
↑Cunningham, F. Gary (২০১৪)। "Chapter 40: Hypertensive Disorders"। Williams Obstetrics। Leveno KJ, Bloom SL, Spong CY, Dashe JS, Hoffman BL, Casey BM, Sheffield JS. (24th সংস্করণ)। New York: McGraw-Hill Education। আইএসবিএন9780071798938। ওসিএলসি871619675।
↑ কখগJames, David K. (২০১১)। "Chapter 48: Neurologic Complications of Preeclampsia/Eclampsia"। High Risk Pregnancy। Steer, Philip J. (4th সংস্করণ)। St. Louis, MO: Saunders/Elsevier। পৃষ্ঠা 861–891। আইএসবিএন9781416059080। ওসিএলসি727346377।
↑Sperling, Jeffrey D.; Gossett, Dana R. (২৫ এপ্রিল ২০১৭)। "Screening for Preeclampsia and the USPSTF Recommendations"। JAMA। 317 (16): 1629। ডিওআই:10.1001/jama.2017.2018।