এদির্নে প্রাসাদ | |
---|---|
Edirne Sarayı | |
বিকল্প নাম | নতুন সাম্রাজ্যিক প্রাসাদ উসমানীয় তুর্কি: Saray-ı Cedid-i Amire |
সাধারণ তথ্যাবলী | |
অবস্থা | বিধ্বস্ত |
ধরন | ১৪৭৫–১৭১৮ প্রাসাদ, ১৭১৮–১৭৬৮ খালি, ১৭৬৮–১৮২৮ প্রাসাদ, ১৮২৯ রুশ ক্যাম্প |
স্থাপত্যশৈলী | উসমানীয় |
অবস্থান | এদির্নে, তুরস্ক |
ঠিকানা | সারায়িচি |
স্থানাঙ্ক | ৪১°৪১′২৮″ উত্তর ২৬°৩৩′১৯″ পূর্ব / ৪১.৬৯১১১° উত্তর ২৬.৫৫৫২৮° পূর্ব |
নির্মাণ শুরু | ১৪৫০ |
সম্পূর্ণ | ১৪৭৫ |
সংস্কার | ১৮৬৮–১৮৭৩ |
ভগ্নপ্রাপ্ত | ১৭৫২ ভূমিকম্প ১৭৭৬ আগুন ১৮৭৮ বিস্ফোরণ |
গ্রাহক | উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান |
কারিগরী বিবরণ | |
কাঠামো ব্যবস্থা | উঠান, প্যাভিলিয়ন এবং বাগান ঘিরে বিভিন্ন ভবন |
আকার | ৩০–৩৫ হেক্টর (৭৪–৮৬ একর) |
এদির্নে প্রাসাদ (তুর্কি: Edirne Sarayı) উসমানীয় সুলতানদের একটি রাজকীয় প্রাসাদ ছিল, যা এদির্নে শহরে অবস্থিত। এটি পূর্বে নতুন রাজকীয় প্রাসাদ (উসমানীয় তুর্কি: Saray-ı Cedid-i Amire) নামে পরিচিত ছিলো । শহরটি তখনকার সময়ে উসমানীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। প্রাসাদের কয়েকটি ভবন এখনও টিকে আছে, তবে পুনর্নির্মাণ কাজ চলছে।
এই প্রাসাদটি শহরের উত্তর দিকে টুঞ্চা নদীর পশ্চিম তীরে একটি শিকার ক্ষেত্র এবং বনভূমির ওপর নির্মিত হয়েছিল, যা ৩০–৩৫ হেক্টর (৭৪–৮৬ একর) ভূমি জুড়ে বিস্তৃত। প্রাসাদটির নির্মাণ কাজ ১৪৫০ সালে সুলতান দ্বিতীয় মুরাদের (শা. ১৪২১–১৪৪৪, ১৪৪৬–১৪৫১) শাসনকালে শুরু হয়েছিল, কিন্তু সুলতান মুরাদের মৃত্যুর পর কাজ বন্ধ হয়ে যায়। কিছু সময় পর কাজ পুনরায় শুরু হয় এবং এটি ১৪৭৫ সালে সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ (শা. ১৪৪৪–১৪৪৬, ১৪৫১–১৪৮১) দ্বারা সম্পন্ন হয়। পরবর্তী বছরগুলোতে, প্রাসাদটি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় এবং সুলতান সুলাইমান (শা. ১৫২০–১৫৬৬), প্রথম আহমেদ (শা. ১৬০৩–১৬১৭), চতুর্থ মুহাম্মদ (শা. ১৬৪৮–১৬৮৭), দ্বিতীয় আহমেদ (শা. ১৬৯১–১৬৯৫) এবং তৃতীয় আহমেদ (শা. ১৭০৩–১৭৩০)-এর শাসনামলে নতুন ভবন সংযোজনের মাধ্যমে সম্প্রসারিত করা হয়।[১][২][৩]
১৭১৮ সালে সুলতান তৃতীয় আহমেদ তার রাজসিংহাসন ইস্তাম্বুল স্থানান্তর করলে প্রাসাদটি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে। ১৭৬৮ সালে সুলতান মুস্তফা তৃতীয় (শা. ১৭৫৭–১৭৭৪) শহরে ফিরে না আসা পর্যন্ত প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে প্রাসাদটি ফাঁকা অবস্থায় ছিল। এই দীর্ঘ সময়ের অবহেলার ফলে প্রাসাদটি ক্ষয়প্রাপ্ত হতে শুরু করে। এর সাথে ১৭৫২ সালের ভূমিকম্প এবং ১৭৭৬ সালের শহরের আগুনও ধ্বংসে অবদান রাখে।
১৮২৫ সালে, সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ (শা. ১৮০৮–১৮৩৮) প্রাসাদের কিছু অংশ মেরামত করেন। কিন্তু ১৮২৯ সালে এদির্নে দখলকারী রুশ বাহিনী এটিকে সামরিক শিবির হিসেবে ব্যবহার করায় প্রাসাদটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৮৬৮ থেকে ১৮৭৩ সালের মধ্যে, তৎকালীন শহরের গভর্নরগণ প্রাসাদ কমপ্লেক্সের অনেক ভবন পুনরুদ্ধার করেন।
অবশেষে, ১৮৭৭-৭৮ সালের রুশ-তুর্কি যুদ্ধের সময় রুশ বাহিনী শহরের কাছাকাছি চলে আসার আশঙ্কায়, এদির্নের গভর্নরের আদেশে নিকটবর্তী একটি গোলাবারুদের গুদাম উড়িয়ে দেওয়া হলে প্রাসাদটি ব্যাপকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।[২][৩] পরে ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাসাদের স্থাপত্য উপাদানগুলো বিভিন্ন স্থানে ব্যবহারের জন্য লুট করে নেওয়া হয়।[১]
অতীতের কিছু ছবি উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাহসেহির বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ মুস্তাফা ওজার, যিনি এই খনন কাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এই ছবিগুলো প্রাসাদ কমপ্লেক্স ধ্বংস হওয়ার আগে তোলা হয়েছিল। ধারণা করা হয় যে রুশ আলোকচিত্রী দিমিত্রি ইয়ারমাকভ (১৮৪৬–১৯১৬), যিনি ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী ১৮৭৭-৭৮ সালের রুশ-তুর্কি যুদ্ধে সেনাবাহিনীর মানচিত্র প্রণেতা হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন, ১৮৭০-এর দশকে গোয়েন্দাগিরির উদ্দেশ্যে এদির্নে শহর পরিদর্শন করেন এবং শহরের প্রতিটি রাস্তার ছবি তোলেন। পুনর্নির্মাণ ও পুনঃস্থাপনের কাজে এই প্রাসাদের ছবিগুলোর গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি বলে ওজার উল্লেখ করেছেন এবং তার বিশ্বাস যে আরও অনেক ছবি এখনও আবিষ্কার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।[৪]
প্যালেস কমপ্লেক্সে ৭২টি আলাদা ভবন ছিল, যাতে ১১৭টি কক্ষ, ১৪টি প্রাসাদ, ১৮টি গোসলখানা, ৮টি মসজিদ এবং ১৭টি প্রবেশদ্বার ও ১৩টি ভূগর্ভস্থ কক্ষ অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর শিখর সময়ে প্রায় ৩৪,০০০ মানুষ এই প্যালেস এলাকার মধ্যে বসবাস করত, যাদের সেবা করত প্রায় ৬,০০০ জন কর্মচারী।[২][৩]
প্রাসাদের মূল ভবনকে "জিহান্নুমা কাস্রি" (আক্ষরিক অর্থে: প্যানোরামিক প্রাসাদ) বলা হত, যা "তখ্ত-ই হুমায়ুন" (আক্ষরিক অর্থে: সম্রাটের সিংহাসন) নামেও পরিচিত ছিল। এই ভবনটিতে সুলতানের কক্ষ, পতাকা কক্ষ, গ্রন্থাগার, মসজিদ এবং অন্যান্য কক্ষ ছিল। প্রাসাদের দক্ষিণে চতুর্থ মুহাম্মদ, দ্বিতীয় মুস্তাফা এবং তৃতীয় আহমেদের জন্য তিনটি সংযুক্ত প্রাসাদ নির্মিত হয়েছিল। এই ভবনগুলির সাথে মিল রেখে ছিল হেরেম কক্ষসমূহ, যা ওয়ালিদায়ে সুলতান (সুলতানের মা), চার জন সুলতান পত্নী, শেহজাদে (রাজপুত্রগণ), কারিয়ে (দাসী), কর্মকর্তাগণ ও রক্ষীদের জন্য নির্ধারিত ছিল। এছাড়াও সেখানে একটি হাসপাতাল ও একটি অভ্যর্থনা কক্ষ ছিল। পশ্চিমে, অভ্যর্থনা কক্ষের সামনের দিকে "সৌভাগ্যের গেট" ("বাব উস-সা'দে") বা "শ্বেত আঘা গেট" ("আক আগালার কাপিসি") অবস্থিত ছিল।[১]
প্রাসাদের চারপাশের এলাকাটি গঠন করার কাজটি দ্বিতীয় বায়েজীদ (শা. ১৪৮১–১৫১২) শুরু করেন। তিনি টুঙ্কা নদীর তলদেশে পাথর বসিয়ে নদীর তীরে বাঁধ নির্মাণ করেন। এরপর সুলতান সুলাইমান ও তার প্রধান স্থপতি মিমার সিনান (আনু. ১৪৮৯/১৪৯০–১৫৮৮) এর নেতৃত্বে এদির্নে প্রাসাদে যেন একটি দ্বিতীয় কাঠামোগত যুগের সূচনা ঘটে। এই সময়ে প্যালেসটির পুনর্নকশা করা হয়, ল্যান্ডস্কেপের টপোগ্রাফি পুনর্বিন্যাস করা হয় এবং পানির সরবরাহের সমস্যা সমাধান করা হয়।
মিমার সিনান তাসলিমুসেলিম গ্রামের একটি জলাধার থেকে এদির্নে নিয়ে আসা পানির মাধ্যমে প্যালেসে প্রবাহিত পানির ব্যবস্থা করেন। প্রাসাদটি বন্যার হাত থেকে রক্ষার জন্য পানি সরবরাহকারী খালটি প্রাসাদের চারপাশে একটি বৃত্তাকার খিলানের আকারে নির্মাণ করা হয়, যা সারাচানে সেতুর কাছে টুঙ্কা নদীর সাথে যুক্ত ছিল। টুঙ্কা নদী এবং সরবরাহকারী খাল প্যালেস এলাকাকে ঘিরে রাখায় একটি প্রতিরক্ষামূলক প্রাচীরের প্রয়োজন হয়নি।[১]
পরবর্তী সময়ে আরও কিছু স্থাপনা যুক্ত করা হয়, যার মধ্যে চতুর্থ মুরাদ (শা. ১৬২৩–১৬৪০) কর্তৃক নির্মিত ইমাদিয়ে প্রাসাদ এবং চতুর্থ মুহাম্মদ (শা. ১৬৪৮–১৬৮৭) কর্তৃক নির্মিত শোভাযাত্রা প্রাসাদ, ইফতার লজ, শিকার (বুলবুল) লজ এবং মালী লজ অন্তর্ভুক্ত ছিল।[১]
বিশেষ করে ২০০১ সালে, প্রাসাদের ফটক "বাব উস-সা'দে" এবং "রিসেপশন হল" স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক কাজ শুরু হয়। জাতীয় প্রাসাদ প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় এই পুনরুদ্ধারের কাজ ২০০৪ সালে সম্পন্ন হয়। অনুমান করা হচ্ছে যে পুরো প্রাসাদ ভবনটি আন্তর্জাতিক কংগ্রেস কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য পুনরুদ্ধার করা হবে।[১]
চিহান্নুমা প্রাসাদ এর স্থাপত্যের কারণে এটি প্রাসাদ কমপ্লেক্সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি ১৪৫০-১৪৫১ সালে নির্মিত হয় এবং সাততলা বিশিষ্ট একটি ভবন যার উপরে একটি অষ্টভুজাকার কক্ষ রয়েছে। এতে "রাজকীয় রুম", পতাকা ঘর, গ্রন্থাগার এবং মসজিদ অন্তর্ভুক্ত ছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় এবং বাহিরের একটি সিঁড়ি আব্দুল আজিজ (শাসনকাল ১৮৬১-১৮৭৬) দ্বারা যোগ করা হয়। এই স্থানে প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ ১৯৫৬ সালে সম্পন্ন হয়।[১]
২০০০ সালে বালি প্রাসাদ হামাম (শব্দার্থে: বালুকা প্রাসাদ স্নানাগার) এবং এর আশেপাশে প্রত্নতাত্ত্বিক কাজ পরিচালিত হয়, যেখানে একটি জল সরবরাহ ব্যবস্থার অস্তিত্ব উদঘাটিত হয়। সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ কর্তৃক নির্মিত এই সরল স্নানাগারটিতে তিনটি স্নানখণ্ড রয়েছে — "সিজাকলিক" (ক্যালডারিয়াম), "ইলিকলিক" (টেপিডারিয়াম) এবং "সোগুকলিক" (ফ্রিজিডারিয়াম)—যা তিনটি ছোট গম্বুজের নিচে অবস্থিত, এক প্রান্তে একটি ইওয়ান সহ। স্নানাগারটি প্রাসাদের সাথে একটি পথচারী পথের মাধ্যমে সংযুক্ত ছিল।[১]
মূল প্রাঙ্গণের দক্ষিণে "মাতবাহ-আমির" (শব্দার্থে: রাজকীয় রান্নাঘর) অবস্থিত ছিল। এটি একটি দীর্ঘায়ত আয়তাকার নকশার ভবন, যা আটটি গম্বুজের নিচে বিস্তৃত। ভবনের উত্তর অংশের বেশিরভাগ অংশ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।[১] বর্তমান সময়ে এই ভবনটি পুনরুদ্ধার করা হয়েছে।[২]
"বিচারের প্রাসাদ" (শব্দার্থে: ন্যায় প্রাসাদ) ১৫৬১ সালে সুলাইমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট দ্বারা নির্মিত হয়, যাকে তুরস্কে "সুলাইমান আইন প্রণেতা" নামেও পরিচিত। এটি প্রাসাদ কমপ্লেক্সের একমাত্র স্থাপনা যা অক্ষত অবস্থায় রয়ে গেছে। এটি একটি আয়তাকার টাওয়ারের আকারে তৈরি, যার উপরে একটি সূচালো ধাতব ছাদ রয়েছে। এটি টুনসা নদীর উপর অবস্থিত ক্ষুদ্র ফাতিহ ব্রিজের পাশে অবস্থিত, যা ১৪৫২ সালে সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ দ্বারা নির্মিত হয়। ভবনের সামনে এখনো দুটি পাথরের স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে। ডান দিকের স্তম্ভটি "সম্মান পাথর" (তুর্কি: সেং-ই হুরমেত) নামে পরিচিত, যা জনগণের পিটিশন বা আবেদন সুলতানের কাছে পৌঁছানোর জন্য ব্যবহৃত হতো। আর বাম দিকের স্তম্ভ, "সতর্কতা পাথর" (তুর্কি: সেং-ই ইব্রেত), যেখানে অপরাধীদের শিরশ্ছেদ করা মাথা প্রদর্শিত হতো।[১][৩]
তুর্কিতে "কানুনি" নামে পরিচিত সুলতান সুলাইমানেল নামে নামকরণ করা এই কানুনি সেতু টুনসা নদীর উপর অবস্থিত এবং প্রাসাদের বাগানকে শহরের সঙ্গে সংযুক্ত করে।[৩] এটি ১৫৫৩-১৫৫৪ সালে নির্মিত হয় এবং ৬০ মি (২০০ ফু) লম্বা, যার মধ্যে চারটি খিলান রয়েছে।[১]
কুম প্রাসাদ হাম্মামের উত্তর-পূর্ব দিকে একটি নামাজগাহ বা প্রার্থনা মঞ্চ অবস্থিত, যা ১৬শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে নির্মিত হয়েছিল। মিহরাবের পেছনে একটি ফোয়ারা রয়েছে।[১]
মুহাম্মাদ দ্য হান্টার নামেও পরিচিত চতুর্থ মুহাম্মাদ কর্তৃক ১৬৭১ সালে নির্মিত এই শিকার (বুলবুল) লজ আংশিকভাবে অক্ষত রয়েছে। ২০০২ সালে পুনরুদ্ধারের পর এটি আজকের দিনে ব্যবহার করা হচ্ছে।[১]
বাল্কান যুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ কবরস্থান প্রাসাদ কমপ্লেক্সের এলাকার ঠিক পূর্বে অবস্থিত।