এলি কোহেন | |
---|---|
জন্ম | এলিয়াহু বেন-শওল কোহেন ২৬ ডিসেম্বর ১৯২৪ |
মৃত্যু | ১৮ মে ১৯৬৫ | (বয়স ৪০)
জাতীয়তা | ইসরায়েলী |
দাম্পত্য সঙ্গী | নাদিয়া মাজাল্ড |
সন্তান | সোফি, ইরিত, শাই |
এলিয়াহু বেন-শওল কোহেন (হিব্রু: אֱלִיָּהוּ בֵּן שָׁאוּל כֹּהֵן, আরবি: إيلي كوهين; ২৬ শে ডিসেম্বর ১৯২৪ - ১৮ মে ১৯৬৫), বা এলি কোহেন ছিলেন একজন ইসরায়েলী গুপ্তচর। সিরিয়াতে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য কোহেন সমধিক পরিচিত, যেখানে তিনি ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক ও সামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর প্রধান উপদেষ্টা পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন।
কিন্তু সিরিয়ার প্রতি-গোয়েন্দাবৃত্তির (কাউন্টার-ইন্টেলিজ্যান্স) দল অবশেষে তার গোয়েন্দা কার্যক্রম উন্মোচিত করে এবং তাকে গ্রেপ্তার করে দোষী সাব্যস্ত করার মাধ্যমে সামরিক আইনে ১৯৬৫ সালে কোহেনের ফাঁসি দন্ডাদেশ কার্যকর করে। ধারণা করা হয় যে, গ্রেপ্তারের পূর্বে কোহেনের জোগাড় করা গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্যগুলো ইসরায়েল কে ছয় দিনের যুদ্ধে সাফল্য এনে দিয়েছিল।[১]
১৯২৪ সালে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে এক ধর্মপ্রাণ জায়নবাদি ইহুদি পরিবারে এলি কোহেনের জন্ম হয়। মূলত তার পিতা ১৯১৪ সালে সিরিয়ার আলেপ্পো শহর ছেড়ে মিশরে এসেছিলেন। এলি কোহেন ১৯৪৭ সালের দিকে মিশরের সেনাবাহিনী তে দাপ্তরিক কাজে যোগদান করেন, কিন্তু আনুগত্যের প্রশ্নে সন্দেহভাজন হওয়ায় সেনাবাহিনীতে কোহেন অযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। ইহুদি হওয়ার দরুণ মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যদের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়ে কোহেন এর পরের বছর মানে ১৯৪৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করে ঘরে অধ্যয়নের সিদ্ধান্ত নেন।
সেই বছরেই ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর অনেক ইহুদি পরিবার মিশর ছেড়ে দেশান্তরিত হয়ে ইসরায়েলে যেতে শুরু করে। তার পিতা-মাতাও এর পরের বছর ১৯৪৯ সালে ইসরায়েলে চলে যায়। কিন্তু ইলেকট্রনিক্সের উপর তার ডিগ্রি শেষ না হওয়ায় এবং মিশরের ইহুদিদের সাহায্য ও তার জায়নবাদী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তিনি মিশরে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এর দু'বছর পর ১৯৫১ সালে মিশরে সামরিক অভ্যুত্থানের সময় সারা দেশে জায়নবাদ-বিরোধী অভিযান শুরু হলে এলি কোহেন গ্রেপ্তার হন এবং তার জায়নবাদী কার্যক্রমের জন্য তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন করা হয়।[২] ১৯৫০ এর দিকে মিশরে থাকাকালীন সময়ে এলি কোহেন মোসাদের গোপন গোশান অভিযানে জড়িত ছিলেন, যার উদ্দেশ্য ছিল মূলত অত্যাচারের শিকার হওয়া সংখ্যালঘু মিশরীয় ইহুদিদের মিশর থেকে বের করে এনে ইসরায়েলে নিয়ে আসা। দোষী সাব্যস্ত করলেও মিশরীয় কর্তৃপক্ষ মোসাদের এই গোপন অভিযানে কোহেনের জড়িত থাকার কোন প্রমাণ দেখাতে পারে নি।
এছাড়াও মিশরের সাথে পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পর্ক খারাপ করার জন্য মোসাদ মিশরীয়-ইহুদিদের ব্যবহার করে ১৯৫৪ সালে যে আত্মঘাতি সুসান অভিযান পরিচালনা করে, সেখানেও কোহেনের নাম জড়িত ছিলেন বলে সন্দেহ করা হয়, যদিও এটাতেও মিশরীয় কর্তৃপক্ষ অভিযানে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের সাথে কোহেনের জড়িত থাকার কোন প্রমাণ প্রতিপাদন করতে পারে নি।[২]
পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে সুয়েজ সংকট নামক দ্বিতীয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে মিশরের সরকার তাদের দেশের ইহুদিদের উপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে তুলে এবং অনেক ইহুদিদের নাগরিকত্ব বাতিল করে তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করে। সেই সময় এলি কোহেন-কেও মিশর ছাড়তে বাধ্য করা হয়। সেই সময় ইহুদি সংস্থার সহায়তায় ইতালির নেপলস শহর দিয়ে হাইফা বন্দরে এসে কোহেন অবশেষে ইসরায়েলে পদার্পণ করেন।[২][৩] এরপর ১৯৫৭ সালে কর্মস্থল হিসেবে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে তিনি যোগদান করেন এবং ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা শাখায় "প্রতি-গোয়েন্দা বিশ্লেষক (কাউন্টার-ইন্ট্যালিজেন্স অ্যানালাইসিস)" হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু এই কাজে আগ্রহ হারিয়ে কোহেন বরং মোসাদে ঢুকার চেষ্টা করেন। কিন্তু মোসাদ কর্তৃক প্রতাখ্যাত হওয়ায় তিনি রুষ্ট হন এবং সেনাবাহিনীর হয়ে প্রতি-গোয়েন্দা বিশ্লেষণ কাজেও ইস্তফা দেন। এর পরের দুই বছর তেল আবিবের একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীতে কোহেন কেরানী হিসেবে চাকরি করেন। ১৯৫৯ সালে কোহেন উদারপন্থী লেখক সামি মাইকেলের বোন "নাদিয়া মাজাল্ড" নামক এক ইরাকি-ইহুদি নারীকে বিয়ে করেন। নাদিয়ার সাথে এলি কোহেনে "সোফি", "ইরিত" আর "শাই" নামের ৩ টি সন্তান আছে[৪] এবং বিয়ের পর কোহেন-পরিবার তেল আবিব শহরের দক্ষিণে বাত ইয়াম শহরে বসবাস করতে শুরু করে।
তৎকালীন মোসাদ প্রধান ডাইরেক্টর-জেনারেল মেইর আমিত এমন বিশেষ কাউকে খুঁজছিলেন, যিনি সিরিয়ার সরকারি কাজে গুপ্তপ্রবেশ করে সেখানকার গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্য মোসাদকে জোগাড় করে এনে দেবে। এই বিশেষ গোপন গোয়েন্দা অভিযানের জন্য কাউকে উপযুক্ত মনে না হওয়ার পর মেইর আমিত শেষে পুরোনো ফাইল ঘেঁটে বাতিল হওয়া মোসাদে চাকরি প্রার্থীদের মধ্য থেকে এলি কোহেনকে আবিষ্কার করেন। এই বিশেষ অভিযানের জন্য কোহেন আসলেই উপযুক্ত কিনা তা দেখার জন্য প্রায় দু'সপ্তাহ ধরে তাকে নজরদারী এবং প্রাক-প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। সব কিছু ঠিক মনে হওয়ার পর কোহেন কে জানানো হয় যে, তিনি এই অভিযানের জন্য উপযুক্ত এবং তাকে পরবর্তী ছয় মাস মোসাদের নিজস্ব ট্রেনিং স্কুলে যেতে হবে। ট্রেনিং শেষে তার স্নাতক রিপোর্ট তাকে কাত্সা বা "ফিল্ড এজেন্ট" হওয়ার জন্য পুরোপুরী উপযুক্ত বলে বিবেচিত করে।[৩][৫]
প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর পরিশেষে গোপন মিশনে নামানোর জন্য "আর্জেন্টিনা ফেরত প্রবাসী সিরিয়ান ব্যবসায়ী" হিসেবে তাকে একটি ভূঁয়া পরিচয় প্রদান করা হয়। এমনকি তার এই ভূঁয়া ব্যবসায়ী পরিচয়টিকে নিখুঁত বানানোর জন্য ১৯৬১ সালে তাকে আর্জেন্টিনাতেও প্রেরণ করা হয়।[৬][৭]
কোহেন ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে "কামেল আমিন থাবেত" (আরবি: كامل أمين ثابت) নাম ধারণ করে সিরিয়ার শহর দামেস্কে স্থানান্তরিত হয়।[৮][৯]
কোহেন কোন কৌশলে এবং কীভাবে সিরিয়ার উচ্চ-পদস্থ রাজনীতিবিদ, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ এবং স্থানীয় কূটনৈতিক সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলবেন, তার একটি সার্বিক রূপরেখা তৈরী করে দেয় মোসাদ।
আর্জেন্টিনার বিভিন্ন ক্যাফেতে রাজনৈতিক গল্প শোনার মাধ্যমে কোহেন তার সামাজিক জীবন অব্যাহত রাখতেন। কোহেন তার নিজ ফ্ল্যাটে প্রায় সময় পার্টির আয়োজন করতেন যেখানে উচ্চ-পদস্থ সিরিয়ান মন্ত্রী, ব্যবসায়ী এবং সিরিয়ার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আসতো মূলত প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের সুন্দরী নারী, বিমানবালা এবং উদীয়মান সংগীত তারকাদের নিয়ে সময় কাটাতে। এই ধরনের পার্টিতে সিরীয় সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা প্রায়শ তাদের সার্বিক কর্মকাণ্ড ও সামরিক পরিকল্পনা নিয়ে অবাধে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতেন। আর এলি কোহেন সেই সমস্ত বৈঠকে মাতাল সেজে আলোচনার সমস্তটাই খুব যত্নসহকারে শুনে নিতেন। এছাড়াও আন্তরিক সেজে কোহেন সিরিয়ার সরকারি কর্মকর্তাদের ঋণও দিতেন যার ফলে ক্রমশ বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠার দরুন সিরিয়ান কর্মকর্তারা কোহেনের কাছ থেকে রাজনৈতিক পরামর্শও চাইতেন। নারী সংক্রান্ত ব্যাপারেও কোহেন দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। সিরিয়াতে তিনি প্রায় ১৭ জন নারীর সাথে প্রণয় সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, যাদের বেশিরভাগই ছিল সমৃদ্ধশালী পরিবারের থেকে আসা মহিলাবৃন্দ।[১০] ধারণা মতে, তৎকালীন সিরিয়ার প্রভাবশালী সেনা কর্মকর্তা ও বাথ পার্টির সদস্য আমিন আল-হাফিজের সাথেও কোহেনের সুসম্পর্ক ছিল।
যদিও ২০০১ সালে আল জাজিরা কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে, হাফিজ কোহেনের সাথে তার সম্পর্কের ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তার স্বপক্ষে যুক্তি হিসাবে হাফিজ বলেন, ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তিনি মস্কো তে ছিলেন।[১১] তাই কোহেনের সাথে তার এই ধরনের সম্পর্কের প্রসঙ্গ সম্পূর্ণই অবান্তর। ধারণা করা হয় যে, হাফিজের শাসনামলে কোহেন কে এমনকি সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিও বানানোর কথা ছিল,[১০] যদিও হাফিজের সচিব এটা দাবি নাকচ করে।[১২]
১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত, এই চার বছরে কোহেন ব্যাপক পরিসরের গোয়েন্দা তথ্য ইসরায়েলে পাচার করে। মূলত রেডিও, গুপ্ত-চিঠি এমনকি গোপনে স্বশরীরে তিনবার ইসরায়েলে গিয়েও তিনি তথ্য সরবরাহ করেছেন। তার গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা-কৃতিত্বগুলোর মধ্যে একটি ছিল গোলান মালভূমিতে সফর যেখানে কোহেন সিরিয়ান সামরিক দুর্গসমূহের চিহ্নিত করে সেসব স্থানসমূহের স্পর্শকাতর তথ্য ইসরায়েল কে প্রেরণ করেছিলেন। সিরিয়ান সেনাদের প্রতি কপট-সহানুভূতি দেখিয়ে প্রখর রৌদে তাদের কষ্টের লাঘবের জন্য কোহেন সিরিয়ান সেনাদের প্রতিটি অবস্থানে গাছ লাগিয়ে আসেন। আর এই গাছগুলোই ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েলীদের কাছে সিরিয়ান সেনাদের অবস্থান স্পষ্ট করে দেয় এবং ইসরায়েলের সেনারা সেই গাছগুলোকেই লক্ষ্য করে সিরিয়ান সেনাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ করে। আর ফলশ্রুতিতে ঐ যুদ্ধে মাত্র দুই দিনেই ইসরায়েল সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে ফেলে। এছাড়াও সিরিয়ার দক্ষিণ সীমান্ত অঞ্চলে বেশ অনেকবার সফর করে কোহেন সিরিয়ার সামরিকবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে স্পর্শকাতর ছবি ও স্কেচ মোসাদের হাতে তুলে দিয়েছিলো।[১৩]
এছাড়াও কোহেন মর্টার আর পরিধি নিয়ে তিনটি লাইন তৈরী ব্যাপারে সিরিয়ানদের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক পরিকল্পনা জেনে ফেলেন। অথচ এর আগে ইসরায়েল সেনাবাহিনী শুধু একটি লাইন নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।[৫][১৪][১৫]
নতুন নিযুক্ত সিরিয়ান গোয়েন্দা উপদেষ্টা কর্ণেল আহমেদ সু'এদানি কাউকেই বিশ্বাস করতেন না এবং ব্যক্তিগতভাবে তিনি কামেল আমিন থাবেত (মানে কোহেন) - কে অপছন্দ করতেন। এ কারণে কোহেন তার পরিচয় ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করতে থাকে এবং ১৯৬৪ সালে নভেম্বরের দিকে কোহেন যখন তথ্য পাচারা করতে এবং তার তৃতীয় সন্তানকে দেখতে গোপনে ইসরায়েলে ভ্রমণ করে, তখন তিনি তার এই উদ্বেগের কথা মোসাদ-কে প্রকাশ করে। তা সত্ত্বেও, মোসাদ শেষবারের মতো কোহেন কে আবার সিরিয়ায় যেতে প্ররোচিত করে। শেষবার সিরিয়ায় যাওয়ার আগে কোহেন তার স্ত্রীকে আশ্বস্ত করেন যে, এটাই সিরিয়ায় তার শেষ সফর এবং এরপরে তিনি পাকাপাকীভাবে ইসরায়েলে ফিরে আসবেন।[২]
১৯৬৫ সালে জানুয়ারীর দিকে সিরিয়ান কর্তৃপক্ষ গোয়েন্দা তথ্যচুরি উদঘাটনে তৎপর হয়ে উঠে। সিরিয়ান কর্তৃপক্ষ তখন গোপনে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কিছু বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আসে যারা সোভিয়েতের বানানো বিভিন্ন শনাক্তকরণ যন্ত্র ও প্রযুক্তির সাহায্যে সিরিয়া থেকে বাইরে পাঠানো কিছু রেডিও-সংকেত পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। এরকম বহু সিগন্যাল ট্রান্সমিশন পর্যবেক্ষণের পর এক পর্যায়ে সিরিয়ার বাইরে যাওয়া এসব রেডিও-সংকেতের উৎস তারা খুঁজে বের করে এবং ২৪ জানুয়ারীতে সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী কোহেনের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে রেডিও-সংকেত পাঠানো অবস্থায় হাতে-নাতে তাকে গ্রেপ্তার করে।
ট্রাইব্যুনালের বিচারে সামরিক আইনের আওতায় গোয়েন্দাবৃত্তি জন্য এলি কোহেন দোষী সাব্যস্ত হন এবং বিচারে তাকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়। রিমান্ডে কোহেনকে বেশ অনেকবার জিজ্ঞাসাবাদ এবং অত্যাচার করা হয়েছিল বলে শোনা যায়।[২][৩] কোহেনের প্রতি সহানুভূতি আদায়ের জন্য ইসরায়েল সেই সময় এই বিচার রুখতে একটি আন্তর্জাতিক প্রচারাভিযান শুরু করে। বল প্রয়োগের মাধ্যমে কোহেনে কে ফাঁসি দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে দামেস্ক কে সরিয়ে আনার জন্য ইসরায়েলের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী (পরবর্তীতে যিনি প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন) গোল্ডা মেয়ার এই আন্তর্জাতিক প্রচারাভিযানের নেতৃত্ব দেন। বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক প্রধানমন্ত্রী এমনকি পোপ পল ষষ্ঠ-ও এই বিচারে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেন। গোল্ডা মেয়ার এই বিচারের বিরুদ্ধে মধ্যস্থতা করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছেও আবেদন জানান।[৩] নানা আন্তর্জাতিক আবেদন এবং ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও কানাডার প্রতিনিধিদের দ্বারা অনেক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও[১৬] সিরিয়ান সরকার কে এই মৃত্যুদন্ড কার্যকরের সিদ্ধান্ত থেকে টলানো যায় নি।
১৯৬৫ সালের ১৫ মে, কোহেন শেষ চিঠিতে তার স্ত্রীকে লিখেন[২] -
"প্রিয় নাদিয়া, তোমার প্রতি আমার অনুরোধ.. যেটা হয়ে গেছে সেটা নিয়ে শোক করো না। তুমি বরং নিজের খেয়াল রেখো এবং ভাল একটি ভবিষ্যতের জন্য প্রত্যাশা রাখো।"
১৯৬৫ সালের ১৮ই মে মাজরেহ স্কয়ারে জনসম্মুখে কোহেনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তার ফাঁসির দিনে কোহেন একজন রাবাই-এর (মানে ইহুদি পুরোহিত) সাথে সাক্ষাতের শেষ ইচ্ছে পোষণ করেন। ট্রাকে করে মাজরেহ্ স্কয়ারে ফাঁসির জন্য নিয়ে যাওয়ার সময় সিরিয়ার প্রবীণ প্রধান ইহুদি পুরোহিত রাবাই "নিসিন আন্দাবো" কোহেনের শেষ যাত্রায় তাকে সঙ্গ দেন।[৩]
১৯৬৫ সালের নভেম্বর মাসে কোহেনের স্ত্রী নাদিয়া তার স্বামী এলি কোহেনের কৃতকার্যের জন্য ক্ষমা চেয়ে সিরিয়ার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হাফেজ আল-আসাদ কে একটি চিঠিতে কোহেনের দেহ ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন। ২০০৭ সালে তুরষ্ক মধ্যস্থতার আশ্বাস দিয়ে কোহেনের মৃতদেহ সিরিয়া থেকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।[১৭]
কিন্তু ২০০৮ সালে হাফেজ আল-আসাদের প্রাক্তন ব্যুরো প্রধান মনসির মাওসিলি জানিয়ে দেন যে, কোহেনের মৃতদেহ ফেরত দেওয়া সম্ভব নয়, কেননা কোথায় তাকে কবর দেওয়া হয়েছিল সেটা এখনও অজানা। কারণ মোসাদ যাতে গোপন মিশনের মাধ্যমে কোহেনের শবদেহ ইসরায়েলে নিয়ে যেতে না পারে এজন্য সিরিয়ানরা সেই সময় অবস্থান পরিবর্তন করার মাধ্যমে ৩ জায়গায় তাকে কবর দিয়েছিলো।[১৮]
২০১৮ সালে ৫ জুলাইয়ে কোহেনের হাতঘড়ি উদ্ধার হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়। এলির স্ত্রী জানায় যে, বিক্রির সময় কোহেনের ঘড়িটি মোসাদ কিনে ফেলে।[১৯] পরে মোসাদের ডিরেক্টর য়োসি কোহেন এলির ঘড়িটি তার পরিবারের কাছে পেশ করে। ঘড়িটি বর্তমানে মোসাদের হেডকোয়ার্টে প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে।[২০]
মৃত্যুর পর থেকে কোহেন ইসরায়েলে জাতীয় বীর হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে। ইসরায়েলের অনেক রাস্তা এবং এলাকা তার নামে রাখা হয়। ১৯৭৭ সালে কোহেনের পুত্রের বার মিতজ্বাহ (১২ এবং ১৩ বছর বয়সে ইহুদি ছেলে-মেয়েদের জন্য করা আয়োজন করা একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান) অনুষ্ঠানে ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মেনাখেম বেগিন, সেনাবাহিনীর প্রধান মোরদেশাই গুর সহ মোসাদের আরো অনেক কর্মকর্তারা অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।[২১] এছাড়াও জেরুজালেমের মাউন্ট হার্জেল-এ নিখোঁজ সৈনিকদের বাগানে এলি কোহেনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি স্মারক নির্মিত হয়েছে।
দ্য ইম্পোসিবল স্পাই নামের চলচ্চিত্রটি কোহেনের জীবন কাহিনীর উপর ভিত্তি করে নির্মিত।[২২] এছাড়াও নেটফ্লিক্সের দ্য স্পাই নামক একটি টিভি সিরিজে অভিনেতা সাশা ব্যারন কোহেন এলি কোহেনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন।