ওথেলো (ইংরেজি: Othello) হল উইলিয়াম শেকসপিয়র রচিত একটি ট্র্যাজেডি। নাটকটির মূল নাম দ্য ট্র্যাজেডি অফ ওথেলো, দ্য মুর অফ ভেনিস (ইংরেজি: The Tragedy of Othello, the Moor of Venice; অনুবাদ: ভেনিসের মুর ওথেলোর বিয়োগান্ত নাটক)। মনে করা হয়, ১৬০৩ সালে শেকসপিয়র এই নাটকটি রচনা করেছিলেন। সিনথিও (জোভান্নি বোক্কাচ্চোর জনৈক শিষ্য) রচিত কাহিনি উন ক্যাপিট্যানো মোরো (জনৈক মুর-জাতীয় ক্যাপ্টেন) অবলম্বনে ওথেলো নাটকটি রচিত হয়। মূল কাহিনিটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৫৬৫ সালে।[২] নাটকের কাহিনি দু’টি প্রধান চরিত্র-কেন্দ্রিক: ভেনেসীয় বাহিনির মুর সেনানায়ক ওথেলো ও তাঁর বিশ্বাসঘাতক অধস্তন সেনানায়ক ইয়াগো। বর্ণবিদ্বেষ, প্রেম, ঈর্ষা, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতিশোধ ও অনুশোচনার মতো বহু বিচিত্র ও চিরকালীন বিষয়বস্তুর প্রেক্ষাপটে রচিত হওয়ায় ওথেলো এখনও পেশাদার ও সামাজিক নাট্যশালায় মঞ্চস্থ হয়। এছাড়াও একাধিকবার ওপেরা, চলচ্চিত্র ও সাহিত্যে এই নাটকটি অভিযোজিত হয়েছে।
ধনী ও অসচ্চরিত্র ভদ্রলোক রোডারিগো তাঁর বন্ধু এনসাইন ইয়াগোর কাছে অভিযোগ জানালেন যে, সেনেটর ব্রাবানশিওর কন্যা ডেসডিমোনার সঙ্গে ভেনেসীয় সেনাবাহিনীর মুর-জাতীয় জেনারেল ওথেলোর গোপন বিবাহ সম্পর্কে ইয়াগো তাঁকে কিছুই জানাননি। এই ঘটনায় রোডারিগো মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। কারণ, ডেসডিমোনকে তিনি ভালোবাসতেন এবং ব্রাবানশিওর কাছে তাঁর কন্যাকে বিবাহের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন।
ইয়াগো ওথেলোকে অপছন্দ করতেন। কারণ, তিনি ক্যাসিও নামে এক যুবককে তাঁর থেকে উচ্চপদে উন্নীত করেছিলেন। এই ক্যাসিওকে ইয়াগো তাঁর নিজের তুলনায় কম দক্ষ সৈনিক মনে করতেন। তাই তিনি ওথেলোর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য যে পরিকল্পনা করেছিলেন, তা খুলে বললেন রোডারিগোকে। ইয়াগো তাঁকে এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে, রোডারিও যদি ব্রাবানশিওকে তাঁর মেয়েকে প্ররোচিত করার কথা জানিয়ে উসকে দেন, তাহলে তাঁদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। এদিকে চুপিসাড়ে বেরিয়ে ইয়াগো খুঁজে বার করলেন ওথেলোকে। তারপর তাঁকে সতর্ক করে বললেন যে, ব্রাবানশিও তাঁর খোঁজে আসছেন।
রোডারিগোর প্ররোচনায় ব্রাবানশিও ক্রুদ্ধ হলেন। ওথেলোর মুখোমুখি না হওয়া পর্যন্ত তিনি শান্তি পাচ্ছিলেন না। কিন্তু ওথেলোর বাসভবনে গিয়ে তিনি দেখলেন, সেখানে চারিদিকে হিংসাত্মক ঘটনা প্রতিরোধের জন্য ভেনিসের ডিউকের রক্ষীরা মোতায়েন রয়েছে। খবর এসে পৌঁছালো যে, তুর্কিরা সাইপ্রাস আক্রমণ করতে চলেছে। সেনেটরদের পরামর্শ দেওয়ার জন্য ওথেলোকে ডাক পাঠানো হল। বাধ্য হয়েই ব্রাবানশিওকে ওথেলোর সঙ্গে ডিউকের বাসভবনে যেতে হল। সেখানে ব্রাবানশিও ওথেলোর বিরুদ্ধে জাদুবিদ্যার মাধ্যমে ডেসডিমোনাকে প্রলুব্ধ করার অভিযোগ আনলেন।
ভেনিসের ডিউক, ব্রাবানশিওর আত্মীয় লোডোভিকো ও গ্র্যাটিয়ানো এবং অন্যান্য সেনেটরদের সামনে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে ওথেলো বলেন যে, ভেনিসে আসার আগে তাঁর জীবনের দুঃখজনক কাহিনি শুনে ডেসডিমোনা তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে। কোনও জাদুমন্ত্রে তিনি ডেসডিমোনাকে বশ করেননি। সেনেট তাঁর বক্তব্যে সন্তুষ্ট হয়। ডেসডিমোনাও স্বীকার করেন যে, ওথেলোকে তিনি ভালোবাসেন। কিন্তু ব্রাবানশিও যাওয়ার আগে ওথেলোকে বলে যান যে, ডেসডিমোনা একদিন তাঁর সঙ্গেও বিশ্বাসঘাতকতা করবে: "যদি তোমার চোখ থাকে, তাহলে দেখে নিও, মুর:/নিজের বাবাকে সে ঠকিয়েছে, এবং তোমাকেও ঠকাতে পারে," (প্রথম অঙ্ক, তৃতীয় দৃশ্য)। ইয়াগো তখনও সেই ঘরে ছিলেন। তিনি ব্রাবানশিওর মন্তব্যটি মনে রেখে দেন। ডিউকের নির্দেশ মতো সাইপ্রাস আক্রমণকারী তুর্কিদের বিরুদ্ধে ভেনেসীয় বাহিনীকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ওথেলো ভেনিস ত্যাগ করেন। তাঁর সঙ্গে যান তাঁর নববিবাহিতা স্ত্রী, তাঁর নতুন লেফট্যানেন্ট ক্যাসিও, তাঁর এনসাইন ইয়াগো, এবং ডেসডিমোনার পরিচারিকা হিসাবে ইয়াগোর স্ত্রী এমিলিয়া।
সাইপ্রাসে পৌঁছে তাঁরা দেখেন যে, একটি ঝড়ে তুর্কি নৌবহর ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। ওথেলো সাধারণ উৎসবের নির্দেশ দিলেন এবং ডেসডিমোনার সঙ্গে তাঁর বিবাহ সম্পূর্ণ করতে চলে যান। তাঁর অনুপস্থিতিতে ইয়াগো ক্যাসিওকে অতিমাত্রায় মদ্যপান করায়। তারপর রোডারিগোকে প্ররোচিত করে ক্যাসিওকে মুষ্টিযুদ্ধে আহ্বান করার জন্য। মন্টানো ক্রুদ্ধ ও মাতাল ক্যাসিওকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে তাঁদের নিজেদের মধ্যেই মারামারি লেগে যায়। মারামারিতে মন্টানো আহত হয়। ওথেলো ফিরে আসেন এবং অন্যদের কাছ থেকে সব ঘটনা জানতে পারেন। ওথেলো ক্যাসিওকেই গোলমালের জন্য দায়ী করলেন এবং তাঁকে পদচ্যূত করলেন। ক্যাসিও বিহ্বল হয়ে পড়ল। ইয়াগো ক্যাসিওকে ডেসডিমোনার কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিল, যাতে ডেসডিমোনা তাঁর স্বামীকে বলে ক্যাসিওকে তাঁর পদ ফিরে পেতে সাহায্য করেন।
ইয়াগোর প্ররোচনায় ওথেলো ক্যাসিও ও ডেসডিমোনার ব্যাপারে সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল। ডেসডিমোনার একটি রুমাল পড়ে যায় (তাঁকে দেওয়া ওথেলোর প্রথম উপহার)। এমিলিয়া সেটি খুঁজে পায়। তাঁর স্বামী ইয়াগোর অনুরোধে তিনি সেটি ইয়াগোকেই দিয়ে দেন। কারণ, সেটি নিয়ে ইয়াগো কী ফাঁদ পাততে চলেছিলেন, সে সম্পর্কে কোনও ধারণাই এমিলিয়ার ছিল না। ওথেলো পুনরায় প্রবেশ করেন এবং ইয়াগোর কাছে শপথ করেন যে তিনি ডেসডিমোনা ও ক্যাসিওকে হত্যা করবেন। এরপর তিনি ইয়াগোকে লেফট্যানেন্ট নিযুক্ত করেন। তৃতীয় অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যটিকে নাটকের গতিপথ সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দেয়। কারণ, এই দৃশ্যেই ইয়াগো সফলভাবে ওথেলোর মনে সন্দেহের বীজ বপন করে তাঁর অবশ্যম্ভাবী নিয়তিকে ডেকে আনেন।
ইয়াগো রুমালটি রেখে দিল ক্যাসিওর বাড়িতে। তারপর ওথেলোকে বলল যে, ইয়াগো যখন ক্যাসিওকে প্রশ্ন করবেন, তখন ক্যাসিওর প্রতিক্রিয়াগুলি লক্ষ্য করেন। ইয়াগো অগ্রসর হন ক্যাসিওর সঙ্গে কথা বলতে। ক্যাসিওর সঙ্গে তাঁর প্রেমিকা স্থানীয় বারবণিতা বিয়াঙ্কার সম্পর্ক নিয়েই কথা বলছিলেন তিনি। কিন্তু বিয়াঙ্কার নামটি উচ্চারণ করছিলেন ফিসফিস করে যাতে ওথেলো মনে করেন যে ওঁরা দু’জনে ডেসডিমোনার ব্যাপারে কথা বলছেন। পরে বিয়াঙ্কা ক্যাসিওর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে যে, অন্যের থেকে পাওয়া একটি উপহার ক্যাসিও তাকে উপহার হিসাবে দিয়েছে। ওথেলো সেটা দেখতে পায়। ইয়াগো ক্যাসিওকে বোঝায় যে, ওই রুমালটি ক্যাসিও পেয়েছে ডেসডিমোনার থেকে।
ক্রুদ্ধ ও মর্মাহত ওথেলো সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি তাঁর স্ত্রীকে হত্যা করবে। ইয়াগোকে তিনি বলেন ক্যাসিওকে হত্যা করতে। এরপর ওথেলো এগিয়ে যান ডেসডিমোনার জীবন দুর্বিষহ করে তুলতে। আগন্তুক ভেনেসীয় অভিজাত ব্যক্তিদের সামনে তিনি ডেসডিমোনাকে আঘাত করেন। এদিকে রোডারিগো অভিযোগ করেন যে, ইয়াগোকে তিনি টাকা দিলেও তিনি পরিবর্তে ডেসডিমোনার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক স্থাপনের জন্য কোনও উদ্যোগই নিচ্ছেন না। কিন্তু ইয়াগো তাঁকে রাজি করান ক্যাসিওকে হত্যা করার জন্য।
ইয়াগোর প্ররোচনায় রোডারিগো বেরিয়ে পড়েন। ক্যাসিও বিয়াঙ্কার বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামলে তিনি ক্যাসিওকে আক্রমণ করেন। ক্যাসিও রোডারিগোকে জখম করতে সক্ষম হন। হাতাহাতির সময় ইয়াগো ক্যাসিওর পিছনে এসে হাজির হন। তিনি ক্যাসিওর পায়ে আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত করে দেন। অন্ধকারে ইয়াগো নিজের পরিচয় গোপন রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। ক্যাসিও সাহায্যের জন্য চিৎকার করলে তা লোডোভিকো ও গ্র্যান্টিয়ানোর কানে যায়। তাঁরা এগিয়ে এলে ইয়াগোও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। রোডারিগো যাতে তাঁর পরিকল্পনার কথা ফাঁস না করে দিতে পারেন, সেই জন্য ইয়াগো গোপনে রোডারিগোকে ছুরিকাঘাত করে। তারপর ইয়াগো বিয়াঙ্কাকে অভিযুক্ত করে ক্যাসিওকে হত্যা করার জন্য একটি ব্যর্থ ষড়যন্ত্র রচনার জন্য।
ওথেলো ডেসডিমোনার মুখোমুখি হয়। তারপর তাঁকে তাঁদের বিছানাতেই ফেলে গলা টিপে ধরেন। এমিলিয়া এলে ডেসডিমোনা মৃত্যুর আগে তাঁর স্বামীর পক্ষই অবলম্বন করেন। ওথেলো ডেসডিমোনাকে ব্যভিচারের অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। এমিলিয়া সাহায্য চাইতে যান। প্রাক্তন গভর্নর মন্টানো গ্র্যাটিয়ানো ও ইয়াগোকে নিয়ে উপস্থিত হন। ওথেলো যখন প্রমাণ হিসাবে রুমালটির কথা উল্লেখ করেন, তখন এমিলিয়া বুঝতে পারেন, তাঁর স্বামী ইয়াগো কী চক্রান্ত করেছিলেন। তিনি সর্বসমক্ষে সেই কথা ফাঁস করে দেন। সেই জন্য ইয়াগো এমিলিয়াকে হত্যা করেন। ওথেলো বুঝতে পারেন যে ডেসডিমোনা বিশ্বাসঘাতিনী ছিলেন না। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। তিনি ইয়াগোকে ছুরিকাঘাত করলেন বটে, কিন্তু মারাত্মক আঘাত করলেন না। বললেন, তিনি চান শয়তান ইয়াগো তাঁর জীবনের অবশিষ্ট অংশ যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকুন।
ইয়াগো তার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে অস্বীকার করল এবং সেই মুহুর্ত থেকে নীরব থাকার শপথ গ্রহণ করল। রোডারিগো, এমিলিয়া ও ডেসডিমোনাকে হত্যা করার দায়ে লোডোভিকো ইয়াগো ও ওথেলোকে গ্রেফতার করলেন। কিন্তু ওথেলো আত্মহত্যা করলেন। লোডোভিকো ক্যাসিওকে ওথেলোর উত্তরসূরি নিযুক্ত করলেন এবং ইয়াগোকে যথাযথ শাস্তি দেওয়ার জন্য তাঁকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানালেন। তারপর তিনি সর্বসমক্ষে ইয়াগোকে অভিযুক্ত করলেন এবং অন্যদের কী হয়েছে তা জানাতে বেরিয়ে গেলেন।
ওথেলো নাটকটি প্রকৃতপক্ষে ইতালীয় লেখক সিনথিওর "আন ক্যাপিটানো মোরো" ("মুর-জাতীয় এক ক্যাপ্টেন") কাহিনির অভিযোজনা। কাহিনিটি পাওয়া যায় জিওভান্নি বোকাচ্চোর ডেকামেরন গ্রন্থের ধাঁচে লেখা গ্লি হেকাটোমিথি (১৫৬৫) নামক তাঁর একশোটি গল্পের একটি সংকলনে। শেকসপিয়রের জীবদ্দশায় সিনথিওর রচনাটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়নি। ওথেলো নাটকের বাচনভঙ্গিও মূল ইতালীয় রচনাটির পরিবর্তে ১৫৮৪ সালে প্রকাশিত সেটির গ্যাব্রিয়েল ক্যাপুই কৃত ফরাসি অনুবাদের অনুরূপ। সিনথিওর কাহিনিটি সম্ভবত ১৫০৮ সালে ভেনিসে ঘটিত একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত হয়েছিল।[৩] এই কাহিনির সঙ্গে আরও প্রাচীন আরব্য রজনী গ্রন্থের "তিন আপেল" গল্পের বর্ণিত একটি ঘটনারও মিল পাওয়া যায়।[৪] সিনথিওর কাহিনিতে ডেসডিমোনাই একমাত্র চরিত্র যাঁর নাম উল্লিখিত হয়েছে। অন্য কয়েকটি চরিত্র চিহ্নিত হয়েছে শুধুমাত্র "মুর", "স্কোয়াড্রন লিডার", "এনসাইন" ও "এনসাইনের স্ত্রী" (নাটকে যাঁরা যথাক্রমে ওথেলো, ক্যাসিও, ইয়াগো ও এমিলিয়া) নামে। সিনথিও একটি নীতিবাক্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন (যা তিনি বসিয়েছিলেন ডেসডিমোনার মুখে)। নীতিবাক্যটি হল, কোনও ইউরোপীয় নারীর পক্ষে অন্য দেশের বদমেজাজি লোককে বিবাহ করা নির্বুদ্ধিতার কাজ।[৫] সিনথিওর কাহিনিটিকে বর্ণসঙ্করত্বের বিপদ সম্পর্কে "আংশিকভাবে বর্ণবিদ্বেষী সতর্কবার্তা" হিসাবে বর্ণনা করা হয়।[৬]
ওথেলো রচনার ক্ষেত্রে শেকসপিয়র সিনথিওর কাহিনিটিকে সযত্নে অনুসরণ করলেও কিছু কিছু বিস্তারিত বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি মূল রচনাটি থেকে দূরে সরে গিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, ব্রাবানশিও, রোডারিগো ও অন্যান্য বেশ কয়েকটি অপ্রধান চরিত্রের উল্লেখ সিনথিওর রচনায় পাওয়া যায় না। তাছাড়া শেকসপিয়রের এমিলিয়া রুমাল-চক্রান্তের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিলেন; কিন্তু সিনথিওর রচনায় তাঁর সমরূপ চরিত্রটির সঙ্গে এই ঘটনার যোগ ছিল না। সিনথিওর "এনসাইন" (নাটকের ইয়াগো) ডেসডিমোনাকে কামনা করতেন। কিন্তু ডেসডিমোনা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করায় তাঁর মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহা জেগে ওঠে। নাটকে এই ধরনের কিছু দেখা যায় না। শেকসপিয়রের ট্র্যাজেডিতে প্রারম্ভিক দৃশ্যগুলি স্বতন্ত্র প্রকৃতির হয়ে থেকে। সেই সঙ্গে থাকে কিছু সরল দৃশ্যও। যেমন, এমিলিয়া ও ডেসডিমোনার দৃশ্যটি যেখানে ডেসডিমোনা শয্যা প্রস্তুত করছেন। শেকসপিয়র ও সিনথিওর কাজের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হল নায়িকার মৃত্যু দৃশ্যের চিত্রায়নে। শেকসপিয়রের নাটকে ওথেলো ডেসডিমোনাকে গলা টিপে হত্যা করেন। কিন্তু সিনথিওর কাহিনিতে "মুর" তাঁর "এনসাইন"কে নিয়োগ করেন বালি-ভর্তি লম্বা মোজা দিয়ে বারবার আঘাত করে তাঁর স্ত্রীকে হত্যা করার জন্য। সিনথিও প্রত্যেকটি বিভীষিকাময় আঘাতের বর্ণনা দিয়েছিলেন। ডেসডিমোনার মৃত্যু ঘটলে "এনসাইন" ও "মুর" দু’জনে মিলে তাঁর মৃতদেহটি বিছানায় রেখে দেন, তারপর তাঁর মাথাটি ফাটিয়ে দিয়ে মাথার উপর ছাদটি ভেঙে পড়ার ব্যবস্থা করেন, যাতে মনে হয় যে ভেঙে পড়া ছাদের আঘাতে তাঁর মৃত্যু ঘটেছে। সিনথিওর কাহিনিতে হত্যাকারীদের কেউ শনাক্ত করতে পারেনি। তারপর "মুর" প্রচণ্ডভাবে ডেসডিমোনার অভাব বোধ করতে থাকেন। সেই থেকে "এনসাইন"কে দেখলেই তিনি বিরক্ত হতে থাকেন। তিনি তাঁর পদাবনতি ঘটান এবং তাঁকে সঙ্গে নিতে অস্বীকার করেন। এরপর "এনসাইন" প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য "স্কোয়াড্রন লিডার"-এর কাছে ডেসডিমোনার মৃত্যুর ব্যাপারে "মুর"-এর ভূমিকার কথা ফাঁস করে দেন। দু’জনে সাইপ্রাস ছেড়ে ভেনিসে আসেন এবং ভেনেসীয় সামন্ত শাসকের কাছে "মুর"কে অভিযুক্ত করেন। তাঁকে গ্রেফতার করে ভেনিসে আনা হয় এবং তাঁর উপর অত্যাচার করা হয়। তিনি তাঁর অপরাধ অস্বীকার করেন। তখন তাঁকে পাঠানো হয় নির্বাসনে। ডেসডিমোনার আত্মীয়েরা ঘটনাচক্রে তাঁকে খুঁজে পান ও হত্যা করেন। যদিও ডেসডিমোনার মৃত্যুর ব্যাপারে "এনসাইন"কেও শনাক্ত করা যায় নি। তবে ভেনিসে অন্যান্য অপরাধে যুক্ত হয়ে পড়লে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। অত্যাচার সহ্য করার পর তাঁর মৃত্যু ঘটে। সিনথিওর কাহিনিতে "এনসাইনের স্ত্রী" (নাটকে এমিলিয়া) স্বামীর মৃত্যুর পরেও জীবিত ছিলেন তাঁর কাহিনি শোনানোর জন্য।[৭]
সিনথিওর "মুর" চরিত্রটি শেকসপিয়রের ওথেলোর মডেল। কিন্তু কোনও কোনও গবেষকের মতে, শেকসপিয়র আনুমানিক ১৬০০ সাল নাগাদ এলিজাবেথীয় ইংল্যান্ডে মরক্কো থেকে আগত বেশ কয়েকজন মুর-জাতীয় প্রতিনিধির থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই চরিত্রটি নির্মাণ করেন।[৮]
এই নাটকের অপর একটি সম্ভাব্য সূত্র হল লিও আফ্রিকানাসের লেখা আফ্রিকার বিবরণ। বইটি ইউরোপে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল এবং অন্যান্য অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছিল[৯] পরবর্তী কয়েক দশকে (কোনও কোনও ক্ষেত্রে কয়েক শতাব্দীতে) একটি সামগ্রিক সহায়ক গ্রন্থের কাজ করেছিল।[১০] ১৬০০ সালে জন পোরি আ জিওগ্রাফিক্যাল হিস্ট্রি অফ আফ্রিকা, রিটেন ইন আরাবিক অ্যান্ড ইটালিয়ান বাই ইয়োন লিও আ মোর... (ইংরেজি: A Geographical Historie of Africa, Written in Arabicke and Italian by Iohn Leo a More...) শিরোনামে বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। এই অনূদিত বইটিই শেকসপিয়র দেখে থাকবেন এবং ওথেলো চরিত্রটির সৃজনে এই বই থেকেই আভাস গ্রহণ করে থাকবেন।[১১]
কথাবস্তু সরবরাহ করা ছাড়া এই বইটিতে ভেনিস বা সাইপ্রাসের কোনও উল্লেখ নেই। এই ক্ষেত্রে মনে করা হয়, শেকসপিয়র গ্যাসপারো কন্টারিনির দ্য কমনওয়েলথ অ্যান্ড গভর্নমেন্ট বইটির ১৫৯৯ সালে লিউস লিউকেনোর কৃত অনুবাদটি অনুসরণ করেছিলেন।[১২][১৩]
এই নাটকটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৬০৪ সালের রিভিলস অফিসের নথিতে। সেখানে বলা হয়েছে "অল সেন্ট’স ডে [উপলক্ষ্যে] পয়লা নভেম্বর... হোয়াইটহলে ব্যাঙ্কোয়েটিং হাউসে কিংস ম্যাজেস্টিজ অভিনেতাগণ দ্য মুর অফ ভেনিস নামে একটি নাটক [অভিনয় করেন]।"[১৪] নাটকটি "শ্যাক্সবার্ড"-এর (ইংরেজি: Shaxberd) রচনা বলে উল্লিখিত হয়েছিল। ১৮৪২ সালে রিভিলসের নথিটি পিটার ক্যানিংহাম কর্তৃক প্রথম প্রকাশিত হয়। একবার এই নথিটির প্রামাণিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলেও, এখন এটিকে অকৃত্রিম সূত্র হিসাবে ধরা হয় (১৯৩০ সালে এ. ই. স্ট্যাম্প এটি সপ্রমাণ করেছিলেন)।[১৫] রচনাশৈলীর দিকটি বিশ্লেষণ করে এই নাটকটি ১৬০৩ বা ১৬০৪ সালে রচিত বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে কেউ কেউ মনে করেন যে, নাটকটি আরও আগে ১৬০১ বা ১৬০২ সালে রচিত হয়।[৩][১৬]
১৬২১ সালের ৬ অক্টোবর স্টেশনার্স কোম্পানির রেজিস্টারে টমার ওয়াকলি কর্তৃক এই নাটকটি অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৬২২ সালে এটি তাঁর দ্বারাই কোয়ার্ট আকারে প্রথম প্রকাশিত হয়:
এক বছর পরে এই নাটকটি শেকসপিয়রের নাটক সংকলনের ফার্স্ট ফোলিওর অন্তর্ভুক্ত হয়। যদিও ফোলিও সংস্করণটি দৈর্ঘ্য ও কথনভঙ্গির দিক থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। ফলগার সংস্করণের সম্পাদকগণ এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন: "ফোলিও নাটকটিতে প্রায় ১৬০টি পঙ্ক্তি আছে, যা কোয়ার্টোয় পাওয়া যায় না। এই পঙ্ক্তিগুচ্ছের অনেকগুলিই একত্রে অনেকটা বিস্তারিত রচনাংশ। আবার কোয়ার্টোতে পাওয়া যায় এমন ডজন খানেক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পঙ্ক্তি বা পঙ্ক্তি-অংশ ফোলিওতে পাওয়া যায় না। অনেক শব্দের পাঠও দুই সংস্করণে ভিন্নরূপ।"[১৮][১৯] এই ব্যাখ্যা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতদ্বৈধ আছে এবং এই বিষয়ে কোনও সাধারণ ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।[১৮] কেরিগ্যান মনে করেন যে, ওথেলো ১৬২৩ সালের ফোলিও সংস্করণটি এবং অন্য বেশ কয়েকটি নাটককে কোয়ার্টো সংস্করণ থেকে ১৬০৬ সালের অ্যাক্ট টু রিস্ট্রেইন আবিউসেস অনুযায়ী আপেক্ষিকভাবে পরিষ্কৃত করা হয়েছিল। এই আইন অনুযায়ী, "কোনও মঞ্চ-নাটক, মধ্যরঙ্গ, বিনোদন-অনুষ্ঠান, মে-গেম (মে মাসে অনুষ্ঠিত এক ধরনের বসন্তোৎসব), বা পেজান্টে (রংবেরঙের পোশাক পরিহিত শোভাযাত্রা অথবা সর্বসমক্ষে ঐতিহাসিক দৃশ্যের অভিনয়) ঈশ্বরের পবিত্র নাম, যিশু খ্রিস্টের নাম, পবিত্র আত্মার নাম অথবা ত্রিত্বের নাম কৌতুকচ্ছলে বা নিন্দাচ্ছলে" উল্লেখ করা নিষিদ্ধ হয়।[২০][২১] একটি পুরনো সংস্করণের ভিত্তিতে কোয়ার্টোয় মুদ্রিত পাঠ এবং তার সঙ্গে ফোলিওয় মুদ্রিত শেকসপিয়রের সংশোধিত সংস্করণের পাঠের পার্থক্য দেখে এই বক্তব্যটি অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হয় না।[১৮] আবার এমনও হতে পারে যে, নির্দিষ্ট সংখ্যক পৃষ্ঠার মধ্যে নাটকটিকে মুদ্রিত করতে গিয়ে কোয়ার্টোর পাঠের কিছু অংশ বাদ দেওয়া হয়েছিল।[৩] অধিকাংশ আধুনিক সংস্করণের মূল ভিত্তি হল দীর্ঘায়িত ফোলিও সংস্করণটি। তবে যেখানে ফোলিওর পাঠটিকে ভুল মনে হয়, সেখানে কোয়ার্টোর শব্দের পাঠ অনুযায়ী তা পরিবর্তিত করা হয়।[২২] ১৬৩০, ১৬৫৫, ১৬৮১, ১৬৯৫, ১৬৯৯ ও ১৭০৫ সালেও কোয়ার্টো প্রকাশিত হয়েছিল।
"ওথেলো " নাটকে মানুষের ঈর্ষাকে যেভাবে প্রদর্শন করা হয়েছে, তার জন্য এটি সাহিত্য বিশারদদের কাছে বিশেষভাবে খ্যাত। সমগ্র নাটক জুড়ে দয়ালু স্বভাবের চরিত্রেরা শুধুমাত্র ঈর্ষার ভিত্তিতেই হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে গিয়েছেন। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চরিত্র হলেন ওথেলো নিজে।
প্রথম দিকের অঙ্কগুলিতে ওথেলোকে দেখানো হয়েছে প্রশংসনীয় সব গুণে গুণান্বিত একজন আদর্শ নায়ক হিসাবে। এইভাবে চরিত্রচিত্রণের উদ্দেশ্য ছিল দর্শকের সহানুভূতি অর্জন। কিন্তু নাটকের পরবর্তী অংশে তাঁর সিদ্ধান্তগুলিকে চালনা করে ঈর্ষা। যার ফলে সে পাপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে। যদিও এই নাটকে ওথেলো যতগুলি অসৎ কাজ করেছিলেন, তার প্রত্যেকটির পিছনে চালিকাশক্তি ছিলেন ইয়াগো, তবু ওথেলোর ঈর্ষাই তাকে সেই সব খারাপ কাজের দিকে ঠেলে দেয়। ইয়াগো যখন বলেন যে, ওথেলোর স্ত্রী ডেসডিমোনার সঙ্গে ক্যাসিও মাত্রাতিরিক্ত সময় কাটাচ্ছেন, তখন ওথেলো ক্রুদ্ধ হয়ে ওথেন। এরপর পরপর কয়েকটি ঘটনা ঘটে যায় এবং ওথেলো নিজের প্রিয়তমাকে খুন করে বসে।
শেকসপিয়র তাঁর মহৎ সৃষ্টিকর্মটিতে পুরুষের কুৎসিততম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যটিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। ‘ট্র্যাজিক নায়ক’ হিসাবে ওথেলোর ধারণাটিকে তিনি নিঁখুতভাবে তুলে ধরেছেন। এখানে ওথেলো এমন এক নায়ক যিনি গোড়াতে দর্শকদের আনুকূল্য লাভ করেন, কিন্তু ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়তে থাকেন অন্যায় নীতিবিগর্হিত কাজে। তাঁর সিদ্ধান্তগুলির ফলে আস্তে আস্তে দর্শক তাঁকে অপছন্দ করতে শুরু করে। যতক্ষণ না তিনি সব হারাচ্ছেন হচ্ছেন ততক্ষণ দর্শকের পক্ষে তাঁকে সমর্থন করা সম্ভব হয় না। ঈর্ষার ধারণাটিকে ব্যবহার করে ট্র্যাজিক নায়কের ধারণাটিকে স্বচ্ছ করে তোলা এই নাটকের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য বিষয়বস্তুর অন্যতম।
নাটকের শিরোনামটিই বলে দেয় যে, এই ট্র্যাজেডিটি ওথেলোর। কিন্তু এই কাহিনিতে ইয়াগোও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। তাঁর চরিত্রটির মধ্যে আদর্শ খলনায়কের বৈশিষ্ট্যটি ফুটে উঠেছে। নাটকের সংলাপের একটা বড়ো অংশ জুড়েও আছেন তিনি। ওথেলো নাটকে ইয়াগো অন্য অনেক চরিত্রকে নিজ ইচ্ছার জোরে চালনা করছেন, তাঁদের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করছেন এবং তাঁদের বদ্ধ করছেন একাধিক মিথ্যার জটিল এক জালে। অন্যান্য চরিত্রগুলি যখন তাঁকে "সৎ" ইয়াগো মনে করছেন, তখন তাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা স্থাপন করে এবং তাঁদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তিনি তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে সক্ষম হচ্ছেন। এই ব্যাখ্যার প্রধান প্রবক্তা হলেন এ. সি. ব্র্যাডলি ও আরও সাম্প্রতিককালে হ্যারোল্ড ব্লুম।[২৩] অন্যান্য সমালোচকেরা, বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীর শেষভাগের সমালোচকেরা (এফ. আর. লিভিসের পরবর্তী) ওথেলোর উপরই আলোকপাত করেছেন।
"মুর" চরিত্রটি শেকসপিয়রের অপর দু’টি নাটকে আবির্ভূত হলেও (টাইটাস অ্যান্ড্রোনিকাস ও দ্য মার্চেন্ট অফ ভেনিস) এই ধরনের চরিত্র তাঁর সমসাময়িক কালের নাটকে শুধু বিরলই না, কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসাবেও তাদের দেখা যেত না।[২৫]
ওথেলোর জাতিগত উৎস সম্পর্কে গবেষকদের মধ্যে ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি। আর্ডেন শেকসপিয়র সংস্করণের সম্পাদক ই. এ. জে. হনিগম্যান এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ওথেলোর জাতিগত পরিচয় অনিশ্চিত। রেনেসাঁ যুগে মুরের উপস্থাপনাগুলি ছিল অস্পষ্ট, বহু বিচিত্র, সামঞ্জস্যহীন ও পরস্পর-বিরোধী। সমালোচকেরা যেহেতু সর্বসম্মতভাবে “মুর” শব্দটিকে সাধারণভাবে কোনও কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার পক্ষপাতী, সেই হেতু শব্দটিকে আফ্রিকার (বা তারও বাইরের) কোনও ব্যক্তি বোঝাতে পরস্পরপরিবর্তনীয়ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে “আফ্রিকান”, “সোমালি”, “ইথিওপিয়ান”, “নিগ্রো”, “আরব”, “বার্বার”, এমনকি “ভারতীয়” অর্থেও।[২৬][২৭] হনিগম্যানের মতে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে black শব্দটির প্রয়োগ (উদাহরণস্বরূপ, "Haply for I am black") কোনও যথাযথ জাতিগত শ্রেণিবিন্যাসের যথেষ্ট প্রমাণ নয়। কারণ, এলিজাবেথীয় যুগে এই শব্দটির সাধারণ অর্থ শ্যামবর্ণ হওয়াও স্বাভাবিক। ইয়াগো ওথেলোর কথা উল্লেখ করতে দুই বার Barbary বা Barbarian শব্দ দু’টি প্রয়োগ করেছেন। যা আপাতদৃষ্টিতে বারবেরি উপকূলের অধিবাসী বারবার জাতিগোষ্ঠীকে নির্দেশ করে। রোডারিগো ওথেলোকে "the thicklips" বলে উল্লেখ করেন, যা সাহারা-নিম্ন আফ্রিকা অঞ্চলের অধিবাসীদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে। তবে হনিগম্যানের মতে, এই জাতীয় মন্তব্যগুলির সব ক’টিই সংশ্লিষ্ট চরিত্রগুলি ওথেলোকে অপমান করার জন্য উল্লেখ করেছিলেন, তাই সেগুলিকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করার প্রয়োজন নেই।[২৮]
যদিও জ্যোৎস্না সিং লিখেছেন যে, ব্রাবানশিওর পক্ষে ওথেলোর ন্যায় শ্রদ্ধেয় ও সম্ভ্রান্ত সেনানায়কের সঙ্গে নিজ কন্যা ডেসডিমোনার বিবাহের বিরোধিতা করার পিছনে জাতিগত কারণ ছাড়া অন্য কোনও কারণ ক্রিয়াশীল তা মনে করা যায় না। তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যে দৃশ্যে ব্রাবানশিও ওথেলোর বিরুদ্ধে জাদুবিদ্যা প্রয়োগের মাধ্যমে তাঁর কন্যাকে বশীকরণের অভিযোগ আনছেন, সেই দৃশ্যটির প্রতি। উল্লেখ্য, এই দৃশ্যে ব্রাবানশিও বলেছিলেন যে "কালিমাখা বক্ষস্থল" ("sooty bosom") কামনা করা ডেসডিমোনার পক্ষে "অস্বাভাবিক" ("unnatural")।[২৯] শ্রীমতী সিং-এর মতে, যেহেতু ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে সাধারণ শ্যামবর্ণ মানুষদের বসবাস ছিল, সেই হেতু ব্রাবানশিওর মতো একজন ভেনেসীয় সেনেটর শুধুমাত্র শ্যামবর্ণের পরিপ্রেক্ষিতে নিজ কন্যার সঙ্গে ওথেলোর বিবাহের বিরোধিতা করবেন, তার কোনও অর্থ হতে পারে না। এ থেকেই অনুমিত হয় যে, ওথেলো সাধারণ শ্যামবর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন না; তিনি ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ।[২৯]
দি অক্সফোর্ড শেকসপিয়র গ্রন্থের সম্পাদক মাইকেল নেইল বলেন যে, ওথেলোর গাত্রবর্ণ সম্পর্কে প্রথম সমালোচনামূলক সূত্রটি (১৬৯৩ সালে প্রকাশিতটমাস রাইমারের সমালোচনা এবং ১৭০৯ সালে শেকসপিয়রের নিকোলাস রো কৃত সম্পাদনার খোদাইচিত্র) থেকে মনে হয়, তিনি ছিলেন সাহারা-নিম্ন অঞ্চলের ব্যক্তিত্ব। কিন্তু ১৮১৪ সালে এডমন্ড কিনের প্রযোজনাটির পূর্বে তাঁকে উত্তর আফ্রিকান হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি।[৩০] ১৬০০ সালে রানি প্রথম এলিজাবেথের দরবারে বারবেরির (মরক্কো) আরব রাজার মুর-জাতীয় রাজদূত আব্দুল ওয়াহিদ বিন মাসুদ বিন মোহাম্মদ ইউনুন ওথেলো চরিত্রটির অন্যতম অনুপ্রেরণা ছিলেন কিনা তা আলোচনা করেছেন হনিগম্যান। এই রাজদূত বেশ কয়েক মাস নিজের উচ্চপদস্থ সফরসঙ্গীদের নিয়ে লন্ডনে অবস্থান করেছিলেন এবং তাঁকে নিয়ে আলোচনাও অনেক হয়েছিল। এই ঘটনার কয়েক বছর পরেই শেকসপিয়র ওথেলো রচনা করেছিলেন। কিন্তু বিন মোহাম্মদ নিজে এই চরিত্রের এক উল্লেখযোগ্য অনুপ্রেরণা কিনা, সেই বিষয়ে হনিগম্যান সংশয় প্রকাশ করেছেন।[৩১]
ওথেলোকে "বারবেরি ঘোড়া" ("Barbary horse",1.1.113) ও "কামুক মুর" ("lascivious Moor", 1.1.127) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তৃতীয় অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যে তিনি ডেসডিমোনার অনুমিত পাপকে বর্ণনা করেছেন "আমার নিজের মুখমণ্ডলের ন্যায় কালো" ("black as mine own face") বলে। অন্যদিকে পঞ্চম অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে শ্বেতাঙ্গিনী ডেসডিমোনার গাত্রবর্ণকে উপস্থাপনা করা হয়েছে ওথেলোর কৃষ্ণবর্ণের বিপরীতে: "তুষার ভিন্ন আর কী তার গাত্রবর্ণের তুলনায় শুভ্র" ("that whiter skin of hers than snow")। ইয়াগো ব্রাবানশিওকে বলেন যে, "এক বুড়ো কালো ভেড়া / তোমার সাদা ভেড়িকে সম্মোহিত করেছে।" ("an old black ram / is tupping your white ewe", ১.১.৮৮)। এলিজাবেথীয় বাচনরীতিতে "কালো" শব্দটি গাত্রবর্ণ ছাড়াও বিভিন্ন ধারণার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হত এবং সেগুলির মধ্যে ছিল বহু ধরনের নেতিবাচক গূঢ়ার্থ।[৩৩][৩৪]
ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রায়শই ওথেলোকে একজন আরব মুর হিসাবে মঞ্চস্থ করা হত। ১৮৩৩ সালে প্রথম লন্ডনের মঞ্চে একজন কৃষ্ণাঙ্গ ওথেলোর ভূমিকায় অভিনয় করেন। ইনি ছিলেন আফ্রিকান-আমেরিকান ইরা অল্ডরিজ। রোজগারের তাগিদে তিনি স্বদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, অল্ডরিজ ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ওথেলো।[৩৫] শেকসপিয়র ওথেলোকে "মুর" হিসাবে উল্লেখ করে তাঁকে মুসলমান বা কৃষ্ণাঙ্গ বা কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমান – যাই বোঝাতে চান না কেন, ঊনবিংশ শতাব্দী ও বিংশ শতাব্দীর একটি বড়ো সময় ধরে অনেক সমালোচক বর্ণবৈষম্যের প্রেক্ষাপটেই বিচার করেন। তাঁদের বিচারে আন্তঃবর্ণ বিবাহ ছিল "নীতিভ্রংশতা" এবং তার পরিণাম ছিল ভয়াবহ।[৩৬] ওথেলো সম্পর্কে এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যবাদী যুগে নাটকটি বিশেষভাবে বিতর্কে জড়িয়ে পরে। সেই সময় সেই দেশে আন্তঃবর্ণ বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল এবং ওথেলো মঞ্চায়নেও বাধা দেওয়া হত।[৩৭]
চলচ্চিত্রে কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতার দ্বারা প্রথম উল্লেখযোগ্য ওথেলো রূপায়ণের নিদর্শনটি ১৯৯৫ সালের। কেনেথ ব্রেনেগ অভিনীত ইয়াগোর বিপরীতে ওথেলোর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন লরেন্স ফিশবার্ন।[৩৮] অতীতে শ্বেতাঙ্গ অভিনেতারাই ব্ল্যাকফেসে অথবা কালো মুখোশ পরে ওথেলোর ভূমিকায় অভিনয় করতেন। অধিকতর সাম্প্রতিককালে যে অভিনেতারা ‘ব্ল্যাক আপ’ বেছে নিয়ে ওথেলো চরিত্রে রূপদান করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম রালফ রিচার্ডসন (১৯৩৭), অরসন ওয়েলস (১৯৫২), জন গিলগাড (১৯৬১), লরেন্স অলিভিয়ার (১৯৬৪) ও অ্যান্টনি হপকিনস (১৯৮১)।[৩৮] ১৯৩০ থেকে ১৯৫৯ সালের মধ্যে তিনটি পৃথক প্রযোজনায় বিশিষ্ট কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান অভিনেতা পল রবসন ওথেলোর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। এই চরিত্রে তাঁকে নির্বাচনের পিছনে একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। ১৯৯৭ সালে শেকসপিয়র থিয়েটার কোম্পানি প্রযোজিত মঞ্চায়নে প্যাট্রিক স্টিউয়ার্ট ওথেলো চরিত্রে অভিনয় করেন। এই প্রযোজনায় অন্যান্য সকল চরিত্রের অভিনেতারা ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ।[৩৯][৪০] অপর এক শ্বেতাঙ্গ অভিনেতা টমাস থেইমও ২০০৭ সালে স্ট্র্যাটফোর্ডে রয়্যাল শেকসপিয়র থিয়েটারে মিউনিখ ক্যামারস্পিল কৃত মঞ্চায়নে ওথেলো চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৮০ ও ১৯৯১ সালে মাইকেল গ্যাম্বনও এই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকের অভিনয়ই সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করেছিল।[৪১][৪২] ২০০৮ সালে কানাডিয়ান টেলিভিশনে এই চরিত্রটিতে রূপদান করেন ভূমধ্যসাগরীয় (ব্রিটিশ-ইতালীয়) বংশোদ্ভূত কার্লো রোটা।[৪৩]
অনেকেই মনে করেন, শেকসপিয়র নামচরিত্রটির জাতি নির্দেশের মাধ্যমে তাঁকে সাংস্কৃতিকভাবে ও দৃশ্যগতভাবে ভেনেসীয় অভিজাত পুরুষ ও আধিকারিকদের থেকে বিচ্ছিন্ন করেছেন। তাই যখন একজন কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা এই চরিত্রটিতে অভিনয় করেন, তখন বিষয়টিকে অনেক বেশি অকৃত্রিম মনে হয়। কিন্তু জাতি-সংক্রান্ত প্রশ্নটির সমাধান কোনও একটি চরিত্রে অভিনেতা নির্বাচনের মাধ্যমে হওয়া সম্ভব নয়। ১৯৭৯ সালে কেইথ ফাওলারের প্রযোজনায় ওথেলো নাটকে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অভিনেতারা অভিনয় করেছিলেন। ভার্জিনিয়ার রিচমন্ডের এম্পায়ার থিয়েটারে (অধুনা নভেম্বর থিয়েটার) মঞ্চস্থ এবং আমেরিকান রিভিলস কোম্পানি প্রযোজিত এই নাটকটিতে নামভূমিকায় অভিনয় করেন আফ্রিকান-আমেরিকান অভিনেতা ক্লেটন করবিন এবং ইয়াগো চরিত্রে অভিনয় করেন মিশ্রজাতীয় হাওয়াইয়ান অভিনেতা হেনরি কে. বল। এই প্রযোজনায় ওথেলোর সেনাবাহিনীতে কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ উভয় ধরনের ভাড়াটে সৈনিক দেখা যায় এবং ইয়াগোর স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেন জনপ্রিয় কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেত্রী মেরি গুডম্যান হান্টার।[৪৪] ২০১৬ সালে নিউ ইয়র্ক থিয়েটার ওয়ার্কশপে স্যাম গোল্ড পরিচালিত প্রযোজনাটিতেও মিশ্রজাতীয় অভিনেতাদের নেওয়া হয়েছিল। এই ক্ষেত্রে ইংরেজ অভিনেতা ডেভিড ওয়েলোয়ো ও ড্যানিয়েল ক্রেইগ যথাক্রমে ওথেলো ও ইয়াগোর ভূমিকায়, মার্কিন অভিনেত্রী রাচেল ব্রসনাহান ডেসডিমোনার ভূমিকায়, ফিন উইটরক ক্যাসিওর ভূমিকায় এবং মার্শা স্টিফেনি ব্লেক এমিলিয়ার ভূমিকায় অভিনয় করেন।
ইংল্যান্ডের প্রোটেস্টান্ট ধর্মসংস্কার আন্দোলন সমাজে ধার্মিক ও নিয়ন্ত্রিত আচরণ প্রচার করত। সেই জন্য সমসাময়িক ইংরেজ সমাজের ঝোঁক ছিল বর্বরতা, প্রতারণা, ঈর্ষা ও লাম্পট্যের মতো সমাজের "অবাঞ্ছিত" বৈশিষ্ট্যগুলিকে যাদের "অন্য" বলে মনে করা হত, তাদের উপর আরোপ করা।[৪৫] কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ বা "অন্য"-এর আনুমানিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে সমসাময়িককালের রেনেসাঁ নাটকগুলিকে একাধারে উৎসাহিত ও জনপ্রিয় করে তোলা হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসাবে, জর্জ পিলের দ্য ব্যাটেল অফ অ্যালকাজার (১৫৮৮) নাটকে প্রদর্শিত কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের প্রতারণার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।[৪৬] মনে করা হয় যে, ওথেলোর এই "অন্যত্ব"ই তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কাছে তাঁকে পরাভূত করতে সহায়তা করেছিল। সেই সময়কার দর্শকমণ্ডলীর চাহিদা ছিল, নিজের জাতিসত্ত্বা এবং তাঁর ও ডেসডিমোনার মধ্যকার বয়সের পার্থক্য নিয়ে ওথেলো শঙ্কান্বিত থাকুন।
"মুর" উপাধিটি উত্তর আফ্রিকান বা মধ্যপ্রাচ্য বংশোদ্ভূত "অন্য" ধর্মাবলম্বীর দ্যোতক। শব্দটির সঠিক জাতিগত সংজ্ঞা অস্পষ্ট হলেও এই দ্যোতনা একাধারে ধর্মীয় ও জাতিগতই।[৪৭] অনেক সমালোচকের মতে, সমগ্র নাটক জুড়ে ‘ভূতে পাওয়া’র যে উল্লেখ বিশেষভাবে ওথেলোর রোগাক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে পাওয়া যায়, তার সঙ্গে সেই সময় জনমানসে প্রচলিত একটি ধারণার সম্পর্ক রয়েছে।[৪৮] ২০১২ সালে ফিলোজফি অ্যান্ড লিটারেচার নিবন্ধে টমাস এম. ভোজার বলেন যে, মৃগীরোগাক্রমণের সঙ্গে মন-শরীর সমস্যা ও আত্মার অস্তিত্বের একটি সম্পর্ক রয়েছে।[৪৯]
বহু বছর ধরে ওথেলোর চরিত্রটিকে নানা ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ. সি. ব্র্যাডলি ওথেলোকে উল্লেখ করেছেন "শেকসপিয়রের নায়কদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা রোম্যান্টিক" (এখানে "নায়ক" শব্দটির মাধ্যমে ব্র্যাডলি মুখ্য চরিত্র বুঝিয়েছেন) এবং "তাঁদের সকলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কবি" হিসাবে। অপর পক্ষে এফ. আর. লিভিস ওথেলোকে বর্ণনা করেছেন "আত্মশ্লাঘাপূর্ণ ব্যক্তি" হিসাবে। তবে কয়েকজন সমালোচক ওথেলোর চরিত্রটির প্রতি কিছুটা ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছেন। উইলিয়াম হ্যাজলিট তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি লিখেছেন: "মুরের প্রকৃতি মহৎ... কিন্তু তাঁর রক্ত সর্বাধিক দাহ্য প্রকৃতির।"
ওথেলো নাটকটির মঞ্চায়নের নথিবদ্ধ বিবরণ এতটাই সুপ্রতুল যা সচরাচর দেখা যায় না। যে মঞ্চায়নগুলির কথা নিশ্চিত জানা যায়, তার মধ্যে প্রথমটি হয়েছিল ১৬০৪ সালের ১ নভেম্বর লন্ডনের হোয়াইটহল প্রাসাদে। রিভিলস অফিসের নথি থেকে জানা যায়, অল সেন্ট’স ডে (অর্থাৎ ১ নভেম্বর) হোয়াইটহলের ব্যাঙ্কোয়েটিং হাউসে কিংস ম্যাজেস্টিজ অভিনেতাগণ দ্য মুর অফ ভেনিস নামে একটি নাটক অভিনয় করেন। এই নাটকটির নাট্যকারের নাম উক্ত নথিতে "শ্যাক্সবার্ড" (ইংরেজি: Shaxberd)।[৫০] এরপর ১৬১০ সালের ৩০ এপ্রিল গ্লোব থিয়েটারে এবং সেই বছরই সেপ্টেম্বরে অক্সফোর্ডে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল।[৫১] ১৬২৯ সালের ২২ নভেম্বর এবং ১৬৩৫ সালের ৬ মে নাটকটি মঞ্চস্থ হয় ব্ল্যাকফ্রেয়ারস থিয়েটারে। রাজকুমারী এলিজাবেথ ও পঞ্চম ফ্রেডরিক, ইলেক্টর প্যালাটাইনের বিবাহ উপলক্ষ্যে ১৬১২ সালের শীতে কিং’স মেন যে কুড়িটি নাটক মঞ্চস্থ করেছিল, তার অন্যতম ছিল ওথেলো।[৫২]
পুনরুজ্জীবন যুগে স্যামুয়েল পেপিস ১৬৬০ সালের ১১ অক্টোবর নাটকটি ককপিট থিয়েটারে মঞ্চস্থ হতে দেখেছিলেন। এই মঞ্চায়নে নিকোলাস বার্ট নামভূমিকায় এবং চার্লস হার্ট ক্যাসিওর ভূমিকায় অভিনয় করেন। ইয়াগোর ভূমিকায় অভিনয় করে ওয়াল্টার ক্লান বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সেই বছরই ৮ ডিসেম্বর টমাস কিলিগ্রিউর নতুন কিং’স কোম্পানি তাঁদের ভেরে স্ট্রিটস্থ থিয়েটারে এই নাটকটি মঞ্চস্থ করেন। এই মঞ্চায়নে ডেসডিমোনার ভূমিকায় অভিনয়কারিণী মার্গারেট হিউজেসই সম্ভবত প্রথম পেশাদার অভিনেত্রী যিনি ইংল্যান্ডে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত মঞ্চে অভিনয় করেন।
ওথেলো হল শেকসপিয়রের সেই অল্প কয়েকটি নাটকের অন্যতম যেগুলি পুনরুজ্জীবন ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে অভিযোজিত অথবা পরিবর্তিত হয়নি।[৫৩]
ঊনবিংশ শতাব্দীর ফরাসি রোম্যান্টিকদের মধ্যে শেকসপিয়রের জনপ্রিয়তা পুনরুজ্জীবিত হলে কবি, নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক আলফ্রেড ডে ভিনি ফরাসি ভাষায় লে মোর ডে ভেনিস (ফরাসি: Le More de Venise) নামে এই নাটকটি অনুবাদ করেন। ১৮২৯ সালের ২৪ অক্টোবর কমেডি-ফ্রান্স-এ এটির প্রিমিয়ার আয়োজিত হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ওথেলো চরিত্রে অভিনয়কারী বিশিষ্ট অভিনেতারা ছিলেন ইরা অল্ডব্রিজ, এডমন্ড কিন, এডউইন ফরেস্ট ও টমাসো সালভিনি এবং ইয়াগো চরিত্রে অসামান্য অভিনয় করেছিলেন এডউইন বুথ ও হেনরি আরভিং।
সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য মার্কিন প্রযোজনাটি সম্ভবত ১৯৪৩ সালে মার্গারেট ওয়েবস্টার কৃত মঞ্চায়নটি। সেই মঞ্চায়নে ওথেলো ও ইয়াগোর ভূমিকায় অভিনয় করেন যথাক্রমে পল রবসন ও জোস ফেরার। এই প্রযোজনাতেই প্রথম আমেরিকায় অপরাপর সকল চরিত্রে শ্বেতাঙ্গ অভিনেতাদের পাশাপাশি একজন কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা ওথেলো চরিত্রে অভিনয় করেন (তার আগে অবশ্য সকল চরিত্রে কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতাদের নিয়ে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল)। প্রযোজনাটি ২৯৬ বার মঞ্চস্থ হয়েছিল, যে সংখ্যা ব্রডওয়ে প্রযোজনায় যে কোনও শেকসপিয়রীয় নাটকের মঞ্চায়নের সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ। প্রযোজনাটি চলচ্চিত্রায়িত না হলেও এটিই ছিল রেকর্ডে প্রকাশিত শেকসপিয়রীয় নাটকের প্রথম দীর্ঘ অভিনয়। এটি প্রথমে প্রকাশিত হয়েছিল একটি মাল্টি-রেকর্ড ৭৮ আরপিএম সেটে এবং পরে প্রকাশিত হয় ৩-এলপি রেকর্ডে। রবসন ১৯৩০ সালে লন্ডনে প্রথম এই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। সেই প্রযোজনায় ডেসডিমোনার ভূমিকায় অভিনয় করেন পেগি অ্যাশক্রফট এবং রোডারিগোর ভূমিকায় অভিনয় করেন রালফ রিচার্ডসন।[৫৪] ১৯৫৯ সালে স্ট্র্যাটপফোর্ড অন অ্যাভনেও রবসন এই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। সেই সময় তাঁর সহ-অভিনেতারা ছিলেন মেরি উরি, স্যাম ওয়ানামেকার ও ভেনেসা রেডগ্রেভ। ১৯৫৯ সালে মধ্য-পশ্চিমি বাচনভঙ্গি ও রক-অ্যান্ড-রোল ড্রামবিট সহকারে মঞ্চস্থ এই "চটকদার" প্রযোজনাটি সম্পর্কে সমালোচকেরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও রবসন তাঁদের প্রশংসাই কুড়ান।[৫৫] দ্য ডেলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার ডব্লিউ. এ. ডার্লিংটন রবসনকে ওথেলো চরিত্রে তাঁর দৃষ্ট শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বলে উল্লেখ করেন।[৫৬] অন্যদিকে ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকায়, যেটিতে পূর্ববর্তী কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত রবসনের বামপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য তাঁকে কঠোরভাবে সমালোচনা করা হয়ে এসেছিল, সেখানেও তাঁর "শক্তিশালী ও রাজকীয়" অভিনয়ের প্রশংসা করা হয় (যদিও এটিকে "অভিনয়ের নয়, বরং উপস্থিতির বিজয়" বলে উল্লেখ করা হয়)।[৫৭]
দর্শকদের আগ্রহ বৃদ্ধির জন্য ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই অভিনেতারা পালা করে ইয়াগো ও ওথেলোর চরিত্রে অভিনয় করতেন। এই ধরনের পালাবদলের দু’টি সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল ড্রুরি লেনে উইলিয়াম চার্লস ম্যাকরেডি ও স্যামুয়েল ফেল্পস কৃত অভিনয় (১৮৩৭) এবং দ্য ওল্ড ভিকে রিচার্ড বার্টন ও জন নেভিল কৃত অভিনয় (১৯৫৫)। ১৮৮০ সালে এডউইন বুথের ইংল্যান্ড সফর দর্শক আকর্ষণে ব্যর্থ হলে হেনরি আরভিং বুথকে লন্ডনে আমন্ত্রণ জানান তাঁর সঙ্গে ওথেলো ও ইয়াগোর চরিত্র দু’টি পর্যায়ক্রমে অভিনয় করার জন্য। এই পদ্ধতিতে বুথের সফর সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে আগ্রহ জেগে ওঠে। জেমস ও’নিলও বুথের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে ওথেলো ও ইয়াগো চরিত্র দু’টিতে অভিনয় করেছিলেন।
মার্কিন অভিনেতা উইলিয়াম মার্শাল অন্তত ছয়টি প্রযোজনায় নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। লন্ডন সানডে টাইমস পত্রিকার হ্যারোল্ড হবসন তাঁকে সমসাময়িক কালে ওথেলো চরিত্রের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বলে উল্লেখ করেন।[৫৮] তিনি আরও বলেন:
[উইলিয়াম মার্শাল] …টারলে অপেক্ষাও মহত্তর, গিলগাড অপেক্ষাও সমরকুশল, ভাক অপেক্ষাও কাব্যিক। প্রথম প্রবেশ থেকে শেষে নিজের উদরে ছুরিকাঘাত পর্যন্ত তিনি ঋজু ও চমকপ্রদ রূপে দীর্ঘকায়, উচ্চ বাইজান্টাইন খিলানতুল্য আকৃতিবিশিষ্ট, সাদা সেমিটীয় পোশাক-পরিহিত, মরমিয়া, আশ্চর্য, আরব্য রোমান্স ও সৌষ্ঠবের এক প্রতিমূর্তি স্বরূপ। শ্রীযুক্ত মার্শাল নাটকটির সুদীর্ঘ আলংকারিক ভাষায় কোথাও হোঁচট খাননি, এবং শেষে সমগ্র প্রেক্ষাগৃহ তাঁর সম্মানে উঠে দাঁড়িয়েছিল।[৫৯]
১৯৬৮ সালে লস এঞ্জেলসে ক্যাচ মাই সোল শিরোনামে এই নাটকের জ্যাজ মিউজিক্যাল উপস্থাপনাতেও মার্শাল ওথেলোর ভূমিকায় অভিনয় করেন। এই প্রযোজনায় তাঁর বিপরীতে ইয়াগোর ভূমিকায় অভিনয় করেন জেরি লি লুইস।[৬০] ১৯৬৪ সালে রেকর্ডে ধৃত তাঁর ওথেলোর বিপরীতে ইয়াগোর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন জে রবিনসন এবং ১৯৮১ সালে ভিডিওকৃত সংস্করণে তাঁর বিপরীতে ইয়াগোর চরিত্রে রূপদান করেন রন মুডি। ১৯৮২ সালে ব্রডওয়ে প্রযোজনায় ওথেলো ও ইয়াগোর ভূমিকায় অভিনয় করেন যথাক্রমে জেমস আর্ল জোনস ও ক্রিস্টোফার প্লামার। ইনিই একমাত্র অভিনেতা যিনি নাটকে অভিনয় করে টনি পুরস্কারের মনোনয়ন লাভ করেছিলেন।
১৯৬৪ সালে রয়্যাল ন্যাশানাল থিয়েটারে লরেন্স অলিভিয়ার ওথেলোর ভূমিকায় অভিনয় করে প্রশংসিত হন। সেই সময় তিনি একটি মঞ্চ আতঙ্কের যে পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন, তার প্রেক্ষিতে তিনি যখন মঞ্চে একা থাকতেন, সেই সময় ফ্র্যাঙ্ক ফিনলেকে (ইয়াগোর চরিত্রে অভিনয়কারী) মঞ্চের বাইরে এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে হত, যেখান থেকে অলিভিয়ার তাঁকে দেখে নিজের স্নায়ু ঠিক রাখতে পারতেন।[৬১] এই মঞ্চায়নটি সম্পূর্ণত এলপিতে রেকর্ডেড হয় এবং ১৯৬৫ সালে জনসাধারণের চাহিদার প্রেক্ষিতে চলচ্চিত্রায়িতও হয় (অলিভিয়ারের জীবনীকারের মতে, মঞ্চ প্রযোজনাটির টিকিট পাওয়া অত্যন্ত দুষ্কর হয়ে পড়ত)। চলচ্চিত্র সংস্করণটি শেকসপিয়রের নাটক-ভিত্তিক ছবিতে অস্কার মনোনয়নের ক্ষেত্রেও একটি রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল – অলিভিয়ার, ফিনলে, ম্যাগি স্মিথ (ডেসডিমোনার চরিত্রে) এবং জয়েস রেডম্যান (ইয়াগোর স্ত্রী এমিলিয়ার চরিত্রে) প্রত্যেকেই অ্যাকাডেমি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন লাভ করেছিলেন। শেষ যে শ্বেতাঙ্গ অভিনেতারা ওথেলো চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসা অর্জন করেছিলেন, অলিভিয়ার তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তবে এর পরেও ১৯৭৯-১৯৮০ সালে রয়্যাল শেকসপিয়র কোম্পানিতে ডোনাল্ড সিনডেন, ১৯৮০ সালে রয়্যাল ন্যাশানাল থিয়েটারে পল স্কোফিল্ড, ১৯৮১ সালে বিবিসি টেলিভিশন শেকসপিয়র প্রযোজনায় অ্যান্টনি হপকিনস এবং ১৯৯০ সালে অ্যালান এইকবর্নের পরিচালনায় স্কারবরোতে একটি মঞ্চ প্রযোজনায় মাইকেল গ্যাম্বন প্রমুখ অভিনেতারাও ওথেলো চরিত্রে রূপদান করেছিলেন। অলিভিয়ারের পূর্ববর্তী প্রযোজনাতেও গ্যাম্বন অভিনয় করেছিলেন। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, "সেখানে আমি দ্বিতীয় ভদ্রলোকের চরিত্রটিও পাইনি। আমার একটা লাইনও ছিল না। ওইভাবেই পিছনে ছিলাম [-] এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে। সেটাই করতাম – আমার একটা ধাতব হেলমেট ছিল, একটা ইয়ারপ্লাগ ছিল আর আমরা দি আর্চার্স শুনতাম। কেউ জানত না। সব লাইন দি আর্চার্স শুনত। তারপর যখন বার্মিংহাম রেপে নিজে ওথেলো চরিত্রে অভিনয় করলাম, তখন আমার বয়স সাতাশ। প্রথম রাতে অলিভিয়ার আমাকে একটি টেলিগ্রাম পাঠালেন। তিনি বলেছিলেন, "আমাকে নকল করো।" তিনি বলেছিলেন, "আমি যা করতাম, তা-ই করো।" অলিভিয়ার ওথেলোর ক্ষেত্রে গলার স্বর নামিয়ে সংলাপ বলতেন। আমিও তাই করলাম। তিনি বড়ো নিগ্রো ঠোঁট আঁকতেন। আজকে সেটা করতে পারবেন না। গুলি করে দেবে। তিনি সম্পূর্ণ নিগ্রো মুখ তৈরি করতেন। সেই সঙ্গে পশ্চাদ্দেশও। আমিও সেগুলির সবই করেছি। তাঁকে অক্ষরে অক্ষরে নকল করেছি। শুধু আমার একটি পনি টেইল ছিল। আমি চরিত্রটি করেছি একজন আরব হিসাবে। আমি পনি টেইলের শেষে একটা ঘণ্টা বেঁধে সেটা মাথায় দিতাম। ভেবেছিলাম, সেভাবেই ভালো লাগবে। নড়াচড়া করলেই আমার চুল এলোমেলো হয়ে যেত।"[৬২] ওথেলো চরিত্রে ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গদের অভিনয় ১৯৯০ সালে গ্যাম্বনের সঙ্গেই শেষ হয়ে যায়। যদিও রয়্যাল শেকসপিয়র কোম্পানি ১৯৯৯ সালের আগে স্ট্র্যাটফোর্ডের প্রধান মঞ্চে এই নাটকটি উপস্থাপনা করতে পারেনি। সেই বছর রে ফিয়ারয়ন প্রথম ব্রিটিশ কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা হিসাবে এই চরিত্রে রূপদান করেন। তিনিই ছিলেন ওথেলো চরিত্রে রবসনের পরে আরএসসি-র প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা।[৬৩]
১৯৯৭ সালে শেকসপিয়র থিয়েটার কোম্পানির (ওয়াশিংটন ডি. সি.) একটি জাতিবৈপরীত্যমূলক প্রযোজনায় ওথেলোর ভূমিকায় অভিনয় করেন প্যাট্রিক স্টিউয়ার্ট। এটি ছিল একটি "ফোটো-নেগেটিভ" প্রযোজনা। অন্যান্য চরিত্রগুলিতে কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতাদের বিপরীতে একজন শ্বেতাঙ্গ ওথেলোকে উপস্থাপনা করা হয় এখানে। চোদ্দো বছর বয়স থেকে স্টিউয়ার্ট এই চরিত্রটিতে অভিনয় করার ইচ্ছা পোষণ করে আসছিলেন। তাই তিনি ও পরিচালক জুড কেলি নাটকটিকে বিপরীত মুখে স্থাপন করেন যেখানে ওথেলো পরিণত হন কৃষ্ণাঙ্গ সমাজে প্রবেশকারী এক শ্বেতাঙ্গে।[৩৯][৪০] নাট্য কোম্পানিগুলি ওথেলোকে নারী চরিত্র হিসাবে উপস্থাপনার পর চরিত্রটির ব্যাখ্যা পরে দীর্ঘতর হয়েছে। এই ক্ষেত্রে চরিত্রগুলির লিঙ্গ পরিবর্তিত আকারে উপস্থাপিত হয়েছে এবং তার মাধ্যমে শেকসপিয়রের নাটকে লিঙ্গ-সংক্রান্ত প্রশ্নগুলিও আলোচিত হয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানি আবার একক মঞ্চায়নে একই অভিনেতাকে দিয়ে একাধিক চরিত্রে অভিনয় করানোর মতো পরীক্ষাও চালিয়েছে।[৬৪][৬৫]
১৯৮৮ সালে কানাডিয়ান নাট্যকার অ্যান-মেরি ম্যাকডোনাল্ড রচিত গুডনাইট ডেসডিমোনা (গুড মর্নিং জুলিয়েট) ছিল ওথেলো ও রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট নাটক দু’টির পুনর্নির্মাণ। ১৯৯০ সালে গভর্নর জেনারেল’স অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী এই নাটকটিতে দেখা যায় জনৈক গবেষক একটি দুর্বোধ্য পাণ্ডুলিপির পাঠোদ্ধার করেন। সেই গবেষকের বিশ্বাস ছিল, এই পান্ডুলিপিটিই উক্ত নাটক দু’টির প্রকৃত উৎস। এরপর তিনি স্থানান্তরিত হন নাটক দু’টির মধ্যেই।[৬৬]
২০০৭ সালের ৪ ডিসেম্বর লন্ডনের ডনমার ওয়্যারহাউসে ওথেলো অভিনয় শুরু হয়। এই প্রযোজনাটির পরিচালক ছিলেন মাইকেল গ্র্যান্ডএজ। এতে ওথেলোর ভূমিকায় শিওয়েটেল এজিওফোর, ইয়াগোর ভূমিকায় ইওয়ান ম্যাকগ্রেগর, ক্যাসিওর ভূমিকায় টম হিডলস্টন, ডেসডিমোনার ভূমিকায় কেলি রেইলি এবং এমিলিয়ার ভূমিকায় মিশেল ফেয়ারলি অভিনয় করেন। এজিওফোর, হিডলস্টন ও ফেয়ারলি লরেন্স অলিভিয়ার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন। এলিওফোর পুরস্কারটি জয়ও করেন। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ার প্লেহাউসের সহযোগিতায় নর্দার্ন ব্রডসাইডসের প্রযোজনায় স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান লেনি হেনরি ওথেলোর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।[৬৭]
২০১৬ সালের মার্চ মাসে ইতিহাসবিদ ওনিয়েকা ইয়াং ওথেলো নামে একটি নাটক প্রযোজনা করেন। এটির উপজীব্য ছিল শেকসপিয়রের নাটকে উল্লিখিত ঘটনাবলির পূর্বে তরুণ ওথেলোর কাল্পনিক কাহিনি।[৬৮][৬৯] ২০১৬ সালের জুন মাসে ব্যারিটোন ও অভিনেতা ডেভিড সেরেরো একটি মরোক্কান প্রযোজনায় নাটকটির নামভূমিকায় অভিনয় করেন। এই প্রযোজনায় কয়েকটি ইহুদি-আরব গান ও নিউ ইয়র্কে ভার্দির অপেরা সংস্করণটি গৃহীত হয়েছিল।[৭০][৭১] ২০১৭ সালে অকল্যান্ডের পপ-আপ গ্লোবে বেন নেলরের পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয় নাটকটি। এই প্রযোজনায় নামভূমিকায় মাওরি অভিনেতা টে কোহে টুহাকা, ডেসডিমোনার ভূমিকায় জেসমিন ব্ল্যাকবরো ও ইয়াগোর ভূমিকায় হাকোন স্মেস্টাড অভিনয় করেন।[৭২] এই প্রযোজনাটি অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে স্থানান্তরিত হলে সেখানে নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন অপর মাওরি অভিনেতা রেগান টেলর।[৭৩]
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওথেলো, দ্য ফল অফ আ ওয়ারিয়র শিরোনামে একটি তামিল অভিযোজনা সিঙ্গাপুরে মঞ্চস্থ হয়। এটির পরিচালক ও প্রযোজক ছিলেন সুব্রহ্মণ্যম গণেশ।[৭৪]
বিভিন্ন দেশের জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে সাহিত্যের চরিত্র হিসাবে ওথেলো বিভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছেন। এই নাটকটি বহু সংখ্যক চলচ্চিত্রেও অভিযোজিত হয়েছে।