ওরিয়েন্টাল সেমিনারি

ওরিয়েন্টাল সেমিনারি

ওরিয়েন্টাল সেমিনারি কলকাতার একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়। ১৮২৯ সালে শিক্ষাবিদ গৌরমোহন আঢ্য সেযুগের এই প্রথম সারির বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। কেবল মাত্র হিন্দু ছেলেরাই এখানে পঠনপাঠনের সুযোগ পেত।[] ওরিয়েন্টাল সেমিনারি ছিল ভারতের প্রথম সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত স্কুল। কারণ, হিন্দু স্কুলকেও সেই সময় কিছু সরকারি নিয়মনীতি মেনে চলতে হত, যা ওরিয়েন্টাল সেমিনারির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না।[] সেই যুগে ইংরেজি শিখতে ছাত্রদের মিশনারি স্কুলগুলিতে ভর্তি হতে হত। সেই সব স্কুলে তারা যে শিক্ষা পেত তা ছিল ধর্মাশ্রয়ী শিক্ষা। গৌরমোহন আঢ্য কোনো প্রকার ধর্মীয় প্রভাব ব্যতিরেকে ছাত্রদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার উদ্দেশ্যেই এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।[] উল্লেখ্য এই যুগে ঐতিহ্যশালী সংস্কৃতফার্সি শিক্ষা তার পূর্বগৌরব হারিয়েছিল।

বিদ্যালয়

[সম্পাদনা]

প্রথমে বেঁশোহাটা অঞ্চলে এই বিদ্যালয়টি অবস্থিত ছিল। পরে তা জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্র সরণির (তৎকালীন চিৎপুর রোড; তবে চিৎপুরে নয়) বর্তমান ঠিকানায় উঠে আসে। ১৮১৪ সালে বাংলার তদনীন্তন গভর্নর লর্ড কার্মিকল এই বিদ্যালয়ের উদ্বোধন করেন। সেই সময় এই বিদ্যালয়ের মাসিক বেতন ছিল ৩ টাকা। হিন্দু স্কুলের মাসিক বেতন ৫ টাকা হওয়ার দরুন ওরিয়েন্টাল সেমিনারি সেই সময় অধিক সংখ্যক ছাত্র টানতে সক্ষম হয়।[]

১৮৩৬ সালে শিশুদের জন্য প্রাতঃকালীন বিভাগটি চালু হয়। ১৮৩৯ সালে বাংলা ভাষাকে শিক্ষার একটি মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হয়। জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় চিৎপুর, দক্ষিণ কলকাতা ও বেলঘড়িয়া অঞ্চলেও এই বিদ্যালয়ের শাখা স্থাপিত হয়। ১৯৩৪ সালে ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে ছাত্র ও ছাত্রীদের সহশিক্ষাপ্রথা চালু হয়। মার্টিন বার্ন নির্মিত মূল বিদ্যালয় ভবনটি ১৯৯৯ সালে হেরিটেজ বিল্ডিং বা ঐতিহ্য ভবন ঘোষিত হয়।[]

১৯০৭ সাল থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এই বিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতির সভাপতি ছিলেন। ১৯২৬ সালে এই পদে বৃত হন অ্যানি বেসান্ত[] ২০০৫ সালে বিদ্যালয়ের ১৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হয়।[]

প্রতিষ্ঠাতা ও শিক্ষকগণ

[সম্পাদনা]

গৌরমোহন আঢ্য (২০ জানুয়ারি, ১৮০৫ – ১৩ মার্চ ১৮৪৬) কোনো প্রকার সরকারি সাহায্য ছাড়াই এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে এবং মেধাবী ছাত্রদের এই বিদ্যালয়ের প্রতি আকর্ষিত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষক নির্বাচনের ব্যাপারেও তিনি যথেষ্ট সতর্ক ছিলেন। জুনিয়র ক্লাসের জন্য তিনি ইউরেশিয়ানদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করতেন। বাঙালি শিক্ষকদের নিয়োগ করতেন ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসের জন্য এবং উচ্চতর শ্রেণির জন্য তিনি উচ্চশিক্ষিত বাঙালি ও ইংরেজদের শিক্ষক রূপে নিয়োগ করতেন। একবার শিক্ষকের সন্ধানে শ্রীরামপুর গিয়ে ফেরার পথে হুগলি নদীতে এক নৌকা-দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু ঘটে।[]

পালাকার অঘোরনাথ কাব্যতীর্থ এই বিদ্যালয়ের হেডপন্ডিত নিযুক্ত হন। বিশিষ্ট শেকসপিয়রবিদ ক্যাপ্টেন ডি. এল. রিচার্ডসন কিছুকাল এই বিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষকতা করেছিলেন।[]

বিশিষ্ট প্রাক্তনী

[সম্পাদনা]

ওরিয়েন্টাল সেমিনারি ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের প্রথম অভিজ্ঞতা থেকেই শিশু রবীন্দ্রনাথের মনে শিক্ষক হওয়ার বাসনা জেগে ওঠে। এই সময় তিনি একটি বেত হাতে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির বিরাট বারান্দার রেলিংগুলিকে পড়িয়ে বেড়াতেন।[]

অন্যান্য বিশিষ্ট প্রাক্তনীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: কৃষ্টদাস পাল, কৈলাসচন্দ্র বসু, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, অক্ষয়কুমার দত্তপরেশ ধর মিঠুন চক্রবর্তী []

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Kopf, David, The Brahmo Samaj and the Shaping of the Modern Indian Mind, p. 49, Princeton University Press.
  2. Roy, Subhajoy। "Pages from past lessons"। The Telegraph, 13 January 2006। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৫-০৪ 
  3. Sengupta, Subodh Chandra and Bose, Anjali (editors), 1976/1998, Sansad Bangali Charitabhidhan (Biographical dictionary) Vol I, (বাংলা), p. 147, আইএসবিএন ৮১-৮৫৬২৬-৬৫-০
  4. "Buddha woe over English"। The Telegraph, 20 February 2005। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৫-০৪ 
  5. ব্যানার্জি, হিরান্ময়, ঠাকুরবাড়ির কথা, (বাংলা), পৃ. ১২৪, শিশু সাহিত্য সাংসদ