নারীর প্রতি সহিংসতা |
---|
ধারাবাহিকের অংশ |
হত্যা |
যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণ |
বিকৃতি |
অন্যান্য বিষয় |
আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো |
সম্পর্কিত বিষয় |
কন্যা কেনা অথবা বিবাহযোগ্য মেয়ে খরিদ করা হল সম্পদ হিসেবে 'বিবাহযোগ্য মেয়ে খরিদ করা' একট শিল্প অথবা ব্যবসা[১] এবং সময়মতো যে সম্পদ[২] পুনরায় ব্যবসা করার জন্যে বেচকেনা করা যায়।[১] অন্যান্যদের কাছে বিবাহযোগ্য মেয়ে কেনা এবং বেচা হল ভারত এবং চিন দেশের মেয়ে বিক্রেতা ও মেয়ে ক্রেতাদের অভ্যাস। এই অভ্যাসকে বলা হয় এক ধরনের 'সুবিধের বিবাহ' কিন্তু এই ধরনের অভ্যাস বিশ্বের অনেক দেশেই বেআইনি করা হয়েছে।[৩]
বিবাহযোগ্য মেয়ে কেনা হল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের একটা বহু পুরোনো অভ্যাস।[৪] বিবাহযোগ্য মেয়ে কেনা হচ্ছে ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য, যেমন, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড,[৫] এবং পাঞ্জাব[৪] ইত্যাদিতে অতি সাধারণ ব্যাপার। সিএনন-আইবিএন তথ্য অনুযায়ী ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে মহিলাদেরকে 'কেনা, বেচা, পাচার করা, ধর্ষণ করা এবং তাদের বিনা অনুমতিতে বিয়ে' করা হয়। বিহার, অসম এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে সাধারণত বিবাহযোগ্য মেয়েদের সংগ্রহ করা হয়ে থাকে।[৩] যদি বিক্রেতার কাছ থেকে কেনা হয় তাহলে কন্যার দর পড়ে (ঝাড়খণ্ডে আঞ্চলিকভাবে বলা হয় 'পরোস') সম্ভবত ৪,০০০ থেকে ৩০,০০০ ভারতীয় টাকা, যেটা ৮৮ থেকে ৬৬০ আমেরিকান ডলার[৫] কন্যার মাবাবাকে সাধারণত দেওয়া হয় গড়ে ৫০০ থেকে ১০০০ ভারতীয় টাকা (আমেরিকান ডলারে ১১ থেকে ২২এর আশপাশ)। পুরুষের তুলনায় মহিলার সংখ্যা কম হওয়ায় কন্যা কেনার কারণ হিসেবে মনে করা হয়। এই অনুপাত কম হওয়াই পালাক্রমে বেশির ভাগ ভারতীয় মাবাবার কন্যাসন্তানের চেয়ে পুত্রসন্তান থাকাটা বেশি পছন্দের এবং কন্যাভ্রূণ হত্যাএর কারণ। বিবিসি খবর অনুযায়ী ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে হরিয়ানা রাজ্যে ১০০০ জন পুরুষ পিছু ৮৬১ জন মহিলার অনুপাত ছিল; এবং ভারতের সার্বিক জাতীয় অনুপাত ছিল ১০০০ জন পুরুষ পিছু ৯২৭ জন মহিলা। মহিলাদের শুধুমাত্র যে বিবাহ করা কিংবা স্ত্রী বানানোর জন্যে কেনা হোত তাই-ই নয়, কিন্তু তাদের খামারের কাজে অথবা বাড়ির পরিচারিকার কাজেও লাগানো হোত। বেশির ভাগ মহিলা 'যৌন দাসী' হয়ে যেত[৫] অথবা জবরদস্তি শ্রমিক[৩] যারা পরে মানব পাচারকারীদের কাছে পুনরায় বিক্রি হয়ে যেত।[৫] এবং খরচ উশুল করে নিত।[৩]
পাঞ্জাবি লেখক কিরপাল কাজাকের মতে রাজপুতদের আগমনের পর ঝাড়খণ্ড রাজ্যে বিবাহযোগ্য মেয়ে বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু হতে থাকে। উপজাতিরা মহিলাদেরকে গয়না পরিয়ে সাজিয়ে দিত বিক্রি করার জন্যে। মহিলাদেরকে বিবাহযোগ্য কন্যা বানিয়ে বিক্রির অভ্যাস ভারতে সবুজ বিপ্লব হওয়ার পর ক্রমশ কমতে আরম্ভ করে, ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে 'সাক্ষরতা বৃদ্ধি' এবং পুরুষ-মহিলা লিঙ্গ অনুপাত আস্তে আস্তে কমে গিয়ে ভালো অবস্থায় আসে। যাইহোক, লিঙ্গ অনুপাত ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে আবার খারাপ হয়। বিবাহযোগ্য মেয়ে কেনা সমাজের গরিব অংশে, বিশেষ করে চাষি, তফশিলি জাতি এবং উপজাতিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারে অনটনের কারণে এবং 'জমিজমা সম্পদের ভাগাভাগি রোধ করতে শুধুমাত্র একজন সন্তানের বিয়ে হোত'।[৪]
বিবাহযোগ্য মেয়ে কেনাও চিন দেশে একটা প্রচীন ঐতিহ্য।[১] এই বদভ্যাস চিনা কমিউনিস্টরা ব্যাপকভাবে উপড়ে ফেলতে চেয়েছিল। যাইহোক, আধুনিক এরকম অভ্যাস 'গ্রাম্য অঞ্চলের দিকে থেকেই গিয়েছিল'; যেটাকে আবার অন্যভাবে বলা হোত 'ভাড়া করা বিয়ে'।[৬] চিনের বেসরকারি সংস্থা অল-চায়না উওমেন্স ফেডারেশনএর দিং লু জানিয়েছেন, চিনের নতুন অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার কারণে বিবাহযোগ্য মেয়ে কেনার অভ্যাসের পুনরুত্থান ঘটেছিল।[১] ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে চিনা পুলিশ ৮৮,০০০এর অধিক মহিলা এবং শিশুকে উদ্ধার করেছিল, যাদেরকে বিয়ে এবং দাসত্ব করার উদ্দেশ্যে বেচে দেওয়া হয়েছিল, এবং চিনা সরকার দাবি করেছিল যে, ১৪৩,০০০ চোরাচালানকারীকে ধরা হয়েছিল এবং দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। কিছু মানবাধিকার কর্মীদের গোষ্ঠীর বিবৃতি অনুযায়ী বলা হয় যে, উপর্যুক্ত সংখ্যাটা ঠিক নয় এবং অপহরণ করা মহিলাদের প্রকৃত সংখ্যাটা হল আরো অনেক বেশি। ইউ এস নিউজ অ্যান্ড ওয়র্ল্ড রিপোর্টএ বে ফ্যাং এবং মার্ক লেয়ং খবর দেন যে, "সরকার মনে করে স্ত্রীদের নিয়ে এই ব্যবসা একটা লজ্জাকর সমস্যা, এই অল্প কয়েক বছর যখন কিনা এ সম্পর্কে সংখ্যাতত্ত্ব দেওয়া শুরু হয়েছে, এবং এরা সেই সব মহিলার ওপর আলোকপাত করার চেষ্টা করেছে, যাদেরকে ব্যবসায় না-জড়িয়ে রক্ষা করা হচ্ছে।"[৭] কারণ যোগ হয় দারিদ্র্য এবং গ্রাম্য অঞ্চলে বিবাহযোগ্য মেয়ে জমা (গ্রাম্য মেয়েরা শহরে যায় কাজ করার জন্যে)।[১] মহিলারা যেমনই কাজ খোঁজার জন্যে শহরের দিকে যেত, তেমনই তারা পুরুষদের দ্বারা বেপরোয়াভাবে অস্থাবর সম্পত্তিরূপে স্ত্রী পাওয়ার জন্যে প্রতারিত হোত।"[৭] ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে চিনে এক-সন্তান নীতি কার্যকর হওয়ায় চিনা দম্পতিদের সন্তানের জন্যে ঐতিহ্যগত পছন্দের পরিবর্তে বিবাহযোগ্য মেয়ে কমে গিয়েছে।[১] দ্য চাইনিজ অ্যাকাডেমি অফ সোশ্যাল সায়েন্সেসের হিসেবে বলা হয়েছে যে, ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে চিনে প্রতি ১২০ জন পুরুষে ১০০ মহিলার অনুপাত ছিল, গ্রামীণ অঞ্চলে এই অসম অনুপাত ছিল প্রায় ১৩০ পুরুষ পিছু ১০০ জন মহিলা। ঠিক এভাবেই পুরুষদের স্ত্রী হিসেবে মহিলা কেনার উপাদান পণসমূহ দামি হয়ে গিয়েছল। হিউম্যান রাইটস ইন চায়না বলেছে যে, ঐতিহ্যগত পণের অর্থ দেওয়ার চেয়েও একজন মেয়ে পাচারকারীর কাছ থেকে ২,০০০ থেকে ৪,০০০ ইয়েন দাম দিয়ে একটা স্ত্রী কেনা একজন পুরুষের পক্ষে সহজতর ব্যাপার; যেটা কখনো আবার ১০,০০০ ইয়েনও হয়ে যায়। গ্রামীণ কর্মীদের জন্যে গড়ে মেয়ে বিক্রি একটা সামর্থ্যের কাজ, যখন ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে চিনের গ্রামীণ কর্মীরা মাসে ৬০ ডলার রোজগার করত।[৭] বিবাহযোগ্য মেয়ে বিক্রির জন্যে বাইরের দেশ থেকে আসত, যেমন, ব্রহ্মদেশ, লাওস, ভিয়েতনাম এবং উত্তর কোরিয়া। মেয়েদের শারীরিক গড়নের ওপর তাদেরকে বিবাহযোগ্য মেয়ে কিংবা যৌনকর্মী হিসেবে বিক্রি করবে সেটা মেয়ে-ব্যবসায়ীরা ঠিক করত। মেয়ে-বিক্রির দাললরা মেয়েদের ফুসলিয়ে নেওয়ার একটা সাধারণ কৌতুকের আশ্রয় নিত; তাদের হরণ করার বদলে কারখানায় ভালো কাজের লোভ দেখিয়ে বিক্রির ধান্ধা করত। মেয়ে-ব্যবসায়ীরা একজন যুবতী মেয়েকে ২৫০ থেকে ৮০০ আমেরিকান ডলারে বিক্রি করতে পারত। ৫০ থেকে ১০০ আমেরিকান ডলার যেত প্রাথমিক মেয়ে হরণকারীর পকেটে, যখন বাকি আয়টা যেত মেয়ে চালানকারীদের কাছে, যারা সরাসরি আসল ক্রেতাদের কাছে আনত।[১]
যেসব চিনা মহিলাকে স্ত্রী হিসেবে কেনা হোত, তাদের মধ্যে সঙ্গে বাচ্চা থাকা মহিলাদের ওই বিয়েতে থেকে যাওয়ার প্রবণতা বেশি ছিল। চায়না উওমেন্স ফেডারেশনএর ফ্যাং য়ুঝু ওইসব মহিলাদের কৃতিত্ব দেন যে, 'তাদের দৃঢ় কর্তব্যবোধ আছে', এবং ধারণাটা হল, তাদের স্বামীকে ছেড়ে যাওয়াটা লজ্জাকর ব্যাপার। য়ুঝু আরো কৃতিত্ব দেন যে, সম্ভবত উক্ত মহিলাদের অনেকের মনে হয়েছে ঘরে ফিরে আগেকার দারিদ্র্য ও কঠিন পরিশ্রমের চেয়ে তাদের জবরদস্তি বিয়ে ভালো বিকল্প অথবা কিছু কিছু মহিলা যেহেতু 'ইতোমধ্যে একজন স্বামীর সঙ্গে আছে' এই ধারণায় আর অন্য স্বামীর কথা তারা ভাবছেনা।[৭]
যেসব সাহিত্যে ফল্গুধারার মতো মহিলাদেরকে বিবাহযোগ্য মেয়ে হিসেবে বিক্রি করার কাহিনি জানা যায় সেই শিরোনামগুলো হল: আরবি লেখক মির দাদএর 'নিয়ামি', পাঞ্জাবি ভাষাতে 'মুল দি তিবীন' (অর্থ 'একজন কেনা মেয়ে'), 'কুদেসান' (পাঞ্জাবিতে অর্থ 'অন্য ভূমি থেকে একজন মেয়ে), পাঞ্জাবি ঔপন্যাসিক দলিপ কাউর তিয়না লিখিত 'এহ্ হামারা জীয়না', এবং নাট্যকার আজমির আউলাখ লিখিত নাটক 'ইক হোর রামায়ণ'।[৪]
বিবাহযোগ্য মেয়ে কেনার বিষয়বস্তু নিয়ে চলচ্চিত্র হয়েছে; হায়দরাবাদ, ভারত থেকে উপসাগরীয় দেশসমূহতে প্রবাসী ভারতীয়দের বিবাহযোগ্য মেয়ে কেনা বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সাগর সারহাদি নির্দেশিত ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে প্রস্তুত চলচ্চিত্র বাজার।[৮]