কন্যাশিশু হত্যা (অন্য অর্থে ভ্রূণহত্যা ) হল নবজাত শিশুকন্যাকে স্বেচ্ছাকৃত হত্যা। যেসব দেশে কন্যাশিশু হত্যার ইতিহাস আছে সেখানে একটা কুপ্রথা হল আধুনিক বিজ্ঞানের প্রয়োগে লিঙ্গের নির্ধারণ করে অবাঞ্ছিত হলে গর্ভপাত করানোর অভ্যাস। চিন, ভারত এবং পকিস্তানএর মতো বিভিন্ন দেশে এই কন্যাশিশু হত্যা একটা প্রধান উদ্বেগের কারণ। এটা সওয়াল করা হয় যে, পুরুষপ্রধান সমাজে নারীদের সব সময় দাবিয়ে রাখার প্রবণতা থেকেই নারীদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্ব করা হয়।[১]
১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে নৃবিজ্ঞানী লায়লা উইলিয়ামসন তার একত্র করা তথ্যের একটা সংক্ষিপ্তসার থেকে জানতে পারেন শিশুহত্যা কত বিস্তৃত ছিল, দেখা যেত যে, প্রত্যেক মহাদেশেই শিশুহত্যা সংঘটিত হয়েছে এবং এগুলো শিকারি সংগ্রাহকসমূহ থেকে উন্নত সমাজ সকলের দ্বারাই সংগঠিত হোত; এবং এই অভ্যাস একটা ব্যতিক্রম ছিলনা, বরং এটা ছিল খুবই সাধারণ।[২] অস্ট্রেলিয়া, আলাস্কা এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশীয় জনগণের মধ্যে এই অভ্যাস ভালোভাবেই নথিভুক্ত করা ছিল, এবং বারবারা মিলারের মত অনুযায়ী এই অভ্যাস 'প্রায় বৈশ্বিক', এমনকি পশ্চিমেও। মিলার যুক্তি দেন যে, যেখানে মহিলারা কৃষিকাজে নিযুক্ত নেই এবং যেখানে কন্যাপণ একটা প্রথা সেখানে কন্যাশিশু হত্যা একটা প্রচলিত ব্যাপার।[৩] ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে চার্লস ডারউইন তার দ্য ডিসেন্ট অফ ম্যান, অ্যান্ড সিলেকশন ইন রিলেশন টু সেক্স বইতে লিখেছেন যে, এই অভ্যাস অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী উপজাতিদের মধ্যে প্রচলিত ছিল।[৪]
১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে অমর্ত্য সেন নিউ ইয়র্ক রিভিউ বুকস্এ বর্ণনা করেছেন যে, এশিয়ায় ১০ কোটি কম মহিলা অনুমান করা যায়, এবং যে 'হারিয়ে যাওয়া' সংখ্যাটা "আমাদের নীরবে একটা ভয়ংকর অসমতার গল্প বলে এবং যা মহিলাদের বাড়তি মরণশীলতার কারণ।" প্রাথমিকভাবে অমর্ত্য সেনের লিঙ্গ পক্ষপতিত্বের পরামর্শ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল এবং এটা বলা হয়েছিল যে, হেপাটাইটিস বি, স্বাভাবিক লিঙ্গ অনুপাতএর পরিবর্তনের কারণ। যাইহোক, এটা বর্তমানে বিস্তারিতভাবে মেনে নেওয়া হয় যে, বিশ্বব্যাপী মহিলার সংখ্যা কম হওয়ার কারণ হল লিঙ্গবিশেষে গর্ভপাত করানো, কন্যাশিশু হত্যা এবং অবহেলা।[৫]
সপ্তম শতকের আরবএ, ইসলাম ধর্মীয় সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার আগে কন্যাশিশু হত্যা ব্যাপকভাবে চালু ছিল। এটা পণ্ডিতদের দ্বারা আরোপিত একট প্রথা ছিল যাতে মহিলাদেরকে সমাজের 'সম্পদ' হিসেবে দেখা হোত। অন্যেরা অনুমান করত যে, একটা দারিদ্র্যের জীবন থেকে প্রতিরোধ করার জন্যে মায়েরা কন্যাশিশুকে হত্যা করবে। ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার পর এই কন্যাশিশু হত্যা বেআইনি হয়ে যায়।[৬]
চীনের কন্যাশিশু হত্যার ইতিহাস ২,০০০ বছরের বিস্তৃত সময়ের।[৭] ষোড়শ শতকের শেষদিকে খ্রিস্টান মিশনারিদের আগমনের সঙ্গে মিশনারিরা আবিষ্কার করলেন যে, সেখানে কন্যাশিশু হত্যা সংঘটিত হচ্ছে - সদ্যোজাতদের নদী অথবা জমা করা রাবিশের মধ্যে ছুড়ে ফেলতে দেখা যেত। সপ্তদশ শতকে মাতেও রিকি নথিবদ্ধ করেছিলেন যে, এই অভ্যাস চীনের বিভিন্ন প্রদেশে ঘটেছিল এবং যে অভ্যাসের প্রাথমিক কারণ ছিল দারিদ্র্য।[৮]
ঊনবিংশ শতকে চীনে কন্যাশিশু হত্যা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। তখনকার কিং থেকে লেখা পাঠ করে প্রচলিত শব্দটা জানা গিয়েছিল নি নু ('শিশু কন্যাদেরকে ডোবানো'), এবং শিশু কন্যাকে ডুবিয়ে হত্যা করার অভ্যাসটা সাধারণ পদ্ধতি ছিল। অন্যান্য হত্যার পদ্ধতি ছিল দম বন্ধ করা এবং খেতে না-দেওয়া।[ক][১০] সদ্যোজাতকে হত্যার অন্য পদ্ধতি ছিল কন্যাশিশুকে কোনো খোলামেলা জিনিসের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া: কন্যাশিশুকে কোনো ঝুড়ি অথবা বালতির মধ্যে রেখে সেটা আবার একটা গাছের মধ্যে ঝোলানো হোত। নারীমঠগুলোতে বৌদ্ধ 'শিশু টাওয়ার' বানানো হোত, যাতে জনগণ একটা শিশুকে সেখানে রখতে পরে; যাইহোক, তবে এটা পরিষ্কার ছিলনা যে, শিশুটাকে দত্তক নেওয়ার জন্যে রাখা হয়েছে অথবা ওটা ইতিমধ্যে মারা গিয়েছে এবং তার শেষকৃত্যের কাজে ওখানে রাখা হয়েছে। ১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দে জিয়াংক্সি প্রদেশে এক মিশনারি লিখেছিলেন যে, এই শিশুদের যখন ওই খোলামেলার মধ্যে কোনো জিনিসে ফেলে রাখা হোত, তখন তারা দু-দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকত, এবং তার পর যত্ন না-নেওয়ার জন্যে অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হোত।[১১]
ঊনবিংশ শতকে চীনের বেশির ভাগ প্রদেশে কন্যাশিশু হত্যার অভ্যাস চালু ছিল। ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসি যেশুইট মিশনারি গ্যাব্রিয়েল পালাত্রে[১২] ১৩টা প্রদেশ থেকে তথ্য জোগাড় করেছিলেন, এবং অ্যানালেস দে লা সাইন্তে-এনফানস (অ্যানালস অফ দ্য হোলি চাইল্ডহুড)ও শ্যাংক্সি এবং সিকুয়ানএ কন্যাশিশু হত্যার প্রমাণ দেখেছিল। পালাত্রের তথ্যাদি থেকে দেখা যায়, এই বদভ্যাস দক্ষিণপূর্বের প্রদেশগুলোতে এবং নিম্ন ইয়াংসি নদী অববাহিকা অঞ্চলে অধিকতরভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।[১৩]