দেশ অনুযায়ী ইসলাম |
---|
![]() |
![]() |
বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ কম্বোডিয়ায় ইসলাম একটি সংখ্যালঘু ধর্ম। কম্বোডিয়ার মুসলিমরা মূলত চাম ও মালয় বংশোদ্ভূত। একটি হিসাব মতে, ১৯৭৫ সালের শেষের দিকে কম্বোডিয়ায় ১৫০,০০০ থেকে ২০০,০০০ জন মুসলমান ছিল। পরে খেমাররুজদের নিপীড়নের ফলে তাদের সংখ্যা হ্রাস পায় এবং ১৯৮০ এর দশকের শেষের দিকে তারা তাদের আগেকার জনবল ও শক্তি হারিয়ে ফেলে। ২০১৬ সালে দেশটির ধর্ম ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বলে যে, কম্বোডিয়ায় মোট ৩৬১,৪৮৩ জন মুসলিম বসবাস করেন, যারা মোট জনসংখ্যার ২.%।
মোট জনসংখ্যা | |
---|---|
৩৬১,৪৮৩ | |
উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যার অঞ্চল | |
কাম্পং চাম, ফান রাং-থাপ চাম, ফান থিয়েট | |
ধর্ম | |
শাফেঈ (ফিকহ), মাতুরিদি (আকিদা) | |
ধর্মগ্রন্থ | |
কুরআন, হাদিস, শাফেঈ (আইনশাস্ত্র) | |
ভাষা | |
চ্যাম ভাষা, মালয় ভাষা |
অন্যান্য চ্যাম ও মালয় মুসলিমদের মত কম্বোডিয়ার চ্যাম ও মালয় মুসলিমরা সাধারণত সুন্নি ইসলামের শাফেয়ী মাজহাব ও ধর্মীয় দার্শনিক ব্যাখ্যায় মাতুরিদি মতবাদ অনুসরণ করেন। ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত জাতিগত কম্বোডীয়দের একটি ছোট সংখ্যাও রয়েছে। চ্যামদের মাঝে তাবলিগ জামাতের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়েছে[১]
২০০৯ সালে পিউ রিসার্চ সেন্টার অনুমান করে যে, কম্বোডিয়ায় মোট ২৩,৬০০০ জন মুসলিম বাস করেন, যা মোট জনসংখ্যার ১.৬%। কম্বোডিয়ার সংস্কৃতি ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৬ সাল পর্যন্ত দেশে প্রায় ৩৬১,৪৮৩ জন মুসলমান ও ৮৮৪টি মসজিদ গোটা কম্বোডিয়া জুড়ে ছড়িয়ে ছিল।[১] ২০১৭ সালে প্রকাশিত পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্য মতে, কম্বোডিয়ায় প্রায় ৩১১,০৪৪ জন মুসলিম বাস করেন। [২]
কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও লাওসে ইসলামের ইতিহাস চ্যাম জাতিগোষ্ঠীর ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। খ্রিস্টীয় ৩ শতাব্দীতে চ্যাম লোকেরা দক্ষিণ ভিয়েতনামের উপকূল জুড়ে চম্পা রাজ্য গঠন করে। কিছু বর্ণনা অনুসারে, ইসলামের সাথে চ্যামদের প্রথম যোগাযোগ নবিজি মুহাম্মাদ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শ্বশুর হজরত জাহশের মাধ্যমে হয়েছিল। তিনি একদল সাহাবার সাথে ৬১৭ সালে আবিসিনিয়া থেকে সমুদ্রপথে ইন্দো-চীনে আসেন।[৩]
৯ম শতাব্দীতে চ্যাম সমাজে ইসলাম প্রবেশ করতে থাকে। ১৬০৭ সালের পর একজন চ্যাম রাজা ইসলাম গ্রহণ করলে ইসলাম চ্যাম সমাজে রাজকীয় ধর্ম হয়ে ওঠে এবং প্রায় অধিকাংশ চ্যামই ইসলাম গ্রহণ করেন। ১৮৩২ সালের ভিয়েতনাম চম্পা রাজ্য আক্রমণ করে জবর দখল করার ফলে ভিয়েতনাম থেকে পালিয়ে আসা চাম মুসলমানরা কম্বোডিয়ায় আশ্রয় নেয়। [৩][৪]
১৬৪২ সালে রাজা প্রথম রামাথিপাদি কম্বোডিয়ার সিংহাসনে আরোহণ করেন। তখন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং কম্বোডিয়ার একমাত্র মুসলিম শাসক হন। এরপর দখলদার ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধিদের হত্যা ও কম্বোডিয়া থেকে কোম্পানিকে বহিষ্কারের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জনগণ ১৬৫৪ সালে নগুয়েন প্রভুদের সহায়তায় তাকে পদচ্যুত করে। এরা তার শাসনের পরের বছরগুলিতে কম্বোডিয়ায় অনেক অস্থিরতা সৃষ্টি করে রেখেছিল।[৩]
চামদের নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত মসজিদ রয়েছে। ১৯৬২ সালে গোটা দেশে প্রায় ১০টি মসজিদ ছিল। ১৯ শতাব্দীর শেষের দিকে কম্বোডিয়ার মুসলমানরা চার জন বিশিষ্ট ধর্মীয় ব্যক্তি; তথা: মুফতি, টুক কালিহ, রাজা কালিক ও ত্বান পাকের নেতৃত্বাধীন একটি ঐক্যবদ্ধ সম্প্রদায় গঠন করে। চ্যাম গ্রামগুলিতে বিশিষ্ট ব্যঃক্তিদের একটি পরিষদ ও একজন হাকেম (শরিয়া বিচারক) ছিল। কম্বোডিয়া স্বাধীন হলে মুসলিম সম্প্রদায়কে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি কাউন্সিলের নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। এটি সরকারী কার্যক্রম ও অন্যান্য মুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে চ্যাম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করত।[৫]
প্রতিটি মুসলিম সম্প্রদায়ের একজন হাকেম রয়েছেন। তিনি সম্প্রদায় ও ইমাম হিসেবে মসজিদে নেতৃত্ব দেন। সেদেশে মুয়াজ্জিনকে বিলাল নামে অভিহিত করা হয় । নমপেনের কাছে অবস্থিত ক্রোয়েচাংভার উপদ্বীপকে চামদের আধ্যাত্মিক কেন্দ্র হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং সেখানে বেশ কয়েকজন উচ্চ মুসলিম কর্মকর্তা বাস করেন। প্রায় প্রতি বছর কিছু সংখ্যক চ্যাম ছাত্র মালয়েশিয়ার কেলান্তানে কুরআন ও ইসলামি শিক্ষা অধ্যয়ন করতে যায়। কেউ সৌদি আরবে অধ্যয়ন করতে বা হজ করতে যায়। ১৯৫০ এর দশকের শেষের পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রায় ৭% চাম জীবনে একবার হজ করেছেন এবং তারা এর কৃতিত্বের চিহ্ন হিসাবে ফেজ বা পাগড়ি পরতে পারে।[৫]
মালয় সম্প্রদায়ের সাথে চ্যামদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও আন্তঃবিবাহের কারণে চ্যামরা একটি অধিকতর সঙ্গতিপূর্ণ ধর্ম গ্রহণ করেছে। প্রকৃতপক্ষে গোঁড়া চামরা মালয় রীতিনীতি ও পারিবারিক কাঠামো গ্রহণ করেছে এবং তাদের অনেকেই মালয় ভাষায় কথা বলে। তারা হজযাত্রীদের মক্কায় পাঠায় এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইসলামি সম্মেলনে যোগ দেয়।[৫]
কম্বোডিয়ায় চ্যামদের ওপর নিপীড়ন মূলত ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত খেমাররুজ শাসনামলে ঘটে। ১৯৭৫ সালে খেমার প্রজাতন্ত্রের বাহিনীকে পরাজিত করার পর খেমাররুজ গণতান্ত্রিক কম্পোডিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ।[৬] তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কমিউনিস্ট পার্টি অফ কাম্পুচিয়া (CPK) নামে পরিচিত ছিল। ক্ষমতা গ্রহণ করার পর তারা সমাজতান্ত্রিক নীতির আলোকে গণতান্ত্রিক কম্বোডিয়ার নীতি ও নিয়মকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করে৷ [৭] এর ফলে জনসাধারণ শহরাঞ্চল থেকে গ্রামাঞ্চলে ব্যাপকভাবে স্থানান্তরিত হয় এবং সেখানে তারা সামান্য খাবার ও বিশ্রাম নিয়ে প্রতিদিন মাঠে কাজ করতে বাধ্য হয়।
সর্বোপরি খেমাররুজ শাসন পদ্ধতিগতভাবে জনগণের আর্থ-সামাজিক কাঠামো ভেঙে ফেলতে শুরু করে এবং তাদের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও জাতিগত পটভূমির উপর ভিত্তি করে স্ক্রীন করা শুরু করে। তখন ইসলাম তো বটেই, এমনকি কম্বোডিয়ার সমাজে প্রভাবশালী বৌদ্ধধর্মকেও দমন করা হয়। সন্ন্যাসীদের মাঠে কাজ করতে পাঠানো হয়। পণ্ডিত ও ইতিহাসবিদরা অনুমান করেন যে, তখন কম্বোডিয়ার জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ খেমাররুজ শাসনে নিহত হয় বা অনাহার ও রোগের কারণে মারা যায়। যারা সংখ্যায় প্রায় ১.০৫ থেকে ২.২ মিলিয়ন জনগণ। [৮] তখন শাসকদের হাতে নিপীড়ন, নির্যাতন ও মৃত্যুর হাত থেকে চামরাও রেহাই পায়নি। ইতিহাসে এটিকে কম্বোডিয়ার গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করা হয়। [৯]
বর্তমান কম্বোডিয়ায় ইসলাম সরকারীভাবে স্বীকৃত ধর্ম। মুসলমানরা স্বাভাবিক ও খোলামেলাভাবে তাদের ধর্ম পালন করতে পারে। দেশের অন্যান্য নাগরিকের মত চামরাও গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করে। তাদের ভোট দেওয়া এবং রাজনীতিবিদ হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার অধিকার আছে। পবিত্র রমজান মাসে সরকার বার্ষিক ইফতার সমাবেশের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ২০১৮ সালে ওআইসির নেতা কম্বোডিয়াকে মুসলিম সহাবস্থানের বাতিঘর বলে অভিহিত করেন। [১০]
|সংগ্রহের-তারিখ=
(সাহায্য)