শারদীয়া দুর্গাপূজা | |
---|---|
অন্য নাম | অকালবোধন, শারদোৎসব |
পালনকারী | বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় |
ধরন | হিন্দু উৎসব |
উদযাপন | পাঁচ দিন। অধিকাংশ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কমপক্ষে চারদিন বন্ধ থাকে। |
শুরু | দুর্গাষষ্ঠী |
সমাপ্তি | বিজয়াদশমী |
তারিখ | আশ্বিন শুক্লপক্ষ |
সম্পর্কিত | মহালয়া |
কলকাতার দুর্গাপূজা | |
---|---|
দেশ | ভারত |
ধরন | ঐতিহ্যবাহী, সাংস্কৃতিক ও শিল্পনৈপুণ্য |
সূত্র | ০০৭০৩ |
অন্তর্ভূক্তির ইতিহাস | |
অন্তর্ভূক্তি | ২০২১ (ষোড়শ অধিবেশন) |
তালিকা | প্রতিনিধিত্বমূলক |
শারদীয়া দুর্গাপূজা পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার বাঙালিদের বৃহত্তম উৎসব। কলকাতা বাঙালি হিন্দুপ্রধান শহর হওয়ায় দুর্গাপূজাই কলকাতার বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। বর্তমান কলকাতার সবচেয়ে পুরনো দুর্গাপূজাটি হয় বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়িতে। কলকাতার দ্বিতীয় প্রাচীনতম দুর্গাপূজাটি হল শোভাবাজার রাজবাড়ির পূজা। বিংশ শতাব্দীতে কলকাতায় বারোয়ারি বা সর্বজনীন পূজা জনপ্রিয় হয়। কলকাতায় প্রায় ৩০০০ সার্বজনীন পূজা হয়।[১] এছাড়া বিভিন্ন পুরনো বাড়িতেও দুর্গাপূজা হয়। দুর্গাপূজার সময় কলকাতা শহর আলোকমালায় সাজানো হয়। অধিকাংশ অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চার দিন বন্ধ থাকে। রাতে শহরবাসী বিভিন্ন মণ্ডপে প্রতিমা দর্শন করতে ভিড় জমান। দুর্গাপূজার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে কলকাতা পুলিশকে বিশেষ টাস্কফোর্স নিয়োগ করতে হয়। কলকাতার দুর্গাপূজাকে পূর্ব গোলার্ধের রিও কার্নিভাল বলা হয়।[২]
কলকাতা তথা বাংলার প্রধান ও প্রাণের এই উৎসব আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্থান করে নিয়েছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা- ইউনেস্কো বাঙালি হিন্দুদের এই উৎসবকে ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ তথা মানবতার জন্য আবহমান অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। প্যারিসে অনুষ্ঠিত ২০২১ খ্রিস্টাব্দের আবহমান বিশ্ব সংস্কৃতি রক্ষা সংক্রান্ত ইউনেস্কোর আন্তঃসরকারি কমিটির ষোড়শ সম্মেলনে (১৫ই ডিসেম্বর) কলকাতার দুর্গাপূজা তালিকাভুক্তির স্বীকৃতি লাভ করে।[৩][৪]
১৬১০ সাল থেকে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার বড়িশায় তাদের আদি বাসভবনে দুর্গাপূজার আয়োজন করে আসছেন। এটিই সম্ভবত কলকাতার প্রাচীনতম দুর্গোৎসব। বর্তমানে এই পরিবারের সাত শরিকের বাড়িতে সাতটি দুর্গাপূজা হয়। এগুলির মধ্যে ছয়টি বড়িশায় ও একটি বিরাটিতে।[৫][৬] ১৭৫৭ সালে শোভাবাজার রাজবাড়িতে নবকৃষ্ণ দেব দুর্গাপূজা শুরু করেন। তার নির্দেশিত পথেই দুর্গাপূজা পরবর্তীকালে কলকাতার ধনিক বাবু সম্প্রদায়ের মর্যাদার প্রতীক হয়ে ওঠে। শাস্ত্রাচার এই সব পূজায় গৌণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যে পূজায় যত বেশি সংখ্যক আমন্ত্রিত ইংরেজ অতিথি উপস্থিত হতেন, সেই পূজার মর্যাদা ততই বাড়ত। দেবীপ্রতিমার সম্মুখেই মুসলমান বাইজি নাচের আসর বসত। ইংরেজরা এসে নাচগান করতেন, তাদের জন্য উইলসন হোটেল থেকে গোরু ও শূকরের মাংস আনানো হত এবং মদ্যপানের আসরও বসত।[৭] রানি রাসমণি এই প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে শুদ্ধাচারে তার জানবাজারের বাড়িতে দুর্গাপূজা শুরু করেন। তিনি ইংরেজ অতিথিদের চিত্তবিনোদনের বদলে তার দেশীয় প্রজাদের বিনোদনের জন্য পূজা উপলক্ষে যাত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। ১৮৬১ সালে তার মৃত্যুর পর রানির জামাতাগণ নিজ নিজ বাসভবনে রানির প্রদর্শিত পথেই দুর্গাপূজার আয়োজন করতে থাকেন।[৮] কলকাতায় আরো অনেক বাড়িতে এই ভাবে দুর্গাপূজা শুরু হয়।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে কলকাতায় বারোয়ারি দুর্গাপূজার সূচনা ঘটে। ১৯১০ সালে ভবানীপুরের বলরাম বসু ঘাট রোডে ভবানীপুর সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভার পক্ষ থেকে বারোয়ারি দুর্গাপূজা আয়োজিত হয়। এই পূজাটি আজও হয়ে আসছে। এরপর ১৯১১ সালে শ্যামপুকুর আদি সর্বজনীন,[৯] ১৯১৩ সালে শ্যামবাজারের শিকদারবাগান, ১৯১৯ সালে নেবুবাগান অর্থাৎ বর্তমান বাগবাজার সর্বজনীন এবং ১৯২৬ সালে সিমলা ব্যায়াম সমিতির বারোয়ারি দুর্গাপূজা শুরু হয়।[১০] ২০০৮ সালের হিসাব অনুসারে, কলকাতায় দুই হাজারেরও বেশি বারোয়ারি পূজা অনুষ্ঠিত হয়।[১১]
১৯৮৫ সাল থেকে এশিয়ান পেইন্টস কর্তৃপক্ষ কলকাতার দুর্গাপূজা কমিটিগুলিকে পুরস্কৃত করার প্রথা চালু করেন। এই পুরস্কারটিকে এশিয়ান পেইন্টস শারদ সম্মান বলা হয়। পরে আরও অনেক বাণিজ্যিক সংস্থা "শারদ সম্মান" বা দুর্গাপূজা পুরস্কার চালু করে।[১২][১৩][১৪]
উত্তর কলকাতার কুমারটুলি এলাকায় কলকাতার অধিকাংশ দুর্গাপ্রতিমা তৈরি হয়। কলকাতায় দুর্গাপ্রতিমা নির্মাণ ও দুর্গাপূজার প্রস্তুতির সঙ্গে কুমারটুলি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। কুমারটুলির শিল্পীদের দুর্গাপ্রতিমার বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। বর্তমানকালে কুমারটুলির দুর্গাপ্রতিমা আমেরিকা, ইউরোপ ও আফ্রিকায় প্রবাসী বাঙালিদের কাছে সরবরাহ করা হয়। ১৯৮৯ সালে প্রথম অমরনাথ ঘোষের তৈরি করা শোলার দুর্গাপ্রতিমা সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ও নাইজেরিয়ায় পাঠানো হয়। মাত্র তিন কিলোগ্রামের এই প্রতিমাগুলি বিমানযোগে প্রেরণের ক্ষেত্রে আদর্শ ছিল।[১৫] ২০০৬ সালে কুমারটুলি থেকে ১২,৩০০টি দুর্গাপ্রতিমা সরবরাহ করা হয়। প্রতি বছর বিশ্বের ৯৩টি রাষ্ট্রে কলকাতার এই পটুয়াপাড়া থেকে প্রতিমা প্রেরণ করা হয়ে থাকে। এই সংখ্যা বর্তমানে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। [১৬]
যদিও কুমারটুলির প্রতিমাশিল্পীরা অনেকেই দারিদ্র্যের মধ্যে দিনযাপন করেন। কুমারটুলির প্রতিমাশিল্পীদের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় হলেন মোহনবাঁশী রুদ্রপাল ও তার দুই পুত্র সনাতন রুদ্রপাল ও প্রদীপ রুদ্রপাল, রাখাল পাল, গণেশ পাল, অলোক সেন, কার্তিক পাল, কেনা পাল প্রমুখ। বর্তমান যুগে ‘থিম শিল্পী’দের রমরমা সত্ত্বেও সনাতন প্রতিমার গুণগ্রাহী আজও কুমারটুলির মৃৎশিল্পীদের দিয়ে প্রতিমা নির্মাণ করান। পুরুষদের পাশাপাশি কুমারটুলিতে প্রায় ৩০ জন মহিলা প্রতিমাশিল্পী রয়েছেন। এঁদের মধ্যে মিনতি পাল, সোমা পাল, কাঞ্চী পাল ও চম্পারাণী পাল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এঁরা দীর্ঘকাল ধরে প্রতিমানির্মাণ শিল্পের সঙ্গে জড়িত।[১৭] কুমারটুলি অঞ্চলের নিজস্ব সর্বজনীন দুর্গাপূজার সূচনা হয় ১৯৩৩ সালে। সেযুগের বিশিষ্ট প্রতিমাশিল্পী গোপেশ্বর পাল ছিলেন কুমারটুলি সর্বজনীনের প্রতিমার নির্মাতা।[১৫] তিনিই সর্বজনীন দুর্গা প্রতিমায় বিবর্তন আনেন। পূর্বে সর্বজনীন দুর্গাপূজার প্রারম্ভিক একচালার (একই চালচিত্রের নিচে দুর্গা ও তাঁর পুত্রকন্যাদের মূর্তি গড়ার) প্রথাকে পরিবর্তন করে তিনিই প্রথম মূর্তিগুলিকে পৃথক পৃথক করে গড়া ও পাঁচ চালায় স্থাপন করা শুরু করেন।[১৮][১৯]
দুর্গোৎসব বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। কেবল হিন্দু নয়, বাংলার সকল সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বয়ে চলে আনন্দোৎসবের প্লাবন। এই উৎসব উদযাপনে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সামিল হন। আবেগেই সমস্ত মানুষ মিলিত হন। আর সেই মিলনে বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সেরা দিকগুলি আলোকিত হয়। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতার দুর্গোৎসব তথা শারদোৎসবের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে উদ্যোগী হয় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আবেদন (নমিনেশন নম্বর ০০৭০৩) গিয়েছিল জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা - ইউনেস্কার দপ্তরে। সেই আবেদনের মূল্যায়ন করেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা প্যারিসে, ১৩ই ডিসেম্বর শুরু হওয়া ষোড়শ অধিবেশনে। তাদের বিচারেই ১৫ই ডিসেম্বর 'হেরিটেজ' তকমা পায় কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের সেরা প্রাণের উৎসব।[২০][২১]
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এই যে, বিশ্বমানের এই স্বীকৃতি আদায়ের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল আগেই। ২০১৮-১৯ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রক শিল্প-ঐতিহাসিক তথা সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সের অধিকর্তা তপতী গুহ-ঠাকুরতাকে কলকাতার দুর্গাপূজাকে নিয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রকের ডসিয়ার প্রস্তুত করার দায়িত্ব দেয় এবং তিনি ভারত সরকারের পক্ষে সেটি তৈরি করেছিলেন। [২২][২৩]
কলকাতার দুই হাজারেরও বেশি সর্বজনীন পূজা সমিতিগুলির মধ্যে থেকে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সর্বজনীন পূজার নামের তালিকা নিচে দেওয়া হল।