কলকাতা এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অধিকারী। এই শহর তার সাহিত্যিক, শৈল্পিক ও বৈপ্লবিক চেতনার জন্য বিশ্ববিদিত। কলকাতা কেবলমাত্র ভারতের পূর্বতন রাজধানীই ছিল না, বরং আধুনিক ভারতের শিল্প ও সাহিত্য চেতনার জন্মস্থানও ছিল। শিল্প ও সাহিত্যের প্রতি কলকাতাবাসীদের বিশেষ আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে; নতুন প্রতিভাকে গ্রহণ করার ঐতিহ্য কলকাতাকে তাই পরিণত করেছে "প্রচণ্ড সৃজনীশক্তিধর এক শহরে"।[৩] এই সকল কারণে কলকাতাকে অনেক সময় "ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী" বলে উল্লেখ করা হয়।[৪][৫]
কলকাতার অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হল শহরের ছোটো ছোটো অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পাড়া সংস্কৃতি। সাধারণত প্রত্যেক পাড়ায় একটি করে ক্লাবঘর সহ নিজস্ব সংঘ বা ক্লাব থাকে। অনেক সময় ক্লাবগুলির নিজস্ব খেলার মাঠও থাকে। পাড়ার বাসিন্দারা অভ্যাসগতভাবে এখানে এই সব ক্লাবঘরে আড্ডা দিতে আসেন; মাঝেমধ্যে এই সব আড্ডা হয়ে ওঠে মুক্তছন্দের বৌদ্ধিক আলাপআলোচনা।[৬] এই শহরে রাজনৈতিক দেওয়াললিখনেরও এক ঐতিহ্য লক্ষিত হয়; এই সব দেওয়াললিখনে কুরুচিপূর্ণ কেচ্ছাকেলেংকারির বর্ণনা থেকে শ্লেষাত্মক রঙ্গব্যঙ্গ, লিমেরিক, কার্টুন, ইস্তাহার – সবই বিধৃত হয়।
কলকাতার অনেক ভবন ও স্থাপনা গথিক, ব্যারোক, রোমান, প্রাচ্য, ও মুঘল স্থাপত্য সহ অন্যান্য ইন্দো-ইসলামীয় শৈলীর মোটিফ দ্বারা সজ্জিত। ঔপনিবেশিক যুগের অনেক উল্লেখযোগ্য ভবনই সুসংরক্ষিত এবং "ঐতিহ্যবাহী ভবন" হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। আবার অনেক ভবনই আজ কালের গহ্বরে বিলীয়মান। ১৮১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় সংগ্রহালয় এশিয়ার প্রাচীনতম জাদুঘর; ভারতের প্রাকৃতিক ইতিহাস ও ভারতীয় শিল্পের এক বিরাট সংগ্রহ এই জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।[৭] কলকাতার অন্যতম দর্শনীয় স্থান ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে শহরের ইতিহাস-সংক্রান্ত একটি জাদুঘর রয়েছে। কলকাতায় অবস্থিত ভারতের জাতীয় গ্রন্থাগার দেশের অগ্রণী পাবলিক লাইব্রেরি। অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস ও অন্যান্য শিল্প প্রদর্শশালায় নিয়মিত শিল্প প্রদর্শনী আয়োজিত হয়ে থাকে।
কলকাতার যাত্রাপালা, নাটক ও গ্রুপ থিয়েটারের ঐতিহ্য সুবিদিত। বাংলা চলচ্চিত্র ও মূলধারার হিন্দি চলচ্চিত্র এখানে সমান জনপ্রিয়। শহরের ফিল্ম স্টুডিও টালিগঞ্জে অবস্থিত; এই কারণে বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পকে "টলিউড" নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। একাধিক কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালকের কর্মজীবন গড়ে উঠেছে এই শহরকে কেন্দ্র করেই। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সত্যজিৎ রায় (১৯২১–১৯৯২), মৃণাল সেন (জন্ম ১৯২৩), ঋত্বিক ঘটক (১৯২৫–১৯৭৬) এবং আধুনিক চিত্র পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (জন্ম ১৯৪৪), অপর্ণা সেন (জন্ম ১৯৪৫), গৌতম ঘোষ (জন্ম ১৯৫০) ও ঋতুপর্ণ ঘোষ (জন্ম ১৯৬২)।
কলকাতার খাদ্যতালিকার প্রধান উপাদান ভাত ও মাছের ঝোল,[৮] এবং রসগোল্লা, সন্দেশ ও মিষ্টি দই প্রভৃতি মিষ্টান্ন। ইলিশ, চিংড়ি ও রুই সহ অন্যান্য মাছের নানা ব্যঞ্জনও কলকাতায় বেশ প্রচলিত। বেগুনি, কাটি রোল, ফুচকা প্রভৃতি পথখাদ্য এবং পূর্ব কলকাতার চায়নাটাউনের ভারতীয় চীনা খাদ্যও যথেষ্ট জনপ্রিয়।[৯][১০]
বাঙালি রমণীরা সাধারণত ঐতিহ্যবাহী পোশাক শাড়ি পরে থাকেন; তবে কেউ কেউ পাশ্চাত্য পোশাক পরতেও অভ্যস্ত। আবার পুরুষদের মধ্যে পাশ্চাত্য পোশাকেরই চল বেশি।
দুর্গাপূজা কলকাতার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এবং সর্বাপেক্ষা জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব।[১১] প্রতি বছর বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে আশ্বিন-কার্তিক মাসে (ইংরেজি সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। অন্যান্য ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবগুলির মধ্যে জগদ্ধাত্রী পূজা, কালীপূজা, ঈদুল ফিতর, দোলযাত্রা, বড়দিন, পয়লা বৈশাখ, পঁচিশে বৈশাখ, সরস্বতী পূজা, রথযাত্রা, পৌষপার্বন ইত্যাদি মহাসমারোহে পালিত হয়। এছাড়াও অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলা, ডোভার লেন সঙ্গীত সম্মেলন, কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব ও নান্দীকারের জাতীয় নাট্য উৎসব ইত্যাদি সাংস্কৃতিক উৎসবও। প্রতি বছর জুন মাসে কলকাতায় সমকামীদের গৌরব পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়; কলকাতার এই পদযাত্রা ভারতের প্রথম গৌরব পদযাত্রা।[১২]
ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে কলকাতাকেন্দ্রিক সাহিত্যিকদের হাত ধরে বাংলা সাহিত্যের আধুনিকীকরণ সম্পন্ন হয়। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮–১৮৯৪), মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪–১৮৭৩), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১–১৯৪১), কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৮–১৯৭৬) ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬–১৯৩৮) প্রমুখ। এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহন করে চলেন শহরের পরবর্তী প্রজন্মের খ্যাতিমান সাহিত্যিকেরা। এঁদের মধ্যে উল্লেখনীয় হলেন জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯–১৯৫৪), বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪–১৯৫০), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮–১৯৭১), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮–১৯৫৬), আশাপূর্ণা দেবী (১৯০৯–১৯৯৫), শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় (জন্ম ১৯৩৫), বুদ্ধদেব গুহ (জন্ম ১৯৩৬), মহাশ্বেতা দেবী (জন্ম ১৯২৬), সমরেশ মজুমদার (জন্ম ১৯৪৪), সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় (জন্ম ১৯৩৬), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (জন্ম ১৯৩৪) এবং জয় গোস্বামী (জন্ম ১৯৫৪) প্রমুখ।
রবীন্দ্রসংগীত, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত ও বাউল প্রভৃতি বাংলা লোকসঙ্গীতের প্রতি কলকাতাবাসীদের বিশেষ আগ্রহ লক্ষিত হয়। ১৯৯০-এর দশকের প্রথম ভাগ থেকে বাংলা সঙ্গীতের জগতে এক নতুন ধারার সূচনা ঘটে। এই ধারার বৈশিষ্ট্য লক্ষিত হয় বিভিন্ন বাংলা ব্যান্ডের গানে। কোনো কোনো ব্যান্ড আবার বাংলা লোকসঙ্গীতের সঙ্গে জ্যাজ ও অন্যান্য পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ফিউশনও ঘটায়। তবে এই ধারায় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কবীর সুমন, নচিকেতা, অঞ্জন দত্ত এবং বাংলা ব্যান্ড চন্দ্রবিন্দু ও ক্যাকটাসের জীবনমুখী গান।
|accessyear=
উপেক্ষা করা হয়েছে (|access-date=
ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য); অজানা প্যারামিটার |accessmonthday=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)
|accessyear=
উপেক্ষা করা হয়েছে (|access-date=
ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য); অজানা প্যারামিটার |accessmonthday=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)
বঙ্গের সংস্কৃতি |
---|
বিষয় সম্পর্কিত ধারাবাহিক |
ইতিহাস |